Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এই অনিঃশেষ পঙ্কিল বিষাক্ত আবর্তই আমাদের ভবিতব্য…

কাশ্মির

সব্যসাচী দাস

 

রাজ্যে (জম্মু ও কাশ্মিরে) লাগু থাকা তিনটি বিশেষ আইনই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধীদের সুরক্ষা প্রদান করে। সশস্ত্র বাহিনী (জম্মু ও কাশ্মির)-র বিশেষ অধিকার আইন (আফস্পা) স্পষ্টতই নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্র অনুযায়ী স্থিরীকৃত আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ডের বিরোধী। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এই আইনের ধারাগুলি, যার মধ্যে সাজা থেকে নিষ্কৃতির ধারাও বর্তমান, অতীব বিপজ্জনক এবং মানুষের জীবনের অধিকার ব্যাহত করে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছিল ১৯৯৫ সালে।

দেশদ্রোহী ভঙ্গিতেই লেখাটা শুরু হল। নাচার। ডোপামিন জাতীয় বড়ি-গেলা দেশপ্রেমিকদের সঙ্গে একজাতীয়তার সংশ্লেষণে সম্মত হতে আপত্তি আছে।

আপত্তি থেকে খুব যে লাভ আছে তেমন নয়। এই যে আজ যারা চারিদিকে হিস্টিরিয়া রোগীর মতো বদলা বদলা করছে, কীসের বদলা, সে বদলার শেষ কোথায়, এই যে এতগুলো প্রাণ চলে গেল সেই ঈপ্সিত বদলা তাদের না ফিরিয়ে আনুক, অন্তত রোধ করার নিশ্চিতি দেবে তো ভবিষ্যতে এহেন প্রাণক্ষয়ের— এসব প্রশ্নের উত্তর নেই তাদের কাছে, খোঁজার চেষ্টা বা ধৈর্যও নেই! আছে শুধু নিশির ডাকের মতো দুটো শব্দ— বদলা আর পাকিস্তান। কিন্তু এ তো তাদের দোষ নয়। এই দুঃসহ অজ্ঞানতা এবং নৈরাজ্য দিয়েই আজ আমাদের দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদ সংজ্ঞায়িত। করা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে, অত্যন্ত সযতনে। আমি হয়তো এই নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের সঙ্গে সংশ্লেষণে আপত্তি জানাচ্ছি, কিন্তু অন্য কোনও ক্ষেত্রে নিজের অগোচরেই তাদের সঙ্গেই বসে পড়ছি এক লাইনে!

ডোপামিন আজ নির্ধারক সত্য। তার নিয়ন্ত্রক কর্পোরেট পুঁজি হোক, বা রাষ্ট্র।

কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। থাক এখন।

আমরা ছিলাম কাশ্মিরে। ১৯৯৫ থেকে এবার আসি ২০১৮তে।

২০১৮র ১৪ই জুন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার হাইকমিশনের অফিস (ওএইচসিএইচআর) কাশ্মির নিয়ে তাদের প্রথম রিপোর্টটি প্রকাশ করে। তাতে পরিষ্কার বলা হয়, “গত সাত দশক ধরে কাশ্মিরী জনগণ এমন এক সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে চলেছেন যা অগুনতি মানুষের জীবন নিয়েছে এবং জীবন ধ্বংস করেছে। এই অতীত এবং বর্তমানের সমস্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলিকে চিহ্নিত করে সেগুলির বিচার করা এবং জনগণকে সুবিচার দেওয়া আজ আশু প্রয়োজন।”

এই রিপোর্টেও পরিষ্কার করে ‘সশস্ত্র শক্তি (জম্মু এবং কাশ্মির)-র বিশেষ অধিকার আইন (আফস্পা) ১৯৯০’ এবং ‘জম্মু এবং কাশ্মির গণ নিরাপত্তা আইন (পিএসএ) ১৯৭৮’-কে কাঠগড়ায় তোলা হয় অগুনতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার ধারক ও বাহক হিসেবে। আরও অনেক কিছুই বলা হয়। সব বলে লেখার ভার না বাড়িয়ে লিংক দিয়ে দিলাম।

ভারত সরকার এ রিপোর্ট সরাসরি এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, দুর্বুদ্ধিপ্রসূত ইত্যাদি বলে উড়িয়ে দেয়। যে প্রতিক্রিয়াকে ‘অহেতুক এবং দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর দক্ষিণ এশিয়ার ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছিলেন “ভারত সরকারের উচিত ছিল রিপোর্টটি গ্রহণ করা এবং একটি আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ তদন্তের সহযোগিতা নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া।”

কিন্তু এ সবই ঔচিত্যের কথা। সেসব আমাদের স্বাভাবিক আচরণ নয়। তার বদলে, আমরা বরং এই ২০১৯এ এসে ঠিক ঠিক যা যা ঘটার ছিল তা-ই তা-ই ঘটতে দেখছি।

পুলওয়ামায় সাম্প্রতিক কালের মধ্যে সবচেয়ে বড় আক্রমণ চালানো হল ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর। দেশপ্রেম, বদলা জাতীয় শব্দগুলি কানের কাছে মশার মতো ভোঁ ভোঁ করতে থাকল। বিরোধীরা সরকারকে দোষারোপ শুরু করল। সরকার সেনাবাহিনীকে ফ্রি হ্যান্ড দিল। এখন সেই ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ চলছে এবং চলবে কিছুদিন।

এবং আমরা সেই ফ্রি হ্যান্ডের মানে তত্ত্বগতভাবে বুঝি। কাশ্মিরী জনতা জীবন দিয়ে বোঝেন।

এক ভিশাস সার্কেল। অন্তহীন।

পুলওয়ামার ঘটনার কথা বলতে গিয়ে এইজন্যই এত মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং জনগণের কথা বলতে হচ্ছে। পাকিস্তান পাকিস্তান করলে আমাদের হয়তো কিছু অ্যাড্রিনালিন বেশি ক্ষরিত হতে পারে, কিন্তু তাতে কাশ্মির সমস্যা মেটে না, এই অন্তহীন প্রাণহানিও বন্ধ হয় না। অবশ্য সেটা যে আদৌ করতে চাওয়া হয়, সে নমুনাও নেই। যাই হোক, মূল কথা হচ্ছে জঙ্গিই বলি বা কাশ্মিরের স্বাধীনতা সংগ্রামী, তাদের পাকিস্তান তর্কের খাতিরে যতই মদত দিক না কেন, কাশ্মিরী জনগণের সমর্থন এবং সহযোগিতা না থাকলে তাদের কিছুই করা সম্ভব নয়। এইটা সার সত্য, এবং এর মধ্যেই কাশ্মির সমস্যা সমাধানের মূল মন্ত্র নিহিত। ফলে প্রকৃত হিম্মত এবং সততার কাজ হচ্ছে সেই জনগণকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া, তাঁদের ক্ষোভ বিক্ষোভ অভাব অভিযোগ এবং দাবি নতজানু হয়ে শোনা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া।

ভারত এবং পাকিস্তান কোনও রাষ্ট্রই সেটা করবে না, করতে চায়ও না।

চাইলে যে একটা বিরাট অস্ত্র হাতছাড়া হয়ে যাবে। সাম্প্রদায়িকতার সুড়সুড়ির মতো জাতীয়তাবাদের সুড়সুড়িটাও কম জোরালো তো নয়! মানুষের নজর চমৎকারভাবে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য এ একদম পরীক্ষিত হাতিয়ার ভারতীয় শাসকশ্রেণির। আর তার সঙ্গে ধরুন আমেরিকা সহ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্রের কারবার। এত কিছুর সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করা কি যায়!

তার চাইতে এই দেশপ্রেম জাতীয় শব্দগুলি ঢের ভালো। দেশদুনিয়া উন্নত হচ্ছে, তাই এগুলির সঙ্গে সার্জিকাল স্ট্রাইক জাতীয় উন্নত শব্দ দু চামচ করে মিশিয়ে দিতে হবে এখন। দেওলরা তো সেই কবে থেকেই বলছেন দুধ মাঙ্গলে ক্ষীর দেবেন আর কাশ্মির মাঙ্গলে চিড় দেবেন, আমরাও তো শুনে আসছি দু তিন প্রজন্ম ধরে।

আর ভালো লাশ, রক্ত। কাশ্মিরী জনতার এবং ভারতীয় সেনার। বরফের খাঁজে খাঁজে তাল তাল মানুষের মাংস, সাদা বরফের গায়ে মনুষ্যশোণিতের কালচে লাল ছিটে আর তার আঁশটে গন্ধ… তবে না ফোঁড়া-ফাটা পুঁজের মতো উগলিয়ে ওঠানো যায় দেশপ্রেম!

এই অনিঃশেষ পঙ্কিল বিষাক্ত আবর্তই আমাদের ভবিতব্য… অতএব!