Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চাঁড়ালনামা

ধার্মিক - চাঁড়ালনামা

তাপস দাস

 

আমি ধার্মিক নই— কোনও ধর্মাবলম্বীই নই সে অর্থে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার মতো মানসিক স্বাবলম্বন আসার পর থেকে কখনও কোনও ধর্মীয় অথবা সামাজিক অনুশাসন মেনে চলিনি, সে সবে বিশ্বাসী নই বলেই। সমাজ সংসার ঈশ্বর ভূত প্রেত কিছুই মানি না, শাস্ত্রমতে বিয়ে করিনি, সামাজিক বিবাহও হয়নি, রেজিস্ট্রি হয়েছিল। এই শতকের প্রথম দিনে মলমাসে বিয়ে হয়েছিল, বিবাহের দিন নতুন শতাব্দী আহবান করা হবে, এই ছেলেমানুষি ইচ্ছায়।

বিবাহ উপলক্ষে ভুরিভোজ ব্যাড যায়নি অবশ্য, কারণ আমি ও আমার বন্ধুরা যৎপরোনাস্তি ঔদরিক, ফলে ভুরিভোজের বন্দোবস্ত হয়েছিল বইকি আনন্দানুষ্ঠান উপলক্ষে।

পরবর্তীকালে, সন্তানের মুখেভাত বা হাতেখড়ির ব্যবস্থাও করিনি, দরকার মনে করিনি। বাবা মার পারলৌকিক কার্য করতে অস্বীকার করেছিলাম বলে  সমাজ একঘরে করেছিল একসময়। তা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত চাপ দিয়ে করিয়ে উঠতে পারেনি কেউই।

ধর্ম না মানলেও, সামাজিক অনুশাসনকে অস্বীকার করলেও, আমি মানুষ মানি। ধর্মব্যবসায়ীদের চূড়ান্ত ঘৃণা করলেও, সাধারণ মানুষের দুর্বলতার পাঁচিলে সিঁদ কেটে ধর্মের ঢুকে যাওয়াকে বুঝতে পারি— বুঝতে চেষ্টা করি অন্তত, যে, সেটা সাধারণ মানুষের অসহায়তা, ধান্দাবাজি নয়। তাই বৃহস্পতিবার বৃহস্পতিবার আমার মা’কে লক্ষ্মীপুজোর ফুল এনে দিতাম। মা’র জীবনের শেষ দিনগুলিতে, যখন তাঁর পক্ষে  আর এমনকি হুইলচেয়ারে বসেও পাঁচালিপাঠ সম্ভব ছিল না, আমি নিজে পাঁচালি পড়েছি পটের সামনে বসে, মার হয়ে। পড়তাম কারণ যাতে সেই মানুষটি মনে শান্তি পান। সেই মানুষটিও জানতেন আমি না মেনে পড়ছি— কিছুদিন বাদে তিনি চলে গেলে (শক্ত মনের মানুষ ছিলেন— জানতেন শীঘ্রই চলে যেতে হবে এ পৃথিবী ছেড়ে, মানসিকভাবে প্রস্তুতও ছিলেন সে ব্যাপারে) তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম  আমি করব না তাও জানতেন, এবং নিজেই বলে গিয়েছিলেন যেন আমি নিজের দর্শনের বিরুদ্ধে কোনও কাজ না করি। দেহদানের অঙ্গীকারও করে গিয়েছিলেন— কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে দেহদান করা হয়।

ফলে আমি জানতাম এই পাঁচালি আমি কেন পড়ছি— কেন আমার পাঁচালি পড়ে কোনও পাপবোধ নেই— কেন কোনওদিন কোনও পাপবোধ থাকবে না। কেন আমি দ্বিচারী নই। জানতাম। জানি।

ধর্মকে অস্বীকার করতে গেলে, ধর্মীয় শোষণের ভিত নড়িয়ে দিতে গেলে, আগে ধর্মকে জানতে হবে অ্যাকাডেমিক্যালি। জানতে হবে কোন শক্তিতে ধর্ম মানুষকে আকর্ষণ করে, কোন বলে বলীয়ান হয়ে সে হয়ে ওঠে নিপীড়িত জনতার আফিম। তবেই ধর্মের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে প্রকৃত লড়াইয়ে দাঁড়ানোর শক্তি আসবে অন্তরে।

মিখায়েল শোলোকফ বেশিরভাগ মানুষের কাছে পরিচিত কোয়ার্টেট ফ্লোজ দ্য ডন নামক কালজয়ী উপন্যাসটির লেখক হিসেবেই। তার পরের ভাগ, অর্থাৎ ভার্জিন সয়েল আপটার্নড (মূল রাশ্যানে ‘পদনিয়েতোভা ত্ জেলিনা’, পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি থেকে শ্রী সত্য গুপ্তর করা ‘কুমারী মাটির ঘুম ভাঙল’ নামে যার চমৎকার বঙ্গানুবাদটি প্রকাশিত হয়) সম্পর্কে খুব বেশি মানুষ অবহিত নন সেভাবে, সম্ভবত। দু খণ্ডে প্রকাশিত এই বিশাল, মহৎ উপন্যাসে রুশ বিপ্লব সম্পর্কে যেভাবে তথ্যপূর্ণ বিশ্লেষণ আছে, সেরকম আর কোনও উপন্যাস দ্বিতীয়টি আছে কিনা জানি না পৃথিবীতে। যৌথখামার, সোশ্যালিজম এবং কম্যুনিজমের ধারণাগুলো চিরে চিরে বিশ্লেষণ করা হয়েছে সেখানে।

ভার্জিন সয়েলের দ্বিতীয় ভাগে আমরা দেখি শ্বেতরক্ষী বাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আলেকজান্ডার পোলোভৎসেভকে, গ্রেমিয়াচি লগ এলাকায় বর্ধিষ্ণু কৃষক ইয়াকভ লুকিচের বাড়িতে লেফটেন্যান্ট ভ্যাস্লাভ লাতিয়েভস্কির সাথে লুকিয়ে থাকাকালীন ধরা পড়েন যিনি। ধরা পড়ার পর, পোলোভৎসেভের প্রধান সম্পত্তির মধ্যে পাওয়া যায় লেনিনের সম্পূর্ণ রচনাবলী— প্রতিটি লাইন দাগিয়ে দাগিয়ে পড়া— প্রতিটি খণ্ডের। বিচারসভায় কৌতূহলী হয়ে তাঁকে কেউ প্রশ্ন করেন শ্বেতরক্ষী বাহিনীর একজন নেতা হয়েও চিরশত্রু লেনিনকে এভাবে খুঁটিয়ে পড়ার কারণ কী— পোলোভৎসেভের উত্তর ছিল কীসের প্রতিরোধ করা হচ্ছে তা সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান না থাকলে প্রতিবাদ অর্থহীন মূঢ়তায় পরিণত হয়, বা হুজুগে, তাই লেনিন অত্যন্ত খুঁটিয়ে পড়ার প্রয়োজন আছে বইকি একজন প্রকৃত অ্যান্টি-কম্যুনিস্টের!

আমিও তাই লক্ষীর পাঁচালি খুঁটিয়ে পড়ি, বাংলার ব্রতকথা বা রামকৃষ্ণ কথামৃতও। লোককে পড়াই। যারা ভক্তি ভরে পড়েন তাদের উদ্দেশে বিরুদ্ধবাণী দেওয়ার আগে তাঁদের সাথে মিশে তাঁদের বোঝবার চেষ্টা করি। কোনও পাপবোধ নেই আমার দ্বিচারিতা সংক্রান্ত, কোনওদিন থাকবেও না। নিজের রাজনৈতিক শুদ্ধতা (পলিটিক্যাল করেক্টনেস) বজায় রাখারও বিশেষ দায় দেখি না, বিশেষ করে জর্জ কার্লিন পড়ার পর থেকে তো আরওই— ‘পলিটিক্যাল কারেক্টনেস ইজ ফ্যাসিজম প্রিটেন্ডিং টু বি ম্যানার্স’।

তাই আমি হনুমান চালিশাও পড়েছি। খুব মন দিয়েই পড়েছি। যাঁরা পড়েন তাঁদের ব্যঙ্গবিদ্রূপ করার থেকে বেশি  আমার বোঝার দরকার ছিল তাঁরা কেন পড়েন। কেন ধর্ম নিপীড়িত জনতার আফিম, তা জানতে সাধারণ মানুষের নাড়ি বোঝার প্রয়োজন বলে মনে করেছি।

সেই সাধারণ মানুষ আমাকে বিভিন্ন তীর্থে টেনে নিয়ে গেছে বহুবার। দেখতে চাইতাম কেন আসে, কীসের আকর্ষণে, নাকি মোহে? ধর্মান্ধ— গালি হিসেবে ভালো, দিলে নিজেকে খানিক উচ্চস্তরের বুদ্ধিজীবী মনে হয়। ঠিক কথা। কিন্তু সেই গালি দেওয়ার যোগ্যতা আমরা কতটা অর্জন করতে পেরেছি আমি সেটাই খুঁজে বেড়াই। ধর্মের আফিঙের আচ্ছন্নতা কাটিয়ে তাদের বার করে আনতে আমরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়েছি কি? জীবন পণ করে? আত্মস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে? অনেক খুঁজেছি উত্তর— এবং স্থির বিশ্বাসে এসেছি যে আমরা (কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ বাদ দিয়ে) যে শুধু পারিনি তাই নয়, আমরা করিনি। নিজেদের কোলে টানা ঝোলের ভাগ একটুও দিতে চাইনি অন্য কাউকে— মেসায়া হয়ে পোডিয়াম থেকে বিরুদ্ধবাদ প্রচার করেছি শুধু— তাই আমরা ব্যর্থ। ওদের সাথে মিশে যেতে পারিনি, দূরত্ব বজায় রেখে জ্ঞানদান করেছি— ওরা পুঁছবে কেন ভদ্দরলোকদের দেওয়া সেই শুকনো, সস্তার, খাতায় কলমের জ্ঞান?

আমার মনে হত, এখনও হয়, ভারতবর্ষকে, অন্তত খানিকটা হলেও, চিনতে গেলে আর কিছু না হোক দুটো কাজ করা দরকার। প্রথমত, দূরপাল্লার ট্রেনে অসংরক্ষিত কামরায় ভ্রমণ— তাই আমি সেটা করে থাকি মাঝেমধ্যেই, স্বেচ্ছায়, আপন আনন্দে। ইস্টিশানের  মেঝেয় খবরের কাগজ পেতে শুয়ে ট্রেনের অপেক্ষা করা, এবং ট্রেন এলে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে (টয়লেটের যতটা কাছে পারা যায়) মেঝেয় বসে ভ্রমণ। অদ্ভুত অভিজ্ঞতা এক, মানুষ দেখার এই নেশা আমার কখনও পুরনো হয় না।

দ্বিতীয়ত, কুম্ভ মেলায় আসা। সেই কবে কালকূট পড়ে (এবং তার চলচিত্রায়ন দেখে— মুকেশের গলায় কভি কভি মেরে দিল মে সেই সিনেমাতেই প্রথম শুনি— সেই গানের উৎস খুঁজে খুঁজে আসল সিনেমাটা, অর্থাৎ ‘কভি কভি’ দেখি তার পরে) চেগে উঠেছিলাম— কিন্তু বিভিন্ন কারণে কখনও আসা হয়নি। ২০০৫ সালে চাকুরীসূত্রে যেখানে যোগ দিয়েছিলাম, ভারত সরকারের সেই গবেষণাগারটি প্রয়াগের (সঙ্গম) কাছেই। যোগ দেওয়ার পরের বছরই ২০০৬-এ ছিল অর্ধকুম্ভ, আর তার ছয় বছর বাদে ২০১৩-তে হয় পূর্ণকুম্ভ। দুটোতেই গেছি, প্রায় রোজই চলে যেতাম অকুস্থলে, পায়ে হেঁটে। ২০১৩-র পূর্ণকুম্ভের প্রধান স্নান মৌনী অমাবস্যার দিন ২৫ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছিল মনে পড়ে, ব্যারিকেড করে করে রাস্তা ঘুরিয়ে দেয় ওইদিন, সমস্ত শহরে সবরকম যান চলাচল বন্ধ থাকে, সাইকেলও মানা। আমার এক ঘনিষ্ঠ ফরাসি বান্ধবী ও গবেষণার সহকারিনী (রিসার্চ কোলাবোরেটর) ক্লেয়ার লেভেনিয়েন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিট্যুট অফ টেকনোলজি থেকে ডক্টরেট করে বর্তমানে যিনি ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া সান্তা বারবারার অধ্যাপিকা, তখন ছিলেন আমাদের গবেষণাগারে ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট হিসেবে, আমি আর ক্লেয়ার গিয়েছিলাম মৌনী অমাবস্যার স্নানের দিন। একেবারে চানের পয়েন্ট পর্যন্ত। দু কোটিরও কিছু বেশি মানুষ এসেছিলেন সেদিন, আটান্ন বর্গমাইল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মেলা প্রাঙ্গনের বাইশটি স্নানঘাটে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে স্মরণাতীত কাল থেকে পৃথিবীর সবথেকে বড় (এক দিনে) জনসমাগম হয়েছিল ২০১৩-র মৌনী অমাবস্যার দিন প্রয়াগে। সেদিনের কুম্ভ দর্শনের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার, এ জীবনে তা ভোলার নয়— প্রতি মুহূর্তে মার্ক টোয়েন মনে পড়ছিল। দিকপাল লেখক মার্ক টোয়েন ১৮৯৫ সালে কুম্ভ মেলা দেখতে আসেন, মানুষ দেখার অভিপ্রায়েই বোধকরি, এবং মানুষকে বোঝারও। হার্টফোর্ড, কনেক্টিকাটের অ্যামেরিক্যান পাবলিশিং কোম্পানি থেকে ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত হয় ওঁর বিখ্যাত গ্রন্থ (বর্তমানে ডোভার পাবলিশারের সুলভ সংস্করণ পাওয়া যায়) ‘ফলোয়িং দ্য ইকুয়েটর : আ জার্নি এরাউন্ড দ্য  ওয়ার্ল্ড’। মার্ক টোয়েন সেখানে লেখেন :

It is wonderful, the power of a faith like that, that can make multitudes upon multitudes of the old and weak and the young and frail enter without hesitation or complaint upon such incredible journeys and endure the resultant miseries without repining. It is done in love, or it is done in fear; I do not know which it is. No matter what the impulse is, the act born of it is beyond imagination marvelous to our kind of people, the cold whites.

এবার, অর্থাৎ ২০১৯-এ আরেকটি অর্ধকুম্ভ প্রয়াগে। চাকুরীসূত্রে আমি কলকাতায় এখন, ফলে গিয়ে উঠতে পারিনি এখনও অবধি। কদিন আগে, ইলাহাবাদ থেকে কলকাতা আসার সময়ে, আমার সহকারী গবেষক শ্রী সুশোভন মাইতি অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং কিছু ফটো তুলে এনেছে এবারের অর্ধকুম্ভের মকর সংক্রান্তি আর পৌষ পূর্ণিমার স্নানের। সেইসব ছবি তন্নিষ্ঠ চিত্তে দেখতে দেখতে অতীতে ফিরে যাই— ২০১৩-র পূর্ণকুম্ভের একটি বিশেষ দিনের কথা মনে পড়ে যায়।

তারিখটা স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে এখনও, ১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৩। বসন্ত-পঞ্চমীর স্নানের দিন। কুম্ভের দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এই বসন্ত-পঞ্চমীর স্নান এবং দিনের হিসেবে তৃতীয় ‘শাহী স্নান’। ২০১৩-র সেই দিনে ষাট লক্ষ মানুষ ‘পুণ্যস্নান’ করেছিলেন, ভোর চারটে পনেরো থেকে বিকেল পৌনে পাঁচটা এই সময়সীমার মধ্যে। সেদিন  মেলা প্রাঙ্গনে উপস্থিত ছিলেন পৌনে দু’কোটি দর্শনার্থী ও পুণ্যসন্ধানী।

কুম্ভের গুরুত্বপূর্ণ স্নানের দিনগুলিকে শাহী স্নান বলে— গুরুত্বের এবং জনসমাগমের দিক থেকে প্রধানতম (দিনের হিসেবে দ্বিতীয়) শাহী স্নান হয় মৌনী অমাবস্যার দিনে— এই সেই স্নান যেদিনের দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যাবে কালকূটের বইয়ে। স্বাধীনতার পরে প্রথম মহাকুম্ভ হয় ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে, মেলায় আসেন প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ পুণ্যার্থী। সেই সময়ের গার্ডিয়ান পত্রিকা এবং টাইম ম্যাগাজিনের আর্কাইভ্যাল কপির রিপোর্টিং পড়ে যা জেনেছি, ১৯৫৪-র মেলার মৌনী অমাবস্যার স্নানের দিনে ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় পদদলিত হয়ে মারা যান প্রায় আটশো মানুষ, দুশোরও বেশি মানুষের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি পরে, আহত হন দু হাজারেরও বেশি মানুষ। মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনার বর্ণনা মিলবে ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’তে, কুম্ভমেলার প্রায় পরপরই (১৯৫৪ সালে বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত, দিলীপ রায়ের সম্পাদনায় অভিনেতৃ সংঘের ব্যানারে ১৯৮২ সালে চলচ্চিত্রায়িত) যে উপন্যাস লেখেন কালকূট।

সে যাই হোক, সেবার বসন্ত পঞ্চমীর সময়ে কন্যার বয়েস ছিল সোয়া চার বছর। তিনি কখনও কোলে চড়েননি আমার, দেহাতিদের মতো সর্বদাই কাঁধে কাঁধেই ঘুরতেন, এখনও ঘোরেন। মেয়ে দেখল রাস্তায় লোকের ঢল নেমেছে— ‘কোথায় যাচ্ছে বাবা?’ বললুম, চান করতে। বলল— ‘আমাকে নিয়ে চলো।’ কি খেয়াল হল, বললাম ‘চল তবে’, বেরিয়ে পড়লাম। কিছু ছিল না সাথে— পার্স, মোবাইল কিছু না। জিন্স হাওয়াই চটি, গায়ে পরেছিলাম একটা ফুলহাতা তসরের শার্ট, তার ওপরে একটা হাতকাটা পাতলা জ্যাকেট তসরেরই। মেয়ের গায়ে মোটামুটি শীতবস্ত্র। জনতার স্রোত এ মিশে গেলাম দুজনে। মেয়ে কাঁধে প্রায় আট কিলোমিটার হেঁটে মেলায় পৌঁছনো গেল— বেচারার মনে খুব দুঃখ, কিছুই কিনতে পারছে না, পয়সা নেই তো সাথে— পয়সার ব্যাগই নেই!

ফেরার সময় গোল বাধলো, কারণ ঠান্ডা নামছে। উত্তর ভারতের বাঘাটে শীত, তার ওপরে পাশে পাশে বয়ে চলেছে গঙ্গা— একেবারে ভারতচন্দ্রের বাঘের বিক্রম সম মাঘের হিমানী। গায়ের জ্যাকেট খুলে কয়েক ফেরতা দিয়ে মেয়েকে সেটা পরালাম— ভাবলাম এবারে নিশ্চিন্ত। কিন্তু কিলোমিটার দুয়েক হাঁটার পরে বুঝলাম, হচ্ছে না, ঠান্ডা ক্রমশ বেড়েই চলেছে— আর কাঁধে বসে আছে— জমি থেকে অনেকটা  উচ্চতায় ফলত— গঙ্গার তীব্র হাওয়াটা সোজা মুখে আছড়ে পড়ছে বেচারার।

নাবালাম। জামাটা খুললাম আমার। সিল্কের জামায় কিছু ঠান্ডা আটকায়— সুতির তুলনায় অন্তত। ওটা দিয়ে পোঁটলা করে বাঁধলাম মেয়েকে। মানে প্রকৃত প্রস্তাবেই পোঁটলা বাঁধলাম— তাতে দুটো সুবিধা হল— প্রথমত ফ্যাব্রিকটা দো-ফেরতা হল, ঠান্ডা বেশি আটকাবে, দ্বিতীয়ত, পোঁটলাটা এবারে আমি ঝোলাব্যাগ এর মতো করে কাঁধে নিয়ে নিলাম (যাতে সেটা করা যায় সেভাবেই বেঁধেছিলাম) ফলে হাওয়া কম লাগবে, আর আমার শরীরে লেগে থাকবে বলে সরাসরি আমার বডি হিট পাবে। ছানা আমার ক্যাঙ্গারুর পেটের থলের মধ্যে বসে থাকার মতো করে ঝোলার মধ্যে থেকে মুখ বাড়িয়ে জুলজুল করে চেয়ে রইল— আমাদের পথ চলা শুরু হল।

সম্পূর্ণ খালি গা, জিন্স হাঁটু অবধি গোটানো, মাঝ রাস্তায় একটা পায়ের হাওয়াই চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গিয়েছিল বলে বিরক্তিতে লাথি মেরে চটি দুটো ফেলে দিয়েছি জলকাদায়— ফলে খালি পা— হাঁটু অবধি ঢেকে গেছে গঙ্গার পাড়ের কাদায়। গঙ্গার ধারে খোলা শ্মশান— বহু মৃতদেহ দাহ হচ্ছে (শীতে বয়স্কদের মৃত্যুর হার বেশি উত্তর ভারতে)— নিরন্তর দাহকার্যের সেই ছাই চলার পথে আমার সারা শরীর ঢেকে দিয়ে যেতে লাগল ক্রমশ। ছয় ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতায় পঁচানব্বই কেজি ওজন, ঝাঁকড়া চুল ছিল তখন পিঠ অবধি প্রায়— পুরোটাই ঢেকে গেল শ্মশ্মানের ছাইয়ে— মহাকায় ডোমের মতো, চণ্ডালের মতো, কালান্তক যমের মতোই হয়তো বা নাকি আদিম মহিষাসুর— আমি কন্যার পোঁটলা কাঁধে হেঁটে চললাম।

অনেক রাস্তা পেরিয়ে যখন আমাদের সংস্থার প্রধান প্রবেশদ্বারে এসে পৌঁছলাম, তখনই বাধল ঘোর বিপদ! সিকিউরিটির কর্তারা আমাকে কিছুতেই ঢুকতে দেবেন না! একদম চিনতে পারেননি কেউ ওই অবস্থায়— আমি তখন একটু গরম জল আর একটা সিগারেটের জন্য হেদিয়ে মরছি— বাধা পেয়ে আক্ষরিক অর্থেই একেবারে মারমুখী হয়ে উঠলাম— চণ্ডাল চেহারায় ওই রুদ্ররূপ দেখে আমাদেরই সিকিউরিটি অফিসাররা শেষে আমারই পেটে বন্দুক ঠেকাল! দোষ নেই বেচারাদের, ‘দাস সাহাব’কে ওই অর্ধোলঙ্গ মূর্তিতে আর চাঁড়াল মেজাজে দেখার কথা তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। শেষে গোলমালে কাঁধের পোঁটলার মধ্যে থেকে আরামের ঘুম ভেঙে কন্যা মুখ বার করল— ‘আঙ্কল, ম্যায় বোবো হুঁ— উও তো বাপ হ্যায় না মেরা, পেহচানতে নেহি ক্যা?’

তারপর দুঃখপ্রকাশ আর সেলামের ছড়াছড়ি।

এই হল গিয়ে আসল বেত্যান্ত!

সুশোভন, এবং বন্ধুবর ব্রতীন (চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শ্রী ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য্য) ছ বছরের পুরনো সেই স্মৃতি আবারও উসকে দিল….

 

ছবি : সুশোভন মাইতি