শতাব্দী দাশ
বইমেলা নিয়ে লেখার ঝক্কি হল, তা নিজের গল্প হয়ে যায়। বইমেলাকে আড়াল করে দাঁড়াতে পারে আমি ও আমরা। নৈর্ব্যক্তিক কিছু লেখা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়৷
শান-বাঁধানো মেলায় ঢোকার মুখে মনে পড়ে ছোটবেলার চুক্কি। যে সময়ে ময়দান পর্যন্ত দু-তিন কিলোমিটার লাইন পড়ত টিকিট কাটার, সেইসময় আমার স্কুলবেলা। একদিন বুঝলাম, লাইনে দাঁড়ালে সন্ধে সাড়ে ছ’টার আগে ঢুকতে পারব না টিকিট কেটে। অগত্যা গোবেচারা মুখ করে গেটে। ‘সেই মেদিনীপুর থেকে আসছি কাকু। রাতের জগন্নাথ এক্সপ্রেস ধরব। ঢুকতে কি পারব না?’ ডাহা মিথ্যে বচন এবং ঢুকে পড়া। তারপর কতবার ঠাঁইনাড়া হল মেলা! প্রবেশও হল টিকিটবিহীন।
বইমেলায় এত বান্ধবযোগ শুনি, তাও একাই যেতে ইচ্ছে করে, চিরকাল। অন্তত একদিন, সবার অলক্ষ্যে পাতা ওল্টানো। সুবর্ণরেখায় দরাদরি করি ‘মনসামঙ্গল’ হাতে৷ ‘মৃচ্ছকটিক’ পড়তে দিয়েছিল কলেজকালে এনবিটির বইওয়ালা। সেই অবসর, সে অবকাশ আর নেই। কাজকম্ম-ফেরত ঢুঁ-মারা এক আধবার। স্বল্প সময়ের কারণে বই-এর সঙ্গে নিভৃতি আরও বেশি দরকার। এককালে লেখকদের ভিনগ্রহী মনে হত। আজকাল বন্ধুদের বই সাজানো থাকে, হাতের ওমে তাদের চেপে ধরি। তবু মাঠে একাই ভালো লাগে৷
আশ্চর্য, আজও সুদৃশ্য মলাটে চড়া দামে বিকোয় নকশাল আন্দোলন আর দেশভাগ! সত্তর আর চল্লিশ মহার্ঘ্য দশক সারস্বত বাজারে। তুরুপের তাস, খাড়াবড়িথোড়। মেলা চলতে চলতে অলক্ষ্যে মারা যান সুদীপ চোঙদার।
বইমেলায় আরও বিকোয় নানা প্রান্তিকতা। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রান্তিকতা, বাউল-ফকির-লোকায়ত। বিকোতে পারে লিঙ্গগত বা শ্রেণিগত প্রান্তিকতাও। প্রয়াত সুচিত্রা ভট্টাচার্যের গল্পের কোনও এক সংকলন বের করেছে এক প্রকাশনী৷ নামখানি মেগাসিরিয়ালোচিত। ‘সব গল্প মেয়েদের’।
বইমেলায় ‘কৃত্তিবাস’-এর পাশেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অক্সিমোরোনিক অবস্থান। বইমেলায় রাইস-মাইস, বইমেলায় ফিসফ্রাই, বইমেলায় টিভি চ্যানেল। এসব সনাতন এখন, এসব নিয়ে উন্নাসিকতাও ক্লিশে। মেলা যে শুধু বই-এর নয়, তাও চির-জানা। মেলায় যা কিছু বই-রহিত, তাদেরও খুঁজি এখানে ওখানে। বইমেলার বিস্ময় সেই পোট্রেট-আঁকিয়েরা, এবার তাদের দেখিনি। রণ-পা পরা বই-বিক্রেতাকে খুঁজি… নেই। সেই দাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে পাওয়া যায়, যার বই এক মিনিট পড়লে পাঁচমিনিট হাসতেই হবে নাকি। তার বই কোনওদিন কিনলাম না, কিন্তু তাকে বুড়ো হতে দেখলাম চোখের সামনে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা আড্ডা-গানের গোল ঠেক একই, মুখ বদলে যায়। বইমেলা হাঁদা-ভোঁদা-নন্টে-ফন্টের কাট আউটেরও। সংবাদপত্রের স্টলে অমিতাভ বচ্চন বা সৌরভ গাঙ্গুলির ঢাউস ছবি দেখতে ভিড় করা জনতারও। ‘সব আমাদের জন্য’।
রীতি মেনে কিছু বই হস্তগত করি। দেবারতি মিত্র-র গদ্য। কবিতা সিংহ-এর অপ্রকাশিত গদ্য৷ আঞ্চলিক বাংলা ভাষা নিয়ে একটি জেলাভিত্তিক দস্তাবেজ। সুবিমল মিশ্রর অবশিষ্ট খণ্ডগুলি। সুখলতা রাও… তিনিও সম্পূর্ণ বুকসেল্ফগত হলেন। জীবনানন্দের ডায়রি কেনা গেল। বন্ধুদের বেশ কিছু বইও। ব্লার্ব-নির্ভর বর্ণনায় না গিয়ে পাঠ করব একে একে। বচ্ছরকার ক্যাটালগ জমানো হয় আরও কেনাকাটার উদ্দেশ্যে।
অতঃপর লিটল ম্যাগ চত্বর। কিছু আলো-আলো নতুন চোখ, কিছু মাঝবয়সি পুরোনো ক্ষ্যাপামি। যে ঘাড়-ত্যাড়া ছেলে কিছুতেই পুশ সেল করবে না, যে গায়ে-পড়া মেয়েটি বই বেচবেই বেচবে— ভালো লাগে তাদের দুজনকেই। ভালো লাগে ছাত্র-রাজনীতির ছেলেমেয়েদের দলীয় পত্রিকা বিক্রির চেষ্টা। দুশো বছুরে মার্ক্স নানা প্রচ্ছদে আত্মমগ্ন। ভালো লাগে লিঙ্গবৈষম্য-বিরোধী সংস্থার মুখপত্রের টেবিলে কিশোরী নয়, নবকিশোর। সংকীর্ণ প্যাসেজ দিয়ে ‘কবিতা চাই, কবিতা চাই’ বলে কেউ হেঁকে যায়।
পিডিএফ আর ই-লাইব্রেরি ফেলে-আসা এই যে এত মানুষের ভিড়, তা সরকারি স্টলের মেকি আলপনা আর বাউলগানের বাড়াবাড়ি ভুলিয়ে দিতে পারে। কলেজ স্ট্রিটের ‘বর্ণপরিচয়’-এর এক অন্ধকার করিডোর মনে পড়ে বরং। বই খুঁজতে গেছি কাজের শেষে, আলতো নভেম্বরি শীতসন্ধ্যা৷ ‘বর্ণপরিচয়’ কমপ্লেক্সে বই-বিপণি পেয়েছিলেন কোনও কোনও প্রকাশনী। অথচ আলোর লাইন কেটে নেওয়া হয়েছে দোকানগুলোর। সন্ধে ছটার ঝলমলে কলেজ স্ট্রিটের এক কোণে একটা বই-বহুল অযত্নলালিত অন্ধকার করিডোর। আমি মোবাইলের আলো ধরে দাঁড়িয়ে। মোমবাতি নিয়ে বই খুঁজছেন কর্মচারী৷ বইমেলা সেই অন্ধকূপ থেকে বর্ষারম্ভে দুঃখিনী বর্ণমালার আলোয় ফেরা যেন।