রাজদীপ্ত রায়
এক-একটা সময় আসে যখন ভাবনাচিন্তা সব কেমন গুলিয়ে যায়। নির্জীব কাঠের মতো মৃত মনে হয় সময়। সমাজচেতনা। অপরাধী, ভীষণভাবে অপরাধী মনে হয় নিজেকে। অমোচনীয় কলঙ্কের ভারে পালিয়ে যেতে, লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে লোকচক্ষুর আড়ালে। অসহায় আর ইতর লাগে আত্মপরিচয়ের পোশাকি নির্মোক। ভাষা হারায়, বিরাম হারায়, চেতনার অন্তঃস্থ শৃংখলা হারায় বেসামাল ঘটনা-অভিঘাতে। নিজেকে মানুষ ভাবতে ঘেন্না হয় খুব, যখন পূজাবকাশের পাহাড়ি ঢালে আমার দশমী-যাপনে অসহায় মিশে যায় ডুয়ার্সের হাসপাতালে যন্ত্রণা আর মৃত্যুর সঙ্গে বেহুঁশ যুঝতে থাকা তিন সন্তানের জননীর স্তিমিত শ্বাসের ওঠাপড়া। তাঁর জল শুকিয়ে যাওয়া ধ্বস্ত চোখের ফ্যালফ্যালে জিজ্ঞাসা। রক্ত, শ্লেষ্মা আর ছাইচাপা নতুন পরিচয়। ধর্ষিতা। আমার তখন বাড়ি-ফেরার আনন্দ। আমার থালায় তখন প্রীতি সম্ভাষণের প্রসাদী উপচার। আর তাঁর কোলপোঁছা শিশুর কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে সংজ্ঞাহীন মায়ের অকৃত্রিম বাৎসল্যের নিরুপায় দুধ। একটি ধর্ষণ, একটি যৌন-হিংসাচিহ্নিত অশ্লীল নির্যাতন। শুধু শিশ্নে সীমাবদ্ধ না-থেকে পূর্ণ পৌরুষের প্রলম্বিত ধ্বজা হিসেবে বিজয়ক্ষেত্রে বা অত্যচারিতর অঙ্গে লোহার রড, মাছমারার কোঁচ, বোতল বা নিদেনপক্ষে যা কিছু হাতের সামনে পাওয়া যায় তা-ই গেঁথে দিয়ে বিজয়গর্বের বেলাগাম আমোদ চলতেই থাকে। বারবার। গ্রাম, শহর, দেশ, পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ সামাজিক ভূখণ্ড, সর্বত্র। পৌরুষ উদযাপনের পরদিন, সকালে সংবাদপত্রের পাতায় আরও একটি নতুন পরিচয়ের উৎপত্তি হয় – ধর্ষিতা। সংবাদপত্রের নিটোল ব্যাকরণে, ধর্ষিতা। কিন্তু আসলে ধর্ষিত। পল্লী, প্রান্তর, বাড়ির উঠোন, রেলস্টেশন, বৃদ্ধাবাস, প্রতিবেশী রাজ্যের বনাঞ্চল, ধর্মস্থান, রাজপথ – গোটা দেশের মানচিত্র জুড়ে কোথায় নয়, কখন নয়, কবে নয়!
দেহ-মস্তিষ্ক-চেতনা অসাড় করা একই বিজ্ঞপ্তি রাত্রিদিন, নিরন্তর। ধর্ষিত – এই পরিচিতির তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে হতে ক্রমে বিশেষ ঘটনা থেকে এখন প্রায় দৈনন্দিন সাধারণ ঘটনার ম্যাড়মেড়ে বিশেষত্বহীনতায় অণ্বিত। যিনি নির্যাতিতা, তাঁর এই ভিন্ন পরিচিতি নির্মাণ প্রায় তাৎক্ষণিক। নির্যাতন-মুহূর্ত থেকেই সে অভিজ্ঞানের স্থির নির্বাচন। কিন্তু যে বীর-‘পুরুষ’ বা পুরুষেরা কাণ্ডটি ঘটালেন, তাঁদের ধর্ষক পরিচিতি কিন্তু কাল এবং বিচারসাপেক্ষ। একধাপ এগিয়ে বলাই যায় যে, সে পরিচয় আমাদের আদতে পুরুষপ্রবল সমাজে আদৌ কখনও নির্মাণ হয় কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ভাষা, ব্যাকরণ থেকে সাহিত্য বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক প্রত্নরূপগুলি সবই এত বেশিমাত্রায় শিশ্ন-কেন্দ্রীক চিহ্ন বা প্রেক্ষিতের ছায়ায় পুষ্ট, লালিত, এমনকী দেশ-কাল-সমাজ নিরপেক্ষতায় ক্লান্তিহীনভাবে লিঙ্গ-রাজনীতির ধারক, যে এ-হেন সামাজিক পরিসরে আমাদের সমবেদনা, সমস্ত ‘আহা’ ‘উহু’ও প্রচ্ছন্ন সে রাজনীতিকে অনুচ্চারে বয়ে নিয়ে চলে। তারপর সময় পেরিয়ে যায়। তারপর খবরের কাগজের পাতা উলটে যায়। আমাদের সমস্ত সহ- ও সম-মর্মিতা কালে কালে দিগন্তে মিলায় ছায়ার মতো। আমরা মেনে নিই, নিতে শিখি। পৃথিবী আরও একটু ক্লান্ত, ন্যুব্জ এবং বয়সী হয়। কিন্তু আইনের হাতে ধরা পড়া বা না-পড়া পুরুষ দানবটির সামাজিক কোনও উল্লেখ আর পাওয়া যায় না প্রতিদিনের পশরা বাজারে। অতি যত্নে গড়ে তোলা সাংস্কৃতিক রাজনীতির নিখুঁত মোড়ক অপরাধীর আড়াল-যাপনে প্রশ্রয় দিয়ে আসলে অপরাধকেই আড়াল করে । শুধু সাময়িকী থেকে শহরে, লেখচিত্র বা সংখ্যাতত্ত্ব থেকে নির্যাতন-পরবর্তী সংসার-জীবনেও নির্যাতিতার আজীবন নতুন পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয় – তিনি ধর্ষিতা।
এ এক অদ্ভুত অপারগ চিহ্নবহন। যেখানে শব্দটির ব্যাকরণসম্মত স্ত্রীলিঙ্গান্তর, ধর্ষিত>ধর্ষিতা, প্রকারান্তরে একটি চরম সামাজিক পরিহাস। চলুন তো ভেবে দেখি, আমরা কবে কোন সুদূর কালে শেষ দেখেছি একটি বয়ষ্ক পুরুষকে ‘ধর্ষিত’ হিসেবে। চিন্তায় চাপ দিয়ে গবেষণা করলে সংখ্যাতত্ত্ব হয়তো সাজানো যাবে, কিন্তু সে সংখ্যা ইতিহাসের পাতায় নেহাৎই বালখিল্য মাইনরিটি। আসলে ধর্ষণের কোনও ব্যাকরণ নেই, অন্তত এই বিরামহীন পুরুষতন্ত্রের সাংস্কৃতিক নারী/পুরুষ নির্মাণ প্রকল্পে তো নয়ই। এখানে, আমাদের পল্লী-গ্রাম-শহর-নগর-চরাচরে নিত্যদিন চলতে থাকা পুরুষশ্রেষ্ঠ-অহমিকা উৎসবের আবহে, অববাহিকায় একটিই ডমিনেটেড অপর, নারী – যাকে নিপীড়নে, শাসনে, সম্ভোগে, অত্যাচারে বা ছেদনে ছিন্নভিন্ন না-করতে পারলে আমার, অর্থাৎ আদর্শ পুরুষপ্রবরের স্বভাব-সন্নত বিজয়কেতন ওড়ে না। উড়তে পারে না। এই লিঙ্গ সমীকরণ এক প্রবল, প্রায় নিষ্কৃতিহীন নির্মাণ। অন্তত ভাষা, সাহিত্য বা সংস্কৃতির দিকে তাকালে তা-ই মনে হয়। স্বভাবতই আমাদের সুখ-দুঃখ-ঝগড়া-অভিমান-রাজনীতি-সমাজনীতির নিত্য লীলাখেলার সাধারণ বাক্য এবং ইচ্ছেবিন্যাসগুলোতে আকারে ইঙ্গিতে নিরন্তর রচিত, রটিত হতে থাকে ধর্ষণ-ইচ্ছা। রেপ রেটরিক। নিজেকে পরাক্রমী দেখাবার নিশ্চিত বাসনায় আমরা প্রকাশ্যে বলি, “রেপ করিয়ে দেব”; আমাদের নিত্য ব্যবহারের অতিসাধের চলিত স্ল্যাং-এ শক্তি জাহির করি যাবতীয় নারীঅঙ্গ ধ্বস্ত করবার নিহিত বাসনায়; আমাদের সবচাইতে প্রিয় যৌবনলীলামুখর ছায়াছবিগুলোতে রোম্যান্সের স্বাভাবিক আর্কাইভ রচনা করি কোনও অভিমানী জেদি নারীকে ক্রমান্বয়ে বিরক্ত করে, স্টক করে, তাঁর “না”-কে “হ্যাঁ”-তে রূপান্তরের তীব্র আকাঙ্ক্ষায়, তা সে ষাটের ঝড়-তোলা জুটির বাংলা ফিল্মেই হোক বা নব্বইয়ের রঙিন হিন্দি বেঢপ বিলাসে।
আমরা আসলে প্রতিদিন ধর্ষণ করি। নারীকে উত্যক্ত করি। মানব সম্প্রদায়ভুক্ত একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গের অংশকে, এবং তার সঙ্গে অন্যান্য মাইনর অস্তিত্বগুলিকেও, শুধুমাত্র, এবং শুধুইমাত্র বডি বা ‘শরীর’ হিসেবে দেখি, চিহ্নিত করি, নিজের বশে রেখে আধিপত্য বিস্তারের মুক্তাঞ্চলে পরিণত করি ভাষায়, কল্পনায়, সৃষ্টিতে এবং প্রতিদিনের নোংরা জঘন্য বেঁচেবর্তে থাকার শরীরী বাস্তবতার ধর্ষণক্রিয়ায়। দেহজ অত্যাচার করে কিছু পুরুষ, যারা যতটা পুরুষ ততটা হয়তো মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি এখনও। কিন্তু যে সংস্কৃতি বা সমাজ সেই দ্বিধাহীন, সংশয়হীন না-মানুষীয় পুরুষ তৈরি করে, আজও, অকৃত্রিম, ঘরে, বাইরে, বিদ্যালয়ে, কলেজে বা পুকুরপাড়ে, তার মানসিক ধর্ষক প্রবৃত্তির কোনও ইতিবৃত্ত, চিহ্নায়ন বা সংখ্যাতত্ত্ব তো রাখিনি আমরা, তার দায় কে নেবে? আর সে দায় না-নিলে, সমাজের প্রতিটি কোনায়, ঘরে বা বাইরে একটি করে নিশ্চিত ধর্ষক তৈরি করবার অপরাধবোধ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারব কি আমরা, এই সব বুঝেও আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে বসে থাকা এই আহাম্মক, নিথর চেতন-প্রতীতি?
গতকাল দিল্লি ছিল। বয়স কম। রাতের বেলা। ধর্ষণের আরও কত কী অফুরন্ত অজুহাত সম্বলিত লালসা-বলি নির্ভয়া। তারপর পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ হয়ে রাতের মহানগরী, স্টেশন, প্ল্যাটফর্ম। অত্যাচারিত অশীতিপর উন্মাদ হতশ্রী বার্ধক্য। অত্যাচারী? প্রায় বালকবয়সী পুরুষেরা। কালের অসহ তাড়নায় এখন অপরাধ বাইরের বা দূরের নয় আর। আমার আপনার উঠোনের কেন্দ্র প্রান্ত ঘেঁটে দিয়ে নির্যাতনের বান ডেকেছে যাপন-পরিসরে। নারীর নির্যাতন, রীতি নীতি সংস্কারের অছিলায় স্রেফ দেহ পরিচয়ে সীমিত করে হেনস্থা / অবজ্ঞা বা হোম ভায়োলেন্স – সবেতেই আমরা জগৎসভায় এগিয়ে। বাদ যাচ্ছেন না একজন মা’ও, যাঁর ঘরে তিনটি সন্তান। বাদ যেতে পারেন না। অব্যাহতি পাবেন না কোনো নারীই। ঘরের পাশে ঘরের মাঝে ঘটে যাচ্ছে রক্তপাত, লেখা হচ্ছে যৌন নির্যাতনের অকৃত্রিম দিনিলিপি। প্রথমে শরীর দিয়ে; তারপর যূথবদ্ধ মহোৎসবের পরম উল্লাসে মাথা খাটিয়ে অত্যাচারের নতুন নতুন ফন্দিফিকির খুঁজে বের করে; এবং শেষে পৌরুষ-কার্নিভ্যালের তৃপ্ত আয়েশে ধ্বস্তভূমিতে বিজয়তাকা প্রোথিত করে নিজ আধিপত্য কায়েম করার মাধ্যমে। যাঃ, প্রাণে মারলাম না, কিন্তু তোর আজীবন বেঁচে থাকার প্রত্যেক ভেঙেচুরে যাওয়া মুহূর্তে এঁকে দিলাম লাঞ্ছনা-অভিজ্ঞান, তুই ভোগ্য, আমি ভোগী! আহা, পৌরুষ!
শুধুই কি এটুকু? না। তাও তো নয়। যে প্রতিবেদন বেরোবে পরদিন, এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় খবরের শিরোপা মাথায় নিয়ে, সংবাদপত্রের সে পাতায় কালো কালিতে আঁকা হবে সহানুভূতির রেখাচিত্র। আক্রান্ত এবং ধ্বস্ত, হাঁটুতে মুখ গোঁজা একটি নারীদেহের নির্ভুল স্যিল্যুয়েট। অর্থাৎ, প্রতিবেদনের শিরোপায় যে মানবিকতার প্রায়োরিটি দাবি করা হল, সেটাও এই বাজারের পণ্যায়ন বা কমোডিফিকেশনের শর্ত মেনে। রেখাচিত্রে চিহ্নিত হল ধর্ষিত নারীর আক্রান্ত বিভঙ্গ। ধর্ষিতর পরিচয় তৈরি হল। নারীদেহ পণ্য হল। পুরুষ ও পৌরুষশাসিত বাজারে স্মার্ট সংবাদপত্রের বিক্রি বাড়ল। কিন্তু যে অত্যাচারীটি / গুলো ধর্ষক, এবং নিশ্চিতভাবেই পুরুষ, তার / তাদের কোনও রেখাচিত্র বাজারে সিল্যুয়েট হয়ে এল না। পৌরুষে বুঁদ হোমোফোবিক ক্রেতার কাছে বিক্রিমূল্য না-থাকায় সংবাদপত্রের স্বঘোষিত লিঙ্গসাম্য বাজার রাজনীতির বাইরে পা রাখল না কিছুতেই। ধর্ষক পরিচয় আড়ালেই থেকে গেল। বিড়ম্বনা তাতে নেই। কিন্তু অবশ্যম্ভাবী ভাবে নির্মিত হলো ধর্ষিত সত্ত্বা।
এই অত্যাচারের দিনলিপির নিত্যনৈমিত্তিক প্রেক্ষিতে একটা কথা প্রায়ই মনে হয় যে, নিষ্কৃতি কোথায়? জানি, মহামহিম প্রতাপশালী রাষ্ট্র সদর্পে বলবেন, কেন, আইন আছে, শাস্তি আছে। রাজনৈতিক নেতা বলতেন, এবং আজও বলবেন, ও’সব তো হয়েই থাকে। সংস্কৃতি পুঁজি চেটেপুটে খেতে অভ্যেস করে ফেলা অ্যাভাঁ গার্দ রাজনীতি গলা ফাটিয়ে নেশার দোহাই, শূচিতার দোহাই পেড়ে লিঙ্গচেতনার পরিপন্থী শস্তা আন্দোলনে বিপ্লব ডেকে দেবে। আর আমরা, ড্রইংরুম আলো করা ভদ্রজন, আড়মোড়া ভেঙে বলব, “ছিঃ, এসব নিয়ে কথা বলতে নেই”। ডিনায়্যাল বজায় রাখে ক্ষমতা সমীকরণ। বলে, পৌরুষ আদতে শিকারি সত্তা, কেন্দ্রীয় তার অবস্থান। নারী প্রান্তিক, সতত শিকার হওয়াই যেন তার নিষ্কৃতিহীন ভবিতব্য। অথচ পথ যে ছিল না, তা নয়। এই সময়ে বোঝা দরকার যে, রাষ্ট্র ধর্ষককে সাজা দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলতে চায়, সেও আসলে অন্যভাবে আরও একবার বডি পলিটিকস বা শরীর-রাজনীতিকেই প্রশ্রয় দেয়। কিন্তু পৌরুষ আধিপত্যের মোহে যে অপরাধ সংগঠিত হল, সে লিঙ্গ-অস্মিতার শেকড় তো মনে। মানস সংস্কৃতির গূঢ় নিশ্চেতনে আত্মনির্মাণের নামান্তর। সে প্রণোদনার শেকড় উচ্ছেদ তো ধর্ষকের বডি বা শরীরকে শাস্তি দিয়ে সম্ভব করা যায় না। অন্য পথ, অন্য ভাবনা এখুনি আবশ্যক। খেলার মাঠে জাতি বা বর্ণ বৈষম্যের যে কোনও উচ্চারণে আজকাল প্রাতিষ্ঠানিক বিধিনিষেধ আছে। উচ্চারণ বা ইঙ্গিত করা মাত্রই শাস্তিবিধান। খেলার শুরুতে প্রতিজ্ঞাপত্রের মন্ত্র উচ্চারণ বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ সভ্য পরিসরের সমস্ত অঞ্চল থেকে এই বৈষম্যের বিরূদ্ধে সোচ্চার প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছে। সাংস্কৃতিক স্তরে বোধ জাগানোর চেষ্ঠা চলছে নিরন্তর। আর সবটাই হচ্ছে রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান বা সরকারের তরফে ব্যাপক মাত্রায় ও বিস্তারে। ফলাফল যে পাওয়া যাচ্ছে সে তো বিশ্বমঞ্চের বড় খেলার মাঠের গত দু’দশকের পরিবর্তনেই স্পষ্ট। আমাদের দেশেও অন্য প্রেক্ষিতে এই ধরনের কিছু প্রচেষ্টা চোখে পড়ছে ইদানিং। দেশের প্রতিটি শিক্ষা কারিকুলামে এখন প্রকৃতিবিদ্যা অবশ্যপাঠ্য। উদ্দেশ্য স্পষ্ট। বিপন্ন প্রকৃতি রক্ষা করা। কিন্তু দেহজ পরিচয়ে নারী, বা এই ‘যে কোনও সময়ে নির্যাতন করা যায়’ জাতীয় অপরায়িত অশক্ত অন্যান্য ‘মানুষ’ সত্তাগুলি ? এদের বিষয়ে কবে আমরা সাংস্কৃতিক আধিপত্যের লালিতপৌরুষ বিলাস থেকে বেরোব? এ দায়িত্ব কবে নেবে আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্র?
সামাজিকভাবে অতিবিপন্ন এই মানুষগুলির আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচবার সম্যক পরিস্থিতি নিশ্চিত করবার কোনও দায় নেই রাষ্ট্রের? মানুষ নামক এই জীবগোষ্ঠীর নিজস্ব আচরণ এবং বোধে এত যে ধন্ধ, প্রশ্ন, লিঙ্গ ভেদাভেদ এবং রাজনীতি, এসব নিয়ে প্রাথমিক সাংস্কৃতিক স্তরে সেনসিটাইজ করার দায়িত্ব, শেষ বিচারে সেই রাষ্ট্রকেই তো নিতে হবে, সে আমরা যতই রাষ্ট্রের শৌখিন মুণ্ডপাত করি না কেন! এই দায় নিতান্তই না থাকলে কিসের রাষ্ট্র, আর কিসেরই বা সমাজ? যদি প্রতিটি ক্লাসে জেন্ডার স্টাডির পাঠ আবশ্যক করা হয়, যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় নারীবিদ্যার পাঠ না থাকলে, যদি লিঙ্গ রাজনীতির জ্ঞানের ন্যূনতম শংসাপত্র না থাকলে আটকে দেওয়া যায় জনপ্রতিনিধিত্ব বা কাজ পাওয়ার অধিকার, তা হলে কি একটুও পরিবর্তন আসবে না? একটি ক্রিকেটার বা অভিনেতাই শুধু নয়, ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল আধারগুলোর সঙ্গে যুক্ত যে কোনও ব্যক্তিকে যদি দায়বদ্ধ করা যায় লিঙ্গসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে, তা হলেও তো খানিক এগনো যায়। না হয় শপথবাক্য পাঠ করলাম প্রতিটি ক্ষেত্রে। অন্তত প্রয়োজনটাকে স্বীকৃতি তো দেওয়া যাবে। সব ক্ষেত্রে, পরিসরে, ঘরে, বাইরে, প্রেমে বা অপ্রেমে। না হয় যা ভাবলাম বা বললাম, সবই ভুল। না হয় অন্যভাবে আরও গভীরতায় এসব ব্যবস্থার কথা ভাবা প্রয়োজন। কিন্তু ভাবাটা যে আশু প্রয়োজন, সে বিষয়ে দ্বিরুক্তি থাকবে না আশা করাটাই শ্রেয়। আশা করাই যায় যে, আজও কিছু মানুষ জেগে আছেন বাহ্যিক পুরুষ অস্তিত্বের দেহরূপের আড়ালে। তাঁরা, অন্তত তাঁরা, আপনি-আমি-আমরা, সকলে এগিয়ে এসে আত্মজার শঙ্কাহীন বেঁচেবর্তে থাকার একটা শাবল, কোঁচ, বোতল বা লাঠি খড় আরও কত কী নৃশংস সম্ভাবনামুক্ত নদীরপাড়ের স্বপ্ন তো দেখতে পারি। অন্তত একবার? একটি মেয়েকে মানুষজ্ঞানে একটি কাম-অপরাধ-নিঃশঙ্ক চব্বিশ ঘন্টাও কি আমরা দিতে পারি না এই একবিংশ শতকের অ্যান্ড্রয়েড মুখর ‘সভ্য’ সমাজে? আমরা এখনও এতটা আদিম, এতটাই শরীর? এখনও, এতটাই পুরুষ?