Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সায়ন্তন ভট্টাচার্যের ফেবুদেওয়াল থেকে

সায়ন্তন ভট্টাচার্য

 

দুরপাল্লার স্লিপার ক্লাসের একটা গন্ধ আছে। নোনতা ঘাম আর ধুলো মেশানো অদ্ভুত অসোয়াস্তিকর একটা ধাতব গন্ধ। গন্ধটা প্রত্যেক বার্থে ঘষটানো দাগের মতো লেপটে থাকে, গা গোলায়, ঘুম আসতে চায় না। সবার নয়, শৌখিন মানুষদের। যাদের গন্ধ নিয়ে অত বাছবিচার নেই তারা দিব্যি ঘুমোয়। তাদের কারও মাথায় বালিশ নেই; কেউ ব্যাগটাকে তো কেউ একটুকরো পোষাককেই পোঁটলা বানিয়ে মাথার নীচে রাখে। কয়েক জায়গায় একটা দুটো এয়ার পিলো যারা মাথার তলা থেকে সরকারি চাকরির মতো ফস্কে যায়। বারবার। অশৌখিন, ভাবলেশহীন মানুষরা বইয়ের তাকের মতো বিছানায় পা গুটিয়ে ঘুমোয়। মেঝেতে হাওয়াই চপ্পলদের সাথে আড্ডা জমায় শেকল প্যাঁচানো স্যুটকেস, প্যান্ট্রি কারের আবর্জনা, পেচ্ছাপের দুর্গন্ধ। সাইড লোয়ারের জানলা দিয়ে ঢোকা হুহু হাওয়ায় ঘুর্ণি লাগে সস্তার লজেন্সের ফেলে দেওয়া র‍্যাপারে, বাথরুমের কাঁচে লালচে টিপ আর জলের দাগ সেঁটে থাকে দিনের পর দিন। পাশাপাশি দুটো আপার বার্থের মাঝখানের সেপারেটরে যে তারজালিগুলো থাকে তাদের কেউ অত্যন্ত দায়সারাভাবে রঙ করেছিল একদিন। পেইন্ট ব্রাশের উদ্ধত আঁচড়ে মোটা ছাইরঙ তাই ফোঁটার আকারে নামতে শুরু করেছিল, অল্প এগিয়ে জমে গেছে– যেভাবে বৃষ্টির সময় দেওয়াল বেয়ে জল চুঁইয়ে পড়ে। এই যে একবাক্স অস্বাচ্ছন্দ্য, ভূমিকম্পের মতো কাঁপতে থাকা একটা লোহার তাল, স্রেফ দায়িত্বপালনের দায়ে ঘুরতে থাকা ফ্যান, তার কোণায় মাখানো কালো প্রাগৈতিহাসিক ঝুল, চলটা উঠে যাওয়া সিট নম্বর– মানুষ তাও ঘুমোয়। শয়ে শয়ে ঘুমন্ত মানুষদের অগোছালো বইয়ের তাকে রেখে দূরপাল্লার ট্রেনরা ক্ষেতের পর ক্ষেত, গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর পার করে যায়। পরিষ্কার রাতে ফুটে থাকা তারাদের মতো পার্থেনিয়াম ঝোপদের পাত্তা না দিয়ে, বিগত বছরের পাতে লেগে থাকা জমাট রক্তকে পাত্তা না দিয়ে, মাঝের অজস্র ছোট ছোট টিমটিম জ্বলা স্টেশন, বাড়িঘর, সিগন্যাল পোস্টদের পাত্তা না দিয়ে ট্রেনরা এগিয়ে যায়।

এটাই ভারত। স্বচ্ছ হোক, অস্বচ্ছ হোক, এটাই। তারা এসি বাক্সদের থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে অনাদি অনন্তকাল ধরে ছুটে চলেছে। সাউথ সিটির সাথে যেমন বেঙ্গল ল্যাম্প চলে, গ্যাসের সাবসিডির সাথে যেমন উনুনের ধোঁয়া চলে, কার ফ্রেশনার মাখানো ওলা উবারের সাথে যেমন “আড়াই ঘণ্টায় তীব্র বশীকরণ” আর বডি ম্যাসাজের বিজ্ঞাপন নিয়ে বনগাঁ লোকাল চলে। স্লিপার ক্লাস তো একটা ক্লাসই, তারা তাই মেশে না! ক্লাসের ধর্মই এটা– আলাদা করে দেওয়া। সিলেবাস, কারিক্যুলাম, এটিকেট, স্বাচ্ছন্দ্য। কিন্তু ঘুম নয়। সেখানে এসে সবকিছু বড় বুনো আর স্নিগ্ধ হয়ে যায়, প্রত্যেকে অসাড় হয়ে আসে। ডানকুনির সর্দারপাড়া থেকে হানিমুন করতে বেরোনো যে বীরপুরুষ তার নতুন বউকে আগলাতে আগলাতে এইমাত্র হাই তুলল সেও, এসি বগিতে যে কিছুক্ষণ আগে টেলিগ্রাফ পড়ছিল সেও– ঘুম পেলে প্রত্যেকেই এমব্রিওর মতো গুটিয়ে যায়। মগজ কাজ করে না, শরীর কাজ করে না। তারা সবাই তখন ট্রেনের একটা অংশ– এই সিলিং ফ্যান, এই বাথরুমের অকেজো কল, এই তেজহীন টিউব, ওই মখমলে পর্দা, ওই ওয়েস্টার্ন কমোড, ওই পরিচ্ছন্ন কাঁচের জানলার মতোই, একটা দায়সারা কিন্তু প্রয়োজনীয় অংশমাত্র। তবে কিনা স্লিপার ক্লাসের এই অসোয়াস্তিকর ধাতব গন্ধের মধ্যে ঘুমোতে পারায় কৃতিত্ব বেশি, শান্তিও।

মাইরি বলছি, যেদিন থেকে আমার উল্টোদিকের লোকটার মতো মাথার নীচে গামছা পেতে মুহূর্তের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে পারব, লেখালিখির দিকে আর ফিরেও তাকাব না!