কাজী লাবণ্য
অষ্টম ক্লাস শেষে তোজা দফতরি ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দেয় ঢং… ঢং… ঢং… নিজকক্ষে বসে হেডস্যার কপাল কুঁচকে কব্জি উলটে ঘড়ি দেখেন, আবার দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির দিকে তাকান, হ্যাঁ যা ভেবেছেন তাই— আঠেরো সেকেন্ড আগেই ঘণ্টা বাজানো হয়ে গেছে। তাঁর অভিজ্ঞ বয়স্ক কপাল আরও কুঞ্চিত হয়। তিনি সাংঘাতিক রেগে যান। কিন্তু এখন আর কিছু করার নাই। মনে মনে ঠিক করে রাখেন তোজাকে সপ্তাহ শেষে ধরবেন। আঠেরো সেকেন্ড যে অনেক সময় সেটা ভোলানাথ দফতরি তোজা কী বুঝবে!
ঘণ্টা পড়লেই উপুর করা বোতলের জলের মতো পুরো স্কুল হুড়মুড় করে বেরুতে চায়, কিন্তু হেডস্যারের কড়া নির্দেশে প্রতি কক্ষের দরোজায় ক্লাস টিচার দাঁড়িয়ে থাকেন। বালিকারা আগে সবাই বের হয়ে যাবে তারপর বালকেরা। এই নিয়ম মেনে চলা হয় বলে কোনও বিশৃঙ্খলা হয় না। নিয়মকানুন, সুস্থ প্রতিযোগিতা ও মানসম্মত লেখাপড়ার জন্য এ স্কুলের সুনাম আছে।
আটটি ক্লাস শেষে ছাত্র ছাত্রীরা সবাই খুব ক্লান্ত হয়ে পরে। সবারই বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে। আসিফা আর সরকার আণিকা সুলতানা বাড়ির পথ ধরে। সপ্তাহে তিন দিন অষ্টম পিরিয়ডে শরীরশিক্ষার ক্লাস থাকে। স্কুলে একজন নতুন ম্যাডাম এসেছেন, তিনি অন্য সাবজেক্টের হলেও শরীরশিক্ষার ক্লাসও নেন, নিজে আগ্রহ করে মেয়েদেরকে নানা বিষয়ে জ্ঞানদান করেন। মেয়েরা সবাই এই নতুন ম্যাডামকে খুব পছন্দ করে। ম্যাডাম বিশেষত মেয়েদেরকে জীবনের জন্য যা যা আবশ্যক, তার বাস্তব শিক্ষা দেন। আজকাল যে প্রায় পদে পদে মেয়েদের বিপদ তা তিনি বিস্তারিত বুঝিয়ে বলেন। তিনি বলেন— “তাই বলে বিপদের ভয়ে ঘরে বসে থাকলে চলবে না, মেয়েদের শিক্ষিত হতে হবে, প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, এবং আত্মনির্ভরশীল হতে হবে, শোনো তোমরা পুতু পুতু হবা না। কেবল রূপচর্চা করলে হবে না, নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবা, নিজের পায়ে দাঁড়াবা, জীবনে কাজ করতে হবে, আর সম্মানজনক একটি কাজ পেতে হলে আগে খুব ভালোভাবে লেখাপড়া করতে হবে। আজকাল এক ফ্যাশন হয়েছে স্লিম হওয়ার ফ্যাশন— তাতে না খেয়ে খেয়ে সবাই অপুষ্টিতে ভুগছে, তোমরা তা করবা না, এখন তোমাদের উঠতি বয়স। সব ধরনের খাবার প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে আর দৌড়ঝাঁপ, ব্যায়াম ইত্যাদি করতে হবে।” তিনি বাল্যবিবাহের অপকারিতা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, প্রতিমাসে মেয়েদের যে মাসিক হয় সেসব নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন “এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এতে লজ্জার কিছু নেই আর এই সময়ে বিশেষ পরিচ্ছন্নতা দরকার।” অর্থাৎ একটি মেয়ের বেড়ে ওঠার কালে যা যা শেখা দরকার তিনি তা খোলামেলাভাবে বিশ্লেষণ করেন। অথচ মেয়েরা এসব ব্যপারে ভীষণ লাজুক ও অজ্ঞ ছিল। দেশে কোথায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তা তিনি মেয়েদেরকে জানান এবং কীভাবে সাবধান হওয়া যায় তাও শিখিয়ে দেন। তিনি বলেন “তোমাদেরকে আত্মরক্ষার কৌশল শিখতে হবে।” তিনি হাতে ধরে জুডো ক্যারাটের কিছু কৌশল শেখান এবং ছোটখাটো ছুরি, ব্লেড বা মরিচের গুঁড়ো সাথে রাখতে বলেন এবং বলেন বেকায়দা রকম বিপদে পড়লে ব্লেড চালাতে দ্বিধা করবা না।
নতুন ম্যাডাম যে কত ভালো আর কত কিছু জানেন আবার দেখতেও কী যে সুন্দর সেই আলাপ করতে করতে নাক থেকে কানের দূরত্বের মতো পথ পেরিয়ে আসিফা ও আণিকা নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছে যায়। পৌঁছানোর আগে জোড়া বটপাকুড়তলায় সেই হারামজাদা মিন্টু নিত্যকার মতোই ওদের জ্বালাতন করে। স্বভাবমত আণিকা তো ভয়েই মরে যায়, আসিফা আজ চড়া গলায় ওকে ওয়ার্নিং দেয় “তুই আর একদিন যদি বদমাইশি করিস, আমি কিন্তু সোজা দাদাজানকে বলে দেব, তারপর ঠ্যালা বুঝিস।”
“এহ তোর ঐ বুড়াভামকে ইয়া দিয়াও পুছি না! দাদাজানের ভয় দেখাস! তোর ঐ বুড়া আমার ঘণ্টা করবে! খাঁড়া তোরে খালি পাইয়া লই মজা দেখাব আমি, রেডি থাকিস তরে খাইতে আমি আইতাছি” বলে অতি দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়।
##
আসিফা হাতমুখ ধুয়ে ঢেকে রাখা ভাতের থালা নিয়ে খেতে বসে। স্কুল থেকে ফিরলে ওর রাক্ষসের মতো ক্ষিধা পায়। মনে হয় আস্ত একটা হাতি ধরে নুন মরিচ মাখিয়ে খেয়ে ফেলতে পারবে। খেয়ে উঠেই সে উঠানে মেলা কাপড়চোপড় তুলে ভাঁজ করে রাখে, রাতের রান্নার যোগাড়, যেমন শুকনো পাতা, ডাল ইত্যাদি চুলার পাশে এনে রাখা, পানি এনে রাখা, হাসমুরগি ঘরে তোলা, কবুতরের খোপের ঝাঁপ ফেলে দেয়া আর যা যা টুকটাক কাজ করে রাখে। মা ও বড়বোনের হাতের কাজ এগিয়ে রাখে, কারণ সন্ধ্যার পরে সে প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়তে বসে। আণিকাকে পড়ায় যে টিচার সেখানে সেও নিয়মিত পড়ে।
##
রাতে তিনি দুধ রুটি খান শেষ পাতে একটি কলা। ক্ষেতের গম ভাঙিয়ে সেই আটার রুটি, বাড়ির গাইয়ের দুধ আর নিজের ক্ষেতের কলা। জীবনের অপরাহ্নে এসে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে তিনি খুবই সাবধানী হয়েছেন। মেপে খান, ভেজালবিহীন খাবারের বিষয়টা মাথায় রাখেন আর প্রচুর হাঁটাহাঁটি করেন বলে বয়স হলেও আজও তিনি বলশালী আছেন। নীরোগ বলা যায় তাকে, দেশে এখন সকলেই যে গণহারে ডায়াবেটিস ও হাই ব্লাডপ্রেসারে আক্রান্ত তা থেকে তিনি মুক্ত। খাবারের সময় পাশে বসে থাকে পুত্রবধূ অর্থাৎ আণিকার মা। আণিকার দাদী রাতে কিছুই খান না। তিনি মাগরিবের নামাজে বসে একবারে এশার নামাজ পড়ে তারপর উঠেন। তখন সরকারবাড়ির দেয়ালের পুরনো ঘড়িতে ১, ২, ৩ করে ১২টা বাজার ঘোষণা আসে। এরপরে আবার তিনি তাহাজ্জত পরেন, কোরান শরীফ তেলাওয়াত করেন। সংসার থেকে তিনি একেবারেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। শুধু কি সংসার! জীবন থেকেও… হতে পারে কোনও অভিমান বা চরম বিবমিষায় তিনি নিজেকে যেন গুটিয়ে নিয়েছেন। কেবল মেজ নাতনী এই আণিকার উপর উনার রয়েছে গভীর দুর্বলতা। আণিকা দাদীর সাথে ঘুমায়। সে মাঝে মধ্যে ভোররাতে লেখাপড়া করে আর দাদী ইবাদত করে।
পৃথিবীতে আসারপর থেকেই এই মেয়েটি শারীরিক মানসিক দুদিক থেকেই খুব দুর্বল। জন্মের পরই তার বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিয়েছিল, নেহাত টাকা আর ঢাকার বড় চিকিৎসকদের ঐকান্তিক কল্যাণে বেঁচে যায়। লেখাপড়া সেভাবে করতে পারে না।
কিন্তু যার দাদা এলাকার একচ্ছত্র ক্ষমতাবান মানুষ, অর্থবিত্তের মালিক, একসময় জনপ্রতিনিধিও ছিলেন, শেষবয়সে এসে খানদানি মানুষ হবার চেষ্টায় কাতর, বলাবাহুল্য তিনি যেভাবেই হোক নাতনিকে শিক্ষিত করবেনই। তাছাড়া আজকাল তিনি নিজেকে পাল্টে ফেলতে চাচ্ছেন, নামের আগে গত তিন বছর ধরে আলহাজ্ব লিখছেন, এলাকায় এতিমখানা, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন, আসিফা ও আণিকা যে স্কুলে পড়ে সেখানেও তিনি মোটা অংকের ডোনেশন দিয়ে থাকেন এবং স্কুল সমিতির সভাপতি তিনি। নিজের ছেলেমেয়েদেরকে ভালোভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, তারা সকলেই শহরে থাকে। কেবল কনিষ্ঠ পুত্র ও তার পরিবারকে নিয়ে তিনি এই মফঃস্বলে থাকেন।
তার বংশে কেউ লেখাপড়া করবে না তা তো আর হতে পারে না, এজন্যই আণিকা আর আসিফার গাঢ় বন্ধুত্ব। আসিফা ছাত্রী ভালো, আর আণিকার দাদার অর্থনৈতিক দিক ভালো। দুই ভালো মিলেমিশে এক হয়ে পথ চলছে সেই প্রথম শ্রেণি থেকে এই নবম শ্রেণি পর্যন্ত। আসিফা প্রতিটি ব্যাপারে, প্রতিটি কাজে আণিকাকে সহযোগিতা করে, ওর সঙ্গে সঙ্গে থাকে, কিছু ফুটফরমাশ করে দেয়। যেমন পরীক্ষার হলে বসে আসিফার খাতা খোলা থাকে আণিকার জন্য— দুই পরিবারের এমনই সমঝোতা হয়ে আছে। আর বড় কথা, এখন দুজন দুজনের প্রাণের বন্ধু।
আণিকার দাদার বিশাল লিচু, আম, কলাবাগানের বিশ্বস্ত পাহারাদার আসিফার বাবা। বহু পুরনো কর্মচারী। সে কৃষিকাজ বা গৃহস্থালি কাজ তেমন কিছুই পারে না, কিন্তু তার বিশ্বস্ততার ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নাই। সে আবার একজন বিরাট গায়েন। নিজে নিজে গান বাঁধে, গান গায়। বলশালী এক সুদর্শন যুবক যে দরাজ গলায় গান গেয়ে বেড়াত, গ্রামে যার কাজ নাই ঠিকানা নাই শেকড় বাকর কিছুই নাই, এমন এক অকর্মা কিন্তু বিশ্বস্ত মানুষকে আণিকার দাদা জেনে বুঝে বহু বছর ধরে পাহারাদার নিযুক্ত করে রেখেছেন। আসিফার মা আণিকাদের বাসায় রান্নার কাজ করে।
আসিফারা ৪ ভাইবোন। ওর গায়েন বাপ নিজে মেয়েদের নাম রেখেছে। মেয়েদেরকে সে অত্যধিক মায়া করে। সবগুলো ছেলেমেয়েই স্কুলে যায়, অন্যেরা তেমন না হলেও ছোটমেয়ে আসিফা লেখাপড়ায় ভালো, বেশ ভালো। স্কুলের শিক্ষকগণ, এলাকার মানুষজন, দাদাজান সবাই জানে গানেওয়ালার ছোট মাইয়াটার মাথা ভালো।
##
বারান্দায় পাতা চৌকিতে পাটি বিছানো, তার উপরে ছড়ানো ছিটানো বই খাতা কলম পেন্সিল জ্যামিতি বক্স, পেন্সিল কাটার ব্লেড, স্কেল… এখানে বসে বসেই আসিফা রোজ ভোরে নিজের পড়া তৈরি করে…
পরীক্ষা চলছে। রাত জাগতে পারে না বলে সে শেষ রাতে উঠে পড়ালেখা করে। বাড়ির এবং স্কুলের টিচারের দেয়া অনুশীলনীগুলো সে বারবার পড়ে একদম ভাজা ভাজা করে ফেলে। স্কুলে ইতিহাস পরীক্ষা। মুখস্থ করা সাম্রাজ্যের কাহিনীগুলো সে আরেকবার ঝালাই করে নিচ্ছে…
“বাবর মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কো-মঙ্গোল বংশোদ্ভূত শাসক। বাবার দিক থেকে তিনি তৈমুর লং ও মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। মধ্য এশিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে বাবর ভারতে ভাগ্য নির্মাণে নিয়োজিত হন। তিনি নিজেকে কাবুলের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন এবং আফগানিস্তান থেকে খাইবার পাস হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন…”
বই উল্টিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করে সে দাড়ি কমা সহ মুখস্থ বলতে থাকে… জোরে জোরে পড়া বলা ওর আজন্মের অভ্যাস। প্রতিটি ভোরে ওর বাবা মা ঘুমের মধ্যেই মেয়ের পড়া শুনে আরও তৃপ্তি নিয়ে ঘুমায়…
হাতে কদিন আগে শহর থেকে দাদাজানের আনা পেন্সিলবক্স। আণিকার একটি আর ওর একটি। বক্সটি এত সুন্দর! দুদিকেই খোলা আর বন্ধ করা যায়, ডালার মাথায় চুম্বক লাগানো থাকায় আপনাআপনি ডালা লেগে যায়। আসিফা মনের মতো করে বক্সটি সাজিয়েছে। আনমনে সে ডালাটি খোলে, বন্ধ করে আর দুলে দুলে ইতিহাস উগড়ায়।
ছানাগুলি আজ মায়ের গা ঘেঁষে আরও পাখার তলে যায়, ফিসিফিসিয়ে বলে “মা ভয় করছে, আজকের ভোরটা এমন কালো কেন মা?” মা বলে “কোনও ভয় নেই বাছা, এই তো তোমরা উড়তে শিখে যাচ্ছ, ডানা শক্ত কর যেন উড়তে পারো, ঠোঁট শক্ত কর যেন খাবার খুঁটে খেতে পারো, এখন আমি যাব তোমাদের জন্য খাবার আনতে…” “না মা না, তুমি যেও না বড় ভয়, বড় ভয়…” কবুতরের খোপে ডানা ঝাপটানোর শব্দ পাওয়া যায়…
আসিফা একবার খোপের দিকে তাকায় আর উচ্চকিতভাবে আওড়াতে থাকে—
“বীভৎস ধ্বংসলীলা ও নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে তার প্রতিটি আক্রমণ ও বিজয় পরিচালিত হয়েছিল, এ কারণে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ তাকে ‘ঈশ্বরের অভিশাপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কোনও দেশ দখল করার পর তিনি পরাজিত সম্রাটদের কাউকেই বাঁচিয়ে রাখতেন না। এমনকি শিশুদেরকেও না। জ্যান্ত শিশুদের বুক চেরা দেখতে তিনি খুব ভালোবাসতেন, সেই সঙ্গে ভালোবাসতেন শিশুদের টকটকে কলিজা তার প্রিয় চিতাদের খাওয়াতে। বস্তুত পৃথিবীর সব প্রাচীন শাসকরাই ছিলেন নিষ্ঠুর ও কসাই। অতীতে শাসকদের মধ্যে কে কত ধরনের নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে তার একটা প্রতিযোগিতা চলত। তাদের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ছিলেন মোঙ্গল শাসক চেঙ্গিজ খান…”
একেবারে আচমকা পেছন থেকে কীসে যেন ওকে জাপটে ধরে, আমাজনের পাইথনের মতো পেঁচিয়ে ধরে… কে! জীন ভূত নাকি! শক্তিশালী হাতে বেষ্টন করে আরেক হাতে মুখ চেপে ধরার ফলে ওর ভয়ার্ত ‘ও… মারে…’ আর্ত চিৎকারটা কোঁত করে গলা দিয়ে আবার নেমে যায়…
কানের কাছে ফিসফিস—
“ভয় পাস না, আমি! আমি!” আমির কণ্ঠস্বর শুনে সত্যিই ওর ভয়টা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায় কিন্তু ভয়ের জায়গায় অন্য কী এক অজানা অনুভূতি ওকে গ্রাস করে… ও ঠিক ভেবে পায় না, বুঝতে পারে না… শরীর নিস্তব্ধ হয়ে আসে, চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে যায়, কেমন যেন বমি বমি লাগতে থাকে। নাহ জীন ভূত বা জঙ্গলের বাঘ ভালুক নয়… তাই বলে! মেয়েদের সহজাত বিবেচনায় পুরো ব্যাপারটা ওর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। জীন ভূত বা বাঘ ভালুক হলেই বুঝি ভালো হত, এমনকি একটা পাইথন! ওদিকে কানের কাছে ফিসফিসানি চলতে থাকে… “সোনা ময়না! আমার যাদুপাখি! কত বড় ডাঙ্গর হইছিস, এ্যাঁ! নিত্য নিত্য দেখি, চোখের সামনে লকলক করে এক্কেরে ডবকা হয়া গেলি! এ্যাঁ! এরম কলা গাছের লাহান কবে হইলি রে! ক্যামনে কী হইল! কী যে সুন্দর হইছিস মাশাল্লাহ… তোকে স্বর্ণের হার বানায় দেব, তোরে আমি অনেকদূর লেখাপড়া শেখাব… ভয় পাস না, একটুও ব্যথা পাবি না…”
চকিতে নতুন টিচারের কথা মনে পড়ে যায়… ততক্ষণে শক্ত অসুরের হাত ওকে চৌকির ওপর শুইয়ে ফেলেছে, বইখাতা, পেন্সিলবক্সধরা হাতটি শরীরের নিচে, বাইম মাছের মতো পিছলে হাতটি সে বের করে নেয়। আসছে… আসছে… একটা থলথলে শুয়োর হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে… শুয়োরের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে, জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছে, ঘোঁত ঘোঁত লাভা ঝরছে…
হঠাত একটা বড় ঘোঁত মাঝপথে আটকে যায়! থেমে যায়! স্তব্ধ হয়ে যায় দানব! রেলের উপর মালগাড়ি হার্ডব্রেক করে, দানবীয় আবেগ কোঁত করে গিলে ফেলে দুই হাতে পরনের কাপড়ের পোটলা তলপেটের উপর চেপে ধরে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে কুঁজো হয়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়…
“আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম…” ঘুম হইতে নামাজ উত্তম ভেসে বেড়ায় বাতাসে বাতাসে…
দানবের কানে এ আহ্বান পৌঁছায় কি?
##
আণিকা ও আসিফা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। ইতিহাস পরীক্ষা। চেঙ্গিজ খান, হালাকু খানের কোন প্রশ্ন আজ আসতে পারে, দু এক কথার পরই আণিকা বলে “জানিস দাদাজানের কী যেন হইছে, ডাক্তারকাকু আসছে আরও কে কে যেন আসছে, কিন্তু ঘরের দরোজা ভেতর থেকে লাগানো আমার বড্ড ভয় করছে রে…”
ওদের পাশ দিয়ে একটা এ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজাতে বাজাতে দ্রুত চলে যায়…
নির্বিকার আসিফা নিজ মনে ইতিহাস আওড়াতে থাকে, পরীক্ষার সময় অন্য কিছুতে মন দিতে রাজী নয় সে। ভীতু আণিকার বড় তাজ্জব লাগে, কারণ আসিফা তো দাদাজানকে বড্ড ভালোবাসে, তাহলে!…