লোপামুদ্রা বল সরকার
আগুনের পরশমণি
কম্পমান একটা মোমবাতির শিখার উপর ঘোরাফেরা করছে কচি একটা আঙুল। প্রথমে দ্রুত —- পরে ধীরে ধীরে—– তাপ সইয়ে সইয়ে।
টেবিলের উপর পড়ার বই খোলা রেখে এক কিশোরী এভাবেই শিখে নিচ্ছে ঠিক কতটুকু সময় আগুনের উপর হাত রাখলে দহন এড়িয়ে যাওয়া যায়, বুঝে নিচ্ছে ঠিক কতটুকু দহন সে সয়ে যেতে পারে। ঠিক কখন তাকে আঙুল সরিয়ে নিতে হবে। কত দ্রুত আগুনে পরিস্থিতি থেকে সরে যেতে হবে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। এসব কি আর শান্ত বৈদ্যুতিন আলোয় শেখা হয়?
আগুনের সামনে বসে শিখতে হয়। তার জন্য অন্ধকার লাগে। আলো-না-জ্বলা সন্ধে —– লোডশেডিং-এর সন্ধে। আঁধার এল বলে, তাই তো ঘরে উঠল আলো জ্বলে। আমার কিশোরীবেলাটা এরকমই লোডশেডিং-এর সন্ধে দিয়ে ভরা। সত্তরের দশক যদি আগুনে বিপ্লবের দশক হয়, তো আশির দশক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের দীর্ঘশ্বাসের দশক, টিমটিমে কেরোসিন ল্যাম্পের বা মোমবাতির ম্লান আলোয় ম্রিয়মান এক দশক, লোডশেডিং-এর অন্ধকারে ডুবে থাকা ক্লান্ত সন্ধের দশক। বিপ্লবী-চেতনা ভুলে সংসদীয় পথে আসা বামপন্থী সরকারের উপর আস্থাস্থাপনের দশক। আর হাজার চুরাশির মায়েদের সন্তানহারা শোক দূরে সরিয়ে রেখে বেঁচে থাকার যুদ্ধ জারি রাখার দশক। এমনই এক অন্ধকার সন্ধ্যায় ফ্যাক্টরি থেকে বাড়ি ফিরে বাবা বলে ওঠেন, “লিন্টুর মায়ের মুখের দিকে তাকাতে ভয় লাগে, পাছে ওই বিষাদ-ভারাক্রান্ত চোখে চোখ পড়ে যায়”।সত্তরের চাপ নিতে না পেরে লিন্টুকাকুর সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়। তারপর থেকে পঙ্গু। আশির দশক স্বপ্নের, স্বপ্নভঙ্গেরও। আশির দশক দেখে কীভাবে সর্বহারার পার্টি ধীরে ধীরে ক্ষমতার মুখ হয়ে ওঠে। আশির দশক মধ্যবিত্তের টানাপোড়েনের দশক। “সিম্পল লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং”-এর দর্শন আঁকড়ে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলার দশক। এ দশক আশা ও নিরাশা , আলোও অন্ধকার, আদর্শ ও আদর্শচ্যুতির মধ্যে দুলতে থাকা এক দশক—— অন্ধকারে ওই মোমবাতির শিখার মত, যার সাথে আমার আগুন নিয়ে খেলার সূত্রপাত , যে আলোয় আমার অন্ধকার চেনার পাঠ শুরু হয়।
অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার
এক অন্ধকার সন্ধ্যায় খবর এল পিন্টুকাকু আর নেই।সেদিন বাবা-মায়ের অন্ধকার মুখের দিকে তাকাতে ভয় পেয়েছি…. তাদের বড় আদরের মানুষ। এঁটেল মাটির মত কালো এক রূপবান পুরুষ…. যার চোখের দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যেত না— সে নাকি ড্রাগ-অ্যাডিক্ট হয়ে গিয়েছিল। পিন্টু কাকু নকশাল ছিল, পিন্টু কাকু কবিতা লিখত, পিন্টুকাকুর একটা ভেঙে যাওয়া প্রেম ছিল। মৃত্যুর জন্য আর ক’টা কারণ লাগে। তখন আমি মৃত্যুর অন্ধকার তেমন চিনি না। আমার কাছে পিন্টুকাকু মানে “বনলতা সেন” কবিতা। নিজে শোনাত, আমার কাছ থেকেও শুনতে চাইত। কোলে ক’রে খাটের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলত,“মনে কর, এটা স্টেজ। বলত ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি’।” হাজার বছরের হিসেবই শেখা হয়নি তখন। “কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়” সে কথা জানতে তখনও ঢের দেরি। তবু মাত্র চার বছর বয়সেই আমার কণ্ঠস্থ হয়ে যায় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। শুধু একজনকে শোনাবার জন্যই—- পিন্টুকাকু, ভোররাতের আবছা অন্ধকারের মত কালো, এক অন্ধকার মানুষ।
আমি অন্ধকার-এর যাত্রী
লোডশেডিং-এর সন্ধেরা ভারি ভালো। কারণ তখন মায়েদের পড়াতে ভালো লাগে না। তাই সেইসব সন্ধ্যায় কবিতা লেখার মত অকাজ করা যায়। বাংলা খাতার শেষ পাতা ছিঁড়ে প্রথম কবিতা লেখা। লিখে ভারি আনন্দ, উৎসাহের সাথে মাকে দেখাই। স্বপ্ন দেখি স্কুল ম্যাগাজিনের পাতায় ছাপার অক্ষরে নিজের নাম।পরদিনই নাচতে নাচতে বড়দির কাছে জমা।দিতে যাওয়া। স্কুলের প্রতিষ্ঠাত্রীর উদ্দেশ্যে লেখা স্বরচিত বারো লাইন। কাগজটা হাতে নিয়ে বড়দির শীতল প্রশ্ন —– “কোথা থেকে টুকেছো”। এমন প্রশ্ন শুনে আমি তো হাঁ এবং ভ্যাঁ। স্বরচিত যে, তা প্রমাণ করার উপায় তো জানা নেই। এরকম যে করা যায় তাও তো জানা নেই চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রীটির। “প্ল্যাগিয়ারিজম” শব্দটা চিনতে তার আরও অনেক পথ হাঁটা বাকি তখনও। কিন্তু গেরুয়া-বসনা শিক্ষিকার মুখের ওই একটি প্রশ্ন দশম-বর্ষীয়া অর্বাচীন মেয়েটিকে আরও এক গহন অন্ধকার চিনিয়ে দেয় —– যার নাম “মিথ্যা” , যারনাম “চুরি” , যার নাম “অপরাধ”।
একইসাথে তৈরি হয়ে যায় মনের মধ্যে ঘৃণা জমিয়ে রাখার এক অন্ধকার কোণ। গেরুয়া রঙের প্রতি ঘৃণা , শিক্ষকতা পেশার প্রতি ঘৃণা, চলতি মতে যা কিছু ভালো, সেইসব কিছুর প্রতি ঘৃণা। এরপর দীর্ঘদিন সে কিছুই লেখে না। লিখলেও ডাইরির পাতার অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে রাখে সেইসব লেখারা। আলোয় ফিরতে তাদের অনেক সময় লেগে যায়। তবে সে আলোর গল্প তো “হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনোখানে”। আজ শুধু অন্ধকারের গল্প।
সখী, আঁধারে একেলা ঘরে, মন মানে না …
লোডশেডিংয়ের সন্ধ্যায় আমার ইস্কুল-ফেরত ক্লান্ত মা একরত্তি বোনকে জড়িয়ে ঘুম দিতেন। বাবা তো চাকরিসূত্রে প্রবাসী। আমার মতন সুখী কে আছে ….. দেদার ফাঁকি মারার সুযোগ, পড়াটাকে সিলেবাসের বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলার সুযোগ, তার চেয়েও বড় সুযোগ ভাবনার পাখা মেলার। সামনে খোলা বই, চোখ কিন্তু অন্ধকার রাস্তায় ….অচেনা আনাগোনায় পরিচিত অবয়ব খোঁজা। আর মন, ততোধিক অন্ধকার আনাচ-কানাচ হাতড়ে বেড়ায়। মোমবাতির শিখার সাথে আগুনে খেলা খেলতে থাকে কিশোরী-আঙুল। খেলতে খেলতে নিবিয়ে ফেলি মোমবাতি। কখনও সলতে উঁচু করে দিয়ে ল্যাম্পের কাঁচ কালো করে ফেলি ভুষোকালিতে যাতে আর পড়তে না হয়। অন্ধকারে জ্বলতে থাকে বয়ঃসন্ধির শরীর। “শরীর, শরীর ! তোমার মন নেই কুসুম”? মনের খবর কে রাখে? না আমি নিজে, না আমার অভিভাবকেরা। “মন বলে, আমি মনের কথা জানি না” ……… মনের খবর রাখে শুধু অন্ধকার।
শরীর-মনের এইসব অন্ধকার হাতড়ানো দিনকালে , পড়াশুনোটা গোল্লায় যায়। পরীক্ষার নম্বর বাড়িতে বলি না, লুকোতে শিখি, মিথ্যে বলতে শিখি।অন্ধকারে পদার্পন তো বড় হওয়ার অঙ্গ। পাক্ষিক “দেশ” পত্রিকাটি আসা মাত্র হামলে পড়ি মাঝের পাতার “অরণ্যদেব” এ….. আমার যৌনচেতনার হাতেখড়ি। “দেশ” পত্রিকায় বুদ্ধদেব গুহ-র “মাধুকরী” বেরোতে শুরু করলে মা পত্রিকাটি নেওয়া বন্ধ করে দেন। আর আমি মায়ের স্কুল-লাইব্রেরী থেকে আনা বইয়ের পাতা উল্টে পড়ে ফেলি বিমল করের “আত্মজা”।
এই এক অদ্ভুত মানুষ, আমার মা।
একদিকের দরজা বন্ধ করেন তো তিনদিকের জানলা খুলে দেন। এই একজন মানুষের মধ্যে একইসাথে কত যে আলো আর কত যে অন্ধকার দেখেছি তা বলার নয়।সারাটা জীবন ধরেই “ছিল আমার মা অচেনা”। কোলে নিতেও সময় লাগত না, কোল থেকে দূরে সরিয়ে দিতেও সময় লাগত না। যেন একই অঙ্গে আসল ও কল্পিত “ভুবনেশ্বরী”।
এ আলোতে, এ আঁধারে
বুধ সন্ধ্যায় গানের ক্লাস। যথারীতি লোডশেডিং। একঘর ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে আমি আর আমার প্রিয় বান্ধবী। মধ্যিখানে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে গল্পে মশগুল। এমনই নিবিষ্ট যে কখন মাস্টারমশাই ক্লাসে ঢুকে এসেছেন টের পাইনি। তিনি আমাদের ভঙ্গী দেখে বলতে বলতে ঢুকছেন, “দুজনে মুখোমুখি/গভীর দুখে দুখী” নাকি “গভীর সুখে সুখী”? সবাই হাসে, আমরা লজ্জা পাই।তখনও এ লাইন আমার অচেনা। পরে যতবার শুনেছি, বা গীতবিতানের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে চোখে পড়েছে, ততবার এই সন্ধে আর এই মানুষটিকে মনে পড়েছে। এই একজন মানুষ যিনি শুধু গান শেখাননি, চিনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথকেও। তাঁর কাছে শেখা প্রতিটি গানকে হৃদমন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন, যেমন করে গর্ভগৃহে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিটা শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন কীভাবে ‘ফ’ বলতে হয়, কীভাবে ‘ড়’ বা “ঢ়” বলতে হয়। কীভাবে উচ্চারণ করলে স্বরসন্ধি এড়িয়ে গাইতে হয় …. “নূতন আলোয় নূতন অন্ধকারে”।
এইসব নূতন আলোর ছোঁয়া পেতে পেতে সন্ধান পেয়ে যাই মানব-মনের গভীরের নূতন অন্ধকারটিরও। চিৎকৃত “মিটু” র প্রতি সমর্থন রেখেও বলতে দ্বিধা নেই, জীবনে সমস্ত অবাঞ্ছিত স্পর্শই একইরকম আবিল লাগেনি।মানবমনের তলানি অন্ধকারের প্রতি কিশোরী মনের কৌতূহলটিও পরম সত্য। অর্বাচীন শৈশবের অন্ধকার গুহাপথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বড় হয়ে যাওয়া এক আলোকিত বাঁক– “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ”।
অন্ধকার-এ বীণা বাজে
আমার আর তার মাঝখানেও একটা লোডশেডিং এর সন্ধে ছিল। ছিল একটা হারমোনিয়াম আর একটা গান। গানের দিদিমণিকে ঘিরে একটা বৃত্ত , তার মাঝখানে একটা কম্পমান আলোক-শিখা । সেই শিখার সাথেই কম্পিত এক কিশোরী আকাঙ্ক্ষা । “সে গান কবে গভীর রবে বাজিবে হিয়া মাঝে”। সে গান সুরে বাজেনি তেমন করে …… কিছুটা বেসুর, কিছুটা বেতাল। জীবন ও কেটে গেছে দ্বন্দ্বে ছন্দে। প্রেম তো স্বপ্নেরই মতন …… “জাগার বেলা” এসেই যায় …… চোখ খুলে তাকালে দেখতে পাই হৃদয়সভা জুড়ে নানা সাজে নানান অতিথি।”নয়ন দুটি মেলিলে যবে পরান হবে খুশি/যে পথ দিয়া চলিয়া যাব, সবারে যাব তুষি।”এইখানে এসে আমার গান শেষ। বাকিটুকু তার গাইবার কথা ছিল। সে গান শেষ করেনি, সে গান “রুদ্ধসঙ্গীত”।
এই পর্বে এসে অন্ধকার পরম আশ্রয় হয়ে ওঠে।
অন্ধকার আড়াল দেয়, কান্না-হাসি
সুখ-দুঃখ ধীরে ধীরে সব সহানুভূতির আকাঙ্খা থেকে সরে এসে ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে। দিনের শেষের একান্ত নিজস্ব অন্ধকারটির জন্য অপেক্ষা তৈরি হয়। এক মহিমাময় অন্ধকারের সাথে পরিচয় হয়। যে অন্ধকারে রবিঠাকুরের রাজা এসে পা রাখেন রাণী সুদর্শনার ঘরে, যে অন্ধকারে বীণা বাজে, যে অন্ধকারে “অরূপরতন” খুঁজে পাওয়া যায়।
আমার আঁধার ভালো
“আলোয় যারে মলিন মুখে মৌন দেখি
আঁধার হলে আঁখিতে তার দীপ্তি একি!”
অন্ধকারেই নিজের কাছে নিজে ধরা পড়ে যাই। স্পষ্ট হয়ে যায় মনের অন্ধকার তলানি, ঝুলকালি-মাখা ঘুপচি কোণ। অন্ধকার দেখিয়ে দেয় আমার নিজস্ব ইদ– আলোয় যাকে আমি ঢেকে রাখি সবার কাছ থেকে, লুকিয়ে রাখি নিজের কাছ থেকেও। আলোয় অবদমিত প্রবৃত্তি অন্ধকারে তেজস্ক্রিয় বস্তুর মত বিকিরিত হতে থাকে। আমি বুঝে নিই রিপুতাড়িত এই জীবন আদতেই এক সুড়ঙ্গ-যাত্রা। গুহামুখের আলোক-উৎসটুকুই নির্দিষ্ট করে দেয় আমার গন্তব্য। আসলে আলো আমি চিনিই না, আলোয় চোখ রাখবো বলেই এক জীবন হেঁটে আসা – আদতে “আমি অন্ধকারের যাত্রী”।
এভাবেই এক জীবন আঁধার ঝাঁপিয়ে আসে বুকের ভিতর– “যে আঁধার আলোর অধিক”।