Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শুভাশিস মৈত্রের কবিতা

শীতের কবিতাগুচ্ছ

 

যত দিন যায়, পুকুরের নীরবতা বাড়ে,
গাছের পাতারা ম্লান হয়ে আসে বিকেলবেলায়
কেউ কেউ পার্কের বেঞ্চে বসে কথা বলে যায়
গ্যাস বেলুনওয়ালা নিয়মিত আসে এ পাড়ায়
রেলিংয়ের গা ঘেঁষে ঘুমোয় কুকুর
পার্কের বেঞ্চের নীচে পিঁপড়ের সারি
এইখানে আর একটু পরে এসে দাঁড়াবে ঝালমুড়িওয়ালা
খবরের কাগজের ঠোঙায় দশ টাকার মুড়িমাখা কিনে খাবে অনেকেই
দূর থেকে লোকাল ট্রেনের শব্দ ভেসে আসে
মনে হয় ডাউন লক্ষ্মীকান্তপুর চলে গেল
পিঁপড়ের দল যৌথ প্রচেষ্টায় মরা প্রজাপতি নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে
পিঁপড়েদের গর্তের ভিতরে আলো যায় না
সেইখানে তারা দল বেঁধে বাস করে।

 

কুয়াশা নেমেছে মাঠে
দূরে দূরে বহুতলে আলো জ্বলে
শহর থেকে বিমানবন্দরে যাওয়ার এটাই এখন প্রধান রাস্তা
এই ডিসেম্বরের সন্ধ্যায়, কলকাতার এত কাছে
পাখি আর ফাঁকা জমি, নিরাপদ ছিল না কখনও
সন্ধ্যা নামলে
শহর উজ্জ্বল হয়, এশিয়ান পেন্টস
মিশরীয় সভ্যতা অথবা কোনারকের সূর্য মন্দিরের মতো।
কখনও ভুল করে
গভীর রাতে
দেশপ্রিয় পার্কের ট্রামলাইনের সামনে চলে এলে মনে হয়
কে যেন বলছে – ‘হাঁসের নীড়ের থেকে খড় পাখির নীড়ের থেকে খড় ছড়াতেছে…’
পৃথিবীর সব মানুষের, এমনকী সব প্রাণীদেরও কান্নার ভাষা একই থেকে গেল
দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধের পরও
লজ্জাবতী, সন্ধ্যামালতী, নয়নতারারা, এইসব ফুল আজকাল এখানে বড় কম দেখা যায়
ইলেকট্রিকের তারের উপর সারাদিন কাক বসে বসে সব দেখে যায়
আমের আঁটি থেকে যে বাঁশি হয়
ক’জনই বা জানে
শীতের সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে
খুব নিচু দিয়ে বাদুড় উড়ে যায়
সকালে সেই সব কথা মনে থাকে না।

 

বালি. ইট, চুন, সুরকি, স্টোনচিপস
বুঝতে হবে
যদি তুমি রাজনীতি বুঝতে চাও।
খাদান মালিকরা কী বলছেন
মন দিয়ে শোনো।
মা ব্রিজের উপর কমিউনিস্ট চিনের মাঞ্জা ওঁত পেতে আছে
আত্মহত্যার খবর আজকাল আর খবরের কাগজ
প্রথম পাতায় ছাপে না
শীতকালে মেঘ করেছে
পার্ক সার্কাসের মোড়ে শিশু বেলুনওয়ালারা ছোটাছুটি করছে
সরকার বলেছে হিজরেরা দৃষ্টিকটু
রাস্তার মোড় থেকে ওদের সরিয়ে দেওয়া হবে
খবর পেলাম
টাকির কাছে ইছামতী নদীতে এখনও বাংলা দেশের
পতাকা লাগানো নৌকা নিশ্চিন্তে ভেসে যায়
বসিরহাটের দিকে চিকেন নাকি বেশ সস্তা হয়ে গিয়েছে
সীমান্ত এলাকার মুরগি, গরু, বিএসএফ, সবই রহস্যে ঢাকা।

 

সরল তালপাতা থেকে ল্যাপটপ
অক্ষরের পানসি ভেসে যায়
যুদ্ধ মহামারী পার হয়ে।
একটা সরল সকাল
রাস্তার মৌন মিছিল
রেলিঙে লুটিয়ে থাকা দলীয় পতাকা…
পাড়ার ফুটবল খেলা শেষের নীরবতার মতো
সন্ধ্যা নেমে এল জানলায়।
আজ খুব বড় চাঁদ উঠেছে আকাশে
রাতের ট্রেনের শব্দ
কোনও দিন হয়তো আমরা এতটাই সভ্য হয়ে যাব যে
লাটাই বা দাড়িয়াবান্দা নাম দিয়ে
নতুন গাড়ি বের করবে জাপানের মারুতি-সুজুকি
বা কোনও বিস্কুটের নাম হবে এক্কা-দোক্কা।

 

শূন্য তো অদৃশ্য
যা নেই।
তবু কত সহজেই বলা হয়
একটা, দু’টো বা তিনটে শূন্যের কথা
শূন্য কী বহু
অসংখ্য
না একটাই
মহাশূন্যের ভিতরে কি আরও অনেক শূন্যেরা বাস করে
শূন্যের প্রতিবেশী
নক্ষত্রেরা
মনে হয়
শূন্যতার ভাষা জানে
যে ভাষায় কথা বলে অরণ্য-মরুভূমি
যে ভাষায় মৃত্যু ডাকে
উষ্ণায়নে নেমে আসা বরফের স্রোত।

 

মানুষ গুণেই চলেছে
সেই কবে, কোন অতীত থেকে
কখনও দূরত্ব, কখনও জনসংখ্যা,
কখনও বইয়ের পাতা
কখনও গণপিটুনিতে নিহতের তালিকা
সংখ্যাই সভ্যতা
এবং শব্দ
শব্দের ভিতরে সংখ্যারা বাস করে
মাত্রা থাকে
তাই শব্দ সুর হয়
শব্দ আর সংখ্যা থেকে
জন্ম নেয়
প্রেম ভালবাসা
সমুদ্রের জলের ঢেউ
পিঁড়ি পেতে বসার আওয়াজ
ফোয়ারার মতো।