সৌমিত দেব
দেখনদারি। শব্দটার প্রতিশব্দও প্রচুর। যেমন ফাটবাজি, বেশি বেশি, ফুটেজ, অশিক্ষিত ইত্যাদি৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধরুন কোনও সেলিব্রিটি কালচক্রে আপনার বন্ধু৷ হতেই পারে। এইবার আপনি করেন কী, আপনি যে কোনও অছিলায় সেটা সকলকে জানান দিয়ে বেড়ান৷
–সেদিন একটা শুক্তো খেলাম ভাই ওই দোকানটার, কী যে ভাল কী বলব।
–ওই দোকানটাতে? আমি আর রণভীর তো প্রায়ই খাই!
এমন। বিষয়টা চোখে লাগে৷ বিরক্ত লাগে৷ তবে সবচাইতে লাগে আপনার ইজ্জতেই৷ কারণ বিশ্বাস করুন ছাই না করুন, লোকে সব বোঝে। আপনাকে নিয়ে খিল্লিও যে ওড়ায় না তেমনটাও নয়।
এইবার মানুষ জীবটাই জাতে অক্সিমোরন। এরা একাধারে এক্সক্লুসিভ আর সঙ্গে সঙ্গেই আবার একটা বৃহত্তর দলের অংশীদারও হতে চাইছে আজীবন। বা বলা যেতে পারে, তারা এমন একটা বৃহত্তর দলের অংশ হতে চায় যেখানে কিনা তারা সকলেরই মতো, কিন্তু সকলেই তাকে গুরু বলে মানবে। মাথায় করে রাখবে। শুধু একটা সুযোগ। ব্যাস। ঠিক, ভুল, সত্য, অসত্য, শিক্ষা, অশিক্ষা সব ভুলে চালাও পানসি বেলঘরিয়া৷ আগে তবু কিছু অন্তরায় ছিল। কিন্তু বর্তমানে এসে গ্যাছে সোশাল মিডিয়া৷ হুজুগ এল কি ব্যাস৷ পোস্টে পোস্টে ছয়লাপ। বর্তমানটার নাম দেশপ্রেম।
না আমি চল্লিশ জন সেনার মৃত্যু নিয়ে কিছু লিখিনি। কোনও পোস্ট দিইনি। কারণ চল্লিশটা মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহের খবর দেখার পর কিছু লেখা যায় না। হ্যাঁ প্রধানমন্ত্রী নমস্য ব্যক্তি৷ তার পরেও উনি নিজের কর্তব্যে অটুট থেকে শুটিং করেছেন। কিন্তু আমি তো সাধারণ মানুষ। ঠিক ওই চল্লিশজন সেনার মতোই, একেবারে মধ্যবিত্ত, বাড়ির পিছুটান থাকা একজন। ফলে আমার মনেই হয়নি, এটা নিয়ে কিছু লেখা যায়। লিখছিও না। কারণ যাঁরা মারা গেলেন তাঁদের আর তাঁদের পরিবারে প্রতি সহর্মমিতা জানানো, এবং নিজে কষ্ট পাওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই।
এই লেখাটাও যেমন লিখছি সেই ভয়াবহ ঘটনার পরবর্তী ঘটনাক্রম নিয়ে৷
যথারীতি এই ঘটনার পর সকলে দেখল, আরে! এইবার তো রেগে যেতে হবে!
–সে কী? রেগে যাবে? কষ্ট হবে না? ওই যে মেয়েটি শহীদ স্বামীকে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরল, সেই ছবি দেখে তোমার মনের ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে না?
–নাহ! আমার রাগ হচ্ছে।
–সে তো আমারও হচ্ছে। প্রশাসন কেন এমন অপদার্থ হবে যে এতজন মানুষকে নিজের মাটিতে এভাবে মরতে হবে ইনটেলিজেন্স ইনফরমেশন থাকা সত্ত্বেও? জবাব দিতে হবে প্রশাসনকে! চলো আমরা একজোট হয়ে…
–কাশ্মিরী দেখলেই মবলিঞ্চিং করি।
–এমা না! আমি তো সরকারকে প্রশ্ন করার কথা বলছিলাম!
–কী? তুই শুয়োরের বাচ্চা, তুই দেশদ্রোহী!
গত কয়েকদিন ধরে টাইমলাইন খুললেই ঘাবড়ে যেতাম। সকলে এত জোরে দেশভক্তি করছে, এত জোরে যা তা বেরিয়ে পড়েছে সোশাল মিডিয়ার বাইরে। নয় নয় করে তিরিশ বছর মতো বয়স তো হল। মাইরি বলছি লোকের বাড়ি গিয়ে, সেখান থেকে তাকে টেনে বের করে এনে হেনস্থা করার মতো অসভ্যতা কখনও দেখিনি। কখনও ভাবিনি কেবলমাত্র একটা রাজ্যের বাসিন্দা হওয়ার জন্যে এক নিরীহ শালওয়ালাকে এত মারধোর করার মতো নোংরা খবরের সম্প্রচার দেখতে হবে। কে নেই এহেন আখাম্বাপনার দলে। ‘প্লিজ আমার বই কিনুন’ মার্কা ফুটেজখোর নিম্নমানের ‘সাহিত্যিক’ থেকে ‘মাহ লাইফ মাহ রুলজ’ মর্মী তরুণ তুর্কি। বিরাট স্পেকট্রাম। এক মহিলাকে প্রকাশ্যে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বাকি মহিলারা সমর্থন জানাচ্ছেন। ক্যানো? না উক্ত মহিলা ‘দেশদ্রোহী’। ক্যানো দেশদ্রোহী? কারণ মহিলা ডানপন্থী নন, এবং সম্ভবত সরকারকে প্রশ্ন করেছিলেন।
বিগত কয়েক বছরের এই একটা অভূতপূর্ব ধারার প্রচলন হয়েছে। ডানপন্থায় বিশ্বাসী নয় মানেই সে দেশদ্রোহী। অথবা কেউ ‘দেশদ্রোহী’ হলেই সে সিপিয়েম, নকশাল, র্যাডিক্যাল ইত্যাদি৷ একজন তো এই কয়েকদিন আগে আর্বান নকশাল ক্যাটাগরির যে লিস্ট নামিয়েছিলে তাতে করে উনি বাদে বাকি আর সকলেই ওই ক্যাটাগরিভুক্ত। এবার এই যে দেশদ্রোহী বলা হয়, সেটা কাদের বলার কথা? যারা দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছে, দেশের গূঢ় তথ্য বাইরে পাচার করেছে, অথবা দেশে নাশকতা চালাতে চাইছে বা এই সবেতে মদত দিচ্ছে ইত্যাদি। তাই তো? এদের দেশদ্রোহী বলা হলে কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। আমারও নেই৷
কিন্তু সমস্যাটা হল বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের যে কোনও নীতি, পদক্ষেপ, যাই হোক না ক্যানো তাই নিয়ে দ্বিমত পোষণ করলেই, একটাও প্রশ্ন করলে সমর্থকরা আপনাকে দেশদ্রোহী অথবা বামপন্থী তকমায় দাগিয়ে দেবে।
–আমাদের পনেরো লাখ কই?
–দেশদ্রোহী! নকশাল!
–দেশে কৃষক আত্মহত্যা নিয়ে কিছু বলবেন?
–তুই দেশদ্রোহী! সিপিয়েম!
–আরি! ই কীরে! আমি আমার নিজেরা দেশটা যাদেরকে চালাতে দিয়েছি তারা আমায় উত্তর দিতে দায়বদ্ধ।
–‘পাকিস্তানে যা!’
হ্যাঁ আমিও চাই নাশকতাবাদী দমন হোক। সমস্ত জঙ্গিঘাঁটি পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়ে যাক। হ্যাঁ আমি চাই এমন একটা দিন আসুক যখন নিজেদের পরিবার প্রিয়জনদের ছেড়ে, সেনাদের আর সীমান্তে পাহারা দেওয়ার দরকারই পড়বে না। কিন্তু এটাও ঠিক এসবই ইউটোপিয়া মাখা। গোটা পৃথিবীটা যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে এ সব চিন্তা অমূলক। কিন্তু একদিন তো হবে। নিশ্চয়ই হবে।
দেখনদারি। শব্দটার প্রতিশব্দও প্রচুর। যেমন ফাটবাজি, বেশি বেশি, ফুটেজ, অশিক্ষিত ইত্যাদি৷ এই যে আপনি হঠাৎ করে বুঝলেন এইবার কদিন টু-লাইনারে বেয়োনেট, সীমান্ত ইত্যাদি জুড়ে দিলেই বেশি লাইক জুটবে। এটা তারাই সবচাইতে বেশি করছে যাদের সবচাইতে কম আসে যায়৷ কিন্তু এর ফল এতটা সুদূরপ্রসারী, এতটা, যে এই সেইদিন এক ভক্ত ধরা পড়ার পর যখন তাকে গণপিটুনির হাত থেকে বাঁচানো হচ্ছে তখনও সে বলে চলেছে— ‘বেশ করেছি, দেশদ্রোহীকে মেরেছি’।
এই যে আমরা নিজেরাই নিজেদের ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে এত সুচারুভাবে এগিয়ে চলেছি, ওরা এটাই চায়। আমরা ধর্ম, রাজ্য, জাতি, লিঙ্গ ভেদাদেদে একে অপরকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলি। ওরা কারা? ওরা সেই নাশকতাবাদীরা যারা কাশ্মিরে এই ঘৃণ্য অপরাধ করেছে। তাদের উচিত এবং কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তিই হওয়া উচিৎ। আর সেটা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে হবে না। একজোট হতে হবে। দেশটার স্বার্থে।
কিন্তু নিশ্চিন্তির কথা হচ্ছে, এখনও এই এতকিছুর পরেও নিহত জওয়ানে স্ত্রী যুদ্ধ চান না, হিন্দুরা মুসলিম যুবককে গণপিটুনির থেকে বাঁচায়, মুসলিমরা জাতীয় পতাকা হাতে রাস্তায় বেরিয়ে মিছিল করে, মানুষ সোশাল মিডিয়ায় নিজের নম্বর শেয়ার করে বলে তার শহরের কোনও কাশ্মিরী মানুষ যে কোনও সাহায্যে যেন তাকে ফোন করে। এটাই আমার দেশ৷
রাস্তায় ময়লা না ফেলে, টিকিট ছাড়া ট্রেনে না উঠে, ট্যাক্স ফাঁকি না দিয়ে দেখুন, গলা ভারী স্টেটাস দিয়ে তারপরে তার কাউন্টারের কাউন্টার স্টেটাস দিয়ে, প্রমাণ করতে হয় না দেশকে ভালোবাসি না বাসি না। সেনারা দিবারাত্রি সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে যেমন, নিজের কর্তব্যটুকু করুন। আপনার দেশ, আপনার থেকে ওইটুকুই চায়। আপনি একজন ভালো, সুচিন্তিত নাগরিক হয়ে উঠুন।
এতে বেয়োনেটের সাথে ক্ল্যারিনেট দিয়ে ছন্দ মিলে যাবে।
ও হ্যাঁ আমি তখনও লাইক করব না।
আমার গদ্য কবিতা পছন্দ।