সুমিত দাস
যে বা যাদের অস্তিত্বে বহু বা বৃহৎ নেই, তারা ধর্মে মাতে। লোকাচারে গুলিয়ে ফেলে দর্শনের গভীর পথ। সভ্যতার চলনই তাই। যুদ্ধে ঘেরা আবহমান ধারায় যারা বহু পথ ঘুরে, বহু জনে মিলিয়েছেন মন, তাঁরা বৃহৎ-এ জাগেন, বাঁচেন, লীলা করেন। হারিয়ে যান বহুর বৃহৎ জগতে। সমকালেরও তাগিদ থাকে, অতীতচারী হয়ে তাঁদের বাঁচিয়ে রাখার।
সময়টা যুদ্ধের। সত্যি কি যুদ্ধের? এখনও গোলাগুলিবোমা উড়ে যায়নি চিহ্নিত শত্রুর দিকে। ঘোষণা হয়নি, কর্নেল দিকনির্দেশ করেননি। তবে যে সময় নাকি হয় হয়।
বছর পঁচিশেক একটু আগের কথা। কাশ্মিরের এক শালওয়ালা তরুণ শীতের নরম রোদে নতুন সাইকেলখানি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল আমাদের মাঠের পাশে। আমাদের উইকেট ঠোকাঠুকি চলছে, দু’দলে ভাগ হচ্ছি। সেই দুপুর-বিকেলে সেও খেলতে চায়। কিন্তু সে কেমন খেলে! তা না বুঝে একদলে নেওয়া হল তাকে। খেলা শুরু আর শেষ হতে সেদিন বেশিক্ষণ লাগেনি। কাশ্মিরী ছেলে একাই বল আর ব্যাট করে জিতিয়ে দিল। জিতে নিল আমাদের মন। এর পরপরই শুনলাম, এ-পাড়ায় ও-পাড়ায় রীতিমত ক্যাম্বিস টুর্নামেন্ট খেলে বেড়ায় সে। মফস্বলের কোনও পাড়ার মধ্য দিয়ে শাল-কম্বল নিয়ে গেলে, তাকে বাহবা দেয় ছেলেছোকরারা। ফলে, ছেলেটিকেও কোথাও দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে হত। কেউ কেউ খেলার আমন্ত্রণ দিত। শুনেছি, ক্রিকেট খেলার জন্য শাল বেচার ছলে দশ বছরের বেশি বর্ধমান শহরে কাটিয়ে গেছে ছেলেটা। তখনও আমার জানা-বোঝা হয়নি, নয়ের দশক মানে লাগাতার অবরুদ্ধ কাশ্মির উপত্যকা। তা সত্ত্বেও, রাস্তায় কখনও সেই কাশ্মিরী যুবককে ধরে ঘা-কতক দেবার গল্প, বা “ভারতমাতা কি জয়” বলানোর আচমকা ফতোয়া ছিল না। ছিল, বাংলার অলিতে গলিতে কাশ্মিরী শালওয়ালার হেঁকে যাওয়ার পরিচিত ছবি। ছিল বিয়ের দিন নানান অর্থনীতিতে– কটকি বা বেনারসির ওপর বাংলার মেয়ে-জামাইয়ের গায়ে বা কাঁধে উপত্যকার উষ্ণতা।
এই আড়াই দশকে পাড়া থেকে সামান্য দূরের মাঠে যাবার পথ ও পথের দুপাশ বদলে গেছে। বর্ষায় কাদা সারা বছর বালিময় সে পথ এখন পিচের। মাটির বাড়ি দালান হয়েছে। ইতিউতি ফ্ল্যাট। এঁদো গলি শহর হতে হতে মাঠ হাওয়া। গলির মোড়ে রামরথের ছোঁয়ায় পোড়ামাটির টবে তুলসির গাছে যে সব শনির থানের জন্ম হল– এক দশক হল প্রায় সবই এখন শ্বেতপাথরের মন্দির। নতুন বলতে হনুমানের আগমন। বেশ কিছুদিন আগে সে পথে শালওয়ালা দেখেছি। আমার এই বড়বেলায় ততদিনে জেনে গেছি কলকাতায় ফুটবল খেলে যাওয়া মেহেরাজুদ্দিন বা ইশফাক আহমেদের নাম। বছর কয়েক আগে ধোনিদের সঙ্গে জাতীয় দলে খেলে ফেললেন পারভেজ রসুল।– এসব তথ্য সামনে এলেই সাইকেলে শাল-কম্বল ঝোলানো সেই ছেলেটার কথাই মনে আসে। মনে পরে ছোট্ট রান-আপে পা লক্ষ্য করে বল, আর দুর্দান্ত ব্যাটিং।
গত মাসে সল্টলেক স্টেডিয়ামের সামনে ফিরদৌসের সঙ্গে দেখা। বছর বত্রিশের সাংবাদিক। রিয়েল কাশ্মিরের খেলা কভার করতে কলকাতায় এসছে। ‘কলকাতাকা বাত আলাগ ভাই!’ বলছিল ফিরদৌস। ওর বারামুলার গ্রামের মানুষ কলকাতা জানে, চেনে। শ্রীনগর চেনে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডান স্পোর্টিং। সেদিন ঘরের মাঠে ইস্টবেঙ্গলকে রুখে দেওয়া রিয়েল কাশ্মিরের এক ফুটবলারও ছিলেন। খেলাধূলার হাত ধরে কাশ্মিরের স্বপ্নদেখা কিশোর-যুবকদের গল্প শুনলাম। এ গল্প যখন চলছে, পুলবামার জঙ্গি আক্রমণ তখনও ঢের দূরে। আর তখন আই লিগের শীর্ষস্থানে জ্বলজ্বল করছে প্রথম খেলতে আসা রিয়েল কাশ্মীর।
বছর সাতেক আগে যেবার ফিরদৌসের সঙ্গে পরিচয়, তখন সদ্য স্নাতোকোত্তর পাশ করা ফিরদৌস প্রেস কলোনিতে থাকে। কয়েকটি কাগজ, এজেন্সি আর দিল্লি সহ বিভিন্ন জাতীয়, আন্তর্জাতিক টিভি, পত্র-পত্রিকার সাংবাদিকদের অফিস পাড়া শ্রীনগরের প্রেস কলোনি। কোনও এডিটর অজ্ঞাত পরিচয়ের গুলির নিশানায় ছিলেন। কোনও সাংবাদিক সংবাদ কভার করতে গিয়ে আহত হয়েছেন। রোজ নানান গল্প আর অভিজ্ঞতা শুনেছি সে সময়। দিল্লি বা ভারত সহ দুনিয়ায় দাবিদাওয়া পৌঁছে দিতে লালচকের পাশে প্রেসকলোনির সামনে অহরহ কর্মসূচী নেয় বিভিন্ন সংগঠন। একদিন সেখানেই দেখলাম ২০০৫-এ নোবেল নমিনেশন পাওয়া পারভিনা আহাঙ্গেরকে। নয়ের দশকে সেনা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যাবার পর তাঁর একমাত্র ছেলে এখনও নিখোঁজ। পারভিনা তারপর থেকে উপত্যকায় হারিয়ে যাওয়া মানুষদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলন করেন। হারানো সন্তানের বাবা-মা’দের নেতৃত্ব দেন।
রতন খাসনবিশ, এই বাঙালি নামটি সে পাড়ায় আজও ঘোরাফেরা করে। সেবার রতনবাবু মানুষটির খোঁজে কাশ্মির টাইমসের অফিসে গিয়ে শুনলাম তিনি কাজ ছেড়েছেন। সেদিন কাশ্মিরী পণ্ডিত এক ভদ্রমহিলা আমায় চা খাওয়ানোর পর সাফ বললেন, রতনবাবু নেই। তবে একজন হাফ-কাশ্মিরী-বাঙালি আছেন। বলেই দেখিয়ে দিলেন গেটের দিকে, সেখানে চা বেচেন এক প্রবীণ।
কাশ্মিরী প্রবীণ চা-ওয়ালা চার দশক কাটিয়েছেন বাংলায়। মূলত রানাঘাট-নৈহাটিতে। জীবন-জীবিকার ৪০টি বসন্ত নদিয়ায় কাটানো মানুষটি তখনও বাঁচতে চান নিমাইয়ের দেশে। নমকিন চায়ের পাত্র সরিয়ে আমার জন্য মিষ্টি চা বানাতে বানাতে বললেন, বাংলাই শ্রেষ্ঠ। তাঁর ছেলে তখন রানাঘাটে। বাবার ফেলে আসা পথঘাটে সাইকেল চালিয়ে শাল বেচে সে।
সেবার ঘুরতে ঘুরতে ঝিলমের পারে দেখলাম আরেকটি ছেলেকে। এমসি ক্যাশ তাঁর নাম। তখন ২২-২৩ হলে, এখন সে ২৯-৩০ হবে! উপমহাদেশের অন্যতম সেরা Rapper, গানেগানে স্বপ্নের কাশ্মির চায় সে। তার প্রতিবাদ সুরে আশ্রয় নেয়। অবশ্য বৃহত্তর ভারতের অলিগলি তাকে শোনে না, চেনে না। অথচ, বিশ্বের প্রতিবাদী সঙ্গীতের শ্রোতারা তাকে চেনে, ডাকে। এ সব যখন ঘটছে, জানছি, শুনছি, তখন মাঝেমধ্যেই আটকে যাচ্ছি– ছোটবেলার সেই কাশ্মিরী ক্রিকেটারে। ও, মনে পড়ল, সেই ছেলেটিকে আমরা আমাদের শচীনবেলায় ‘কাশ্মিরী’ বলে ডাকতাম।
আজকাল ফেসবুকও রোজকার রুটিন। রানাঘাট, বর্ধমান, দিল্লি, বাঁশদ্রোণী, শিলিগুড়ি, ঢাকা যাতায়াত বহুলাংশেই ভায়া সোশ্যাল মিডিয়া। দিন কয়েক হল, রানাঘাটে এক কাশ্মিরী শালওয়ালাকে মারধরের ছবি ভাইরাল হয়েছে। নাক থেকে রক্ত গড়িয়ে থুতনি হয়ে শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে ছেলেটি বলছে, কিছুতেই বাংলা ছেড়ে যাবে না! যন্ত্রণার এ দৃশ্যে যখন ক্রিকেটার কাশ্মিরী, কাশ্মির টাইমসের সামনের চাওয়ালা চাচা, বন্ধু ফিরদৌস, এমসি ক্যাশের গান, মেহরাজ-ইশফাকের ফুটবল,ঝিলমের পার একাকার, তখন আমারই শৈশবের এক অতি পরিচিতের টাইম লাইনে উঁকি দেয় আরেক যন্ত্রণা।
গল্পটা ভিডিও মারফত ফেসবুকে দিয়েছে নৈহাটির একটি মেয়ে। রানাঘাটে কাশ্মিরী যুবককে মারার পর, নৈহাটির এক পাড়ায় শাল বেচতে আসা এক কাশ্মীরিকে ‘জয় হিন্দ’ বলতে বলেন এক গৃহবধু। তিনি বছর ২৪-২৫-এর মেয়েটির মা। আজব আবদার! নিউটনের তূতীয় সূত্র বা আলু-আখরোটের দাম না। বলতে হবে ‘জয় হিন্দ’। কারণ, এখন এ সবই চলে। আয়েস করে ভর দুপুরে শাল কেনার বাহানায় “আমিও যুদ্ধ চাই” বা ‘শাসিতকে শাসন করা প্রতিটি শাসকের অধিকার, অধিকার তারও’– নরমে-গরমে মধ্যবিত্ত বাঙালি মন নিম্নচিত্তে যখন ক্রমেই বুঝিয়ে দিচ্ছে, যখন মনেমনে আঁকা যুদ্ধ পথে নেমে আসবে ভাবে, আমার স্মৃতিতে হুস করে ক্রিং-ক্রিং সাইকেলে পাড়া বদলায় কাশ্মিরী ছেলেটা। স্কুলফেরতা আরেকজন চেঁচিয়ে জানতে চায়, -‘আমাদের পাড়ায় আসবে তো খেলতে?’ অন্য গলিতে হারিয়ে যাবার আগে, হাত নেড়ে ক্রিকেটার বলে– ‘আসব’। আমরাও গলি বদলাই। নয়ের দশক, তখন উপত্যকা অবরুদ্ধ ছিল, শালওয়ালা নয়। এখন শালওয়ালার নাক ফেটে রক্ত, কাশ্মীরেও বসন্ত এল। সীমান্তে নাকি এবার যুদ্ধ আসে যখন তখন!