Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ফ্রাঞ্জ বারম্যান স্টেইনার-এর কবিতা

ফ্রাঞ্জ বারম্যান স্টেইনার

হিন্দোল ভট্টাচার্য

 

১৯০৯ সালে জন্ম প্রাগে। রক্ষণশীল ইহুদি পরিবারের সন্তান। প্রাগেই পড়াশুনো সমাজতত্ত্ব, প্রাচ্য ভাষা এবং নৃতত্ববিদ্যা নিয়ে। প্যালেস্তাইনে আরবী ভাষায় ডক্টরেট করার জন্য এক বছর কাটানোর পর তিনি ভিয়েনা, লন্ডন এবং অক্সফোর্ডে পড়াশুনো করেন। যুদ্ধের সময় তিনি অক্সফোর্ডেই কাটান। ৪২-এ ইহুদিনিধন যজ্ঞে প্রাণ হারান তাঁর বাবা-মা। তাঁর দীর্ঘ একটি কবিতা ‘গেবের্ট ইম গার্টেন’ তাঁর বাবা ও মায়ের মৃত্যু নিয়েই লেখা। যুদ্ধের পরে স্টেইনার নিজেও মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন কিন্তু লেখালেখি ও নৃতত্ববিদ্যায় গবেষণা ও অধ্যাপনা চালিয়ে যান। তিনি নিজে তাঁর একটি কবিতাও প্রকাশিত অবস্থায় দেখে যেতে পারেননি। আমেরিকান-ইন্ডিয়ান, এস্কিমো, সাইবেরিয়ান এবং আফ্রিকান লোকসাহিত্য নিয়ে যেমন লিখেছেন তিনি্‌ তেমন ইহুদি ও ক্রিশ্চিয়ান মিস্টিক লেখাপত্র নিয়েও অনেক কাজ করেছেন। যদিও কোনওকিছুই তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। ১৯৫২ সালে করোনারি থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হয়ে তিনি অক্সফোর্ডে মারা যান। মৃত্যুর পর তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এখনও তাঁর অনেক লেখাই অপ্রকাশিত।

 

মৃত শহরের কবিতা

কুয়াশার চেয়েও বেশি রহস্যময় হল যুদ্ধ
যুদ্ধের চেয়েও মানুষ
মানুষের চেয়েও
শয়তান
যারা
শয়তানের চেয়েও অনেক বেশি রহস্যময়!

 

অস্তমিত সূর্যের সঙ্গে কিছুক্ষণ

শুনতে পাওনি তার সেই কণ্ঠস্বর- ‘তুমি কোথায়?? কোথায় তুমি?’
কিছু মানুষের মধ্যে আমি অপেক্ষা করছিলাম।
অনেকেই ছিল সেখানে, তাদের চারিদিকে ছিল দেওয়ালঘেরা বাড়ি
কখনও কখনও শুনতে পেতাম গান, শব্দগুলি আসত, আর চলে যেত,
আমি ছিলাম আমার রাস্তায়।

শুনতে পাওনি সেই কণ্ঠ, যে বলে উঠেছিল- ‘সন্ধ্যা! সন্ধ্যা!’
হ্যাঁ, সন্ধ্যাই আসবে, যেমন সন্ধ্যা আসে
রক্তাক্ত পাহাড়গুলির ওপর যেভাব ছায়াগুলি ঢেলে দেয় কেউ
শোনা যায় পশুচারকদের বাঁশির শব্দ
সময় কীভাবে ফুরিয়ে আসছে তা নিয়ে বিলাপের গান।

পাখিগুলি সেখানে চক্কর কাটছে
ধীরে, অতি ধীরে, আমার মুখ হয়ে উঠছে ভারী আর সোনালি
কেউ কেউ এখনও গুনে যাচ্ছে টাকা
এক এক করে, সূর্যাস্তের সঙ্গে, নীরব হয়ে যাচ্ছে সমস্ত প্রাণ।

সে কি ডেকে ওঠেনি আজও- ‘সন্ধ্যা! সন্ধ্যা’!
সে কি জিজ্ঞেস করেনি? – ‘তুমি কোথায়? কোথায় তুমি?’

প্রচুর দরজার ওপারে থাকে সেই পবিত্র নগরী।
রাতে সেও একলা হয়ে যায়
নীরবে, প্রসারিত পাহাড়গুলির দূরত্বের মতো!

 

৮ মে, ১৯৪৫

পাখিদের উড়ে যাওয়ার মতো বিষাদ, যা কিছু যন্ত্রণার মতো, কষ্ট
পাথরের মতো ভারী
মাটির নীচে যা কিছু সহ্য করে চলেছে, বহন করে চলেছে
শরীরের সঙ্গে মিশে আছে মাটিতে বহুবছরের ভালোবাসা

মানুষ তাদের অশুভ প্রশ্রয় দেওয়া যুদ্ধকে কবর দিয়েছে
বিয়ারের বোতল থেকে মাথা চাড়া দিচ্ছে পপি
কাগজের এক একটি শৃঙ্খল লাশ এবং জ্বরাক্রান্ত বাড়িগুলিকে বেঁধে রেখেছে

ভিজে যাওয়া পতাকাগুলি উৎসবের মৃদু বাতাসে উড়ছে
পিছনে রয়েছে এলোমেলো পড়ে থাকা ড্রাম
একজন স্কেটার বরফ হয়ে যাওয়া রক্তের হ্রদের উপর দিয়ে
জিগজ্যাগ করে কোথায় চলেছে!

 

ইংল্যন্ডে কাফকা

বেলসেন হয়ে নয়, এমনকী সমস্ত কাজের চাকর হয়েও নয়
সেই অপরিচিত লোকটি এসেছিল, উদ্বাস্তু ছিল না মোটে
তা সত্ত্বেও ঘটনাটি ছিল খুব দুঃখের-
সে যে আসলে কোন দেশের লোক, তা নিয়ে প্রচুর সংশয়,
এমনকী তার ধর্মও ছিল বেশ অস্বস্তির কারণ।

“কাফকা পড়েছেন?” প্রাতরাশের সময় জিজ্ঞেস করলেন মিসেস ব্রিটল।
“তাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না, আর বেশ মৌলিক, আমার মনে হয়”
“কাফকা পড়েছেন?” জিজ্ঞেস করলেন চায়ের আসরে মিসেস টুসলিক,
“তাহলে আপনি জগৎকে কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন—
যদিও তাঁর কোনওকিছুই বাস্তব নয়”
মিস ডিগস জিজ্ঞেস করলেন, “তাই কী?”
ভাবলাম এই কথাটি হয়ত প্রতিক্রিয়াশীল। “তাই কি মনে করেন না?’
কেবল বাচ্চা জিওফ্রে পিটজম্যান স্বপ্ন দেখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল- ‘কে?’
“আমার মনে হয়, যার ভালো লাগবে,
তারা হয়ত মরেই যাবে, হয়ত বা মৃত,
বলতে চাইছি প্রাগের সেই সব মানুষের কথা- কী নাম তাদের,
তাতে কিছুই এসে যায় না…”
তবুও সদরদরজার দিকের রাস্তাটি ছিল অন্যান্য দিনের মতোই উজ্জ্বল।

 

নীরব মানুষের গান

ছেলেটি যে মরুভূমি তৈরি করেছিল, তার জন্য, লোকটির ঘরের জন্য;
আর তারা দুজনেই, প্রায় কোনও চিহ্ন ছাড়াই
আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল : হে ক্ষুধার্ত, সংকুচিত সময়
তারা কীভাবে আমাকে ভালোবেসেফেলেছিল
কীভাবে আমার ভিতর পুঁতে দিয়েছিল আশ্চর্য যন্ত্রণা
জল দিয়েছিল তাতে—

নীরব গায়কটির প্রার্থনাসঙ্গীত যেভাবে উড়ছিল তার চুলের ভিতর
যার গান আমি নত হয়ে শুনছিলাম
আমার আঙুলগুলির ভিতর সেই গান কোঁকড়ানো চুলের মতো হয়ে গেল
অনুভব করতে পারলে সেই সোনালি আংটি, বরফের ভিতর যা গুনগুন করছে?

 

মেশিন এবং মানুষ

ভাঙা মেশিনটার দিকে তাকিয়ে রইল সেই ভাঙা মানুষটা
কে কাকে সান্ত্বনা দেবে এ কথা বুঝে উঠতে পারছিল না হয়তো
মাঝখানে একটা আস্ত শহর পক্ষাঘাতগ্রস্ত
শিরা ফুলে গেছে মানুষটার, রক্তের রঙ নীল
ফুসফুস শব্দ করছে
মেশিনটা চালু হয়নি কতকাল-
নাটবল্টু খসে পড়ে গেছে
মেশিন, মেশিনের রক্ত, মেশিনের ঘাম, মেশিনের লজ্জা
লোকটি একটা কথাও বলে উঠতে পারছে না
মেশিনটিও নীরব
একটি শহর পড়ে আছে, মাঝখানে, বোবা ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত
একা

 

দুটি দেশ

জ্যান্ত বোমার টুকরো দেখলে হেসে ওঠে বসন্তের ফুল
সমস্ত সঙ্গীত যেমন ধাক্কা খায় দেওয়ালের গায়ে
তুমি পেরিয়ে যেতে পারবে না, পারবে না তুমি পেরিয়ে যেতে
ওপাশে নীরব সেই গলি
আজ অন্ধ
আমি আর তাকে রহস্য বলি না

 

গাইড

এখানে কবর শুয়ে আছে। তুমি অমন তাকিয়ে থেক না।
ওই যে ইস্কুলবাড়ি,
ওই যে বাজার, ওই চার্চ।
ওই অস্তিত্ববাদী একটি উপন্যাস
নিজের পাতার ভিতর
ঘুমিয়ে
পড়ছে
এখানে কবর শুয়ে আছে
তুমি অমন
তাকিয়ে থেক না
ফুলের ভিতরে দ্যাখো কত গোপন
পোকাদের ঘর
বুকের উপর দিয়ে একটি দেওয়াল
মাথা উঁচু করে
তাকিয়ে
থেক না
ওই দ্যাখো তাজা একটা বোমা
মরচে পড়া পিস্তল
রক্তাক্ত বেয়নেট
খাচ্ছে
মানুষ
একে সভ্যতা বলে
একটি কবর
আমি, তার নাম দিয়েছি সভ্যতা
তুমি
আপত্তি কোর না
আমাদের
উপন্যাস নেই

কিছু
লেখকের কবর পড়ে আছে