Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সাংবিধানিক সঙ্কট নয়, চোখ ঘোরানোর ফন্দি

সিবিআই

আবীর আচার্য

 

নতুন বছরের উৎসবের আমেজ ফুরোতে না ফুরোতেই পশ্চিমবঙ্গ প্রত্যক্ষ করল নতুন যাত্রাপালা। লাউডন স্ট্রিটে কলকাতার পুলিশ কমিশনারের কোয়ার্টারের সামনে থেকে সিবিআই অফিসারদের টেনেহ্যাঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে শেক্সপিয়ার সরণী থানায় আটকে ফেলল কলকাতা পুলিশ। কলকাতায় সিবিআইয়ের দুটি অফিসই ঘিরে ফেলল কলকাতা আর বিধাননগর পুলিশ। পালটা চলে এল আধা-সামরিক বাহিনী। শুধু সেনা নামানোই বাকি ছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই ক্লাইম্যাক্সটা আর দেখা গেল না। নইলে লালুপ্রসাদ যাদবকে চারা ঘোটালা মামলায় গ্রেপ্তার করার সময় উপেন বিশ্বাস দানাপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনা আনিয়েছিলেন। কলকাতার কপাল খারাপ। তাই রাজপথে সেনা-আধা সেনা-সিবিআই বনাম কলকাতা আর রাজ্য পুলিশের লড়াই দেখা গেল না। বদলে মুখ্যমন্ত্রী সদলবলে বসে পড়লেন ধর্ণায়। সঙ্গে পাঁচ পুলিশ কর্তা।

অনেকেই লাফিয়ে পড়লেন সাংবিধানিক সঙ্কটের প্রশ্ন তুলে। কেউ দোষ দিলেন কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজ্যকে না জানিয়েই পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে হানা দেবার জন্য। আবার কেউ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করলেন তদন্ত আটকে দেবার অভিযোগ তুলে।  বাইরে থেকে দেখলে ব্যাপারটা তেমনই দেখায় বটে। এ যেন সেই কুরুক্ষেত্রের “ধর্মযুদ্ধ”, দুপক্ষই যেখানে লড়ে যাচ্ছে ধর্ম ও অধিকারের প্রশ্নে, অবশ্যই নিজনিজ ব্যাখ্যা অনুযায়ী। এই লড়াইয়ে ভারতীয় সংবিধান ও গণতন্ত্রের হাল কী দাঁড়াল, সেটা বিচার করার আগে লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটটা একবার বিচার করা যাক।

বর্তমান পালার উৎস রয়েছে সারদা কাণ্ডের তদন্তভার সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেবার মধ্যে। সুপ্রিম কোর্ট এই নির্দেশ দিয়েছিলেন ২০১৪ সালে। পরবর্তী পাঁচ বছরে সিবিআইয়ের অগ্রগতি কতদূর? হ্যাঁ সিবিআই মদন মিত্র, তাপস পাল, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেপ্তার করেছিল। এবং সকলেই জামিন পেয়েছেন। কিন্তু বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সিবিআই কতটা তথ্য বের করতে পেরেছে? আসলে প্রশ্নটা হল সিবিআই কি আদৌ তেমন কিছু করতে চেয়েছে কোনওদিনই? নইলে পাঁচ বছরে একটা প্রায়-প্রকাশ্য বিষয়ে প্রমাণগুলো দাঁড় করানো যায় না? কেউ কি এটা বিশ্বাস করেন? সিবিআই অনেকটা সময় বাদে হঠাৎ কিছুদিনের জন্য চেতে ওঠে। খানিকটা নাচনকোদনের পর আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

উল্টোদিকে রাজ্য সরকার এবং পুলিশের ভূমিকাও একই রকম। প্রথমত সিবিআই তদন্ত আটকানোর ব্যাপারে একের পর এক কোর্ট কেস করে অনাবশ্যক সময় নষ্ট করা হয়েছে। কেউ হয়তো বলতেই পারেন, রাজ্যের অধিকার রক্ষা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণের জন্যই এই পদক্ষেপ জরুরি ছিল। হয়তো তাই। কিন্তু এর ফলে আসল অপরাধীরা তথ্য ও প্রমাণ লোপের যথেষ্ট সময় পেয়ে গেল। কেউ যদি অভিযোগ করেন আইনি টানাপোড়েনকে দীর্ঘায়িত করা হয়েছে এই জন্যই, কোনও উত্তর কি পাওয়া যাবে? আর সবশেষে রাজীবকুমারকে কেন্দ্র করে যে নাটক হল, তাতে তো আরও সন্দেহ মাথাচাড়া দিল।

কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়ায় সারদাসহ অন্যান্য চিট ফান্ডের লক্ষ লক্ষ বিনিয়োগকারীদের প্রশ্নটা কোথায় গেল? কোথায় গেল আত্মহত্যাকারী একশর মতো এজেন্টদের পরিবারের প্রশ্ন? এরা তো কেউ শখ করে চিট ফান্ডের জালে জড়াননি! নিতান্ত অভাবে এবং উপার্জনের সুযোগ না পেয়েই তারা চিট ফান্ডের এজেন্ট হয়েছিলেন। আজ সাংবিধানিক টানাপোড়েনের আড়ালে তাদের কাহিনীই চাপা পড়ে যাচ্ছে। রাজ্য সরকার বলবেন শ্যামলকুমার সেন কমিশন করে তারা তো ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত দেওয়া শুরু করেছিলেন। ভালো। সেই ক্ষতিপূরণের টাকাটা কি এইসব চিট ফান্ডের সম্পত্তি বিক্রি করে এসেছিল? না, টাকাটা এসেছিল রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকে। কেন? ফুর্তি করবে একজন আর তার দায় মেটাবে রাজ্যের সরকারি তহবিল, এটা কি মামাবাড়ি নাকি?

চিট ফান্ড কাণ্ডে কে অপরাধী, কে চক্রান্তকারী আর কে সত্যিই নিরপরাধ, সেটা তদন্ত ও বিচারসাপেক্ষ। তার আগে নাম ভেসে ওঠা সকলেই অভিযুক্তই মাত্র, অপরাধী নন। কিন্তু তদন্তটাই যদি টানা ও নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে না হয়, অথবা কাউকে তলব করা মাত্রই যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খোঁজার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়, তাহলে তো তদন্তটাই করা মুশকিল। যে যাই বলুন, আজকের ভারতবর্ষে কিংবা একটি রাজ্যেও পুলিশ ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা বলে আর কিছু অবিশিষ্ট নেই। সিবিআই-কে সুপ্রিম কোর্টই অন্য একটি মামলার সূত্রে বলেছিলেন কেব্দ্রীয় সরকারের তোতাপাখি। আবার পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ অতীতের দলদাস থেকে আজ যে দলকর্মী হয়ে উঠেছে, সেটাও প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে। সিবিআই-ই করুক আর রাজ্যের সিট, বঞ্চিত ও প্রতারিত মানুষদের কথা কেউ ভাববে না, শুধু ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অনুযায়ীই কিঞ্চিত খেলাধুলা করবে।

যারা রাজীবকুমারকে কেন্দ্র করে সাংবিধানিক সঙ্কটের কথা বলছেন, তারা আসলে উপরে উপরে দেখছেন। সাংবিধানিক সঙ্কট আসতে পারছে কেন? আসলে সঙ্কট দেখা দিয়েছে গোটা রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিপদ্ধতিতেই। এই কথা সবাই মানেন, একদা অসাধু রাজনীতিক ছিল হাতে গোনা। আর আজ সৎ রাজনীতিক হল মিউজিয়াম পিস। কেন এটা হতে পারল? রাতারাতি সমস্ত মানুষ খারাপ হয়ে গেল? আসলে অর্থনৈতিক সঙ্কট যত বাড়ছে, ততই মানুষের সামনে আশার আলো দেখানোর রাস্তাটাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে মানুষ রাজনীতিতে আসবে কেন? আর সমর্থনই বা করবে কেন? ক্ষমতার সঙ্গে থাকলে গুড়মধু মিলবে, এই আশ্বাসটাই এক্ষেত্রে অক্সিজেনের কাজ করছে। আর সেই কারণেই দুর্নীতি বাড়ছে, বাড়ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে পকেট ভরিয়ে নেওয়া।

“শেষের কবিতা”-র ক্লাইম্যাক্স ঘটেছিল শিলং পাহাড়ে। আজ যদি কেউ মনে করেন, শিলং পাহাড়ে সারদা বা অন্যান্য চিট ফান্ডের তদন্তের ক্লাইম্যাক্স আসবে, তারা দিবাস্বপ্ন দেখছেন। রাজীবকুমারকে সিবিআই খুব চাপে ফেলবে। লাউডন স্ট্রিটে তাদের অফিসাররা যেভাবে নিগৃহীত হয়েছিল, তাতে বাহিনীর মনোবল ধরে রাখার জন্য এটা করতেই হবে। এবং ঐ পর্যন্তই। কিছুদিন পরে সব আবার ধামাচাপা পড়ে যাবে।