অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়
সেদিন দুপুরে ভাতঘুমে মন ছিল না। জানলার দিকে অকারণেই তাকিয়ে ছিলাম। হলুদ বসন্তবৌরি পাখিটা আম গাছের পাতার ফাঁকে উঁকি দিয়ে উড়ে গেল পশ্চিমাকাশে। শীতের পড়ন্ত বেলায় মনটা কেমন যেন ঘর বিবাগী হয়ে পড়ে, কোথাও বেরিয়ে পড়তে চায়। সব দিন সম্ভব না হলেও সে দিন হল। ভাঙা খাল, খোয়াই পেরিয়ে চললাম ইলামবাজারের সবুজ জঙ্গলের দিকে। সরষেখেতের সোনালী সুখ উপচে পড়ছে বীরভূমের প্রান্তরে প্রান্তরে। উত্তরে হাওয়ায় শুকনো পাতার উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে ভাবতে থাকি ইলামবাজার তো শুধু জঙ্গল নয় বীরভূমের ইতিহাস চেতনার একটা অধ্যায়।
সে প্রায় আড়াইশো বছর আগের কথা। তখন এই ইলামবাজার জঙ্গলে পলাশের ঘন জঙ্গল থাকায় এই অঞ্চলে লাক্ষাচাষ খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ড-এর এক মানুষ David Erskine বীরভূম জেলায় এলেন। বীরভূমের প্রথম কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট John Cheap সাহেবের হাত ধরে তিনি নামলেন নীলের ব্যবসায়। অল্প দিনের মধ্যে তিনি প্রচুর অর্থ লাভ করলেন। নীল চাষের লাভের অর্থ ঢালতে শুরু করলেন লাক্ষাচাষে। আস্তে আস্তে এ অঞ্চলের লাক্ষাশিল্পটিও খুব উন্নতি করতে শুরু করল। এ অঞ্চলে নীলকুঠির পাশাপাশি লাক্ষাকুঠির সংখ্যাও বাড়তে থাকলো। অজয় নদের পথে বাণিজ্যের সুবিধা থাকায় এই অঞ্চল ক্রমশ সমৃদ্ধশালী এক জনপদে পরিণত হল। তৈরি হতে থাকল ঘরবাড়ি গির্জা। এইসব সফল ব্যবসা বাণিজ্যের ফলে ইলামবাজার ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ধীরে ধীরে একটি সুসমৃদ্ধ বিত্তবান শ্রেণি গড়ে ওঠে। এইসব ধনবান ব্যক্তিরাই পরে এই অঞ্চলে নানা মন্দির গড়ার কাজে ব্রতী হন।
আমরা গৌড়ের রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি, গীতগোবিন্দের কবি জয়দেবখ্যাত কেন্দুলির পথকে ডান হাতে রেখে অজয় নদের দিকে এগিয়ে চলি। অজয় মানে যাকে জয় করা যায় না। বর্ষার সময় এর এই অজেয় রূপ আমরা প্রতক্ষ্য করেছি বহুবার, কিন্তু শীতের অজয় বড় শ্রান্ত। এই অজয় নদের গতিপথের বাম ধারে আছে বীরভূম আর ডান ধা্রে বর্ধমান। আমরা ব্রিজ পেরিয়ে বর্ধমান জেলায় প্রবেশ করলাম। খানিক এগিয়ে বসুধা।
লোকে বলে বসুধাম থেকেই নাকি এ অঞ্চলের নাম হয়েছে বসুধা। মনে প্রশ্ন জাগে কোন বসুদের ধাম এই বসুধা। বাংলা মঙ্গলকাব্যের অন্যতম ধর্মমঙ্গলের এক কবি ছিলেন নরসিংহ বসু। তাঁদের এ অঞ্চলে আদিবাস ছিল। তাঁদের নামেই এ অঞ্চলের নাম বসুধা হয়েছে। পরবর্তীকালে তাঁরা চলে যান কালনার কাছে এক গ্রামে। বসুধা পৌঁছে আমরা ন্যাশনাল হাইওয়ে থেকে নেমে বাম দিকের মোরাম রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম আমাদের গন্তব্যে। আজ আমাদের গন্তব্য মৌখিরা।
বসুধা থেকে মৌখিরার দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। এই পথেই পড়ে ভোগতোলার শিখররীতির দুটি শিবমন্দির। আমরা এগিয়ে চললাম মোরাম রাস্তা ধরে পেরিয়ে গেলাম আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপির ক্ষেত, খড়ের চাল, টিনের চাল, বাঁশ বাগান, শৌচঘর, কলাতলা, আমগাছ, ভাঙা শিব মন্দির, খেলার মাঠ, স্কুল বাড়ি। দাঁড়ালাম মোরাম রাস্তার ধারে এক বিশাল প্রাচীন অশোক গাছের নিচে। চেনা অচেনা পাখির কলকলানিতে মুখর হয়ে আছে অশোক গাছের তলা। গাছের পাশ দিয়ে পায়ে চলার পথ। সেই পায়ে চলার পথের পাশেই গুচ্ছ শিবমন্দির চত্বর। এই মন্দিরগুলো পথের পাশে গ্রাম জীবনের সঙ্গে এমন মিলে মিশে আছে যে প্রথম দেখায় তেমন চমক লাগে না। বাড়ির উঠোনের পাশে তুলসী মঞ্চের মতোই আটপৌরে এদের রূপ (চিত্র:১)।
চিত্র : ১
অশোকগাছের পাশ দিয়ে চার পাঁচ পা এগোলেই চোখে পড়ে ডানহাতে তিনটি পশ্চিমমুখী মন্দির, বাম হাতে দুটি পূর্বমুখী মন্দির। এদের দুপাশে রেখে এগিয়ে গেলে ডানদিকে একটি তুলনায় বড়ো এবং বাঁদিকে দুটি উত্তরমুখী মন্দির দেখতে পাওয়া যায়। এই বাঁদিকের মন্দিরটির ঠিক বিপরীতে দুটি দক্ষিণমুখী মন্দির আছে। এই দক্ষিণমুখী মন্দির দুটির পুব দিকের মন্দিরটির গা ঘেঁষে গঙ্গাধর রায়ের বাড়ি। এই দক্ষিণমুখী মন্দিরের পশ্চিমদিকের মন্দিরটির গায়ে একটি জয়ন্তী ফুলের গাছ উঠে গেছে। এই জয়ন্তী ফুলের গাছের পাশেই পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটি দুর্গাদালান। দুর্গাদালানটির পাশে এক বিশাল অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ এই পরিবারের অতীতদিনের সমৃ্দ্ধি ও এ অঞ্চলের প্রাচীনত্বের নিদর্শন আজও বহন করে চলেছে। গঙ্গাধর রায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল এদের পরিবারের পূর্বপুরুষরাই এই মন্দিরগুলি নির্মাণ করেছিলেন। আগের মতো ধূমধাম না হলেও এই দুর্গাদালানে আজও দুর্গাপূজো হয়। আগে একটি এক নলি কামানে বারুদ ভরে তোপ দেগে দুর্গাপূজোর শুভ সূচনা হতো। মোষবলি হতো এবং এই দুর্গাপূজোর সময় খুব আনন্দ উত্তেজনার সঙ্গে নারকেল কাড়াকাড়ি খেলার ও প্রচলন ছিল। একবার দুর্ঘটনা ঘটায় কামানের তোপদাগা বন্ধ হয়ে যায়। মোষ বলির পরিবর্তে আজ ছাগবলি হয়। ক্রমশ এই পারিবারিক পূজো এক সার্বজনীন চেহারা লাভ করছে।
যে মন্দিরগুলো পেরিয়ে দুর্গাদালানে পৌছতে হয় সেগুলো সবই শিব মন্দির শুধু একটি বিষ্ণুমন্দির। এতগুলো শিবমন্দির থাকায় এই স্থানটি গুচ্ছ শিবমন্দির চত্বর নামে পরিচিত। সত্যি কথা বলতে কী, এই গুচ্ছশিব মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে এই মন্দিরগুলোর নির্মাণশৈলী ও অলংকরণ দেখতে দেখতে ধর্মীয় ভাবের উর্ধে উঠে সে যুগের মন্দির শিল্পীদের দক্ষতা ও তাদের শিল্পীমনকে প্রণাম করতে ইচ্ছে হয় (চিত্র:২)।
চিত্র : ২
মনে পড়ে বাংলার মন্দির তৈরির ধারাটা প্রধানত শুরু হয় মধ্য যুগে। শান্তিনিকেতনে বড় হবার সুবাদে বিনোদবিহারীর হিন্দি ভবনে করা মধ্যযুগীয় সন্ত ফ্রেস্কোটির কথা মনে পড়ে যায়। ভক্তি আন্দোলন সারা ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক স্মরণীয় অধ্যায়। ভক্তি আন্দোলন মানুষকে যে মানবতার পাঠ দিয়েছিল, যে ভালোবাসা ও প্রেমের কথা শিখিয়েছিল তা আমাদের আজও ভাবায়। এই ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব বাংলার সংস্কৃতি ও বাঙালির জীবনকে যথেষ্ট আলোড়িত করে তোলে। অনেকে মনে করেন এই ভক্তি আন্দোলনের প্রভাবেই ষোড়শ শতকের শেষভাগ থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত চৈতন্য পরবর্তী যুগে সারা বাংলায় এক সমন্বয়ের সংস্কৃতির পরিমণ্ডলের সৃষ্টি হয় এবং মন্দির নির্মাণের আগ্রহ এত ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
আমরা জানি বাংলার মন্দিরের মূল উপাদান মাটি। তাই পোড়ামাটির মন্দির বা টেরাকোটার মন্দিরই বাংলার বিশেষত্ব। এও জানি বাংলায় শিখর, চালা ও রত্ন এই তিন ধরনের রীতির মন্দির প্রধানত দেখা যায়। এর মধ্যে চালা ও রত্ন এই দুই রীতি বাংলার নিজস্ব। বাংলার কুঁড়েঘরের অনুসরণে এই চালা রীতির মন্দিরগুলি নির্মিত। আমরা চারচালা, আটচালা এমন কি বারোচালার মন্দির বাংলার বিভিন্নস্থানে দেখতে পাই। দেখতে পাই এই মন্দিরের ওপর চূড়ো তৈরি করে রত্ন মন্দির নির্মানের কাজও। একরত্ন, পঞ্চরত্ন, নবরত্ন মন্দিরের স্থাপত্য নির্মানের কারিগরী দক্ষতা দেখে বিস্মিত হতে হয়। বাংলায় পঁচিশরত্নের মন্দিরেরও নিদর্শন মেলে।
মৌখিরায় এই তিন রীতির মন্দিরই দেখতে পাওয়া যায়। শিখর রীতির তিনটি পশ্চিমমুখী মন্দির ও দুটি পুবমুখী মন্দির অর্থাৎ শিখররীতির মোট পাঁচটি শিব মন্দির এ অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। দেখতে পাওয়া যায় আটচালা রীতির একটি উত্তরমুখী ও দুটি দক্ষিণমুখি মোট তিনটি মন্দির। এগুলিও শিবমন্দির। কিন্তু এখানে একটি উত্তরমুখি বিষ্ণুমন্দির বা লক্ষ্মীজনার্দনের মন্দির আছে সেই মন্দিরটি পঞ্চরত্নমন্দির রীতির অন্তর্গত। এই মন্দিরটি অন্যান্য মন্দিরগুলির তুলনায় আকারে ও আয়তনে বিশাল। এর নির্মাণশৈলী অন্যান্য মন্দিরগুলির তুলনায় আলাদা এবং এর অলংকরণেও আধিক্য লক্ষ্য করার মতো।
এই গুচ্ছ শিবমন্দির চত্বরে একটি দক্ষিণমুখী আটচালা মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার ফলকে উৎকীর্ণ আছে শকাব্দ ১৭১৫, সন ১২০০ (চিত্র:৩)। এই ফলকটি দেখে অনুমান করা সহজ যে এই মন্দিরটি আনুমানিক ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু মৌখিরার সব মন্দির যে একই সময় নির্মাণ করা হয়েছিল তা মন্দিরগুলির শিল্প রীতি বা অলংকরণ দেখে আমার মনে হয় না। এই বংশের বিভিন্ন পুরুষরা বিভিন্ন সময়ে তাদের সমৃদ্ধি সূচিত করতে এই মন্দিরগুলি নির্মাণ করে থাকবেন। মৌখিরার মন্দিরগুলির অলংকরণ দেখতে দেখতে রাঢ়ের এ অঞ্চলের মন্দিরের ইতিহাসের পাতাটা একবার উল্টে দেখতে ইচ্ছা করে।
চিত্র : ৩
অজয় নদের ঐ পাড়ে বর্তমান বীরভূম জেলার ইলামবাজার থানা থেকে প্রায় ছয় সাত কিলোমিটার দূরে ঘুড়িষা বলে একটা জায়গা আছে। লোকে বলে এই অঞ্চলটি সপ্তদশ শতকে সংস্কৃত এবং ন্যায়শাস্ত্র আলোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। বর্তমান বীরভূমের সবথেকে প্রাচীন মন্দিরটি এই অঞ্চলেই আছে। ঘুড়িষার রঘুনাথ মন্দির। এই মন্দিরটি ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত। David McCutchion এই মন্দির সম্পর্কে আলোচনায় লিখেছিলেন যে বাংলা যেসব অলংকৃত মন্দির আছে তার মধ্যে এই মন্দিরটি প্রাচীনতম এমনকি বিষ্ণুপুরের মন্দিরগুলির চেয়েও বহু প্রাচীন। শোনা যায় এই মন্দিরের মতো এত অলংকরণ করা মন্দির বাংলায় এর আগে আর তৈরি হয়নি। অতএব বলা যায় যে এই রঘুনাথ মন্দিরে বাংলার মন্দিরের অলংকরণের যে ভূমিকা রচিত হয়েছিল তা পরবর্তীকালে বাংলার মন্দিরের অলংকরণের প্রবণতার একটা স্রোত তৈরি করে দেয়। যার প্রভাব আমরা দেখতে পাই মৌখিরার মন্দিরগুলির অলংকরণেও।
মৌখিরার মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতাদের খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল এই রায় পরিবারের আদি পুরুষ পরমানন্দ রায় বর্তমান গুসকরার দরিয়াপুরের বাসিন্দা ছিলেন। পরমানন্দ রায় বর্ধমান রাজার দ্বারপত্তনীদার হয়ে এই অঞ্চলে তার জমিদারির পত্তন করেছিলেন। অনুমান করা হয় মৌখিরার ভাঙা জমিদার বাড়িটি এদের আদি বাড়ি ছিল। কালিকাপুরের বাড়িটি পরবর্তীকালে নির্মাণ করা হয়। পরমানন্দ রায়ের কালিকাপুর জমিদারবাড়ির সঙ্গে সংযোগের কথা আমরা সকলেই জানি কালিকাপুর অঞ্চলটির সুপরিচিতির কারণে। কালিকাপুরের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হল এখনো অনুধাবন যোগ্য এর জমিদার বাড়ির স্থাপত্য, দুর্গাপূজোর ধূম এবং এর সংলগ্ন দুটি শিখররীতির অপূর্ব টেরাকোটার শিবমন্দির ও তার অলংকরণ। এ ছাড়া ও আরো একটি উল্লেখযোগ্য কারণ আমার মনে হয় খন্ডহর থেকে রসগোল্লা চলচ্চিত্রে এই জমিদার বাড়ির অসামান্য চিত্রায়ণ। কিন্তু মৌখিরার এই অঞ্চল কালিকাপুরের চেয়ে প্রাচীন হলেও এর পরিচিতি কালিকাপুরের চেয়ে অনেক কম। প্রায় নেই বললেই চলে। মৌখিরার মন্দিরের ক্ষয়িষ্ণুতা ও সাধারণ মানুষের আঞ্চলিক ইতিহাস সম্পর্কে সচেতনতার অভাব আমাদের মৌখিরা থেকে বিমুখ করে রেখেছে। একটু মন দিয়ে দেখলে এই মন্দিরগুলির অলংকরণের বৈচিত্রে মুগ্ধ হতে হয়।
মৌখিরার মন্দিরের অলংকরণে প্রধানত তিন ধরনের মোটিফ লক্ষ্য করা যায় – পৌরাণিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক। প্রতিটি মন্দিরের প্র্রবেশপথের দেওয়াল জুড়ে অলংকরণের প্রবণতা লক্ষনীয়। কিন্তু প্রবেশপথের দরজার মাথায় এই অলংকরণের প্রবণতা সবথেকে বেশি দেখা যায়। পৌরাণিক মোটিফের মধ্যে রাম, কৃষ্ণ, শিব, পার্বতী, কালীর মোটিফগুলি উল্লেখযোগ্য।
গুচ্ছ শিব মন্দির চত্বরে ঢুকেই ডান হাতের শিখর রীতির পশ্চিমমুখি যে শিবমন্দিরগুলি আছে তার প্রথম মন্দিরটির প্রবেশদ্বারের ঠিক উপরে একটি অসাধারণ প্যানেল আছে। প্যানেলটিতে বিভিন্ন দেবদেবীর অলংকরণের পাশাপাশি সামাজিক মোটিফ এমনকি প্রাকৃতিক মোটিফের মিশেল দেখতে পাওয়া যায়। প্যানেলটির নিচের দিকে বাঁ ও ডান হাতে বাদ্য বাদনরত দুই বাদককে দেখা যায় যা সেই সময়ের সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবন থেকে উঠে এসেছে বলেই মনে হয়। এর ঠিক ওপরে বাঁদিকে কবি জয়দেবের অমর কাব্য গীতগোবিন্দর পৃষ্ঠা থেকে উঠে আসা রাধা-কৃষ্ণ প্রেমের চিরস্মরণীয় অধ্যায় “দেহিপদপল্লব মুদারম্” চিত্র মূর্ত হয়ে উঠেছে (চিত্র:৪)। দরজার ঠিক উপরে মাঝে ফুল এবং পাখির অলংকরণ করা আছে। এর ডান দিকের চৌকো প্যানেলে রাধা ও কৃষ্ণ যুগলের বংশীবাদনরত মূর্তি অলংকৃত আছে। এর ঠিক উপরের প্যানেলে শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্ম সমন্বয়ের এক অসামান্য উদাহারণ আমরা দেখতে পাই কালীকৃষ্ণের মূর্তিটিতে (চিত্র:৫)। এখানে মহাকালী দাঁড়িয়ে আছেন শ্রীকৃষ্ণের লীলায়িত ভঙ্গিতে। কালীর হাতে নরমুণ্ড ও আয়ুধ থাকলেও দেহ বল্লরীর পেলব ভঙ্গিমায় কালীর সেই পরিচিত রুদ্ররূপ অন্তর্হিত। মা কালী জিভ কেটে চিরাচরিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলেও শিবের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। এই মন্দিরের প্রবেশপথের উপরে মাঝখানে পার্বতী সহ বৃষবাহন শিবের একটি অসাধারণ প্যানেল আছে। এখানে স্থুলোদর লোকায়ত শিব দৃশ্যমান। এর বাঁদিকের চৌকো প্যানেলে শ্রী রাধিকা সহচরীদের সাথে শৃঙ্গাররতা। এখানে রাধার পোষাকে যেন ইসলামিক রীতির প্রভাব লক্ষ করা যায়। ডানহাতে শিখররীতির পশ্চিমমুখী শিবমন্দিরের দ্বিতীয় মন্দিরটির প্রবেশদ্বারের ওপরে রাম সীতার সভার দৃশ্য উৎকীর্ণ আছে। এই মোটফটিতে জোড়হাতে হনুমান পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। ডানহাতে শিখররীতির পশ্চিমমুখী শিবমন্দিরের তৃতীয় মন্দিরটির প্রবেশদ্বারের ওপরের প্যানেলে আমরা দেখতে পাই এক পুরুষ ময়ূর ও সহচর সহচরীর সঙ্গে বসে আছেন। মনে প্রশ্ন জাগে এই মূর্তি কি কার্তিকেয়র? এই প্যানেলের নীচের দুপাশে দুজন নর এবং নারীকে বিশ্রামরত অবস্থায় দেখা যায়। এর দুপাশের দুটি প্যানেলে নৃত্যগীতে মগ্ন স্ত্রী পুরুষের মূর্তিও উৎকীর্ণ আছে।
চিত্র : ৪
চিত্র : ৫
বাংলার বেশীরভাগ মন্দিরের মতো সংকীর্তনের দৃশ্য মৌখিরার মন্দিরেও উৎকীর্ণ আছে। এই শিব মন্দির চত্বরে ঢুকেই বাঁ হাতের শিখর রীতির পূবমুখি যে শিবমন্দিরগুলি আছে তার প্রথমটিতে সংকীর্তনকারীরা গলায় মালা পরে খোল মৃদঙ্গ করতাল প্রভৃতি বাদ্য নিয়ে বিভোর হয়ে নামগান করছেন। এর তলার প্যানেল গুলিতে বিশ্রামরত নর নারীর সমাজচিত্র অলংকৃত আছে। দ্বিতীয়টিতে পাই কৃষ্ণের গোষ্ঠলীলার চিরাচরিত দৃশ্য।
মন্দির চত্বরের ঢুকেই বাঁহাতে তৃতীয় যে উত্তরমুখি আটচালা শিবমন্দিরটি আছে তার দরজার উপরে ফুল লতা পাতা সহ জাফরি সদৃশ মোটিফের সঙ্গে চূড়ায় নিশান সহ সারিবদ্ধ আটটি আটচালা মন্দিরের চিত্র অলংকৃত আছে (চিত্র:৬), যা দেখে তৎকালীন বিত্তবানেদের মন্দির প্রতিষ্ঠার আগ্রহের সামগ্রিক চেহারাটা আমরা অনুমান করতে পারি। মন্দিরগুলির দরজায় বিগ্রহের উপস্থিতির আভাস থাকলেও এদের অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে তা থেকে বর্তমানে বিগ্রহ বিষয়ে কোনো অনুমানই সম্ভব নয়। এই মন্দিরটির ঠিক বিপরীতে দক্ষিণমুখী যে দুটি আটচালা শিব মন্দির আছে তার পূবদিকের মন্দিরটির দরজার ওপর রামসীতার সভার একটি অলংকরণ আছে। রাম ও সীতা দুজনে সিংহাসনে বসে আছেন, হনুমান তাদের প্রণাম করছেন এবং কিংকর কিংকরী চামর দোলাচ্ছেন। এই মন্দিরটির উপরদিকে দুই কোণায় দুটি অশ্বাকৃতি সিংহের মোটিফ দেখতে পাওয়া যায়। এই মোটিফ এই মন্দিরেই নতুন নয়। এ অঞ্চলের আরো দু’একটা মন্দিরে আমরা এই অশ্বাকৃতিসিংহের নিদর্শন পাই। মনে মনে ভাবতে থাকি … সব মানুষের মনেই এক রাজপুত্র থাকে আর থাকে তার এক বন্দিনী রাজকন্যা। সেই বন্দিনী রাজকন্যাকে রাক্ষসপুরী থেকে উদ্ধার করতে হবে। এই দুর্গম পথ দ্রুত অতিক্রম করার জন্য রাজপুত্রের চাই পক্ষীরাজ ঘোড়া। মনে প্রশ্ন জাগে, এই অশ্বাকৃতি সিংহ কোন দেশের কোন পুরাণে কোন জীবন যুদ্ধ জয়ের রূপকথা থেকে উঠে এল? এ চত্বরে দক্ষিণমুখী যে দুটি আটচালা শিব মন্দির আছে তার পশ্চিমদিকের মন্দিরটি যেটির গা ঘেঁষে একটি জয়ন্তী গাছ আছে সেই মন্দিরের প্রবেশপথের উপরে জাফরি সদৃশ কাজের সঙ্গে শুকসারি এবং ফুল লতা পাতার দৃশ্য উৎকীর্ণ আছে।
চিত্র : ৬
মৌখিরার শিব মন্দির চত্বরে যে উত্তরমুখী পঞ্চরত্ন মন্দিরটি আছে সেটি বিষ্ণু মন্দির। এই মন্দিরের কৃষ্ণের জীবন অবলম্বনে তিন ধরনের কাহিনীর চমৎকার অলংকরণ লক্ষ্য করা যায়। একদম ডানদিকের অলংকরণের মূল বিষয়টি হল কৃষ্ণজন্ম লীলা। এই মন্দিরে কৃষ্ণজন্মলীলার কাহিনী গুলি শিল্পীরা অলংকৃত করেছেন অসামান্য দক্ষতায়। এর মধ্যে দুটি প্যানেল বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। প্রথমটি হল কংসের কারাগারে মা দেবকীর কোলে চতুর্ভূজ শ্রীকৃষ্ণের জন্ম কথা (চিত্র:৭)। পরে আমরা জানি দেবকীর বিশেষ অনুরোধে কংসের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে দ্বিভূজ মনূষ্যমূর্তি ধারণ করেন কৃষ্ণ। দ্বিতীয়টি হলো যোগমায়ার দৈববাণী “তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে” (চিত্র:৮)। শিশু শ্রীকৃষ্ণকে কংসের হাত থেকে রক্ষা করতে বাসুদেব রেখে আসেন গোকুলে মা যশোদার কাছে। কারাগারে নিয়ে আসেন মা যশোদার কন্যা যোগমায়াকে রেখে দেন দেবকীর কোলে। নবজাতকের জন্মের খবর পেয়ে কংস নবজাতকটি বধ করতে কারাগারে ছুটে আসেন এবং যখন কংস শিশু কন্যাটিকে বধ করতে উদ্যত হন তখন শিশুকন্যা যোগমায়া দেবী মূর্তি ধারণ করেন এবং বলেন, তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে। মৌখিরার মন্দিরে শিল্পীরা যোগমায়ার এই কাহিনীটি সুন্দর দক্ষতায় উৎকীর্ণ করেছেন। এই মন্দিরে মাঝখানে কৃষ্ণের রাসলীলার কাহিনী উৎকীর্ণ আছে। বাংলার মন্দিরে রাসমণ্ডলের মোটিফ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মন্দিরেও রাসমণ্ডলের একটি সুন্দর মোটিফ আমরা দেখতে পাই। কার্তিক পূর্ণিমায় কৃষ্ণকে কেন্দ্রকরে গোপীনিদের চক্রাকার নৃত্য রাসমন্ডলের মোটিফে অলংকৃত আছে। এই মন্দিরের একদম বামদিকে কৃষ্ণের বাল্যলীলার কিছু কাহিনী উৎকীর্ণ আছে। এছাড়াও এই মন্দিরের অলংকরণে ফুল ও পাখির মোটিফ লক্ষনীয়। তৎকালীন সমাজজীবন থেকে উঠে আসা নারীর দৈনন্দিন যাপনের দু’তিনটি মোটিফ আমরা এই মন্দিরে দেখতে পাই। এই মন্দিরের লক্ষী জনার্দনের যুগলমূর্তির বিগ্রহটি যে পেতলের দোলার (সিংহাসন) উপর রক্ষিত সেটি আনুমানিক দেড়শ বছরের প্রাচীন। এই দোলাটি মন্দিরের ভিতরে একটি দীর্ঘায়িত কুলুঙ্গিতে রক্ষিত। কুলুঙ্গিতে ফুল, লতা, পাতা ও পাখির একটি অপূর্ব আলপনা অঙ্কিত আছে (চিত্র:৯)।
চিত্র : ৭
চিত্র : ৮
চিত্র : ৯
এই মন্দিরগুলির অলংকরণে চিত্রকলার কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। অনুমান করা হয় পোড়ামাটির ইঁটের ওপর শামুকের খোল পোড়ানো চুনের একটা প্রলেপ লাগিয়ে তার ওপর এই চিত্র অঙ্কন করা হয়েছিলো। চিত্রাঙ্কনে লাল রঙের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো (চিত্র:১০)। অজয়ের ধারে যে লাল পাথর পাওয়া যেতো তার সঙ্গে তেঁতুল বিচির আঠা মিশিয়ে কি এই লাল রং তারা পেতো? নাকি লাক্ষা শোধন করার সময় পাতনার জল রক্তবর্ণ হয়ে উঠত সেই জলের সঙ্গে গোলাকৃতি শিমূলপাতা ভিজিয়ে যে দেশীয় আলতা তৈরি হতো সেই আলতার সঙ্গে তেঁতুল বিচির আঠা মিশিয়ে এই লাল রং পেত তারা। মনে অনেক প্রশ্ন ভিড় করে আসে, পরমানন্দ রায়েদের এত আর্থিক সমৃদ্ধির কারণ কী? তাঁরাও কি নীলচাষ, লাক্ষাচাষ, রেশমের চাষ থেকেই ব্রিটিশদের আনুগত্যে মুনাফা অর্জন করতেন? মূলত ফুল, লতা, পাতাই ছিল চিত্রগুলির বিষয়। ১৯৭৮-এর বন্যায় এই ছবিগুলির বেশীরভাগটাই নষ্ট হয়ে যায়। এই মন্দিরে কিছু পাথরের টালির ওপর শ্যালো রিলিফের কাজ আজও অলংকৃত আছে। অনুমান করা হয় এগুলো নরম ল্যাটারাইটের ফুলপাথরের টালি। এই টালি গুলির ওপর রিলিফের কাজ মুগ্ধ হবার মতো। এছাড়াও প্রায় সব শিখররীতির মন্দিরের গায়ে বিশেষ করে মন্দিরের নিচের অংশে ছোটো ছোটো টেরাকোটার ত্রিমাত্রিক কাজের নিদর্শণ পাওয়া যায় (চিত্র:১১)।
চিত্র : ১০
চিত্র : ১১
আমরা শুনেছি বাংলার মন্দির শিল্পীরা মূলত সুত্রধর সম্প্রদায়ের মানুষ। এরা শুধু মাটি নয় কাঠ, পাথর এমনকি চিত্র রচনায় সমান সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এরা দল বেঁধে নানা জায়গায় ঘুরতেন। মেলার দোকানদাররা যেমন এক মেলা থেকে অন্য মেলায় সফর করেন তাঁদের পণ্যসম্ভার নিয়ে, তেমনি হয়ত মন্দির শিল্পীরাও এক বিত্তবানের আশ্রয় থেকে আর এক বিত্তবানের আশ্রয় গ্রহণ করতেন তাঁদের সমস্ত অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও শিল্পসত্তা নিয়ে মূলত গ্রাসাচ্ছাদনের কারণে ও নিজেদের নতুন করে ফুটিয়ে তুলতে। এভাবেই মন্দির শিল্পীরা মন্দিরের শিল্প সংস্কৃতিকে প্রবহমান রেখেছেন স্থান থেকে স্থানান্তরে, যুগ থেকে যুগান্তরে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মন্দির প্রতিষ্ঠাতার অভিরুচি মন্দির শিল্পীদের বিষয় নির্বাচন এবং নির্মাণকে প্রভাবিত করতো। কিন্তু অভিরুচি যারই হোক মন্দির শিল্পীদের শাস্ত্র আত্মীকরণের ক্ষমতা ও তাকে শিল্পে রূপ দেবার দক্ষতা আমায় মুগ্ধ করেছে। বর্তমানে দাঁড়িয়ে এই অঞ্চলকে দেখে যতই অনুন্নত মনে হোক না কেন অজয় নদের তীরবর্তী এই অঞ্চলগুলো ব্যবসা বানিজ্যে একসময় যে কতটা উন্নতি করেছিল এবং এই আর্থিক সমৃদ্ধির ফলে এই অঞ্চলের ছোটো ছোটো গ্রামগুলি শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে কতটা ঋদ্ধ হয়ে উঠেছিল তার প্রমাণ আজও এই মন্দিরগুলি বহন করে চলেছে। শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব রীতির এক সুন্দর সমন্বয় আমরা দেখতে পাই এই মৌখিরার মন্দিরের অলংকরণে।
আজ এই একবিংশ শতকে মোবাইল ফোন হাতে মন্দিরগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকি আর কবে আমরা সচেতন হব। জীবনপণ করে সংরক্ষণ করবো আমাদের ইতিহাসকে আমাদের ঐতিহ্যকে। কবে আবার আমরা মুখ ফেরাব আমাদের গ্রামগুলোর দিকে। রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো মনে আসে, “… ভারতবর্ষের একক গ্রাম, এই গ্রামগুলিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে …।”
অন্ধকার নেমে আসে চরাচরে। শীতের সন্ধ্যায় একবুক হাহাকার সঙ্গে ক’রে ঘরে ফিরে আসি।