Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভারত-পাক কাশ্মির কাজিয়া কি চিরন্তন? শেষ নেই?

ভারত পাকিস্তান কাশ্মির

আশরাফুল আমীন সম্রাট  

 

গত শতাব্দীর প্রান্তে এসে লন্ডনে খিদমত সেমিনারে সলমন আসিফ আশার বাণী শুনিয়েছেন, “I do believe we will live in peace, but the question is how much pain we will have to go through to get there” (Salman Asif, Khidmet Seminar, Indian and Pakistani Relations in the 21st Century). শুধু সলমন আসিফ কেন, ভারত ও পাকিস্তানের সমস্ত শান্তিকামী মানুষ আজও আশায় বুক বেঁধে আছেন— কাশ্মির সমস্যার অবসান হবে, মানুষ বাঁচবে মানুষের পরিচয়ে। কিন্তু একবিংশ শতকে ভারত ও পাকিস্তানের জটিল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় সন্ত্রাসকবলিত দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন কতটা বস্তুনিষ্ঠ সেটা পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে বৈকি। সেদিকে নজর দিলে বোঝা যায় যে কাশ্মির সমস্যার সমাধান মনে হয় সুদূর অতীতেও হওয়া সম্ভব নয়। কারণ এই কাশ্মির ইস্যু এমন একটি ইস্যু যেটাকে পুঁজি করে দুই দেশের ভোটকেন্দ্রিক রাজনীতির রং বদলে দেওয়া যায়। ভোট রাজনীতিতে কাশ্মির ইস্যু দুই দেশেই চড়া দামে প্যকেজ সেল হয়। দুই দেশ হাজারো আভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত থাকলেও এই ইস্যুকে সামনে রেখে আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ঠিক ভোটের আগে সরগরম থাকে। পাকিস্তানে কিছুদিন আগে সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে কাশ্মির ইস্যুকে শিখণ্ডী করে ভারতবিরোধী সুর চড়িয়েছিলেন ইমরান খান। ভোটে জিতে “ভারত এক পা এগোলে আমি দুই পা এগোবো” জাতীয় ঔদার্যের বাণী শোনালেও ভোটের আগে ভারতবিরোধী আবেগ ব্যবহার করতে ভোলেননি তিনি। ভারতের রাজনীতিটাও ঠিক একই কায়দায় চলে। চিরশত্রু হিসাবে পাকিস্তানের কাকতাড়ুয়া ফিগারটি বসিয়ে রাখা আছে। বেকারত্ব, কৃষক আত্মহত্যা, ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারি থেকে নজর ঘুরিয়ে সাধারণ জনরোষ পাকিস্তানের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রের আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস ও পক্ষপাতপুষ্ট মিডিয়ার যৌথ ‘উদ্যোগে’ দুই দেশের মানুষের সাধারণভাবে জেনোফোবিয়ায় আক্রান্ত। দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানই এই পারস্পরিক শত্রুভাব জিইয়ে রেখে আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফায়দা তোলে।

মূল প্রশ্নে আসি। কাশ্মির সাধারণভাবে হিন্দু অধ্যুষিত জম্মু, মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মির ও বৌদ্ধ অধ্যুষিত লাদাখ, এই তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। কাশ্মির সমস্যা মূলত মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মিরকে নিয়ে। কাশ্মিরের মিলিট্যান্ট গ্রুপের সঙ্গে ভারত রাষ্ট্রের বিরোধিতার জটিল ভূরাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তাদের কাছে দুটি অপশন খোলা। তারা চায় পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হতে বা স্বাধীন ভূখণ্ড হিসাবে আজাদ কাশ্মিরের আত্মপ্রকাশ। সেই মর্মেই তারা ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে যথেষ্ট আগ্রহী। মিলিট্যান্ট গ্রুপ ভাল করেই জানে ক্ষমতার প্রশ্নে তারা ভারতের সিকিউরিটি ফোর্সের সঙ্গে এঁটে উঠবে না। সেজন্য তাঁরা চায় একবিংশ শতকের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা মাথায় রেখে আন্তর্জাতিক সঙ্ঘ তাদের তাদের এই অধিকারকে ‘মানবিকতা’র খাতিরে স্বীকৃতি দিক। আফস্পার মতো কাশ্মিরের উপর লাগু হওয়া একাধিক দমননীতি মানবিধাকার লঙ্ঘনের সামিল বলে তারা বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয়। ভারত সরকার তাদের এই সমস্ত দাবি মানতে নারাজ। ভারত সরকার বরাবর এই মিলিট্যান্ট গ্রুপকে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি হিসাবেই দেখিয়ে এসেছে, যে শক্তি ভারত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের উপর প্রবল আঘাত হানে। তথাপি ভারত সরকার পুরো ব্যাপারটিকে শমিত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তান সরকারকে সীমান্ত সন্ত্রাশের অভিযোগে অভিযুক্ত করে এসেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র কাশ্মিরের এই অচলাবস্থাকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে ভেঙে দিতে চায়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কাশ্মিরের মিলিট্যান্ট গ্রুপকে পাকিস্তান আপাতভাবে সমর্থন করে জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর বলে মনে হলেও ব্যপারটা তেমন নয় অবশ্যই। কাশ্মিরের মিলিট্যান্ট গ্রুপের পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির চাহিদায় তাদের প্রবল আগ্রহ থাকলেও দ্বিতীয় অপশন মোতাবেক স্বাধীন রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ড হিসাবে আজাদ কাশ্মিরের আত্মপ্রকাশে তাদের বিশেষ আগ্রহ নেই। কেন নেই? সেটা দিনের আলোর মতো পরিস্কার।

ভারত সরকার কাশ্মির সমস্যাকে আভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসাবে দেখিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের মতো কোনও আন্তর্জাতিক তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ চায় না। কিন্তু অন্যদিকে পাকিস্তান চায় রাষ্ট্রেপুঞ্জের কাশ্মির সংক্রান্ত রেজোলিউশনের বাস্তবায়ন, যার ভিতর লুকিয়ে আছে তাদের নিজস্ব কূটনৈতিক স্বার্থ। কাশ্মির মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় তারা ভেবেই নিয়েছে যে আঞ্চলিক গণভোট হলে সেই রায় ভারত বিরোধী মিলিট্যান্ট গ্রুপের পক্ষেই যাবে। ফলত আজাদ কাশ্মিরকে তারা দখলে নিতে পারবে। অর্থাৎ পাকিস্তানের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তি ইচ্ছার প্রতি সওয়ালে কোনও মানবিক পটভূমিকা নেই, আছে দখলদারি মানসিকতা। কিন্তু ভারত অখণ্ডতার প্রশ্নে আঞ্চলিক গণভোটে অনাগ্রহী। তারা চায় জম্মু-কাশ্মিরের সামগ্রিক গণভোট, তাতে ভারতের পক্ষে রায় যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। কারণ হিন্দু অধ্যুষিত জম্মু ও বৌদ্ধ অধ্যুষিত লাদাখ ভারতের সঙ্গে সংযুক্তির পক্ষে রায় দেবে বলে ভারত রাষ্ট্র মনে করে। কিন্তু এখন যেহেতু কাশ্মির বর্তমান ভারত রাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক সীমানার মধ্যেই রয়েছে তাই সমস্যা সমাধানে ভারত রাষ্টের সেরকম তাড়া নেই। দীর্ঘসূত্রিতা বজায় রেখেই ভারত চলতে চায়, তাতে কাশ্মিরের জনজীবন যুগযুগ ধরে বেয়নেটের সামনে অতিবাহিত হোক তাতে রাষ্ট্রের কিছু যায় আসে না। অন্যদিকে পাকিস্তানের জনগণ এই ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে তারা কাশ্মিরে মুসলিম ভাতৃত্বের প্রতি ‘দায়বদ্ধ’, অন্যদিকে যুগযুগ ধরে ভারতের সঙ্গে এমন একটি যুদ্ধ-যুদ্ধ আবহে লিপ্ত হয়ে থাকা যেটা কোনওদিনই জেতা যাবে না। পরিণামে কাশ্মির ভূখণ্ড দুই রাষ্ট্রের দাপাদাপিতে মাঝখানে পিষে যেতে থাকবে।

কাশ্মির সমস্যার এই জটিলতা বুঝে সমস্যা সমাধানের রাস্তা হিসাবে এ যাবৎ বহু লেখালেখি হয়েছে। সাংবাদিক, গবেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, কূটনীতিজ্ঞ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই নানারকমভাবে শান্তি স্থাপনের উপায় বাতলেছেন। তাদের কেউ কেউ কাশ্মিরকে দেখেছেন স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসাবে, কেউবা ভারত বা পাকিস্তানের ভৌগলিক চৌহদ্দির অংশ হিসাবে, কেউবা চান নিয়ন্ত্রণ রেখায় বিভক্ত কাশ্মিরকে রাষ্ট্রেপুঞ্জের মোতায়েন করা শান্তিরক্ষাকারী শক্তির তত্ত্বাবধানে রাখতে। কিন্তু সমাধানের এত রাস্তা খোলা থাকা সত্ত্বেও দুই রাষ্ট্রের কাশ্মির কাজিয়ার বরফ এতটুকু গলেনি। স্রেফ মাঝেমাধ্যে দ্বিপাক্ষিক-ত্রিপাক্ষিক চুক্তি আর ভারত-পাকিস্তানের প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচেই আবদ্ধ থেকে গেছে। কারণ আগেই বলেছি, “ম্যাটার অব ডিসপিউট” অর্থাৎ কাশ্মির ভারতের সঙ্গে অঙ্গীভূত থাকার দরুণ এই সব শান্তি আলোচনায় কোন ফলদায়ী টোটকা বেরিয়ে আসে না। অন্যদিকে দেশভাগের সময় থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রয়েছে তীব্র পারস্পরিক বৈরিতা ও সেখান হতে উদ্ভুত প্রবল অবিশ্বাস। এই শত্রুতা ও অবিশ্বাসের বীজ এতটাই গভীর যে তারা শত্রুভাবাপন্ন ঐতিহাসিক বোঝের লিগ্যাসি ঘাড় থেকে নামাতে অপারগ। ভারতে জহরলাল নেহেরু থেকে শুরু করে নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানে মুহম্মদ আলি জিন্না থেকে শুরু করে ইমরান খান সেই লিগ্যাসি বয়ে আনছে। ঘৃণার বীজ এতটাই প্রোথিত যে কয়েক বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজু যখন কুড়ি বছরের মধ্যে ভারত-পাকিস্তান মিলে যাওয়ার শান্তিকামী ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন তখন তাকে নিয়ে তামাশার বন্যা বয়ে গিয়েছিল দুই দেশে।

দেশভাগের পর থেকে সিন্ধু দিয়ে বহু জল বয়ে গেছে কিন্তু ভারত-পাক সম্পর্কের বরফ গলেনি। সন্ত্রাসক্লিষ্ট একবিংশ শতকের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত আর কাশ্মিরকে বিসংবাদের ক্ষেত্র বলে মানেই না। কেন মানে না সেটা ২০০২ সালে কাশ্মিরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সাক্সেনা একটি উপমা দিয়ে বুঝিয়েছেন, “A dispute is about two people having the potential right to something. In this instance you have a situation where you have a house. Another person wants the house; they come in and occupy one third of it and then tell me we have a dispute.” (Victor Schofield, Kashmir in Conflict: India Pakistan and the Unending War) অর্থাৎ ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়কে ভারত-পাক আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে টেনে আনার ব্যাপারে পাকিস্তান অনধিকারচর্চা করছে বলে মনে করে ভারত। একই স্তরের অভিযোগ পাকিস্তান সরকার ভারতের উপর দেগে দেয়। পাকিস্তানী জনসাধারণের একটা বড় অংশ বিশ্বাস করে যে তারা ভারতের বিশেষ এক চক্রান্তের শিকার। ভারতরাষ্ট্র পাকিস্তানের বালুচিস্তান সমস্যাকে উসকে দিয়ে সে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার উপর আঘাত হানছে বলে তারা মনে করে। এই বিশ্বাস আরও পোক্ত হয়েছে ১৯৯৮ সালে ভারতে হিন্দুত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। পাকিস্তানের ইসলামীয় মৌলবাদ ও তদপুরি জঙ্গি অনুপ্রবেশের কাউন্টার ডিসকোর্স হিসাবে তারা ধর্মনিরপেক্ষ উদার ভারতবর্ষে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাকে তুলে ধরতে চেয়েছে। এই এজেন্ডার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ইতিহাসের পক্ষপাতপুষ্ট পুনর্লিখন শুরু করেছে যাতে সমাজ-সাংস্কৃতিক জীবনের সর্বস্তরে সাধারণ জনমানসে তাদের হিন্দুত্ববাদী আইডিওলজি সঞ্চালিত করা যায়। অন্যদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্র নিজ ক্ষেত্রে সাধারণ জনমানসে এমন একটি ভ্রান্ত ইতিহাসবোধ তৈরি করে ফেলেছে যার দরুণ পাকিস্তানের মানুষ বিশ্বাস করে “সাম্রাজ্যবাদী” ভারতকে রুখে দেওয়ার জন্য দেশভাগ-উত্তর যুদ্ধগুলি কতখানি প্রয়োজন ছিল। সেই সুবাদে কাশ্মিরের মিলিট্যান্ট গ্রুপকে ভারতের বিরুদ্ধে উসকে দেওয়ার পিছনে পাকিস্তান সরকারের যে স্বার্থ রয়েছে সেটাকে ঘুরপথে জনসাধারণের কাছে জাষ্টিফাইও করে ফেলেছে পাকিস্তান রাষ্ট্র।

পারস্পরিক অজ্ঞতায় বৈরিতাবোধের জন্ম দেয়, বৈরিতাবোধ থেকেই আসে পারস্পরিক হিংসা। তবে আশার কথা এটাই যে দুই রাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থগন্ধী প্রোপাগান্ডা ও পক্ষপাতপুষ্ট মিডিয়ার পারস্পরিক বিরুদ্ধ-প্রচারে সাধারণ জনমানসে ঘৃণার বীজ প্রোথিত থাকলেও দুই দেশের অ্যাকাডেমিক ও ইন্টালেকচুয়াল লেভেলে এবং মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এই বৈরিতাবোধ নেই। কারণ তারা মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় প্রভাবিত নয়। ভারত-পাক দ্বন্দের ঐতিহাসিক, ভৌগলিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তারা ভালরকমের ওয়াকিবহাল। তাদের মধ্যে অজ্ঞতা নেই বলে বৈরিতাবোধও নেই। তাই দুই দেশের জ্ঞানী বিবেকের উচিৎ শুধু সেমিনার ওয়ার্কশপ আলোচনায় ব্যাপারটি আবদ্ধ না রেখে সাধারণ জনমানসকে বস্তুনিষ্ঠ প্রচারের মধ্য দিয়ে যৌথভাবে প্রকৃত বাস্তবতা সম্পর্কে মানুষকে ওয়াকিবহাল ও সচেতন করে তোলা। অজ্ঞতা দূরীকরণের মধ্যেই রয়েছে সুলুক সমাধান। সময়সাপেক্ষ হলেও, তার বাস্তব রূপায়ণ অসম্ভব নয়। আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনেই মধ্যেই হয়েছিল। কারণ তারা এই যুদ্ধ চলতে থাকার ভয়াবহতা ও সাধারণ জনজীবনে তার কুপ্রভাব নিয়ে সচেতন হয়েছিল। সেই সচেতনতাই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে ইতিবাচক প্রেষণা যোগায়। দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ জনমানসকেই বুঝতে হবে ও বোঝাতে হবে যে দুই দেশের মানুষকে কী বীভৎস কুপ্রভাব বয়ে বেড়াতে হচ্ছে কাশ্মির দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে। ভারত ও পাকিস্তানের জাতীয় আয়ের সিংহভাগটাই প্রতিরক্ষা খাতে স্রেফ অপচয় হয়। অথচ দেশের শ্রীবৃদ্ধির জন্য জাতীয় আয়ের সিংহভাগটা মানব সম্পদ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের খাতে ব্যবহার করা প্রয়োজন। যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা জারি থাকা মানে অস্ত্রব্যবসায়ী পশ্চিমী দুনিয়াকে লাভের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেওয়া, এই সচেতনতা বোধটা সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সঞ্চালিত হওয়া দরকার।

সিমলায় দ্বিপাক্ষিক চুক্তি থেকে শুরু করে যত বার আলোচনায় বসেছে দুই দেশ কোনওবারই আশানুরূপ রফা বেরোয়নি। ভারত-পাক দ্বন্দ্ব নিস্পত্তির সদিচ্ছা মনে হয় দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে নেই। কারণ আলোচনায় বসার আগে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিজেদের অবস্থান থেকে এক চুল নড়ার মানসিকতা নেই। যে আলোচনায় নমনীয়তা নেই, সেই আলোচনা ব্যর্থ হবে এবং বারবার ব্যর্থ হবে সেটাই ভবিতব্য। আলোচনায় তাই নমনীয়তা আনা দরকার। সহিষ্ণু দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জনসাধারণের সুবিধা অসুবিধা বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিৎ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিতর্ক আলোচনার পরিসরগুলো তথ্য ও জ্ঞানভিত্তিক হোক, কারণ অজ্ঞতা যেকোনও আলোচনার পরিসরকে পঙ্কিল করে তুলতে পারে। আবার অন্যদিকে কাশ্মিরের মিলিট্যান্ট গ্রুপকে বাদ দিয়েও শান্তি আলোচনার প্রক্রিয়া চলতে পারে না। রাষ্ট্রীয় দমননীতিতে ন্যুব্জ, রাজনৈতিক ও নাগরিক স্বাধীনতা বঞ্চিত, অর্থনৈতিকভাবে জর্জরিত জনগোষ্ঠীর পুঞ্জীভূত ক্ষোভই এই জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। সেই নিরাপত্তাহীনতা থেকেই তারা রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান নিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে পুরো ব্যপারটিকে আরও ঘোলাটে করে দিয়েছে নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য। পাকিস্তানের জঙ্গি অনুপ্রবেশের সঙ্গে এই ভূখণ্ডের মিলিট্যান্ট গ্রুপের নাম জড়িয়ে গিয়ে তাদের মিডিয়া প্রচারিত জঙ্গি অপবাদ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কাশ্মিরের এক মিলিট্যান্ট গ্রুপের নেতার আক্ষেপ, “আপনারা তাদের ইসলামীয় সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে এক সারিতে এনে সন্ত্রাসবাদী অপবাদ দেন, কিন্তু আদতে তারা একদল আহত মানুষের সমাহরণ।” (Asia Watch, Human Rights in India, Kashmir Under Siege)

ভারত রাষ্ট্রের উচিৎ এই ক্ষতের গভীরতা বোঝা এবং পাশাপাশি এটা স্বীকার করে নেওয়া যে কাশ্মিরের বিক্ষোভকারীরা প্রথমেই অস্ত্র তুলে নেয়নি। ১৯৯১ সালে মিলিট্যান্ট গ্রুপের হাতে অস্ত্র ওঠার অনেক আগে থেকেই এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। কিন্তু আজাদির জন্য তাদের এই লড়াই হয়ত শেষমেশ ব্যার্থতায় পর্যবসিত হবে, কারণ ভারত বা পাকিস্তান কোনও রাষ্ট্রই তাদের স্বাধীন ভূখণ্ড হিসাবে দেখতে রাজি নয়। দুই রাষ্ট্রই চায় নিজ ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে কাশ্মিরকে টেনে নিতে। পোস্ট ৯/১১ পিরিয়ডে কাশ্মিরের স্বাধীনতা সংগ্রামী যারা ভারত রাষ্ট্রের দখলদারির বিরুদ্ধে লড়ছে তাদের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিদের মিলিয়ে দেওয়ার নোংরা রাজনৈতিক খেলাটা পাকিস্তান রাষ্ট্র শুরু করেছে। এতে করে কাশ্মিরের সংগ্রামীদের আন্দোলনের মূল সূর কেটে গিয়ে “জঙ্গি কার্যকলাপের” অপবাদ জুটেছে। তাই সংগ্রামীদের উচিৎ এই অশুভ শক্তির প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করা। পাশাপাশি তাদের এটাও বোঝা উচিৎ যে ভারতের এগ্রিমেন্ট ছাড়া তাদের দাবিদাওয়ার বাস্তবায়ন ও আমূল ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই বিক্ষিপ্ত আন্দোলন দিয়ে সমস্যার সুরাহা হবে না। অন্যদিকে পাকিস্তানের স্মরণে রাখা উচিৎ যে কাশ্মির ট্রমা ঘুরিয়ে তাদের নিজদের দেশেই মৌলবাদী অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে কি না এবং গণতন্ত্রহননকারী সেনা অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করছে কি না। পাকিস্তানের ভেবে দেঝা উচিৎ এই যুদ্ধংদেহি মনোভাব দেশের জনসাধারণের মূলবোধ কোন জায়গায় নামিয়ে এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, বিবেচনা করা উচিৎ এর পরিণতি কতটা ভয়াবহ। কাশ্মিরের মানুষের কথা মাথায় রেখে ভারত ও পাকিস্তানকে নিজ রিজিড স্ট্যান্ডপয়েন্ট থেকে বেরিয়ে এসে দ্বন্দ্ব নিস্পত্তিতে পারস্পরিক ভূমিকার কথা স্বীকার করে নেওয়ার সময় এসেছে। প্রতিবেশীর সঙ্গে শান্তি ও সংহতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে দুই প্রতিবেশীরই সমান সদিচ্ছা থাকা দরকার। সেই সদিচ্ছা না থাকলে শান্তি প্রক্রিয়া উদযাপন স্তরেই আটকে থাকবে, বাস্তবায়ন হবে না।