হারুণ রশিদ
মহাবিশ্বের মহা বাগান
২০১৭ খৃষ্টাব্দ
একুশ শতকের শুরুতে একজন লিখেছে— “এমনকি সাড়ে পাঁচশো বছর আগেও পৃথিবীর মানুষের বেশ কয়েকটা ধারণার মধ্যে ছিল সমুদ্র অসীম, পৃথিবী সমতল চ্যাপটা মতন জায়গা, সূর্য তার চারপাশে ঘোরে ইত্যাদি। একটি ছোট নৌকায় চড়েও যে সারা দুনিয়া ঘুরে আসা যায় সেটা অধিকাংশ মানুষের কল্পনারও অতীত ছিল।”
২৫৬৭ খৃষ্টাব্দ
আরও সাড়ে পাঁচশো বছর পর হয়তো কেউ লিখবে, “২১-২২ শতকের মানুষের ধারণা ছিল– মহাবিশ্ব অসীম, আলোর চেয়ে বেশী গতিতে ছোটা অসম্ভব, মহাবিশ্বের নীহারিকা সংখ্যা মাত্র ২ ট্রিলিয়ন, তার কোনওটিতে মানুষের পৌঁছানো অসম্ভব আলোর গতিতে ছুটলেও। মহাবিশ্বে যে আরও কয়েকশো ট্রিলিয়ন নীহারিকা আছে এবং একটা পকেট ডিভাইস দিয়ে তার সবগুলোর জীবন্ত বর্তমানের ছবি হাতের তালুতে এনে দেখা সম্ভব সেটা তাদের কল্পনাতেও ছিল না।”
প্রযুক্তির বিবর্তন এবং অগ্রগতি আমাদের কল্পনার চেয়েও অনেক বেশী চমকপ্রদ।
মহাবিশ্ব কত বড়?
প্রশ্নটা ছেলেবেলা থেকেই যেরকম ভাবাত, এখনও ভাবায়। পুরনো উত্তরটিই পাই এখনও। বর্তমান প্রযুক্তির চোখে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের আকার 8.8×1023 sqkm। কিন্তু অংক দিয়ে এটা বোঝা মুশকিল। উদাহরণ দিয়ে বুঝতে হলে আলোর গতির কাছে যেতে হবে। বিশ্বের আয়তন বোঝার আগে আমাদের নক্ষত্রপাড়া ‘ছায়াপথ’ নীহারিকার আয়তন বোঝার চেষ্টা করি। ছায়াপথ নীহারিকার এপার ওপার করতে একটা টর্চের আলোর দেড় থেকে দুই লাখ বছরের মতো লাগে। গোটা মানব জাতির বয়স এর চেয়ে ঢের কম। আমাদের নক্ষত্রপাড়ায় আনুমানিক ১০-৪০ হাজার কোটি নক্ষত্রের বসবাস। সুতরাং এই পাড়াকে তেমন ছোট বলা যাবে না। কিন্তু অন্য পাড়ার লোকেরা বলে আমাদের পাড়া তেমন বড় না, নিম্ন মধ্যবিত্ত মাত্র। আমাদের নিম্নবিত্ত নীহারিকাকে সর্বোচ্চ শক্তিশালী দূরবীন দিয়েও খুঁজে বের করতে কষ্ট হয় মহাবিশ্বের ঘিঞ্জি থেকে।
একুশ শতকের প্রযুক্তি চশমায় দেখা মহাবিশ্ব
প্রথমে একটি ছবি দেখি–
উপরের ছবিটায় প্রযুক্তি শিশুর চোখে বিশ্ব দেখার পর খেয়াল করে বোঝার চেষ্টা করা যায় আকার আকৃতি দূরত্ব ইত্যাদি। সাথে একটা স্কেল দেয়া আছে মহাবিশ্ব কত বড় তা বোঝার জন্য। এক মিলিমিটার সমান দাগের দূরত্ব হল মাত্র ১ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। সমস্ত মহাবিশ্বের ব্যাস হল আনুমানিক ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ।
আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি চশমার এই বিশ্বঘিঞ্জিতে আছে মাত্র ২০০০ কোটি নীহারিকা। সেই বিশ্বঘিঞ্জির নগণ্য একটি নীহারিকার মাঝারি একটা নক্ষত্রের অতিক্ষুদ্র একটি গ্রহের জীবাণুসম প্রাণী হয়েও মানুষ সেই মহাবিশ্ব ঘিঞ্জির একটা মানচিত্রও তৈরী করতে পেরেছে। সেটা নিয়ে মানুষ হিসেবে কিছুটা গর্ব করাই যায়। এ দিয়ে কিছুটা অনুমান করা যায় মহাবিশ্বের আকার। আমাদের সময়-অসময়, ইহকাল-পরকাল, আগমন-নির্গমন, ধর্ম-কর্ম, ভুত-ভবিষ্যত সবকিছুই এর ভেতরে আত্মগরিমানিমগ্ন।
এখন কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে এই মহাবিশ্বের মহাজঞ্জালের মধ্যে আমাদের ১০ হাজার কোটি নক্ষত্র সমৃদ্ধ ‘ছায়াপথ’ নীহারিকা কোন জায়গায়? মাঝখানে তীরচিহ্ন দিয়ে যে বিন্দুটা নির্দেশ করা হয়েছে, সেখানটায় পরমাণুর চেয়ে ক্ষুদে আনুবীক্ষণিক বিন্দুটিতে আমাদের নীহারিকা গ্রামের অবস্থান। বর্তমান প্রযুক্তির চশমায় নিজেদের নীহারিকারই তেমন কিছুই জানি না এখনও। বাকীদের খোঁজ করা তো অবান্তর। জগতের একমাত্র সভ্য সমাজ বলে মানুষের গর্ব চূর্ণ হবার জন্য হয়তো আরো পাঁচশো বছর পাড়ি দিতে হবে। ‘সভ্যতা’, ‘আধুনিকতা’, এইসব বিশেষণ তাই খুব বেশী আপেক্ষিক।
খুবই সাধারণ জ্ঞানের রচনা। শিশুর চোখে জগত দেখার বিস্ময় থেকে লেখা। শিশু মনের মানুষদের জন্য হলেও যে কোনও বয়সের মানুষের মধ্যে তা আনন্দের যোগান দিতে পারে। আর বলাই বাহুল্য, যে কোনও বয়সের মানুষ শিশু হতে পারে।
[Source: Observable Universe, Wikipedia. Lawrence M Krauss and Robert J. Scherrer (2007). “The Return of a Static Universe and the End of Cosmology”. General Relativity and Gravitation. ]