Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নীচু তলা থেকে দেখা জনস্বাস্থ্য : যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ

যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ

ছন্দা চক্রবর্তী

 

গল্প তো অনেক রকম হয়। তা এ গল্প হল রোগের; এমন সব মারাত্মক রোগের, মানবসমাজে যাদের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের, এত উন্নতি ও অগ্রগতির পরেও যাদের আজও নির্মূল করা যায়নি। একটু ভুল বললাম, আসলে শুধু রোগের নয়; রোগীরও গল্প। আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গের এক কোণে অখ্যাত এক গ্রামাঞ্চলের কিছু যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ রোগীদের গল্প। তারা ও তাদের চোখ দিয়ে দেখা সরকারি জনস্বাস্থ্য পরিষেবা, স্বাস্থ্যকর্মীদের যথাসাধ্য চেষ্টা এই সব সংক্রামক রোগীদের জন্যে, এই সব মিলিয়ে মিশিয়ে এই লেখা। গল্প বলছি বটে এই লেখাকে। আসলে ২০১৩ সালের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা— কিছু স্বচক্ষে দেখা, কিছু স্বকর্ণে শোনা। তাই গল্প হলেও সত্যি।

আমাদের আখ্যান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার এক গ্রামাঞ্চল নিয়ে। গ্রামাঞ্চল মানে বিশুদ্ধ “রুরাল এরিয়া”— চাষবাসের জমি, গাছপালা, মাঠ, পুকুর, তার মাঝে মাঝে ছড়ানো ছিটোনো কিছু বাড়িঘর, অধিকাংশই কাঁচা। এই সব নিয়ে জনপদ। গ্রামের সাধারণ লোক, বিশেষ করে গরিবগুর্বো লোক, যেমন করে থাকে আর কি। রাস্তা বলতে লাল মাটির মেঠো রাস্তা। ক্ষেত পেরিয়ে, মাঠ ছাড়িয়ে লাল মাটির পথ এঁকে বেঁকে হুই দূরে চলে গেছে। তাই দিয়ে সাইকেল, মোটরবাইক, পায়ে হাঁটা। পাকা রাস্তা মানে পিচঢালা বাসের রাস্তা; সে তো সেই অনে-এক দূরে।

এমনি গ্রামের পর গ্রাম, একের পর আরেক। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় গ্রামই তো বেশি। ২০১১-র জনপরিসংখ্যান বলছে পশ্চিম মেদিনীপুরে অধিবাসীদের শতকরা প্রায় অষ্টাশি জন গ্রামবাসী। আগের থেকে অনেক পাল্টেছে পশ্চিম বাংলার গ্রাম, তবু সবটা তো পাল্টায়নি। তার ওপর পশ্চিম মেদিনীপুরে গ্রামীণ দারিদ্র্যের হার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের তুলনায় অনেকটাই বেশি। শতকরা প্রায় ৪৪ জন দারিদ্র্য সীমার নিচে। তাই এদিকের গ্রামগুলোর অনেকগুলোতেই দারিদ্র্য ও অনুন্নয়নের ছাপ নানা জায়গায় এখনও স্পষ্ট।

জাতীয় পঞ্চায়েত নির্দেশিকা অনুযায়ী আশপাশের ন-দশটি গ্রাম মিলিয়ে ওরই মধ্যে একটু বড় ও বর্ধিষ্ণু একটি গ্রামের গ্রামপঞ্চায়েতের ওপর বাকি অনুন্নত গ্রামের দেখাশোনার ভার দেওয়া থাকে। এইরকম একটি একটু বড়, ও তুলনায় বর্ধিষ্ণু, একটি গ্রামের উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রতে আসা রোগীদের নিয়ে এই লেখা। ২০১৩ সালের পর পাঁচ বছর কেটে গেছে, হয়তো কিছু বদল হয়েছে। কিন্তু এই লেখাটিতে আমি ২০১৩ সালের কথা যেমন দেখেছি ও শুনেছি, তেমন বলেছি।

একটিই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র; ব্লকের এই গ্রামের এবং আশপাশের আরও আট নটা গ্রামের সব মিলিয়ে প্রায় আট-ন’ হাজার লোককে স্বাস্থ্যপরিষেবা দিয়ে থাকে। এই উপকেন্দ্র থেকে রিপোর্ট যায় নিকটস্থ গ্রামীণ হাসপাতালে, সেখান থেকে জেলা হাসপাতালে।

২০১৩ সালে দেখেছিলাম উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রটি গ্রামপঞ্চায়েতের অফিস বাড়িতে। দোতলা, পাকা বাড়ি; নানা সরকারি অফিস তার মধ্যে, দেওয়ালে কত রকম নোটিস ও পোস্টার। তার মধ্যে একতলায় একটি ঘরে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের নিজস্ব কোন বাড়ি নেই[1]। কাজেই সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র মানে একতলায় একটি ঘর, বারান্দা মিলিয়ে। ঘরটি বসবার চেয়ার, কাজের টেবিল, জিনিসপত্র রাখার জন্য সেলফ, নানা মেডিকেল ‘কিট’ ইত্যাদিতে ভর্তি। ওরই মধ্যে এক দিকে পর্দা টাঙিয়ে একটু আব্রুআড়ালের ব্যবস্থা, পিছনে একটি ছোট খাট– “ওই যারা ‘কপার টি’ পরাতে আসে তাদের জন্য”। কর্মী বলতে দু জন ‘এএনএম’ (সহায়িকা সেবিকা ধাত্রী)। তাঁদের মধ্যে একজন এই কেন্দ্রে গত পঁচিশ বছর ধরে আছেন। কথোপকথনে তিনিই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁকে এ লেখায় ‘দিদি’ বলে উল্লেখ করব। এছাড়া সরকারি তথ্য অনুযায়ী তখন এই সেন্টারে ছজন ‘আশা’ (Accredited Social Health Activist) কর্মী থাকার কথা। সকলেই মহিলা।

এ অঞ্চলে জনস্বাস্থ্যের বিচারে প্রধান অসুখবিসুখ বলতে ‘টিবি’ অর্থাৎ যক্ষ্মা, আর কুষ্ঠ। না, না, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, জ্বরজারি, পেটের অসুখ এসব তো আছেই। কিউলেক্স মশা-বাহিত ‘হাইড্রোসিল’ রোগও এখানে ভালোভাবেই উপস্থিত। কিন্ত অতি প্রাচীন দুটি মহাব্যাধি, যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ, এখনও এ অঞ্চলে ভালোমতো বিদ্যমান। শুনে একটু অবাক লাগতে পারে, কিন্তু এটাই সত্যি। যক্ষ্মার ব্যাপারে তবু খানিকটা আন্দাজ হয়ত করা যায়, কারণ তথ্য বলে ভারতে যক্ষ্মারোগীর সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে সব চেয়ে বেশি। কিন্তু অনেকের ধারণা দেশ থেকে কুষ্ঠ বুঝি বেশ কিছু বছর আগেই নির্মূল হয়েছে। তা প্রচলিত ধারণা যাই হোক, চিকিৎসাজগতে যতই বৈপ্লবিক উদ্ভাবন হোক না কেন, এ অঞ্চলে আজও, এই একবিংশ শতাব্দীতেও, যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ দুটিই রোগই বিদ্যমান, এবং দুটি রোগেরই নতুন সংক্রমণ এখনও হয়েই চলেছে। এ তথ্য সরকারিভাবেও স্বীকৃত[2]। এক এক করে সে গল্প বলি।

জাতবিশেষে রাজরোগ : গল্প ১

যক্ষ্মা থেকে মৃত্যুহার কমাতে, ও নতুন সংক্রমণ নিবারণ করার জন্যে ভারত সরকারের RNTCP[3] প্রোগ্রামের অন্যতম লক্ষ্য হল নতুন যক্ষ্মা সংক্রমণের অন্তত ৭০% কেসগুলিকে সঠিক সনাক্ত করা, ও এই ধরনের কেসের অন্তত ৮৫% নিরাময় করা। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রতেও সেই লক্ষ্য সামনে রেখে চেষ্টা চালানো হয়। শুনেছিলাম প্রতি মাসে নতুন পুরনো রোগী মিলিয়ে গড়ে ১০-১২টি যক্ষ্মা রোগী এই কেন্দ্রে বিনামূল্যে চিকিৎসা পেয়ে থাকে। ভাগ্যক্রমে এই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে তখনও অবধি ‘এমডিআর টিবি’ (Multi Drug Resistant-TB)-র রোগী কেউ ধরা পড়েনি[4]

২০১৩-র মে মাসে রেজিস্টারে দেখেছিলাম এই কেন্দ্রে ৯টি যক্ষ্মা রোগী চিকিৎসা পাচ্ছে; ৭ জন পুরুষ, ২ জন মহিলা। দেখলাম ঐ ৯ জনের ৮ জনই ‘আদিবাসী’ সম্প্রদায় থেকে! এটা কি রকম ব্যাপার? নিছক এককালীন সমাপতন, নাকি তার থেকে বেশি কিছু? দিদি জানিয়ে ছিলেন এ অঞ্চলে এটাই ঘটনা; যক্ষ্মা ‘আদিবাসীদের’ মধ্যেই বেশি।

এখানে বোধহয় একটু ব্যাখ্যার দরকার। আমরা সাধারণত ‘আদিবাসী’ বলতে সমগ্র তপশিলি উপজাতিদের মেলানো মেশানো একটা অস্তিত্ব বুঝে থাকি। কিন্তু সে হল শহুরে লোকেদের বোঝা। এ অঞ্চলের লোকেরা বিভিন্ন তপশিলি উপজাতির লোকেদের দেখতে ও সঙ্গে বসবাস করতে অভ্যস্ত। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় সমগ্র জনসংখ্যায় তপশিলি উপজাতির উপস্থিতি যদি ১৪.১% হয়, তবে সরকারি হিসেব অনুযায়ী এ অঞ্চলে তাদের ১৫.৭৪% উপস্থিতি[5]। এই সব অঞ্চলে স্থানীয় লোকেরা ‘আদিবাসী’ বলতে বোঝে কোল, ভীল, মুন্ডা— এই সব উপজাতিদের, আর বিশেষ করে সাঁওতালদের। শবরদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়। যদিও তারাও জঙ্গলের বাসিন্দা ও জঙ্গলের কাঠ নিয়ে তাদের জীবিকা, তবুও স্থানীয় লোকেদের চোখে ‘আদিবাসীদের’ থেকে তাদের  সমাজ ও অবস্থান আলাদা। যেমন, গ্রামের মধ্যে আলাদা ‘শবর পাড়া’, সেটা ‘আদিবাসীদের’ নিবাস নয়। আমাদের আলোচ্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অধীনে যে সব গ্রাম, সেখানে কোল, ভীল, মুন্ডা, এ সব উপজাতি নেই। আছে সাঁওতালরা। তাই দিদির “আদিবাসীদের মধ্যে যক্ষ্মা বেশি” এই মন্তব্য প্রসঙ্গে বুঝতে হবে ‘আদিবাসী’ বলতে এখানে সাঁওতালদের কথাই প্রধানত বলা হচ্ছে।

দিদি আরও বলেছিলেন ‘আদিবাসীদের’ তুলনায় অন্যান্য তপশিলি উপজাতি, যেমন শবরদের মধ্যে, কিন্তু এত যক্ষ্মা রোগ দেখা যায় না। ‘আদিবাসীদের’ মধ্যে এত যক্ষ্মা কেন? অচিকিৎসিত রোগ কি থেকেই যাচ্ছে পরিবারে বা সম্প্রদায়ের মধ্যে? আর থেকে যাচ্ছে রোগের উৎস? এ প্রসঙ্গে মনে রাখা ভালো যে যক্ষ্মা বায়ুবাহিত হয়ে ছড়ায়। অর্থাৎ, যক্ষ্মার বীজাণু পরিবেশে থাকলে নিশ্বাস প্রশ্বাসের বায়ুর সঙ্গে তা শরীরে ঢোকে।  তাই বাড়িতে, বা কাছাকাছি কোনও যক্ষ্মারোগী থাকলে সংক্রমণের সম্ভাবনা যথেষ্ট থাকে। এ রোগে সংক্রমণ হওয়া মাত্র অসুস্থতা প্রকট হয় না। তাই যক্ষ্মা অনেক সময় প্রচ্ছন্নভাবে শরীরে থেকে যায়। পরীক্ষা করলে ভারতবর্ষের অনেকের শরীরেই প্রচ্ছন্নভাবে থাকা যক্ষ্মার বীজাণু পাওয়া যেতে পারে। যক্ষ্মা রোগ হিসেবে প্রকাশ পায় যখন সংক্রমণ  প্রচ্ছন্ন থেকে বেড়ে প্রকট হয়ে ওঠে। শারীরিক অপুষ্টি ও তজ্জনিত দুর্বলতা যক্ষ্মারোগের এই প্রচ্ছন্ন থেকে প্রকট হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, পুষ্ট ও নিয়মিত যত্ন নেওয়া শরীরে যক্ষ্মার বীজাণু প্রচ্ছন্নভাবে থাকলেও তা বেড়ে যক্ষ্মারোগে পরিণত নাও হতে পারে।

খাদ্য ও পুষ্টির সঙ্গে যক্ষ্মার এই সম্পর্কের ওপর দিদি কিন্তু তাঁর বহু বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বেশ অন্যরকম একটা আলোকপাত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ‘আদিবাসীদের’ মধ্যে এত যক্ষ্মা তাদের মদ্যপানে অত্যধিক আসক্তির জন্যে। বলেছিলেন যক্ষ্মা হল রাজরোগ, তাকে কাবু করতে হলে ওষুধ ছাড়াও লাগে রাজকীয়, ভালো ভালো, পুষ্টিকর খাদ্য। সে সব খাদ্য ‘আদিবাসীরা’ খায় না।

কেন খায় না? পায় না বলে, নাকি কিনতে পারে না বলে? দিদি বলেছিলেন কারণটা একটু জটিল। মদের নেশা এদের বড় সাঙ্ঘাতিক ও মাত্রাতিরিক্ত। মদ্যপানে আসক্তির জন্যে এরা শরীরকে সুষম ও পুষ্টিকর খাবার না দিয়ে খাওয়ায় মদ। বলেছিলেন মদের জন্যেই এরা অধিকাংশই ‘সপরিবারে’ আজীবন বিপজ্জনক রকম অপুষ্টিতে ভোগে। শরীরকে খাবার না দিয়ে চলে মদ্যপান। ফলে শরীর ঝাঁঝরা হয়ে থাকে। অপুষ্টিজনিত দুর্বল শরীর চারপাশের যক্ষ্মাবীজাণুর প্রতিরোধে কত আর লড়াই করতে পারে?

কেবলমাত্র মাত্রাছাড়া মদ্যপান থেকে ‘সপরিবারে’ এইরকম মারাত্মক অপুষ্টির অবস্থা হতে পারে? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে বরং আরেক অভিজ্ঞতার কথা বলি। সেও ঐ একই অঞ্চলের Integrated Child Development Service (আইসিডিএস) সেন্টারের অভিজ্ঞতা। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। আপনাদের জন্যে গল্পের মধ্যে গল্প।

মদের নেশা ও নিদারুণ অপুষ্টি : গল্প ২

আইসিডিএস সম্পর্কে প্রথমে একটু বলে নেওয়া ভালো। আইসিডিএস প্রোগ্রামটি আদতে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যরক্ষা ও পুষ্টির জন্যে UNICEF-এর একটি বিশ্বজোড়া প্রচেষ্টা। এই প্রোগ্রাম বিশেষ করে ছয় বছর অবধি বয়সের শিশু[6], ও ১৬-৪৪ বছর বয়সের সন্তানসম্ভবা বা স্তন্যদায়িনী কিশোরী ও মহিলাদের জন্যে। এর উদ্দেশ্যগুলি বিবিধ ও মহৎ। যেমন— মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, ও পুষ্টির উন্নতি করা ও এই বিষয়ে শিক্ষা প্রচার; শিশুমৃত্যুর হার কমানো; বাচ্চাদের স্কুল ছেড়ে দেওয়ার হার কমানো; মায়েদের নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্য ও পুষ্টিকর খাদ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং পারঙ্গম করে তোলা; ইত্যাদি।

শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি ভারতবর্ষে একটি বহুদিনের জ্বলন্ত সমস্যা। সেই সমস্যার মোকাবিলা করতে ১৯৭৪ সালে ভারত সরকার আইসিডিএস স্কিম প্রথম চালু করে; বিশেষ করে গ্রামীণ ভারতের মা ও শিশুদের জন্যে[7]। বর্তমানে এই স্কিমটি জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের (National Rural Health Mission) অন্তর্গত হওয়ায় জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের অঙ্গনওয়াড়ী কেন্দ্র থেকে এই স্কিম চালানো হয়।

উপরের গল্প ১-এ যে গ্রাম ও উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের কথা বলেছি, তার কাছেই এক অঙ্গনওয়াড়ী কেন্দ্রে আমি গিয়েছিলাম। সেটি ওই গ্রামের একমাত্র স্কুলটির এক পাশে। টিনের চালের পাকা ঘরে সামান্য কিছু আসবাব, কিছু শিক্ষামূলক খেলনাপাতি, জানলায় পরদার বদলে কোনরকমে কাপড় দিয়ে ঢাকা। গ্রামের ১৭২টি বাড়ির জন্যে এই কেন্দ্র একজন মাত্র মহিলা কর্মী সামলান। সুবিধের জন্যে তাঁকে এই লেখায় ‘বীণা’ বলে উল্লেখ করব। ‘বীণা’র অন্যতম কাজ হল স্থানীয় কারুর সাহায্যে সপ্তাহে তিনবার ভাত ও ডিমের কারি রান্না করে কেন্দ্রে আসা ০-৬ বছরের শিশুদের ও সন্তানসম্ভবা মায়েদের মধ্যাহ্নভোজন করানো। গরম ভাত, আর ডিমের ঝোল শুনতে লোভনীয়। কিন্তু ‘বীণা’ বলেছিলেন সবচেয়ে বড় সমস্যা হল বাচ্চাগুলিকে কেন্দ্রে আনা। মায়েরা আসতে ইচ্ছুক না হলে তো শিশুদের আর আসা হয় না। তাই, প্রথম কাজ হল বাড়ি বাড়ি নিজে গিয়ে বাবা-মাদের বোঝানো যাতে মায়েরা আসতে রাজি হয়। কখনও কখনও এমনও হয়েছে যে ‘বীণা’কে নিজেকেই শিশুকে কোলে করে বা হাত ধরে কেন্দ্রে আনতে হয়েছে। এইরকম করে যে কজনকে খেতে দেওয়া, ও পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন করা যায়, সেই চেষ্টা করে যাওয়া।

‘বীণা’ বারো দিন বাদে বাদে কেন্দ্রে আসা শিশুদের ওজন ও মাপ নেন, উচ্চতা ও ওজনবৃদ্ধি দেখার জন্যে। একটি রেজিস্টারে এই সব ওজন, মাপ, নাম ধাম সব লিখে রাখেন তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে— (১) অত্যন্ত অপুষ্ট, (২) মাঝারিরকম অপুষ্ট, (৩) স্বাভাবিক শিশু। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম শ্রেণিটিকে নিয়ে যথেষ্ট চিন্তার কারণ থাকে।

জিজ্ঞেস করাতে ‘বীণা’ ওই গ্রামের ১৭২টি ঘরের একটি হাতে তৈরি চার্ট দেখিয়ে ছিলেন। তাতে বাড়িগুলি শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অবস্থা অনুযায়ী আলাদা আলাদা রং দিয়ে বিশেষভাবে চিহ্নিত। অত্যন্ত অপুষ্ট শিশুদের বাড়িগুলি লাল রং দিয়ে চিহ্নিত। মাঝারিরকম অপুষ্ট শিশুদের বাড়ি হলুদ রং দিয়ে, এবং স্বাভাবিক শিশুদের বাড়ি সবুজ দিয়ে।

লাল রঙের বাড়ি দেখলাম ১৮টি। সেই সব বাড়ির মায়েরা কোনও এক সময় শিশুকে আইসিডিএস কেন্দ্রে এনেছিলেন বলে ওই সব বাড়িতে অত্যন্ত অপুষ্ট শিশু বা শিশুরা আছে এটা জানা গেছে। সঙ্গত কারণেই এই সংখ্যাটি নিয়ে ‘বীণা’ চিন্তিত। ১৮টির মধ্যে ৮টি বাড়িতে ‘বীণা’ গিয়ে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শিশুদের মা সহ নিয়মিত আনাতে পেরেছেন। বাকি ১০টির ক্ষেত্রে পারেননি। মায়েরা আসেন না, অতএব শিশুরা আসতে পারে না।

এই ১০টি বাড়ির মায়েরা আসেন না কেন? ‘বীণা’ বলেছিলেন দূরত্ব হয়তো একটা কারণ; এই বাড়িগুলি মূল গ্রাম ও আইসিডিএস কেন্দ্র থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বাচ্চা নিয়ে দেড় দু কিলোমিটার দূরের কেন্দ্রে সপ্তাহে তিনবার যাতায়াত চাট্টিখানি কথা নয়।

আর এর সঙ্গে শুনিয়েছিলেন সেই সব বাড়িতে দারিদ্র্য ও মদের নেশা মেশানো এক অদ্ভুত জীবনচর্যার কথা। মূল গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে এই বাড়িগুলি ‘আদিবাসীদের’। ‘বীণা’ বলেছিলেন এই সব বাড়িতে বাচ্চাদের মধ্যে সাংঘাতিক অপুষ্টির কারণ কেবল অর্থাভাব নয়। একটা বড় কারণ হল বাবা-মায়ের সন্তানের প্রতি অবহেলা। উনি দেখেছেন যতদিন ওদের বাচ্চা মায়ের দুধ খায়, ততদিন তার ওজন স্বাভাবিক থাকে। রেজিস্টার খুলে দেখালেন ছ মাস পর্যন্ত ওই সব বাড়ির বাচ্চাদের ওজন, বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক। তারপর যেই মায়ের দুধ বন্ধ করে শক্ত খাবার দেওয়া শুরু হল, অমনি ধীরে ধীরে পুষ্টির অভাবে বাচ্চার ওজন ও বিকাশ ব্যাহত হতে থাকল, এবং ক্রমশ বাচ্চা গভীরতর অপুষ্টির শিকার হতে লাগল। ওনার বক্তব্য, বাবা-মা শিশুর খাবারের দিকে ঠিকমতো খেয়াল করে না। খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে নিজেদের অজ্ঞানতা তো আছেই; নিজেরাই ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করে না। তার ওপরে  নিজেরা নেশাগ্রস্ত হওয়া একটা মূল কারণ। হাতে পয়সা এলে সেটা দিয়ে খাবার কেনার বদলে নেশার পেছনে খরচা করে। আইসিডিএস কেন্দ্রে এলে তো তবু দুটো খেতে পায় বাচ্চাগুলো, কিন্তু তাও নিয়ে আসে না। অর্থাৎ, গ্রামে বিশেষ করে যে সব শিশুদের স্বাস্থ্য ও জীবন সুরক্ষার জন্যে আইসিডিএস কেন্দ্র করা হয়েছে, সেই সব শিশুদের একটা বড় অংশ এই মূল্যবান পরিষেবা থেকে বঞ্চিত থাকছে।

এদের ঘরে রোজগার যে নেই, তা নয়। ‘বীণা’ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানালেন, উনি ‘আদিবাসীদের’ অনেক বাড়িতে দেখেছেন মেয়ে মরদ দুজনেই কাজ করতে যায়। কিন্তু বাচ্চাগুলি সব বাড়িতে পড়ে থাকে। বেশিরভাগ সময় ওরই মধ্যে একটু বড় বাচ্চার ঘাড়ে ছোটগুলিকে দেখার ভার থাকে। কোনও কোনও মা সকালে বেরনোর আগে হয়ত যা পারে রান্না করে দিয়ে গেল, সারাদিন ধরে বাচ্চাগুলি তাই নিজেরাই নিয়ে কোনওমতে খেল। কে বেশি পেল, কে কম পেল, কে পেল না, কেই বা দেখছে? কোনও কোনও বাচ্চার ভাগ্যে আবার সেটুকুও থাকে না। তাদের মা হয়তো কোনও খাবারের বন্দোবস্ত রেখে গেল না। যদি আশপাশে আত্মীয় বা সহৃদয় প্রতিবেশী থাকে, তো বাচ্চাগুলির পেটে কিছু পড়ে; নাহলে খালি পেটেই ছোট থেকে তাদের দিন কাটে। ‘বীণা’ এক এরকম বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলেন দু বছরের একটি বাচ্চা একা রয়েছে বাড়িতে। বাড়িতে খাবার আছে কিনা কে জানে। খাবার থাকলেও তাকে দেখার, খাইয়ে দেবার বা খেতে দেওয়ার কোনও লোক কোথাও ধারেকাছে নেই। বাবা মা দুই গেছে সকাল থেকে কাজে। ফলে বাচ্চার ভাগ্যে দিনভর অর্ধাহার বা অনাহার।

দিদির মতোই ‘বীণা’ও বলেছিলেন ‘আদিবাসীদের’ মধ্যে মদের নেশা বড় ভয়ঙ্কর। পুরুষানুক্রমে, মহিলা পুরুষ, ছোট বড়, জওয়ান বৃদ্ধ নির্বিশেষে সেই নেশা; এমন নেশা যে বোধবুদ্ধিবিহীন এক অবস্থা। গ্রামের বাকি লোক সব সংসর্গ এড়িয়ে চলে। এরকম কিছু বাড়ির বাচ্চাদের কাছে ‘বীণা’ শুনেছিলেন তাদের বাবা মা কাজ সেরে ফেরে সেই রাতে, নেশায় চুরচুর হয়ে। হাতে যে কটা পয়সা কাজ করে আসে, তা মদের ঠেকে শেষ। নিজেদের পেটেও কিছু পড়ে না, বাচ্চাদের তো কথাই নেই। বাবা-মা দুজনেই বেহুঁশ, কেই বা খাবার আনে, আর কেই বা খাবার তৈরি করে? অতএব সপরিবারে অর্ধাহারে, অনাহারে দিনরাত্রি যাপন। বড়রা অচেতন, তাই বাচ্চারা ছোট থেকেই না খেয়ে, আধপেটা খেয়ে এভাবে অপুষ্টির থেকে আরও ঘোরতর অপুষ্টির শিকার হতে থাকে। এদেরকে খাদ্য ও পুষ্টির কথা বলতে গেলেই বা শুনছে কে?

ছোটবেলা থেকে পুষ্টির অভাব নিয়ে বেড়ে ওঠা এই সব শিশুদের, ও তাদের বাপ মায়ের শরীরে কি এমন সামর্থ্য থাকতে পারে যে যক্ষ্মার মতো বড় বড় অসুখের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে? কিছু শিশু পাঁচ বছর বয়সের গণ্ডিটি পেরোতে পারে না; তার আগেই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেয়। বাকিরা জীর্ণ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অনাহারক্লিষ্ট ও অপুষ্ট শরীর নিয়ে এক অসম লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। সে লড়াইয়ের অনেক শত্রুর মধ্যে একটি শত্রু Mycobacterium Tuberculosis bacteria, অপুষ্ট শরীরে সংক্রমণ হলে যেটির বিশেষ শ্রীবৃদ্ধি লাভ হয়। আর অতিরিক্ত মদ্যপান ও দীর্ঘকালীন অপুষ্টির জটিল কারণশৃঙ্খল এই জনগোষ্ঠীটির মধ্যে ক্রমাগত যক্ষ্মা রোগের সংক্রমণে সাহায্য করে চলে।

ওপরের দুই গল্প থেকে একটা কথা অন্তত পরিষ্কার হওয়া উচিত। একেবারে মাটির স্তর থেকে উঠে আসা এসব কথার যদি কোনও মূল্য থাকে, তবে এ অঞ্চলের ‘আদিবাসীদের’ মধ্যে যক্ষ্মা নির্মূল করার লড়াই কেবল ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করার লড়াই নয়। মূল সমাজের চোখ এড়িয়ে যে সব চোরাগোপ্তা পথে যক্ষ্মা তার নিঃশব্দ আগ্রাসন চালিয়ে যায়, এই জনগোষ্ঠীটির মন বুঝে তাদের সঙ্গে নিয়ে সেই সব পথ রোধ করতে হবে।

ওষুধের সঙ্গে গরম ভাত : গল্প ৩

এবার আমাদের পুরনো গল্পে— সেই গ্রামের উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের যক্ষ্মার গল্পে ফেরা যাক। সেখানে যক্ষ্মার সঙ্গে ওষুধ দিয়ে লড়াইয়ের কী অবস্থা শোনা যাক।

বহু চেষ্টা সত্ত্বেও যক্ষ্মা রোগকে পরাস্ত করতে না পেরে, ১৯৯৩ সালে ‘হু’ (WHO)[8] যক্ষ্মাকে ‘সারা পৃথিবীব্যাপী সংকট’ বলে ঘোষণা করে। সেই সময় ‘ডটস’ (‘Directly Observed Treatment Strategy’) পদ্ধতিকে যক্ষ্মার চিকিৎসার জন্য সব চেয়ে উপযোগী পদ্ধতি বলে নির্ধারণ করা হয়। যক্ষ্মার চিকিৎসার মূল কথা হল নিয়মিত এবং সঠিক মাত্রায় ওষুধ খাওয়া। ‘ডটস’ পদ্ধতিতে রোগীকে যক্ষ্মার ওষুধ ‘ডটস’ এজেন্টের সামনে খেতে হয়। এতে রোগীর ওষুধ না খাবার বা ফাঁকি দেবার উপায় থাকে না। ফলে রোগ প্রশমনে সুফল আশা করা যায়। এই ‘ডটস’ এজেন্ট কোনও সমাজকর্মী হতে পারেন, পরিবারের সদস্য হতে পারেন, বা কোনও স্বাস্থ্যকর্মীও হতে পারেন।

২০০৩ সালের মধ্যে যে ১৮২টি দেশ ‘ডটস’ পদ্ধতিকে যক্ষ্মার চিকিৎসার জন্যে গ্রহণ ও প্রয়োগ করা শুরু করে, ভারত তার মধ্যে অন্যতম। আমাদের আলোচ্য এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতেও যক্ষ্মারোগ নির্ণীত হলে ‘ডটস’ (‘directly observed treatment strategy’) পদ্ধতি অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। চিকিৎসা মানে অন্তত ছয় মাসের একটা টানা চিকিৎসা। তার মধ্যে সপ্তাহে তিনবার[9] নির্ধারিত ডোজে Rifampicin (R), Isoniazid (I), ইত্যাদি নানা ওষুধ খাওয়া। তার মানে রোগীকে সপ্তাহে তিনবার সরকারি ক্লিনিকে আসতে হবে, এবং এসে নার্সদের বা স্বাস্থ্যকর্মীদের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত এবং সঠিক ডোজে ওষুধ খেতে হবে।

এ তো খুব ভালো ব্যবস্থা, তাহলে যক্ষ্মা নির্মূল হয় না কেন? দিদির কথায় মনে হল এই ব্যবস্থার মধ্যেই রোগীর জন্যে কিছু সমস্যা লুকিয়ে আছে। তাঁর কথা অনুযায়ী, প্রথমত, এই রুটিন সব রোগী মেনে উঠতে পারে না। প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে তিনবার করে বাড়ি থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা, এবং সেটা মাসের পর মাস করে যাওয়া অনেকের পক্ষেই মুশকিল। এখানকার রোগীরা সব গরীব, দিন-আনি-দিন-খাই টাইপের। ওষুধ খেতে এলে তাদের কাজে কামাই হয়। সেদিনের পয়সা পায় না। এ ছাড়া অনেকেই দূর দূরান্ত থেকে আসে। এই একটি সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র এতগুলো গ্রামের মধ্যে। কাজেই ওষুধ ও চিকিৎসা বিনামূল্যের হলেও বেশিরভাগ রোগী অনিয়মিত হয়ে পড়ে।

কিন্তু দূরত্ব, কাজে কামাই, এ সব ছাড়াও এর মধ্যে একটা ‘গরম ভাতের’ গল্প আছে, সেটা দিদি শোনালেন। ‘ডটস’ পদ্ধতি অনুযায়ী রোগীকে খালি পেটে ওষুধ খেতে হয়। বিনামূল্যের চিকিৎসা পেতে খালি পেটে দূর দূর থেকে রোগাভোগা সব লোকেরা আসে এই কেন্দ্রে। আর ‘টিবি’র ওষুধও কড়া কড়া, সব মিলিয়ে প্রায় সাতখানা ট্যাবলেট[10]! শরীরের ওপর এর ধকল বেশ জোরালো। স্বাস্থ্যকর্মীরা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন যে খালি পেটে জোরালো ওষুধ খাবার পরে যক্ষ্মারোগী বেশ ঝিমিয়ে পড়ে। সেদিন, বা অনেক সময় তার পরদিনও, তার আর  উঠে কাজকর্ম করার শক্তি থাকে না। অর্থাৎ, এক দিনের চিকিৎসার জন্যে এক কি দুদিনের কাজ বন্ধ। এর ওপর ওষুধ খাবার পর অভুক্ত মানুষগুলোকে খালি পেটেই আবার অতটা রাস্তা পেরিয়ে ঘরে ফিরতে হয়। কারণ, ‘ডটস’ স্কিমের রোগীদের জন্য কোনও খাবার দেবার বা ‘মিল’ খেতে দেবার সরকারি অনুমোদন নেই[11]। তাই অনেকেই একবার দুবারের পর আর চিকিৎসার জন্যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পা মাড়ায় না। ফলে রোগ যেমনকার তেমন থেকে যায়, অথবা বেড়ে যায়।

এর সমাধান কী? দিদির মতে, ‘ডটস’ স্কিমের সঙ্গে গরম ভাতের একটা সংযোগ দরকার। তিনি বলেছিলেন ‘অঙ্গনওয়াড়ী’ স্কিমের মতো ‘ডটস’ স্কিমের রোগীদের জন্যও একটা ‘মিল’ দেবার কথা ভাবতে। যে ছ বা আট মাস ‘ডটস’ অনুযায়ী ওষুধ খেতে রোগী সরকারি ক্লিনিকে আসবে, অন্তত সেই ক মাস যদি ওষুধ খাবার পর ‘মিড ডে মিল’-এর মতো একটি করে পুষ্টিকর ‘মিল’ তাদের দেওয়া যায়, তাহলে হয়তো এ সব গ্রামাঞ্চলের গরীব যক্ষ্মারোগীদের ভাতের টানে নিয়মিত ওষুধ খেতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতে আকৃষ্ট করা যেতে পারে। তাতে নিয়মিত চিকিৎসাও পাবে, আর উপকারও হবে। এত বড় দেশের এত লক্ষ লক্ষ যক্ষ্মারোগীদের এভাবে বিনামূল্যের চিকিৎসার সঙ্গে উপরি বিনামূল্যের ভোজন করানো আমাদের দেশের জনস্বাস্থ্যের খাতে সামান্য বাজেটে সম্ভব কিনা জানি না; কিন্তু কথাটার মধ্যে কোথাও একটা গভীর সত্য আছে, এরকমটা মনে হয়েছিল।

গলিত, বিকৃত, স্বেচ্ছানির্বাসিত : গল্প ৪

কুষ্ঠ যে এ অঞ্চলে একটা সমস্যা সে তো আগেই বলেছি। ২০০৫ সালে ভারত সরকার দেশকে ‘কুষ্ঠ মুক্ত’ ঘোষণা করেন। অনেকে ভাবেন তার মানে সারা দেশে বুঝি আর একটিও কুষ্ঠরোগী থাকল না। তা কিন্তু নয়। এ ঘোষণার মানে হল সব মিলিয়ে রোগের হার প্রতি ১০,০০০-এর মধ্যে ১ জনের নীচে পৌঁছেছে। সেটা হয়তো সামগ্রিকভাবে সত্য, কিন্তু কিছু অঞ্চলের জন্যে সত্য নয়। যেমন এ ঘোষণার পরেও, সরকারি তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে পশ্চিম মেদিনীপুরে কুষ্ঠরোগের হার ২০০৮-২০০৯ সালে প্রতি ১০,০০০ এর মধ্যে ১.৯৫, এবং ২০১১-২০১২ সালে সেই হার বেড়ে প্রতি ১০,০০০-এর মধ্যে ২.০৮ হয়েছে[12]। যে কোনও ছোঁয়াচে রোগের নতুন সংক্রমণ বৃদ্ধি সব সময়েই চিন্তার বিষয়। কুষ্ঠরোগের মতো মহারোগের তো কথাই নেই। সরকারি (National Leprosy Eradication Programme, NLEP) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১০-২০১১ এই দুই বছরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ১২৩২ জন নতুন কুষ্ঠরোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে; ২০১১-২০১২ সালে তা বেড়ে ১৬১৫ হয়ে দাঁড়িয়েছে[13]। ২০১২র NLEP প্রোগ্রেস রিপোর্টও[14] বলছে পশ্চিমবঙ্গ সমেত কিছু কিছু রাজ্যে নতুন কুষ্ঠরোগীর সংখ্যা কমা তো দূরস্থান, ২০১১-২০১২ সালে ২০১০-২০১১ থেকে বেড়েছে। এমনিতেও এখনও এদিকের পথে, ঘাটে, হাটে হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা কুষ্ঠরোগী মাঝেমাঝেই চোখে পড়ে।

আমাদের গল্পের উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেজিস্টার বলছে ২০১৩ সালে ২০ জন কুষ্ঠরোগী ছিল, নতুন ও পুরনো মিলিয়ে। তাদের ৬ জন পুরুষ, ১৪ জন মহিলা। ২০ জনের মধ্যে ১৬ জনই তপশিলি উপজাতির, কিন্তু সবাই ‘আদিবাসী’ নয়। বরং এই রোগীদের মধ্যে লোধা, শবরদের সংখ্যা বেশি। স্বাস্থ্যকর্মীরা বলেছিলেন— ওনাদের কেন্দ্রে ওনারা যা দেখে এসেছেন, তাতে কুষ্ঠরোগ এ অঞ্চলে ‘আদিবাসীদের’ থেকে অন্য তপশিলি উপজাতিদের, যেমন শবরদের, মধ্যে বেশি; এবং উচ্চবর্ণের লোকজনের থেকে তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের মধ্যে বেশি। এটা তাঁদের অভিজ্ঞতাপ্রসূত উপলব্ধি। অর্থাৎ, এখানেও একটা সামাজিক অনুসন্ধানের সুযোগ আছে। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁরা তেমন কোনও আলোকপাত করতে পারলেন না।

বরং তাঁরা দেখালেন যে ২০ জনের মধ্যে যে ৪টি নতুন সংক্রমণ, সে ৪টিই নাবালকদের। তাদের বয়স ১৪র নীচে। কুষ্ঠরোগের শ্রেণিভাগ অনুযায়ী বলতে গেলে ২টি paucibacillary (PB), ও ২টি multibacillary (MB) কেস। এই সব নাবালক কিশোর কিশোরীরা কিভাবে এই রোগাক্রান্ত হচ্ছে, এটা একটা আলাদা করে চিন্তার বিষয়। নতুন সংক্রমণ যখন নাবালকদের মধ্যে, তখন বুঝতে হবে নতুন করে আরেক প্রজন্মের ওপর এই রোগের থাবা পড়ল। কুষ্ঠের সংক্রমণ কুষ্ঠরোগীর সঙ্গে কোনওভাবে সুস্থ শরীরের সংস্পর্শের ফলে হয় বলে মনে করা হয়। ইদানিং রোগীর হাঁচি কাশি থেকে নিশ্বাসবাহিত সংক্রমণ হতে পারে এ কথাও বলা হচ্ছে। ‘হু’ (WHO) কীটপতঙ্গ বাহিত সংক্রমণের সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দিতে চায় না। যে পথেই হয়ে সংক্রমণ থাকুক, নতুন সংক্রমণ রুখতে, এবং বিশেষ করে এই সব কিশোর কিশোরীদের এক অবাঞ্ছিত ভবিষ্যতের হাত থেকে সুরক্ষার জন্যে সংক্রমণের উৎসগুলিকে চিহ্নিত করা অবশ্য প্রয়োজন।

কিন্তু এই প্রয়োজনীয় কাজটা খুব একটা সহজ নয়। কারণ, Mycobacterium Leprae (M. Leprae), যে ব্যাকটেরিয়া থেকে কুষ্ঠ হয়, সেটি সেই অর্থে ভয়ঙ্কর সংক্রামক নয়। মানে, একবার সংসর্গে এলেই সংক্রমণ হয় না। যে কুষ্ঠরোগীর চিকিৎসা হয়নি, তার সঙ্গে বারবার, ঘনিষ্ঠ, এবং দীর্ঘকাল ধরে সংসর্গ হলে তবেই কুষ্ঠ সংক্রমণ ঘটে। মানে, সংক্রমণ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এছাড়া, শরীরে কুষ্ঠ সংক্রমণ হবার পরে লক্ষণ প্রকাশিত হতেও অনেকটা সময় লাগে। ‘হু’ (WHO)-র মতে সংক্রমণ হবার পরে ৫ থেকে ২০ বছরও লাগতে পারে কুষ্ঠের শারীরিক লক্ষণ প্রকাশিত হতে। সংক্রামিত হবার পর শরীরের ভিতর খুব ধীরে ধীরে এই ব্যাকটেরিয়া বাড়তে থাকে। তাই সংক্রমণ হবার পরেও বহুদিন অবধি শরীরে কোনও লক্ষ্মণ প্রকাশিত না হতে পারে। অর্থাৎ, সংক্রমণের শুরু, ও কুষ্ঠরোগ নির্ণীত হওয়া, এই দুটির মধ্যে অনেক বছরের ব্যবধান থাকতে পারে। এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান থাকায় ঠিক কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সঙ্গে সংসর্গের ফলে সংক্রমণ হয়েছে, সেটা নির্ধারণ করা সবসময় অত সহজ নয়। ফলে রোগী ধরা পড়লেও রোগের প্রকৃত উৎস বহু ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে না। এরই ফলশ্রুতি নতুন সংক্রমণ অবাধে বেড়ে চলা, ও কুষ্ঠরোগ নির্মূল না করতে পারা।

উদাহরণস্বরূপ ২০১৩ সালে ওই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে ধরা পড়া চারটি অপ্রাপ্তবয়স্ক নতুন কেসের মধ্যে একটির গল্প বলি। স্থানীয় একটি বারো বছরের ক্লাস সেভেনে পড়া মেয়ে, তপশিলি জাতির। মোটামুটি স্বচ্ছল ঘরের; বাবা ট্রাক ড্রাইভার। উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের একজন ‘আশা’ কর্মী বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিজিট করার সময় মেয়েটির গালে চার পাঁচটি লালচে দাগ লক্ষ করেন, এবং বুঝিয়ে সুঝিয়ে মেয়েটিকে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে দেখানোর জন্যে রাজি করান। দেখানোর পর রোগটি ধরা পড়ে, এবং চিকিৎসা শুরু হয়। কুষ্ঠ ঠিক সময়ে ধরা পড়লে সারে। স্বাস্থ্যকর্মীরা সকলেই আশা রাখেন যে চিকিৎসা সম্পূর্ণ হলে মেয়েটি পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে।

এখন কোথা থেকে এই মেয়েটির কুষ্ঠ হল, এ কথা তাঁরা নির্ণয় করতে অপারগ। বাবা মা, কারুরই আপাতদৃষ্টিতে কোনও কুষ্ঠের লক্ষণ তাঁরা দেখতে পাননি। আর এই মেয়েটির বারো বছরের জীবনের সম্পূর্ণ সামাজিক বলয়, প্রতিটি সামাজিক সম্পর্ক তাঁদের পক্ষে জানা বা অনুসন্ধান করে দেখা সম্ভব নয়। সংক্রমণের উৎস অতএব নজরের আড়ালেই থেকে যায়। তাঁদের চিন্তা হল— এই মেয়েটিকে নাহয় সময়মত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনান গেছে, ও চিহ্নিত করার পর চিকিৎসা শুরু করানো গেছে। কিন্তু কুষ্ঠ সংক্রমণের শিকার এরকম আরও কত জন আছে কে জানে, যাদের চিহ্নিত করা যায়নি; অথচ সময়মত চিকিৎসা করালে হয়ত তাদের রোগ নিরাময় হত।

অন্যান্য অনেক রোগের মতোই কুষ্ঠরোগের ক্ষেত্রেও একটা বিরাট সমস্যা হল— under-reporting। এই কেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মীরা দৃঢ়বিশ্বাসে বলেছিলেন— যে কজন এই কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসেন, এ অঞ্চলে কুষ্ঠাক্রান্তদের প্রকৃত সংখ্যাটা তার থেকে অনেক, অনেক বেশি। এছাড়াও আছে under-utilization। চিকিৎসাতে যাদের সত্যি উপকার হতে পারত, তেমন অনেক কুষ্ঠরোগী স্বাস্থ্যকেন্দ্র এড়িয়ে চলেন, ও সরকারি সবরকম আশ্বাস ও কুষ্ঠরোগীদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফেরাবার প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের সরকারি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার আওতার বাইরে রাখতে পছন্দ করেন। শুনেছিলাম ওই গ্রামের এরকম একটি বাড়ির কথা, যে বাড়ির প্রতিটি সদস্যের কুষ্ঠ আছে, এবং সে কথা সবাই জানে। কিন্তু সে বাড়ির লোকেরা কখনওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন না। স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলেও তাঁরা সাড়া দেন না।

এ প্রসঙ্গে বলি, কুষ্ঠাক্রান্তদের এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র এড়িয়ে চলার কথা আমি এক ভূতপূর্ব জনস্বাস্থ্য আধিকারিকের মুখ থেকেও শুনেছি। তিনি বলেছিলেন যে এই অঞ্চলে এরকম একটি পুরো গ্রাম আছে, যেখানে কুষ্ঠ ঘরে ঘরে। কুষ্ঠ সেখানে এতই ব্যাপক ও সহজে দৃশ্যমান, যে স্থানীয় লোকেরা সে গ্রামের নাম দিয়েছে ‘লেপ্রসি পাড়া’। সে গ্রামের পাশেই সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কিন্তু কুষ্ঠাক্রান্তদের কোনও তাগিদ নেই সে কেন্দ্রে যাবার, বা গিয়ে কোনও পরিষেবা নেবার। এ অঞ্চলে কুষ্ঠ থেকে অঙ্গহানি হলে অঙ্গপুনর্নির্মাণের জন্য তৈরি বিশেষ শল্যচিকিৎসা ক্লিনিকটিতেও নাকি কম রোগী আসে।

সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাতে সবরকম চিকিৎসা, ওষুধ, পুনর্বাসনের সুযোগসুবিধা থাকা সত্ত্বেও কুষ্ঠাক্রান্তদের মধ্যে এই স্বাস্থ্য পরিষেবা নিতে অনাগ্রহ ভারতের জনস্বাস্থ্যের পক্ষে সত্যিই একটি মস্ত বড় প্রতিবন্ধক। কেন এই অনাগ্রহ, এর একাধিক কারণ থাকতে পারে। যেমন, সামাজিক বিতৃষ্ণার কথা তোলা যেতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে কুষ্ঠরোগ সম্পর্কে বহুল প্রচার সত্ত্বেও কুষ্ঠরোগ ও কুষ্ঠরোগীদের সম্পর্কে মূল সমাজে যে একটা ব্যাপক ভীতি, ঘৃণা ও কুসংস্কার আছে যুগযুগান্ত ধরে, এটা তো সত্যি। কুষ্ঠাক্রান্তদের কাজ থেকে ছাঁটাই করে দেওয়া, লোকালয় থেকে দূরে আলাদা বসতি করতে বাধ্য করা, ইত্যাদি নানাভাবে সমাজ এই ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা প্রকাশ করে থাকে। এ নিয়ে বহু নিবন্ধ লেখালেখি হয়েছে[15]। কুষ্ঠরোগীদের ওপর এই সামাজিক বিতৃষ্ণার প্রভাব অবশ্যই সুখের নয়। বিদ্বেষ ও ঘৃণার চিরাচরিত ঝাপটায় অভ্যস্ত কুষ্ঠাক্রান্তরাও সমাজের মূল ধারাটির থেকে নিজেদের সন্তর্পণে সরিয়ে রাখতে চান। সেই সমাজের প্রস্তাবিত চিকিৎসা নিতে এলেও তো নিজেকে ও নিজের পরিবারকে চিহ্নিত করা হয়, ও সমাজের সামনে মুখ দেখাতে হয়। সেটাই হয়তো অন্যতম কারণ কুষ্ঠাক্রান্তদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না যাবার। তাই হয়তো খুব কমজনই সাড়া দেন।

এ ছাড়াও এ অঞ্চলের অনাগ্রহ হয়তো কোনও বিশেষ লৌকিক বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত। দিদি, ও উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মীরা, অন্তত সেইরকম একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন লাল মাটির রাঢ়ভূমির লোকেদের মধ্যে একটা প্রচলিত বিশ্বাস আছে যে কুষ্ঠ হল ‘লাল মাটির’ দোষ। ‘মাটির দোষে’ লাল মাটির দেশের মানুষদের এই রোগ হয়। লাল মাটির দেশে থাকলে কিছু লোকের এই রোগ হবে— এটাই তারা, আজ বলে নয়, শত শত বছর ধরে দেখে আসছে। প্রমাণ হিসেবে তারা বলে— পশ্চিমবঙ্গের লাল মাটির জেলাগুলিতে, যেমন পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, কুষ্ঠের আধিক্য বেশি। অন্যান্য অ-লাল মাটির জেলাগুলিতে, যেমন হুগলি, এ রোগের প্রকোপ তুলনায় অনেক কম। এটি একটি আঞ্চলিক বিশ্বাস। কোনও সরলীকরণের বা সামান্যীকরণের দাবি নেই এর সঙ্গে। এখন এ বিশ্বাসের সত্যতা কত দূর, কুষ্ঠরোগের বাহক M. Leprae-র সঙ্গে ‘লাল মাটি’র আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে কিনা, এসব আলাদাভাবে বিচার্য। কিন্তু সেটা আমাদের আলোচ্য নয়। আলোচ্য হল এই বিশ্বাসের সঙ্গে চিকিৎসার প্রতি অনাগ্রহের একটা সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা।

‘দিদি’ বলতে চেয়েছিলেন যে এই লৌকিক বিশ্বাস থেকে কিছু লোকের মনে রোগটি সম্পর্কে এক ধরনের ‘মেনে নেওয়ার’ মনোভাব জন্মায়। ছোট থেকে যারা পরিবারে বা গোষ্ঠীতে এই রোগ কাছ থেকে দেখে আসছে, তাদের নতুন করে এর বিপদ সম্বন্ধে সতর্ক করলে বিশেষ ফল নাও হতে পারে। মাটির থেকে এই রোগ আসে, এ কথা বিশ্বাস করলে রোগ থেকে বাঁচার জন্যে পারিপার্শ্বিকের বা নিজের ব্যবহারের কোনও আশু পরিবর্তন প্রয়োজন, এ কথা মানার তেমন কোনও প্রয়োজন থাকে না। রোগটি তখন আর ‘ভয়ঙ্কর’ থাকে না; একরকম ‘ভবিতব্য’ বলে মেনে নেওয়া হয়। সেই থেকেই হয়তো এ বিষয়ে যে কারুর কিছু করার আছে বা থাকতে পারে, সে নিয়ে রোগাক্রান্ত বা তার পরিবার বিশেষ মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করে না।

এ কথা সত্য হলে কুষ্ঠের চিকিৎসা সম্পর্কে এ অঞ্চলে কুষ্ঠরোগীদের মধ্যে যে অনাগ্রহ দেখা যায়, তাকে ঠিক সরকারি জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার সচেতন ও সরাসরি প্রত্যাখ্যান বলা যায় না। এ হল নিজেদের প্রত্যয়ে স্থির থাকা, ও অন্যান্য অনেক কিছুর মতো রোগটিকেও নিজের জীবনে মেনে নেওয়া।

উপসংহার

টুকরো টুকরো স্মৃতি থেকে উঠে আসা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে দুই মারাত্মক ব্যাধির গল্পের এখানেই দাঁড়ি টানব। তার আগে সামান্য কিছু কথা। সারা বিশ্বে ভিন্ন ভিন্ন মানুষ, বা গোষ্ঠীর, মধ্যে স্বাস্থ্যের অবস্থার পার্থক্য দেখা যায়। আগে মনে করা হত এই পার্থক্য নিছক শারীরবৃত্তীয় কারণে হয়ে থাকে। ইদানীং কিন্তু অনেকেই মনে করেন এরকম বেশ কিছু স্বাস্থ্যের অসাম্যের আসল কারণ সামাজিক অসাম্য। লিঙ্গ, জাতি, বর্ণ, সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান ইত্যাদি নানা সামাজিক বিভেদ বহু ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যের অসাম্য তৈরি করে। যেমন ভারতে সর্বনিম্ন স্তরের দরিদ্রতম পরিবারগুলির সদস্যদের মৃত্যুর সম্ভাবনা সর্বোচ্চ স্তরের ধনীতম পরিবারগুলির সদস্যদের থেকে ৮৬ শতাংশ বেশি[16]। এ গল্পের মধ্যে এরকম কিছু স্বাস্থ্যসংক্রান্ত অসমতার কথা উঠে এসেছে যা নেহাতই এই অঞ্চলের কথা। এ কথাগুলি যদি সত্যি হয়, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নৈতিক তাগিদ থেকে একটু দেখা দরকার এইরকম সব সংক্রামক ও ক্ষতিকারক ব্যাধির এই অসম বোঝা এ অঞ্চলের সমাজের এই বিশেষ অংশগুলির ওপর এত বেশি কেন। এ ছাড়াও কিছু আঞ্চলিক ও একেবারে নিজস্ব চাহিদার কথা উঠে এসেছে, যেগুলি কান পেতে শোনা দরকার। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা যদিও সবার জন্যে, কিন্তু তা নেহাতই গড়পড়তা ও সর্বজনীন হলে অনেক সময় ঠিকমতো কার্যকর হয় না।

 

[1]তখন শুনেছিলাম সরকারি অর্থ সাহায্য এসে পড়ে আছে, কিন্ত জমির অভাবে বাড়ি তোলা যায়নি। ২০১৮ সালে শুনলাম গ্রামপঞ্চায়েতের বাড়িটি বড় করা হয়েছে, কিন্তু উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রটি আজও সেই গ্রামপঞ্চায়েতের অফিসেই বর্তমান।

[2]Development and Planning Department. Government of West Bengal. 2011. District Human Development Report : Paschim Medinipur. pp 105-107. Also, State Bureau of Health Intelligence, Directorate of Health Services, Government of West Bengal, 2017. Health on the March 2015-2016. P. 148.

[3] পুরো নামটি হল Revised National TB Control Program (RNTCP)

[4] ‘এমডিআর টিবি’ যক্ষ্মার জন্য সচরাচর ওষুধগুলিতে বা প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতিতে সারে না। ফলে এ ধরনের যক্ষ্মা সারানো খুবই মুশকিল; অথচ রোগটি সাধারণ যক্ষ্মার মতোই খুব সংক্রামক। মানে, জনস্বাস্থ্যের পক্ষে এ এক অতি মারাত্মক ধরনের যক্ষ্মা।

[5]Development and Planning Department. Government of West Bengal. 2011.  District human Development Report : Paschim Medinipur,  p.46, Percentage of scheduled caste, scheduled tribe and general caste population,  2001, Table 2.12.

[6]ছয় বছর অবধি বয়স সীমারাখার কারণ হল ধরে নেওয়া হচ্ছে যে ছয় বছরের পর শিশুটি স্কুলে যাবে এবং ‘মিড ডে মিল’ প্রকল্পের আওতায় পড়বে, ও ঐ প্রকল্প তার পুষ্টি বিধান করবে।

[7]এখন শহরের বস্তিবাসীদের মধ্যেও এই স্কিম চালু হয়েছে।

[8]World Health Organization (WHO)

[9]২০১৩ সালে তখন RNTCP নিয়ম অনুযায়ী যক্ষ্মা-র চিকিৎসাধীন রোগীকে সপ্তাহে তিনবার ওষুধ খাবার নিয়ম ছিল। ২০১৪ সাল থেকে RNTCP দৈনিক ওষুধ খাবার নিয়ম করে। ২০১৭ সাল থেকে তা বাস্তবে কর্মসূচিতে প্রযুক্ত হয়।

[10]নতুন দৈনিক ওষুধ খাওয়ার নিয়মে দুটি কি তিনটি ট্যাবলেট খেতে হয়।

[11]২০১৩ সালে এরকম অনুমোদন ছিল না। এখনও ‘মিল’ খেতে দেবার অনুমোদন নেই। কিন্তু এখন নিয়ম হয়েছে মাসে ৫০০ টাকা রোগীকে পুষ্টিকর খাদ্যের খরচ হিসেবে দেওয়া হবে।

[12]State Bureau of Health Intelligence, Directorate of Health Services, Government of West Bengal.Health on the March 2011-2012.Kolkata: Saraswaty Press Ltd., p.123.

[13]State Bureau of Health Intelligence, Directorate of Health Services, Government of West Bengal. Health on the March 2011-2012. Table VIII. 3.4. Districtwise Comparative Statement of New Cases. Kolkata: Saraswaty Press Ltd., p.126.

[14]Central Leprosy Division, Directorate General of Health Services, Government of India. National Leprosy Eradication Programme (NLEP). Progress Report as on 31st march 2012, p.3. Available at: http://nlep.nic.in/pdf/ProgressReport2011-12.pdf  [Last accessed on: Dec 6, 2018].

[15]উদাহরণ স্বরূপ – Mankar M J et al. 2011. A Comparative Study of the Quality of Life, Knowledge, Attitude and Belief About Leprosy Disease Among Leprosy Patients and Community Members in Shantivan Leprosy Rehabilitation centre, Nere, Maharashtra, India. J Glob Infect Dis, 3 (4): 378-382. Kushwah S S et al. 1981. A study of social stigma among leprosy patients attending leprosy clinic in Gwalior.Lepr India, 53 (2): 221-225. Rao P S, et al. 2008. Extent and correlates of leprosy stigma in rural India.Indian J of Lepr, 80 (2): 164-74.

[16]Subramanian SV, Ackerson LK, Subramanyam M, Sivaramakrishnan K. Health inequalities in India: the axes of stratification. Brown J World Aff. 2008;14:127.

 

লেখক অধ্যাপিকা, মানবিক ও সামাজিক বিদ্যাবিভাগ, আইআইটি খড়গপুর