হিন্দোল পালিত
একটি ক্রিকেট-সংক্রান্ত ওয়েবসাইটের বিজ্ঞাপন খেলার মাঝেমধ্যেই দেখানো হচ্ছে। নামী একটি কনভেন্ট স্কুলে বাবা-মা তাদের সন্তানকে ভর্তি করতে নিয়ে গেছেন। স্কুলের ভারিক্কি প্রিন্সিপল বাচ্চাটিকে জিজ্ঞেস করছেন: তুমি বড় হয়ে কী হবে? জবাবে হাতের মোবাইল সেটে স্কোর চেক করতে থাকা বাবা বলে ফেলছেন: নাইট ওয়াচম্যান। উত্তরটি শুনে প্রিন্সিপলের মুখটা কুঁচকে যাচ্ছে। ছেলেটির ক্রিকেট-অনুরাগী বাবাকে তিনি শ্লেষভরা জবাব দিচ্ছেন।
মজাদার এই বিজ্ঞাপনের মূল মজাটাই লুকিয়ে রয়েছে ঠিক সময়ে ভুল শব্দ– নাইট ওয়াচম্যান বলে ফেলাতে। দামী কনভেন্ট স্কুলের ছাত্র সে, ডক্টর, ইঞ্জিনয়ার, বিজনেস টাইকুন বা আরও অনেক কিছুই হতে চাইবে। কিন্তু নাইট ওয়াচম্যানের মতো অন্ত্যজ, আর্থ-সামাজিকভাবে নিচু কোনও পেশা নিশ্চয় সে বেছে নেবে না। অতএব এই হিউমার।
বিজ্ঞাপনটি দেখে আমি হাসি। আমরা হাসি। আমরা মানে মধ্যবিত্ত যাদের জন্য এই বিজ্ঞাপনটি বানানো। কিন্তু ধরুন যদি কোনও পেশাদার নৈশপ্রহরী তাঁর ছেলেমেয়ের সঙ্গে জমিয়ে রোববারের সন্ধেয় ইন্দো-পাক ম্যাচ দেখতে বসেছেন, চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন, আর দু-ওভার অন্তর এই বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে, তখন তাঁরও কি ব্যাপারটা একইরকম মজাদার লাগবে? হাসি পাবে ? চা’টা কি একটু হলেও পানসে লাগবে না তাঁর?
আমার পুরনো স্কুলে এক মাস্টারমশাই ছিলেন। বাজে কথা তিনি ছাত্রদের মুখে মোটে সহ্য করতে পারতেন না। কেউ একটু অসভ্য কথা বললেই তিনি গর্জন করতেন: আবার তোদের মুখে রিকশাওয়ালা language. স্যর যখনই এটা বলে ধমক দিতেন, কোণার বেঞ্চে বসা বাপি মণ্ডল মুখটি নামিয়ে নিত। ওর বাবা স্থানীয় রিকশাচালক ছিলেন।
স্যার এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করতেন কারণ তিনি চাইতেন না তাঁর ছাত্ররা যেন ভবিষ্যতের রিকশাচালক হোক। বিজ্ঞাপন-নির্মাতারাও জানে এই শাইনিং ইন্ডিয়াতে কেউই নাইট ওয়াচম্যান হতে চাইবে না। কিন্তু তাদের না চাওয়া সত্ত্বেও কিন্তু রিকশাচালক এবং নাইট ওয়াচম্যানরা আমাদের চারপাশে রয়ে গেছেন। ইনফ্যাক্ট ভীষণভাবেই রয়ে গেছেন, নিজেদের প্রয়োজনে এবং অবশ্যই আমাদের প্রয়োজনে।
রিকশাচালক বা নাইট ওয়াচম্যানদের প্রতি আমাদের যতই শ্রেণীউপেক্ষা থাকুক না কেন, তীব্র দাবদাহে বা বর্ষাতে আমরা সবাই রিকশা চাপি। নাইট ওয়াচম্যানের বাঁশি ও লাঠির ঠকঠক শুনলে আমাদের সবারই আশ্বস্ত লাগে। এরা সবাই আমাদের সহ নাগরিক। তবুও প্রাপ্য সম্মানটুকু এদের আমরা দিই না। বরং আমরা যে ওঁদের মতো দৈন্যদশাতে নেই, ওদের চেয়ে ঢের ভাল আছি, সেটিকে বিভিন্নভাবে দেখিয়ে-দেখিয়ে, তারিয়ে তারিয়ে সেলিব্রেট করি।
অথচ বিজ্ঞাপনের ওই বাচ্চাটি যদি বিজ্ঞাপনের ওই স্কুলটিতে পড়ার সুযোগ পেত, তবে হয়ত বিজ্ঞাপনের ওই প্রিন্সিপালই ক্লাসে বাচ্চাটিকে dignity of labour বা কোনও-কাজই-ছোট-নয় ইত্যাদির উপরে সন্দর্ভমূলক বক্তৃতা দিতেন। ঠিক যেমনটা দিতেন আমার পুরনো স্কুলের ‘রিকশাওয়ালা language’ সহ্য না করতে পারা নীতিবাগীশ মাস্টারমশাই।