Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পদাতিক

মৃণালদা

সৌমিত্র দস্তিদার

 

 

 

সৌমিত্র দস্তিদার তথ্যচিত্র নির্মাতা, লেখক।

 

কখনও কখনও এমন হয়। প্রিয়জন চলে গেলে হয়। মা বাবার চলে যাওয়ার পর তো হয়েইছিল। এমনকি আমার গুরু, শিক্ষক মতি নন্দী প্রয়াণের দিনে এরকম অনুভব হয়েছিল। কাছের বন্ধু চলে গেলেও আজ যেমন হচ্ছে, তেমনই বড় বিষণ্ণ, একা লাগে।

সব কাজ অবশ্য ঠিকঠাকই করছি। দৈনন্দিন জীবনে কোথাও কোনও ফাঁকি নেই। তবু থেকে থেকেই বুকের ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগছে। মনে হচ্ছে কোনও চিরচেনা আপনজন আমাকে ছেড়ে চিরকালের মতো চলে গেলেন। অথচ মৃণাল সেনের সঙ্গে সে অর্থে আমার পরিচয় ছিল না। আমি কখনও তাঁর একান্ত ঘনিষ্ঠ বৃত্তের লোকও ছিলাম না।

পাশাপাশি এটাও ঠিক যে মৃণাল সেন নিজগুণে আমার মতো অতি সাধারণ এক ডকুমেন্টারি নির্মাতাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। প্রথম দিনের পরিচয় কীভাবে হয়েছিল তার খুঁটিনাটি আজও মনে আছে। তখন ২০০২ সাল। সবে সবে গুজরাত গণহত্যা নিয়ে ছবিটা শেষ করেছি। এখানে সেখানে ছবিটা দেখানো হচ্ছে। একটু আধটু চর্চাও হচ্ছে ছবিটা নিয়ে। এমন সময় অধৃষকুমার ফোন করে বললেন যে— মৃণাল সেন তোমায় খুঁজছেন। গুজরাত নিয়ে ছবি দেখবেন বলে।

অধৃষদা পেশায় ডাক্তার। বিশ্বাসে বামপন্থী। ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন দুই প্রথিতযশা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও মৃণাল সেনকে। অধৃষদার সঙ্গে মৃণাল সেনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বাবা ও ছেলের। এবং অবশ্যই প্রিয় কমরেডের।

আমি মৃণালদার বাড়ি গেলাম। যে সময় দিয়েছিলেন কাঁটায় কাঁটায় সেই সময়েই এলেন সিনেমার মহীরুহ আমার মতো সামান্য জনের ছবি দেখবেন বলে। তাঁর বাড়িতে সেই প্রথম কাছ থেকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে নতুন ধারার অন্যতম পথিকৃতকে। প্রণাম করতে গেলে নিলেন না। বললেন— আগে ছবি দেখব। পরে কথা। ছবি চালানো হল। ছোট ডিভানে আধশোয়া হয়ে মৃণাল সেন ছবি দেখছেন। আর আমি মুগ্ধতা নিয়েও বেশ ভয়ে ভয়ে দেখছি বাইশে শ্রাবণ, নীল আকাশের নিচে, ওকা উরি কথা, মৃগয়া, ভুবন সোম, কলকাতা-৭১, আকালের সন্ধানে’র পরিচালককে।

বৌদি বাদাম চানাচুর বিস্কুট দিয়ে গেছেন। মৃণাল সেন ফিরেও তাকালেন না। একমনে ছবি দেখছেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন পরিচালক সামান্য এক তরুণের ছবি দেখছেন নাওয়া-খাওয়া ভুলে। কুড়ি মিনিটের তথ্যচিত্র শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে বুকের ভেতর টেনে নিলেন মৃণালদা। ওই স্পর্শ, উষ্ণতা, আবেগে মুহূর্তে তিনি আপনজন, মৃণাল সেন থেকে মৃণালদা হয়ে গেলেন। গুজরাত জেনোসাইড নিয়ে সেই ছবি পরে অনেক পুরস্কার পেয়েছে। তবে ছবি দেখার পরে মৃণালদার সপ্রশংস দৃষ্টি আর পিঠে হাত রাখাই মনে হয় আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

এরপরেও নানা সময়, বিভিন্ন বিষয়ে মৃণালদার স্নেহ অনুভব করেছি। কতবার মৃণাল সেনের বাড়িতে গেছি। যেতে না যেতেই মৃণালদা হাঁক ডাক শুরু করে দিলেন— কই গেলে সব, সৌমিত্রকে চা-জলখাবার দাও। যতই বলি— মৃণালদা এখন কিছু খাব না। শুধু চা হলেই চলবে। মৃণালদা ততই বলেন, তাই কখনও হয়। কতদিন পরে এলে। বলতে বলতেই গীতা সেন স্বয়ং হাতে ট্রে নিয়ে ঢুকলেন। চায়ের কাপ আর প্লেট নামাতে নামাতে মৃণালদার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন— খাও। সত্যিই তো অনেক দিন বাদে এলে। ফুলকপির সিঙ্গারা করেছি। খেয়ে দেখো, কেমন হয়েছে। মৃণালদা হৈ হৈ করে উঠলেন— ও বাচ্চা ছেলে। স্বাদটাদের বোঝেটা কী! আমি দেখছি টেস্ট করে কী মাল বানিয়েছ। বলেই প্লেট থেকে একটা গরম সিঙাড়া মুখে পুরেই বলে উঠলেন— ফাস্ট ক্লাস। গীতাদিও যেন এই প্রশংসাটুকুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে আমাকে শুনিয়ে বললেন— তোমাকে খেতে দেওয়ার জন্য তোমার মৃণালদার কেন এত আগ্রহ বুঝেছ তো! কে বলবে আমার সামনে পৃথিবীবিখ্যাত এক দম্পতি এইরকম খুনসুটি করছেন। এইভাবে অক্লেশে আমার মতো সাধারণ, অতি সাধারণদের সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন মৃণালদা।

ঠিক করলাম ঝুপড়ি বস্তিতে গিয়ে আমার সিনেমা দেখাব। জনতার জন্য সিনেমা উৎসব। মৃণালদা শুনে খুব খুশি। ওঁর মধ্যে এমন একটা ছেলেমানুষি ছিল যা আমার মতো সামান্য ছেলেকেও ভীষণরকম প্রাণিত করত। একবার শুনলাম গুজরাত গণহত্যা নিয়ে ডকুমেন্টারিটা পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিনবে। হাজার ষাটেক দাম পাব। মনে মনে খুশি হলাম। মন্দ কী! তখন ওই টাকা কম নয়। নতুন ছবি করার রসদ জোগাড় করা যাবে। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে, কারও নেপথ্য অঙ্গুলিহেলনে আমার ছবিটি সরকার কিনল না। বদলে কিনল এমন একজনের, যিনি গুজরাতেই যাননি। মিথ্যে কথা বলে, আমার ছবির কিছু ফুটেজ নিয়ে এবং তা না জানিয়ে নিজের ছবিতে ব্যবহার করে সরকারের অনুগ্রহ লাভ করলেন। মনটা খারাপ হল। মৃণালদা সব শুনলেন। তারপর কোনও গোপন রহস্য ফাঁস করার ভঙ্গিতে মাছি তাড়াবার গলায় বললেন— বেঁচে গেলে সৌমিত্র। সরকার ছবি কেনাও যা আর মর্গে বেওয়ারিশ লাশ থাকাও তাই। দুটো একই। সরকার কিনলে তোমার ছবি আর কেউই দেখতে পারবে না। মুহূর্তে আমার যাবতীয় হতাশা কেটে গেল।

এই ছিলেন মৃণাল সেন। মৃণালদার সিনেমা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘটনাও সিনেমার মতো নাটকীয়। অনেকেই হয়তো জানেন তবু বলি। মৃণালদা তখন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে সম্ভবত মধ্যপ্রদেশের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একদিন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে জঙ্গলের কাছে আসতে না আসতেই আচমকাই চোখে পড়ল সূর্য অস্ত যাচ্ছে। লালে লাল আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃণাল সেনের হঠাৎই মনে হল এসব কী করে তিনি জীবন নষ্ট করছেন! সিনেমা তাঁকে করতেই হবে। পরের দিনই চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে সটান কলকাতায়। তারপর সব ইতিহাস। মৃণালদার সিনেমা নিয়ে কিছু বলব না। তা নিয়ে বলা, বিশ্লেষণ করার অনেক যোগ্য লোক আছেন। আমি শুধু মনে করিয়ে দেব যে মৃণাল সেনের নীল আকাশের নিচে সিনেমাটিই স্বাধীনতার পরে একমাত্র ফিল্ম যা ভারত রাষ্ট্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। সালটা বোধহয় ১৯৬২। চিন-ভারত যুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত নীল আকাশের নিচে সরকারের রোষানলে পড়েছিল নির্মাতার চিন-প্রীতি আবিষ্কার করে।

মৃণাল সেন ভারতের নিওওয়েভ সিনেমার অন্যতম জনক এটা অনেকেই বলেন। কিন্তু খুব কম লোক একথা বলেন যে মৃণাল সেন আক্ষরিক অর্থেই লাতিন আমেরিকার ঘরানার চলচ্চিত্র পরিচালক যিনি সরাসরি মুভমেন্টের অংশ হয়ে ছবি বানাতেন। এরকম অ্যাকটিভিস্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা আমাদের দেশে অন্য কেউ আর জন্মেছেন বলে আমি অন্তত মনে করতে পারছি না। ঋত্বিক ঘটককে মনে রেখেই কথাটা বললাম।

অনেকদিন ধরে ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করছি। এতদিনে কিছুটা পরিচিতি নিশ্চয়ই হয়েছে। তবু সিনেমা সার্কিটে দু-একজন টেকনিশিয়ান ছাড়া আমার সেরকম কোনও বন্ধু নেই। নিজে প্রবল বামপন্থী হয়েও তথাকথিত বামমহলেও আমি ব্রাত্য। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক শুধু গৌতম ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আর সদ্য চলে যাওয়া মৃণালদার সঙ্গে। প্রথম দুজনের সঙ্গে সম্পর্ক দাদা ভাই বা বন্ধুর মতো। আর মৃণালদা ছিলেন আমার পরম অভিভাবক। সময়ে সময়ে পিতৃস্নেহে আগলে রাখতেন। তাই পরিণত বয়সে বিদায় নিলেও মৃণালদার এই চলে যাওয়া আমার কাছে প্রায় পিতৃবিয়োগ। যন্ত্রণার ও বিষাদের। এ ক্ষত সারতে সময় লাগবে।