পুণ্যব্রত গুণ
আমি আর আমার ভাই জন্মেছিলাম মেডিকেল কলেজে। তখন মেডিক্লেম ছিল না। সবটাই ছিল ফ্রি।
আমার ছেলে জন্মাল ফুলবাগানের এক নার্সিং হোমে। আমার এক শিক্ষিকা সিজারিয়ান সেকশন করেছিলেন। খুব বেশি খরচ হয়নি। তখন আমি কানোরিয়া জুট সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়নের স্বাস্থ্য আন্দোলনে হোল-টাইমার। মাসিক ভাতা তিন হাজার টাকা। স্ত্রীর স্কুলের মাইনে ছিল কম। তবু খরচ সামাল দেওয়া গেছিল।
তার বছর ছয়েক পরে স্ত্রীর পেটে অসহ্য ব্যথা উঠল, গলব্লাডার স্টোন। অপারেশন করেছিল আমারই এক জুনিয়র। তবু এবার খরচ সামাল দিতে ধার করতে হল।
কেউ বুদ্ধি দিল, এমন বিপদে ভরসা হল মেডিক্লেম। তিনজনের মেডিক্লেম, একেকজনের বছরে এক লাখ টাকার কভার। মেডিক্লেম করার কয়েক মাস বাদেই আমারও গলব্লাডার স্টোন ধরা পড়ল। স্টোন অর্থাৎ পাথর নয়, ছোট্ট পাথরের কণা। অথচ ব্যথা হয়। আমার অপারেশন করাব, এদিকে বিমা কোম্পানির বক্তব্য— তোমার অসুখ ‘pre-existing’, আগে থেকেই আছে। তাই ক্যাশ-লেস এর সুবিধা পাওয়া যাবে না।
পয়সা দিয়ে অপারেশন করালাম, উকিলের ভাষায় চিঠি লিখে বললাম কেন আমার অসুখকে ‘pre-existing’ বলা যায় না। অনেকটা পয়সা রি-ইমবার্সড হল।
তারপর গত ১৫ বছরে মেডিক্লেমে কোনও ক্লেম করিনি। আগামী ৪ঠা মার্চ চোখের অপারেশন করাব। ডাক্তার যে লেন্স লাগানোর কথা বলছেন, তাতে ৩৬ হাজার টাকার প্যাকেজ। বিমা কোম্পানি দেবে ২১ হাজার, বাকিটা কো-পেমেন্ট করতে হবে। আমরা কিন্তু এই ১৫ বছরে প্রিমিয়াম হিসেবে প্রায় দেড় লাখ টাকা কোম্পানিকে দিয়েছি।
যেটা বোঝাতে চাইছি তা হল, মেডিক্লেম বা স্বাস্থ্য বিমা থাকলেই যে আপনার পকেট থেকে খরচ হবে না, এমন নয়।
আমার যে মেডিক্লেম বা স্বাস্থ্য বিমার কথা বলছিলাম, তাতে প্রিমিয়াম দিতে হয়েছিল বা হয় ব্যক্তিকে, যিনি ‘ইনশিওর্ড’।
আজ অন্য আরেক ধরনের স্বাস্থ্য-বিমার কথা বলব যাতে ব্যক্তিকে প্রিমিয়াম দিতে হয় না। প্রিমিয়াম দিয়ে দেয় সরকার। তাও কম নয়। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনায় ছিল ৫ জনের পরিবার পিছু বছরে ৩০ হাজার টাকা। ২০১৭ সালের পশ্চিমবঙ্গের ‘স্বাস্থ্য সাথী’ প্রকল্পে পরিবার পিছু কভার পাঁচ লাখ টাকা আর নরেন্দ্র মোদির ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পেও তা-ই, পরিবার পিছু পাঁচ লাখ।
ভাবছেন তাহলে চিন্তা কী? সারা বছরে একটা পরিবারে পাঁচ লাখের বেশি চিকিৎসার জন্য খরচ হয় নাকি? না, ভুল ভাবছেন। আমাদের বিমার আওতাভুক্ত চিকিৎসার জন্য যে খরচ হয় তার দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি খরচ হয় আউটডোর চিকিৎসায়, অর্থাৎ আপনি ডাক্তারকে চেম্বারে দেখালেন, তার পরামর্শ মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালেন, ওষুধ কিনলেন এইসবেই খরচটা হয় বেশি। নিজে প্রিমিয়াম দিয়ে মেডিক্লেম করুন বা সরকার আপনার হয়ে প্রিমিয়াম দিক, কোনোটাতেই বিমা কোম্পানি আপনাকে এ’সব খরচ দেবে না।
আমাদের দেশে মেডিক্লেম, অর্থাৎ ব্যক্তি প্রিমিয়াম দিয়ে বিমা কিনবেন, এমনটা প্রথম দেখা যায় ১৯৮৬ সালে। স্বাস্থ্য বিমায় বেসরকারি অনুপ্রবেশ ১৯৯৯ সালে। আর সরকার বিমা প্রিমিয়াম দিচ্ছেন এমনটা প্রথম দেখা যায় কর্নাটকে ২০০৩ সালে। প্রকল্পের নাম ছিল ‘যশস্বিনী হেলথ ইন্সুরেন্স’। তারপর ২০০৭ সালে অন্ধপ্রদেশে এল ‘রাজীব আরোগ্যশ্রী প্রকল্প’। কেন্দ্র সরকারের উদ্যোগে ২০০৮ সালে সারা দেশ জুড়ে ‘রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা’। ২০০৯ সালে তামিলনাড়ু সরকার নিয়ে এল ‘কলাইগ্নার স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প’। কর্নাটকের ‘রাজীব আরোগ্যশ্রী প্রকল্প’ আর হিমাচল প্রদেশের ‘আরএসবিওয়াই প্লাস’ ২০১০ সালে।
সবচেয়ে বেশি আমাদের রাজ্যে আলোচিত হচ্ছে ‘আরএসবিওয়াই’, ‘স্বাস্থ্য সাথী’ আর ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্প।
প্রথমে ‘আরএসবিআই’-এর কথায় আসি। ২০১০ সালের পয়লা এপ্রিল এই প্রকল্পের শুরু। অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষ, বিশেষত ১০০ দিনের কাজের তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের পরিবারগুলোর হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসার খরচ জোগানোর জন্য এই প্রকল্প। এক-একটি পরিবারের ৫ জন সদস্য অবধি সুযোগ পান, পরিবার পিছু সর্বমোট ত্রিশ হাজার টাকা। কার্ড তৈরি সময় পরিবার পিছু ৩০ টাকা খরচ হয়, আর কোনও খরচ নেই। প্রিমিয়াম দেয় কেন্দ্র সরকার শতকরা ৬০ ভাগ এবং রাজ্য সরকার শতকরা ৪০ ভাগ। ক্যাশলেস, পেপারলেস, স্মার্ট কার্ড সুবিধা। এটি চালানো হয় পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে। অর্থাৎ বিমা কোম্পানিগুলো বেসরকারি; হাসপাতাল সরকারি বেসরকারি দুই হতে পারে। ২০১০ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় সারা দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ বিমার কভারে। আমাদের রাজ্যে বিমার কভারে ছিলেন ১৭ শতাংশ মানুষ।
এবার ‘স্বাস্থ্য সাথী’। ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি, সরকারিভাবে শুরু হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আর বাস্তবে কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি। যাঁরা ‘আরএসবিওয়াই’ তালিকায় ছিলেন তাঁরা ছাড়াও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যরা, আইসিডিএস ও আশা কর্মীরা, সিভিক ভলেন্টিয়ার, শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মীরা এই সুবিধা পান। ৪৫ লক্ষ পরিবার অর্থাৎ প্রায় আড়াই কোটি মানুষ ‘স্বাস্থ্য সাথী’-র অধীনে আছেন। পরিবার পিছু বছরে ৫ লক্ষ টাকার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসার খরচের কভার। সদস্যসংখ্যার কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। ২০১৭-২০১৮ সালে এর দায়িত্ব ছিল দুটি সরকারি বিমা কোম্পানির। ২০১৮-২০১৯ সালে এই দায়িত্ব পেয়েছে দুটি বেসরকারি বিমা কোম্পানি।
‘আয়ুষ্মান ভারত’-এর প্রসঙ্গে আসা যাক।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট ঘোষণার সময় এই প্রকল্প ঘোষিত হয়েছিল। ১০ কোটি পরিবার অর্থাৎ প্রায় ৫০ কোটি মানুষ এই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন। পরিবারগুলিকে চিহ্নিত করা হবে ২০১১ সালের সোশিও-ইকনমিক কাস্ট সেন্সাস-এর উপর ভিত্তি করে। খরচে কেন্দ্র ও রাজ্য বহন করবে ৬০:৪০ অনুপাতে। রাজ্যে চলমান অন্য সরকারি স্বাস্থ্য বিমাগুলোর ‘আয়ুষ্মান ভারত’-এ লীন হয়ে যাওয়ার কথা। রাজ্যে কোনও বিমা কোম্পানির মাধ্যমে অথবা ট্রাস্ট বা সোসাইটির মাধ্যমে অথবা মিশ্র কোনও পদ্ধতিতে এই প্রকল্প চলার কথা।
আমরা যদি দেশের রাজ্যগুলোকে দেখি, তাহলে দেখা যাবে ইতিমধ্যেই সরকার প্রিমিয়াম দিয়ে যেখানে যেখানে স্বাস্থ্য বিমা চালান, সেই রাজ্যগুলো হল অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, গুজরাট, গোয়া, কেরালা, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ু।
আমাদের রাজ্যে ২০১৮ সালের ১৫ই অক্টোবর নরেন্দ্র মোদির ‘আয়ুষ্মান ভারত’ আর মমতা ব্যানার্জির ‘স্বাস্থ্য সাথী’-র মিলন হয়েছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করলেন ‘আয়ুষ্মান ভারত’-এর সঙ্গে ‘স্বাস্থ্য সাথী’-র আর সম্পর্ক থাকবে না। কারণ হিসেবে বলা হল, ‘আয়ুষ্মান ভারত’-এর সুবিধা-প্রাপকদের কাছে নরেন্দ্র মোদির ছবি সহ চিঠি যাচ্ছে।
কিন্তু আয়ুষ্মান ভারত কেবল ১০ কোটি পরিবারের জন্য পরিবার পিছু বছরে পাঁচ লাখ টাকার কভারই নয়। এই প্রকল্পে ঘোষণা করা হয়েছিল সারাদেশে দেড় লক্ষ হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টার তৈরি হবে। ঠিক দু’দিন আগে পশ্চিমবঙ্গের ১৬২টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র কিন্তু সু-স্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসেবে উন্নীত হয়েছে। আগে একটি সাব সেন্টারে দুজন করে এ.এন.এম থাকতেন। এই ১৬২টি সু-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কিন্তু নিয়োগ করা হয়েছে ১৬২ জন গ্রেড টু স্টাফ নার্সকে। এরা জিএনএম, বিএসসি নার্সিং অথবা এমএসসি নার্সিং করেছেন। এঁদের ৬ মাসের ব্রিজ সার্টিফিকেট ইন কমিউনিটি হেলথ নার্সিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। রাজ্য সরকারের ওয়েবসাইট ডাবলু বি হেলথ-এ গিয়ে আদেশের আর্কাইভ দেখুন। কোন জেলায় কতগুলো সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র তার হিসেব পাবেন। পরিষ্কার দেখতে পারবেন কোন জেলার জন্য ন্যাশনাল হেলথ মিশনের তহবিল থেকে কত অর্থ দেওয়া হচ্ছে।
দেশবাসীর স্বাস্থ্যের সমস্যার সমাধানের পথ বিমা নয়, তা সে ‘স্বাস্থ্য সাথী’ হোক বা ‘আয়ুষ্মান ভারত’। ঘোষণা-মতো সবকিছু চললেও প্রায় দেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ সরকারি স্বাস্থ্যবিমার আওতার বাইরে থাকবেন।
সরকারি অর্থে চলা স্বাস্থ্য বিমাগুলো কোনওটাই মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসার দায় বহন করে না অথচ তাতেই মানুষের খরচ হয় সবচেয়ে বেশি। সরকার যদি খরচ করবেই তাহলে সেই খরচ হোক সরকারি পরিকাঠামো উন্নত করে তার মাধ্যমে অধিকাংশ পরিষেবা প্রদান করার জন্য।
২০১০ সালে তৎকালীন যোজনা কমিশন এক উচ্চস্তরীয় বিশেষজ্ঞ দল নিয়োগ করেছিল ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ কীভাবে বাস্তবায়িত করা যায়, তার সুপারিশ করার জন্য।
ডা কে শ্রীনাথ রেড্ডির নেতৃত্বাধীন সেই বিশেষজ্ঞ দল হিসেব করে দেখিয়ে দিয়েছিল কীভাবে জিডিপির সামান্য অংশ স্বাস্থ্য খাতে সরকারি খরচে বৃদ্ধি করলেই সরকার সমস্ত নাগরিকের প্রাথমিক, দ্বিতীয় স্তরের এবং অন্তিম স্তরের অত্যাবশ্যক পরিষেবাগুলো দিতে পারে।
আর ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার মানে সবার জন্য সমান মানের স্বাস্থ্য পরিষেবা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বারবার প্রমাণিত হয়েছে গরিব আর ধনবান মানুষের জন্য আলাদা স্বাস্থ্য পরিষেবা চললে আখেরে গরিব মানুষেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। ধনীদের জন্য চালু পরিকাঠামো গরিবদের জন্য চালু পরিকাঠামো থেকে সমস্ত শাঁস, সমস্ত রস শুষে নেয়।
তাই স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিমা নয়, সবার জন্য স্বাস্থ্যের দাবিতে সরব হোন।