Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আমার পানের ’পরে চলে গেল কে?

সুতপা ভট্টাচার্য 

 

“অ্যাই তোর মুখে কি রে? হাঁ কর! হাঁ কর! হাঁ কর বলছি!” প্রাণপণে ঠোঁট চেপে আছি! মুখে উঁ উঁ আওয়াজ! কোনও মতেই যাতে জিভ না বেরিয়ে আসে! জিভ বেরোলেই তো মা টের পেয়ে যাবে! কিন্তু মা’ও এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন! মধ্যমা আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে চেপে ধরল আমার গাল! ঠোঁট হাঁসের মতো চোঙ্গা হয়ে বেরিয়ে পড়ল গুপ্তধন! সবে চুন আর খয়েরের রসে লাল হয়ে জিভে রঙ ধরেছিল! “আবার!! আবার পান খেয়েছিস!! দাঁড়া! আজ ওনারই একদিন কি আমারই একদিন! হাজারবার বারণ করা সত্ত্বেও কি সমস্ত বাজে অভ্যাস করাচ্ছেন! ফ্যাল! ফ্যাল বলছি!” তা আমার ফেলে দেওয়ার অপেক্ষায় থাকলে তো! গালে এমন চাপ দিল যে সব গোপনীয়তা বেরিয়ে মাটিতে ঝরে পড়ল! আমি গরু চোরের মতো চোরা চোখে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম ঠাকুমার কোনও দোষ নেই! আমিই চেয়েছিলাম!

“উঁ! আবার সালিশী হচ্ছে! আজ টান মেরে সব পানের বাটা ফেলে দেব!” মনে ভাবলাম পানের বাটা ফেলে দিলে মা খাবে কি! খাওয়ার পরে তো তেনারও একটি পান লাগে! আবার আশঙ্কাও হল রাগ হলে এই মহিলা পারেন না এমন কোনও কাজ নেই! আর সব ফেলে দিক কিন্তু ঐ পান ছেঁচুনিটা?? ওটাও ফেলে দেবে না কি রে বাবা!! আমার তো আবার পান চিবিয়ে খেতে ভাল লাগে না! কি সুন্দর সাদা ভেজা কাপড়ে মোড়া সবুজ সতেজ পান বার করে ঠাকুমা! নিঁখুত করে পানের বোঁটা ছাড়িয়ে জল রঙের তুলির মতো আঙ্গুল বুলিয়ে ওতে চুন মাখায়! জাঁতি দিয়ে চানাচুরের মতো ঝিরি ঝিরি সুপুরি কাটে, তাতে এক চিমটি খয়ের দেয়, এক চিমটি ভাজা মৌরী! তারপর কেমন যেন একটা অদ্ভুত কায়দায় হাত ঘোরায় আর শোয়া সিঙ্গারার মতো দেখতে হয়ে যায় পানটা! আমি ততদিনে জানি ওটাকে ‘খিলি’ করা বলে!

দাও না ঠাকুমা আমি একটা পান খিলি! “আলো মাইয়া! থো থো দেহি!! পারতি না! পারতি না! ড্যানাডি ব্যথা করব!” কে কার কথা শোনে! আমি ততক্ষণে এক খাবলা চুন উঠিয়ে পানে দেওয়াল রঙ করার মতো মাখিয়ে সারা! “আলো মাইয়া! করস কি! মুখ তো পুইড়া ঝামা হইব! তোরে নিয়া তো পারন যায় না! এরপর যদি মায় বকে তো আমারে কইতে আসিস না য্যান!” ওদিকে আমার অপটু খিলির ফাঁক দিয়ে ঝুরঝুর করে পড়ে যায় সুপুরির কুচি! “দ্যাখসো! দ্যাখসো! কান্ডোটা দ্যাখসো!” তাতে মোটেও দমি না আমি! উফফ ঠাকমা! তুমি পান ছেঁচুনিটা দাও তো! আমি অধৈর্য্য! কতক্ষণে সুপুরি আর খয়ের দিয়ে পানটাকে দুরমুশে পিষব! খাওয়ার উৎসাহের চেয়ে ছেঁচার উৎসাহই যে বেশী বলাই বাহুল্য! “আলো! আমারে পানটা খাইতে দে আগে!” আমি মাথা নেড়ে চকচকে চোখে বসে রই! কতক্ষণে ঠাকুমার হবে আর আমি পান থেঁতো করব!

ঠাকুমা খিলিখানা ছেঁচুনির মধ্যে ফেলে ছেঁচতে শুরু করে! ঠাকুমাকে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি! ধবধবে ফর্সা! খালি গায়ে সাদা থান জড়ানো! মাথার কাপড় এতটুকু নড়ার উপায় নেই! মেদবহুল শরীর বয়সের ভারে ঝুঁকে দুই হাঁটুর কাছাকাছি! হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা পেতলের দণ্ডটি উঠছে আর নামছে! পান ছেঁচার শব্দের তালে তালে দুলে ওঠে ঠাকুমার চামড়া কুঁচকে ঝুলে পড়া বাহু! ঐ দৃশ্যটা দেখলেই আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতাম না! ইচ্ছে করে আরও দুলিয়ে দিতাম সেই ঝোলা চামড়া! মাঝে মাঝে আটা মাখার মতো মাখতেও পিছ পা হতাম না! ইস কি নরম তুমি ঠাকমা! আবার ঠাকুমা চিৎকার করে উঠত! “জ্বালাইন্যা মাইয়া! তর কি এট্টু সুস্থির নাই!”

আর কতক্ষণ? হোলো তোমার? আমি অধৈর্য্য! ঠাকুমা এবার ছেঁচুনি রেখে সাবধানে কাচিয়ে থেঁতো করা পান বের করে আনে! পরম তৃপ্তি চোখে নিয়ে নিজের মুখে পোরে! পাশের ছোট শিশির মধ্যে থেকে বের করে আনে দোক্তাগুঁড়ো! সুগন্ধে আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস টানি! দোক্তা মুখে পুরে খেয়াল পড়ে আমার কথা! ছেঁচুনির মধ্যে লেগে থাকা অবশিষ্টটুকু আমার মুখে দিয়ে বুড়ি ইন্দির ঠাকুরুনের মতো হাসে! আমিও অনাস্বাদিত আনন্দে উদ্বেল! সতর্ক চোখে চারিদিকে তাকাই! মা দেখে ফেললে বিপদ! টেনে নিই পানের বাটা! অপটু হাতের চুন, খয়ের মাখানো পান আর কুচি করা সুপুরি নিয়ে বেশ করে ছেঁচতে থাকি! পান মিহি করার মধ্যেই যেন আমার সার্থকতা! শিশুমন একটু পরেই অধৈর্য্য! দেখো তো হয়েছে কি না! ঠাকুমা একবার উঁকি দিয়ে দেখে বলে “হয় নাই! আরও ছ্যাঁচা লাগব!” আমি আবার পরম মনোনিবেশ করি কাজে! অবশেষে পানের দফারফা সারা করে তৃপ্ত মুখে কাচিয়ে উঠিয়ে মুখে পুরে ছুট লাগাই আয়নার কাছে! ঠোঁট কতটা লাল হল দেখতে হবে তো! ঠাকুমা বলে ঠোঁট লাল হলে বর নাকি খুব ভালবাসে! লাল না হলে জিভ দিয়ে ঠেলে ঠেলে পানের পিক মাখিয়ে নিতাম সারা ঠোঁটে! বেশ সিনেমার ঐ মেয়েগুলোর মতো কেমন সুন্দর লাল লাল ঠোঁট! এসব চলত সবই মায়ের অগোচরে! জানতে পারলে রক্ষা ছিল না! শাশুড়ী বা মেয়ে কেউই ছাড় পেত না তাঁর কাছে! এত কড়া শাসনের ফাঁকেও কেমন করে যেন অভ্যাসটা হয়েই গেল! তারপর ঠাকুমাও একদিন চলে গেল! আমিও দিব্যি নিজে সেজে চিবিয়ে পান খেতে শিখে গেছি! পান ছেঁচুনির কথাও ভুলে গেছি! নতুন নতুন বছর, নতুন ক্লাস, চোখ ধাঁধানো নতুন সব জিনিস আসছে জীবনে! পান যে ছেঁচে খাওয়া যায় সে কথাই ভুলে গেলাম!

কিছুদিন আগে মা আমাকে বলল “বুড়ি! বাড়ীতে একটা জিনিস আছে! ওটা একমাত্র তোর কাজেই লাগবে! তুইই একমাত্র ওটার যোগ্য কদর করবি! এবার নিয়ে যাস ওটা!” আমি অবাক! কি এমন জিনিস! মা হাতে করে নিয়ে এল সেই পান ছেঁচুনি! আমি অবাক হয়ে হাতে নিলাম! ঠাকুমা চলে যাওয়ার পর একদিনও ব্যবহার হয়নি, একদিনও মাজা হয়নি! এখনও ইন্দির ঠাকুরুণের হাতের স্পর্শ লেগে সেই পান ছেঁচুনির গায়ে! চামড়া ঝুলে যাওয়া থলথলে মেদযুক্ত এক হাত এখনও ছেঁচতে থাকে আমার মনের ভেতর! নরম চামড়া দুলে দুলে ওঠে! আমি ধরতে যাই আর সরে যায় ছিটকে “আলো মাইয়া কি করস! তর কি এট্টু সুস্থির নাই!”