Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দূর নয় বেশি দূর ওই সাজানো সাজানো বকুল বনের ধারে

কললুকুডিপাট্টি বার্ড স্যানচুয়ারি

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

শীতটা বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে এবছর। দক্ষিণ ভারতের এ অঞ্চলটায় নভেম্বরের শুরুতে এতটা ঠান্ডা সচরাচর দেখা যায় না। মাদুরাই করাইকুডি হাইওয়েতে স্পিডোমিটারের কাঁটা নব্বইয়ের ঘর ছুঁই ছুঁই, হাতের মুঠোফোনে গুগল ম্যাপ বলছে ভেটটানগুডি পৌঁছতে আর মাত্র কিলোমিটার দুয়েক। সহসা কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে স্পষ্ট হয় আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দেওয়া নুয়ে পড়া চেহারাটা। শীতালি সকালে আলো ফোটেনি তখনও ঠিক করে, ধোঁয়া ওঠা পাড়াগেঁয়ে মাটির ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে নবতিপর বৃদ্ধ বললেন, সাবধানে যাবেন বাবুরা, ওরা কিন্তু এখনও বেশ ছোট, উড়তে শেখেনি, ডানা গজায়নি এখনও, বেশি আওয়াজ যেন না হয়। পাশ থেকে একগাল হেসে আমার কলিগ কাম গাইড তামিল যুবক মাললেশ বলল, “ওয়েলকাম টু কললুকুডিপাট্টি বার্ড স্যানচুয়ারি”। মনে পড়ে যায় তপ্ত এপ্রিলের লালগড়ের মাটির সেই অশিক্ষিত গাঁওবুড়োর কথা, “জঙ্গলে বাঘ থাকলে সবার মঙ্গল হইবেক, আবার নতুন করে সেজে উইঠবেক আমাদের এ বাপ পিতিমোর জঙ্গল।”

দশটা পাঁচটার আইটি সেক্টরের চাপ যতই থাকুক না কেন বাইনোকুলারটা এখনও আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। এ ব্যাঙ্গালোর শহরে এসেছি মাত্র মাস ছয়েক হল, আমার পাখির বাতিক অজানা নয় আমার রুমমেট তথা কলিগ তামিল যুবক মাললেশের, কালীপুজোর রাতে মুচকি হেসে বলল, “কললুকুডিপাট্টি-র নাম তোমার শোনার কথা নয়, তামিলনাডুর সবচেয়ে প্রাচীন বার্ড স্যানচুয়ারি ঘেঁষে আমার গ্রাম, দেওয়ালির পরদিন শনিবার, এখান থেকে মাত্র শ চারেক কিলোমিটার, সারারাত গাড়ি চালালে আরামে ভোর ভোর পৌঁছে যাব।”

আমার মনে যে সংশয় ছিল না তা নয়, একাধিকবার বলেছি যে ভারতবর্ষের মতো দেশে দেওয়ালিতে যেখানে নির্বিচারে শব্দবাজি ও আতশবাজি পোড়ানো হয় সেখানে এই সময়টা পাখিদের পক্ষে সবচেয়ে ভয়ংকর। অতএব পাখি দেখার দুরাশা না করাই ভালো। শুনে উত্তর দেয় না কিছু, মুচকি হাসে শুধু, “চলই না, পাখি দেখাবার দায়িত্ব আমার।” পাখি না হোক, নতুন জায়গা দর্শনের আকর্ষণই বা কম কিসে, অতএব হৈ হৈ করে জুম কার, পায়ের তলায় সর্ষে, ঠিকানা কললুকুডিপাট্টি, জিলা শিবগঙ্গা, তামিলনাডু।

আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না দেখে নিজেই বলে ওঠে মাললেশ, “অবাক হওয়ার কিছু নেই, এটাই এ গাঁয়ের রীতি, পর্যটকদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার “দায়িত্ব” প্রতিদিন গ্রামের এক একটি ঘরের, সাথে ওই “স্ট্যাটুটারি ওয়ার্নিং”, আর যাই হোক পাখিদের বিরক্ত করা চলবে না।”

“ব্যাপারটার সূত্রপাত বছর ত্রিশেক আগে, কোনও এক দেওয়ালির রাতের পরে হঠাৎই গ্রামের মানুষ লক্ষ্য করে আশেপাশের গাছগাছালির সেই চিরাচরিত পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না, পরের কিছুদিন সকালে পাখির ছানাদের মৃত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তারপর, গ্রাম পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্ত, আর বাকিটা ইতিহাস। গত তিরিশ বছরে এখানে দেওয়ালিতে কোনও প্রকার বাজি ফাটেনি, আর আগামী তিনশো বছরেও ফাটবে না।”

“তা, গ্রামের অল্পবয়সী ছেলেছোকরারা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিল এই সিদ্ধান্ত? মানে বছরকার এই একটা দিনেই একটু আমোদ প্রমোদ…..”

আমায় মাঝপথেই থামিয়ে দিল মাললেশ,

“আচ্ছা বেশ তো, ওই আমাদের হাই সেকেন্ডারি স্কুল, ছেলেরা স্কুলে যাচ্ছে, বিশ্বাস না হয় একজনকে পাকড়াও করে কথা বলে দেখ না….”

একরাশ বিস্ময় নিয়ে যে খুদেটাকে পাকড়াও করি খুব বেশি হলে সেটার বয়স হবে বছর দশেক… একজন প্রাপ্তবয়স্ক কনজারভেশনিস্টের মত সে বললে

“ও মা, আমাদের ঘরে অতিথি এলে তাদের কি আমরা তাড়িয়ে দেই?! আজ আমাদের গাঁয়ের এত নাম ডাক, কত দূর থেকে কত দেশি বিদেশি মানুষ এখানে আসেন ওই পাখিদের দেখতে… না গো বাবু, শুধু দেওয়ালিতে কেন, বিয়ে সাদি থেকে শুরু করে কোনও অনুষ্ঠানেই এখানে কোনওরকম বাদ্যযন্ত্র বাজে না, পাখির ছানাদের কষ্ট হয় যে…

আর ওই যে আসার পথে বড় বড় দুটো জলের ট্যাঙ্ক দেখলেন, ওটা গ্রামের মানুষের জন্য নয়, আমাদের শীতকালীন অতিথিদের দীর্ঘ পথশ্রমের পরে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য, এখন আমরা গর্বের সাথে বলতে পারি প্রতি বছর প্রায় তিরিশ হাজার অতিথির নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের ব্যবস্থা হয় এখানে, এই গ্রামবাসীদের সৌজন্যে। দেওয়ালিতে গোটা গ্রামে মিষ্টি বিতরণ করা হয়, ফরেস্টের কর্মীদের সাথে একসঙ্গে উৎসবে মাতেন মানুষ, কিন্তু কোনওরকম শব্দের ব্যবহার না করে।

আপনারা তো শহরের পড়ালেখা জানা মানুষ, দু কলম লিখুন না আমাদের নিয়ে, এই গ্রামখানি নিয়ে, যেখানে পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে গিয়ে গত তিরিশ বছর ধরে দিওয়ালি পালন করা হয় না।”

আবেগরুদ্ধ গলায় কথাগুলো বলছিলেন স্থানীয় ফরেস্ট কনজারভেটর, তার চোখগুলো চকচক করছিল গর্বে আনন্দে।

মনে একরাশ তৃপ্তি নিয়ে ফেরত আসার যাত্রা শুরু করি কললুকুডিপাট্টি থেকে, সন্ধ্যে প্রায় হব হব, নানান জাতের হাজার হাজার পাখির কলতানে উজ্জ্বল মুখগুলিকে বিদায় জানিয়ে এক্সিলারেটরে চাপ দেয় মাললেশ, সিটটাকে সামান্য হেলিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে চোখ বুজি, শ্যামল মিত্র গাইছেন তখন… দূর নয় বেশি দূর ওই সাজানো সাজানো বকুল বনের ধারে……