দেবতোষ দাশ
গোটা বিশশতক জুড়ে নানান ম্যানিফেস্টোর যে বোলবোলা, ঠাটবাট, একুশে এসে তারা টিকবে তো! নাকি এখানেই ইস্তেহারের ইতি? ম্যানিফেস্টোর মৃত্যু এখন কি কেবল সময়ের অপেক্ষা? মার্ক্সবাদী ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এরিক হবস্বম তাঁর লেখা শেষ বই ‘ফ্র্যাকচারড টাইমস্, কালচার অ্যান্ড সোসাইটি ইন দ্য টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি’-তে এইসব প্রশ্ন তুলেছেন। বিশশতকের সমাজ ও সংস্কৃতিকে কাটা-ছেঁড়া করে সুরতহাল করেছেন সেই ‘ফুটিফাটা সময়ের’। আর সে বীক্ষণ-ব্রহ্মাণ্ডে ঢোকার আগে পাঠকের সামনে নিজেই গড়ে দিয়েছেন এক চিলতে চৌকাঠ। সে চৌকাঠের শিরোনাম – ম্যানিফেস্টোস। ইস্তেহারবলী। ম্যানিফেস্টোময় বিশশতকের সালতামামি করে সাহেব আশঙ্কা করেছেন, একুশ শতকে এদের অস্তিত্ব নিয়ে। দিস্তে দিস্তে ইস্তেহারের হার মেনে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। কারণ সময় তাদের মূল্যহীন করে দিয়েছে।
সাহেবের বই প্রকাশের ঠিক পরের বছর, ২০১৪য় কন্নড় ভাষায় প্রকাশিত হল বিশিষ্ট কন্নড় লেখক ইউ আর অনন্তমূর্তি’র অন্তিম বই ‘হিন্দুত্ব অর হিন্দ স্বরাজ’ (ইংরেজি অনুবাদ ২০১৬য়)। গুজরাট গণহত্যার নায়ক নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির সটান দিল্লির মসনদ-প্রাপ্তি মেনে নিতে পারেননি অনন্তমূর্তি। ভোটের আগেই যখন মোদিলহর টের পাওয়া যাচ্ছে, বললেন, মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি আর দেশে থাকবেন না। নির্বাচনে জয়ী হয়ে মোদি দিল্লি দরবার দখল করতেই রে-রে করে তেড়ে এল মোদি-ব্রিগেড। তারা বিমানের টিকিট কেটে লেখককে পাকিস্তান পাঠিয়ে দিতে সোচ্চার হল। বেশি দিন দেখতে হয়নি মোদির ‘আচ্ছে দিন’, অনন্তমূর্তি অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ধরাধাম ত্যাগ করলেন। কিন্তু শেষ বইয়েও সারাজীবন যা করেছেন তাই করলেন। ক্ষুরধার ভাষায় জঙ্গি আরএসএস ও তাদের হিন্দুত্ববাদকে ফালাফালা করে দিয়ে গেলেন। বইয়ের মুখবন্ধে শিব বিশ্বনাথন লিখলেন, এই বই ইঙ্গিত দিল ‘এজ অফ ম্যানিফেস্টো’ এখনও শেষ হয়নি। ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ম্যানিফেস্টোকে তাঁর লেখক জীবনের সোয়ানসং হিসেবে মনোনীত করেছেন। ভারতবর্ষের রাজনীতির অন্দরে ঢুকতে গেলে, নেশন স্টেট নামক অন্ধকারের অতল স্পর্শ করতে চাইলে, চাই ইস্তেহারের বয়ান।
দুই যুগপুরুষ তাঁদের শেষ কাজে, দুটিই মরণোত্তর প্রকাশ, অজান্তেই ছুঁয়ে ফেললেন দুই বিপরীত চিন্তাকে। পশ্চিমের হয়তো আর দরকার নেই ইস্তেহার, প্রয়োজন আমাদের, তাই এই বৈপরীত্য। যাইহোক ইস্তেহারের ভবিষ্যৎ জল্পনা ছেড়ে, আপাতত ইউআরএ (ইউ আর অনন্তমূর্তি যে সম্বোধনে বেশি পরিচিত) শেষজীবনে কী ভেবেছিলেন ভারতের ঘেয়ো রাজনীতি নিয়ে; সঙ্ঘী-হিন্দুত্ববাদ আর গান্ধীজীর হিন্দ স্বরাজ, দুই বিপ্রতীপ মতবাদ নিয়ে কী বিচার-বিশ্লেষণ করেছিলেন, চলুন দেখা যাক।
‘আপনি আমাকে আজ সেই দেবতারই মন্ত্র দিন যিনি হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান ব্রাহ্ম সকলেরই, যাঁর মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে, কোনো ব্যক্তির কাছে কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না, যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন- যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।’
যখন জানতে পারল সে হিন্দুই নয়, সে এক আইরিশ দম্পতির সন্তান, হিন্দুত্বের হামবড়াইয়ে গর্বিত গোরা মুহূর্তে ভেঙে পড়ল চুরচুর। কত ভঙ্গুর তার হিন্দুয়ানী! কত পলকা তার গর্ব! ভুল বুঝতে পেরে পরেশবাবুর কাছে সমর্পণ করেছিল নিজেকে। খোঁজ করেছিল ভারতবর্ষের দেবতার। হয়ে উঠতে চেয়েছিল বিশ্বমানব।
উগ্র উন্মাদনার থেকে মুক্তি পেতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সঙ্গে গান্ধীও কি খোঁজ করেননি জীবনভর, এই মন্দিরের? এই ভারতমন্ত্রের? এই বিশ্বমানবতার? আজকের ভারতবর্ষের দিকে তাকালে ‘গোরা’র এই খোঁজ ও আত্মজিজ্ঞাসা কেমন প্রাসঙ্গিক মনে হয়। এখন কেন, হিন্দুত্ববাদের এই হিংস্রতার শুরুয়াত হয়েছিল যে সময়, সেই ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলী দেখেশুনে সাহিত্য অ্যাকাডেমির তৎকালীন সভাপতি ইউ আর অনন্তমূর্তির মনে হয়েছিল, এখন টেগোরের ‘গোরা’ পড়ার সময়, চর্চার সময়। অনেককে তিনি এই চর্চায় উদ্বুদ্ধও করেছিলেন। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, নরেন্দ্র মোদিরা ‘গোরা’ পড়েন না।
স্কটিশ বাপ-মা, যারা সিপাহী বিদ্রোহের সময় প্রাণভয়ে পালিয়েছিল, সদ্যজাত সন্তানকে আস্তাবলে ফেলেই, সেই শ্বেতাঙ্গ শিশুকে গোরা নাম দিয়ে লালন-পালন করেছিল এক বাঙালি গোঁড়া হিন্দু পরিবার। বড় হয়ে সে নিজেও হয়ে ওঠে এক কঠিন ‘হিন্দু’। সে দুচ্ছাই করেছিল ব্রাহ্মসমাজকে, যাদের গায়ে খ্রিস্টধর্মের গন্ধ, ইংরিজি বুলির প্রতি অসীম ভক্তি আর ‘আমিই শ্রেষ্ট’ গোছের উন্নাসিকতা। কিন্তু হিন্দুত্বের পরাক্রমের মধ্যেই গলদগাড্ডা জেগে ওঠে। ধীরে ধীরে চিড় ধরে ধর্মান্ধতার পলকা বিশোয়াসে। যে পালক-পিতা তাকে পৈতে পরিয়ে বানিয়েছিল চরম ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু, সে-ই পিতাই পূজা করার সময় তাকে স্পর্শ করে না! ক্রমে গোরা বোঝে সে একজন কমপ্লিট আউটসাইডার। তার ভুল ভাঙে।
জন্মবৃত্তান্ত সামনে আসতেই গোরার চোখ থেকে খসে পড়েছিল মিথ্যের কাজল। যে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জাতিভেদ চোখের মণির মতো আগলে রেখেছিল, মুহূর্তে অসার হয়ে উঠেছিল সেই জাত্যাভিমান। মা আনন্দময়ীর ঘরে একদা সে খেতে পর্যন্ত চায়নি জাতপাতের বজ্জাতির ঘোরে। মায়ের ঘরে বিধর্মী দাসী লছমিয়ার ছোঁয়া সে নেবে না। অথচ এই লছমিয়াই বসন্ত-আক্রান্ত শিশু গোরাকে পরমযত্নে আরোগ্য করেছিল একদা।
পরে অন্ধত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে মা আনন্দময়ীকে সে বলে, ‘মা, তুমিই আমার মা! যে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম তিনিই আমার ঘরের মধ্যে এসে বসেছিলেন। তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই- শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা! তুমিই আমার ভারতবর্ষ!’
অথচ এই উদার ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে গড়ে ওঠে হিন্দুত্ববাদ। আজ যার অষ্টশুঁড়, ভারতবর্ষের চিরকালীন ধর্মকে চারপাশ থেকে পেঁচিয়ে, দমবন্ধ করতে অতিসক্রিয়। এই মার-মার কাট-কাট সিনড্রোমের শুরুয়াৎ গত শতকে। হিন্দু মহাসভার নেতা চক্ষুচিকিৎসক বালকৃষ্ণ শিবরাম মুঞ্জে দেখা করেছিলেন ইটালির ফ্যাসিস্ট একনায়ক মুসোলিনির সঙ্গে। উদ্দেশ্য ছিল মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট দলের আদলে একটি জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী দল তৈরি করা। পরে মুঞ্জের শিষ্য হিন্দুত্ববাদের গত শতকের পোস্টারবয় বি ডি সাভারকর ও গুরুজি এম এস গোলওয়ালকরের পরাণেও ঠাঁই নিয়েছিল জঙ্গি ফ্যাসিবাদ। যেদিন থেকে হিন্দুত্বকে মিলিট্যান্ট হিন্দুইজমে পরিণত করতে চাইলেন নেতারা, হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে হিন্দুধর্মের চিরবিচ্ছেদ ঘটে গেল। তেলেজলে যেমন লটরপটর হয় না, তেমনই উদার হিন্দুধর্মের সঙ্গে যায় না জঙ্গিপনা। কিন্তু ক্ষমতা ও মতাদর্শের রাজনীতির উগ্র প্রণোদনায় ঘটাতেই হবে এই দুষ্কর্ম। কীভাবে দেওয়া হল গোঁজামিল? ঘটানো হল এই সামরিকীকরণ? পেলব নরোত্তমকে বানিয়ে দেওয়া হল কঠিন টেররিস্ট? কীভাবে?
কাট টু ‘আলিবাবার গুপ্তভাণ্ডার’। প্রবন্ধের নাম, ‘পুনর্’ বিষয়ে পুনর্বিবেচনা। আমাদের আত্ম-আধুনিকীকরণের একটি ঐতিহ্য। লেখক দিকপাল চিন্তাবিদ শিবাজী বন্দ্যোপাধায়। গত শতাব্দীতে কীভাবে ‘হিন্দুত্ব’কে গড়েপিটে ‘হিন্দুত্ববাদ’ নামক এক বীজমন্ত্র বানানো হচ্ছে, তার ছানবিন করেছেন শিবাজী। আসুন দেখা যাক।
‘বর্তমান সময়ে কতকগুলি বিশেষ কারণে হিন্দু আপনার হিন্দুত্ব লইয়া ভয়ংকর রুখিয়া উঠিয়াছে। … বিশ্বরচনায় এই হিন্দুত্বই বিধাতার চরম কীর্তি এবং এই সৃষ্টিতেই তিনি তাঁহার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করিয়া আর-কিছুতেই অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না, এইটে আমাদের বুলি।’
হঠাৎ শুনলে মনে হতে পারে, কথাটা বুঝি এখনকার সময় সম্পর্কে বলা হচ্ছে। এখন জলে-স্থলে এবং অন্তরীক্ষে (মানে ফেসবুকসহ সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ায়) গো-রক্ষক ও হনুমান-সেনাদের যে দাপট, এই মন্তব্যটি সে-প্রসঙ্গে পুরোপুরি খাপে-খাপ হলেও, আদপে তা সমসাময়িক কোনো রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের নয়। ১৯১৪ সালে মন্তব্যটি করেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বাস্তব’ রচনায়। এই ‘হিন্দুত্ব লইয়া ভয়ংকর রুখিয়া উঠিয়াছে’ সময়ের বছর দশেকের মধ্যেই ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় বিনায়ক দামোদর সাভারকরের পুস্তিকা : হিন্দুত্ব / হু ইজ এ হিন্দু। মুষ্ঠি আরো পাকানো হয়, কিছুই যেন গলতে না-পারে। আরো আঁটোসাটো করা হয় হিন্দুত্বের সংজ্ঞা।
‘হিন্দু’ কে? সাভারকরের সাফ-সাফ জবাব : সিন্ধুনদ থেকে সমুদ্র অবধি বিস্তৃত ভারতবর্ষকে যে একযোগে ‘পিতৃভূমি’ জ্ঞান করে সে-ই ‘হিন্দু’। ‘পিতৃভূমি ও পুণ্যভূমি’র সরল সমীকরণের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে সাভারকরের প্রার্থিত রাষ্ট্র-কাঠামো। ওই সমীকরণের মোদ্দা কথা হল, মুসলমান বা খ্রিস্টানরা যেহেতু আরব বা প্যালেস্টাইনকে তাদের ‘পুণ্যভূমি’ জ্ঞান করে, তাদের দেশাত্মবোধ সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া অসম্ভব।
শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় টিপ্পনি যোগ করছেন এখানে, ‘অল্প দিনের ভেতর, একই যুক্তি অনুসারে, অনাত্মীয়দের নাম তালিকা আর একটু বাড়ে – মুসলিম-খ্রিস্টানদের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক ‘পুণ্যভূমি’র ভক্তকুল কম্যুনিস্টদের এক সারিতে ঠাঁই করে দেন আরেক হিন্দু তাত্ত্বিক (গুরুজি) গোলওয়ালকর। ‘হিন্দু’ কে, এই জটিল প্রশ্নের তড়িৎ-সমাধান ঘটিয়ে, সেই ‘হিন্দু’কেই ভাবনার একক হিসেবে ধরে, সাভারকর লেখেন তাঁর ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বিষয়ক ইস্তেহার।’
সেই ইস্তেহার অনুযায়ী:
১. সংখ্যালঘুদের স্বাধীন ধর্মাচরণের সুযোগ থাকবে, কিন্তু কড়া নজর রাখা হবে যাতে সংখ্যাগুরুদের ন্যায়সম্মত অধিকার তারা কোনোমতেই খর্ব না করে, রাষ্ট্রের ভেতর আরেকটা রাষ্ট্র বানিয়ে না বসে।
[আসুন মিলিয়ে নিই: মহানগরের রাজাবাজার বা পার্কসার্কাসসহ রাজ্যের মুসলিম-মহল্লাগুলোকে কত সহজে ও কৌশলে দেগে দেওয়া হয় ‘পাকিস্তান’ বলে।]
২. নাগরি জাতীয় লিপি, হিন্দি জাতীয় ভাষা ও সংস্কৃত দেবভাষা রূপে পরিগণিত হবে।
[হিন্দি-হিন্দুস্তানের ত্রহস্পর্শে হাঁফ উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বাকি ভারতবর্ষের। সংস্কৃতকেও কোঅপ্ট করা হয়েছে এমনভাবে যেন সংস্কৃতভাষায় লিখিত সব ‘কর্ম’ই হিন্দু-সম্পত্তি! এতে সাফল্যও এতটাই অন্য ধর্মাবলম্বীরাও তাই-ই বিশ্বাস করে!]
৩. দু-হাত খুলে অভ্যর্থনা জানাতে হবে যন্ত্রযুগকে – শিল্পবাণিজ্যের প্রসারের লক্ষে ব্যক্তিপুঁজিকে নানাভাবে জোগাতে হবে সাহায্য ও উৎসাহ।
[আম্বানি-আদানি-মালিয়াদের অতিরিক্ত আদর ও প্রীতি দেখেই বোঝা যায়!]
৪. পুঁজিপতি ও শ্রমিক, দু-পক্ষের স্বার্থকেই নিয়ন্ত্রণ করা হবে জাতীয় প্রয়োজনের নিক্তিতে – কোনো শিল্পসংস্থা যদি দুর্ভাগ্যবশত লোকসানের মুখ দেখে, তাহলে তার দায়ভাগ শ্রমিকদেরও নিতে হবে।
[কী আনন্দ! বিপুল মুনাফায় ভাগ নেই, লোকসানে দায় আছে!]
৫. ধর্মঘট-লকআউটের জেরে যদি উৎপাদন-ব্যবস্থা টালমাটাল হয়, তাহলে সে-সব কঠোর হস্তে দমন করবে রাষ্ট্র।
[রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নই ফ্যাসিবাদের মূল অস্ত্র।]
৬. ব্যক্তিগত মালিকানা হবে রাষ্ট্রীয় নীতির অন্যতম স্তম্ভ।
[যৌথ যা কিছু, সামাজিক বিন্যাস থেকে অর্থনীতি, সবেতেই এদের বিরাট আপত্তি। ফলত আম্বানি-আদানিরাই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় নীতির স্তম্ভ।]
৭. হিন্দুদের ‘পুণ্যভূমি’র নাম হবে ‘ভারত’ অথবা ‘হিন্দুস্থান’।
[আর্যাবর্ত, যেখানে চতুঃবর্ণ ব্যবস্থার চল, অর্থাৎ উত্তরভারত, তাকেই গোটা ভারতবর্ষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অন্যায় জোরাজুরি।]
ঠিক এর বিপরীত-চর্চাই সারাজীবন করে গেছেন গান্ধী। আশিস লাহিড়ী দেখিয়েছেন কীভাবে গান্ধী উগ্র-হিন্দুত্ববাদের প্রতিস্পর্ধী হিসেবে নিজের মতবাদকে স্পষ্ট করেছেন। গান্ধী বলেন, ‘আমার হিন্দুত্ব আমাকে শেখায় সকল ধর্মকে সম্মান করতে।’
সঙ্ঘীরা যেমন নরোত্তম রামকে বানিয়েছেন মিলিটারি-রাম, গান্ধীর রামরাজ্য তা নয়। সেখানে তিনি বৈষ্ণব। ন্যায়বিচার আর গণতান্ত্রিক আদর্শই সেই রাজ্যের ভিত্তি। সংখ্যাগুরুবাদ নয়, ‘নগণ্যতম নাগরিকটিও সেখানে দ্রুত সুবিচার পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত। তার জন্য বিরাট বিপুল জটিল ব্যয়-বহুল কর্মকাণ্ড নিষ্প্রয়োজন।’ সম্পদের নির্মম অসাম্য বন্টনও তাঁর না-পসন্দ। ‘বর্তমানের এই নিষ্ঠুর অসাম্যের দশায়, যেখানে কিছু লোক সম্পদের কোলে গড়াগড়ি খাচ্ছে, আর জনগণের পেটে জুটছে না যথেষ্ট খাবার, সেখানে রামরাজ্য আসতে পারে না। সমাজতন্ত্রী ও অন্যদের সঙ্গে আমার বিরোধ কেবল এই জায়গায় যে স্থায়ী কোনো সংস্কার আনবার জন্য হিংসার পথকে আমি আক্রমণ করি।’ কমিউনিস্টদের সঙ্গে উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর বিরোধ নেই। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে-আসা সাম্যকেও তিনি দোষারোপ করেন। কারণ তা হিংসাময়। রক্তাক্ত।
সঙ্ঘের রামরাজ্য যেখানে মনুর অনুশাসনের ক্রিয়াভূমি, ব্রাহ্মণ্যবাদের ল্যাবরেটরি, গান্ধীর রামরাজ্য সেখানে স্বপ্নরাজ্য। সেই ‘স্বপ্নের রামরাজ্যে রাজা আর ভিখিরির সমান অধিকার সুনিশ্চিত থাকবে।’ এই মতাদর্শে সারাজীবন অটল থাকলে; অনুদার, সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘীদের সঙ্গে তো তাঁর তীব্র বিরোধিতা হবেই। ফলত ঠিক এই জায়গাতেই, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে তিনটি গুলি করে তাঁকে খুন করার যৌক্তিকতা তৈরি করে ফেলতে পারেন হিন্দু মহাসভার সদস্য নাথুরাম। অনন্তমূর্তি লেখেন, কীভাবে গান্ধীর মৃত্যুতে, কন্নড় কবি সীতারামাইয়া সত্যদ্রষ্টা হয়ে বলে ফেলেন, আমরা সকলেই সাপের মতো। বিষধর। গডসে কেবল এর বিষদাঁত।
কীভাবে বিষ ঢালার প্রক্রিয়া শুরু হয় ভারতবর্ষে, তার সঞ্চারপথটি নির্দিষ্ট করেন শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধে। দেখব আমরা সেই পথটি।
১৯২৫ সালে সাভারকর শুরু করেন ‘মরাঠি ভাষাশুদ্ধি’ আন্দোলন – মারাঠির সঙ্গে আরবি-ফারসির সংস্রব চুকিয়ে দেওয়ার আয়োজন ছিল সেটি। পিতৃভূমির যোগ্য জাতীয় পতাকার জন্যে সাভারকর বাছেন তিন প্রতীক – কুণ্ডলিনী, ওঁংকার ও কৃপাণ। নকশাটি ‘হিন্দু মহাসভা’ গ্রহণ করলে ফাউ হিসেবে যুক্ত হয় স্বস্তিক। সাভারকরের অভিমতঃ শস্ত্রবিহীন যে তার প্রণবনাদে কেউ কান দেয় না, হাতে কৃপাণ না থাকলে মূলাধারচক্রে ঘা দিয়ে কুলকূণ্ডলিনীকে চাগিয়ে তোলা যায় না; ঐশীশক্তির দুর্লভ প্রেরণা কাম্য হলে হিন্দুদের আগে পরতে হবে যুদ্ধসাজ, অর্জন করতে হবে সামরিক প্রতিভা।
আমাদের মনে পড়ে যাবে, ১৯২০তেই কংগ্রেস ত্যাগ করছেন সঙ্ঘীদের আদিগুরু বালকৃষ্ণ শিবরাম মুঞ্জে মূলত দুটো কারণ দেখিয়ে। কী সেই জোড়া কারণ? তিনি গান্ধীর অহিংসা ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী। বুকে মণ্ডল, হাতে কমণ্ডলু, চোখে খোয়াইশঃ একটি জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী দল তৈরি করতে হবে। ১৯২৫-এ তৈরি হয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। আরএসএস। ১৯৩১-এ দেখা করে ফেলছেন ফ্যাসিস্ট একনায়ক মুসোলিনির সঙ্গে। মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট দলের আদলে গড়তে হবে সঙ্ঘ। মুঞ্জে-শিষ্য সাভারকর গুরুর স্বপ্ন সাকার করতে জানকবুল করলেন।
সাভারকরের সেই অভিপ্রেত হিন্দু-সামরিকীকরণ আজ সম্পূর্ণ হয়েছে। যোগী ও মোদির নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে গো-রক্ষক সেনা, যারা গোস্তের গন্ধে গন্ধে ঢুকে যেতে পারছে বিধর্মীর অন্দরমহলে। তাকে ‘যোগ্য’ সাজাও দিতে পারছে।
সাভারকরের মতাদর্শে সাম্যের কোনো জায়গা ছিল না, তেমনি সব রকমের আন্তর্জাতিকতাবাদী চিন্তার প্রতি ছিল গভীর বিরাগ। ১৯৬১ সালের ১৫ই জানুয়ারি, প্রকাশ্য সভায় দেওয়া জীবনের শেষ অভিভাষণে সাভারকর বলেন: কেবলমাত্র সামরিক সামর্থ্যের বাটখারা দিয়েই দেশীয় মহত্ত্বের পরিমাপ করা যায়; যে গণতন্ত্র ভীরু এবং পদে-পদে শত্রুর সামনে মাথা নোয়াতে কুণ্ঠিত হয় না তা ত্যাজ্য; নপুংসক গণতন্ত্রের চেয়ে হিটলার শতগুণে শ্রেয়; ভারতের উচিত, তার সামরিক বাহিনীকে আরো আধুনিক ও জোরদার করা; ভারতের কর্তব্য, ক্রমাগত নতুন ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধোপকরণ বানিয়ে চলা – যথা, হাইড্রোজেন বোমা।
এই ধর্মীয় মিলিটারাইজেশনের পাশাপাশি, আশিস লাহিড়ি ধরিয়ে দিতে চান, আজকের হিন্দুত্ববাদীদের অর্থনৈতিক সুবিধাবাদ। তারা বিজ্ঞানের মুক্তচিন্তার ওপর গণেশ-চাপা দিয়েছেন, কিন্তু বিজ্ঞানের বাণিজ্যিক ও সামরিক দিকগুলিকে দু’হাত বাড়িয়ে বরণ করেছেন। তার জন্য আন্তর্জাতিক পুঁজির কাছে – যারা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নিয়ন্তা – দেশটাকে সস্তা দরে বেচে দেওয়ার ঠিকাদারি নিয়েছেন।
তাই মোদির আমলে সাভারকরের পুরনো হিন্দুত্ববাদের একটা নতুন ডানা গজিয়েছে, যা নির্মমভাবে অর্থনৈতিক। এই হিন্দুত্ববাদ কেবল ধর্মীয় দিক থেকেই প্রতিক্রিয়াশীল নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও তারা দেশ-বিরোধী।
শাহ ও মোদি দেশটাকে সস্তায় বেচে দিচ্ছেন। এবং এই গোটা প্রক্রিয়ায় মোদির ভূমিকা বৃহৎ এক বিপণন প্রতিষ্ঠানের চালু সেলসম্যানের। আদিবাসীদের থেকে দেশের সম্পদ ছিনিয়ে বহুজাতিকের হাতে জলের দরে তুলে দিয়ে ‘টার্গেট’ ছাপিয়ে গিয়ে তিনি ‘ইন্সেন্টিভ’ পাচ্ছেন। এইভাবে তৈরি হয়ে চলেছে ক্যাশলেস ‘আচ্ছে দিনে’র ছক।
ডিজিটাল রামরাজ্যের এই ব্লুপ্রিন্ট গান্ধীর সনাতনী রামরাজ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। এই বিপরীত বিহারেই কি ক্রমমুক্তি হবে ইন্ডিয়ার, নাকি সেই দেবতার মন্ত্রের খোঁজ করব আমরা ভারতবাসী, যিনি হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান ব্রাহ্ম সকলেরই, যাঁর মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে, কোনো ব্যক্তির কাছে কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না, যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন- যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।
ইউআরএ সেই দেবতার স্বপ্ন বুকে নিয়ে ভারতভূমি ছেড়ে গেছেন চিরকালের জন্য, রেখে গেছেন মুক্তির সঞ্চারপথ। ম্যানিফেস্টো।
হিন্দুত্ব অর হিন্দ স্বরাজ
ইউ আর অনন্তমূর্তি
হার্পার পেরেনিয়াল
মূল্য ৩৫০ ভারতীয় টাকা