Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ ও আমরা

স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ

কৌশিক দত্ত

 

স্বাস্থ্য আসলে শুধু একটা শারীরিক অবস্থা নয়, মানসিক অবস্থাও বটে। আরেকটু এগিয়ে বলা যায়, স্বাস্থ্য একটা সাংস্কৃতিক, দার্শনিক, রাজনৈতিক ব্যাপার… এই সবকিছুর মধ্যে প্রতিফলিত এবং এসবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শুধু ব্যক্তির নয়, একটি সমাজের, তথা রাষ্ট্রের দর্শন ও (রাজ)নীতি পরিস্ফুট হয় তার স্বাস্থ্যচেতনায় এবং স্বাস্থ্যনীতিতে। ব্যক্তির স্বাস্থ্যচেতনা প্রভাবিত করে সেই ব্যক্তির নিজস্ব স্বাস্থ্য ছাড়াও গণস্বাস্থ্যকে (যেমন যক্ষ্মা, পোলিও জাতীয় রোগ বা পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে আমার আচরণ জনস্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে), আবার রাষ্ট্র ও সমাজের স্বাস্থ্যনীতি ও ভাবনা প্রভাবিত করে সমষ্টির মতোই ব্যক্তিকেও। স্বাস্থ্যনীতি বা স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্বন্ধে কোনও আলোচনা তাই একটি সরল সোজাসাপ্টা দোষারোপ বা গুণগানের চারণগীতি হতে পারে না। আলোচনার পথটি অতি সর্পিল, তার অজস্র বাঁক ও গোলকধাঁধা।

স্বাস্থ্য পরিষেবার বেসরকারিকরণ ও তার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই কয়েকটা সত্যের মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন।

  1. অন্য সব ক্ষেত্রের মতো স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও সরকারি ও বেসরকারি পরিষেবার মধ্যে একটি প্রায়োগিক ও দার্শনিক টানাপোড়েন চিরকালই ছিল। সরকার নিয়ন্ত্রিত জনমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনাদি কাল থেকে বিশ্ব জুড়ে চালু ছিল এবং হঠাৎ তা ভেঙে যাচ্ছে, এমন বিশ্বাসের কোনও ভিত্তি নেই। স্বাস্থ্য পরিষেবাকে রাষ্ট্রের আইনে নিয়ন্ত্রণ করার প্রাচীনতম সুসংহত প্রচেষ্টা সম্ভবত লক্ষ্য করা যায় হামুরাবির কোডে, কিন্তু তা কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সংস্থান মাত্র। জনসাধারণের জন্য সরকারি খরচে স্বাস্থ্য পরিষেবা ওয়েলফেয়ার স্টেটের ধারণাটির মতোই আগাগোড়া বিতর্কিত, নানা বাধার সম্মুখীন এবং বহু ক্ষেত্রে ব্যর্থ।
  2. দায় এবং অধিকার, দুই দিক থেকে বিচার করেই বলা যায় যে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকার বহির্ভূত সাধারণ নাগরিকের ভূমিকা আছেই, তাঁদের অংশগ্রহণ জরুরি। এই অংশগ্রহণকে বেসরকারি প্রচেষ্টা, পাব্লিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি), ইত্যাদি বিভিন্ন নাম দেওয়া যায়, অংশগ্রহণের বা নিয়ন্ত্রণের রকমফের অনুসারে। এই অংশগ্রহণের সম্পর্কটি দ্বান্দ্বিক এবং গতিশীল (ডায়নামিক) একটি ভারসাম্য বজায় রাখে, যাকে আপাত দৃষ্টিতে স্থিতাবস্থা বলে মনে হয়। ভারসাম্য বজায় রাখতে পারা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
  3. অন্তত আক্ষরিক বা তাত্ত্বিক অর্থে বেসরকারিকরণ মানেই বাণিজ্যিকীকরণ নয়, যদিও বাস্তবে অনেকটা তাই দাঁড়িয়েছে। একবিংশ শতকের পৃথিবী নামক বৃহৎ বাজার-গ্রহে দাঁড়িয়ে যখন জল-স্থল-অন্তরীক্ষ ও মনুষ্যত্বের তিনভাগ বিক্রয়যোগ্য এবং একভাগ পুণর্নবীকরণযোগ্য মূলধন, অর্থাৎ অবাণিজ্যিক “মানবধন” হিসেবে পড়ে থাকা অচল পয়সাটিকেও প্রথম সুযোগে গলিয়ে ধাতুশিল্পের কাঁচামালে রূপান্তরিত করাই বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিসংগত, তখন আর কী বা আশা করা যায়? স্বয়ং সরকার বাহাদুর যখন বাণিজ্যিকভাবে অসফল বলে ব্যস্ত রুটের ট্রেন বা সম্মানিত গবেষণা সংস্থার অনুদান বন্ধ করে দিতে উদ্যত, তখন বেসরকারি বিনিয়োগকারী নিজ দায়িত্বে উড্ডীন রাখার জন্য মনুষ্যত্বের ধ্বজাটি কিনবেন কোন দোকান থেকে?
  4. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সরকারি খরচে যেখানে নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া হয়, তা প্রায়শ অপ্রতুল (অনেক ক্ষেত্রে লোক দেখানো মাত্র), পরিষেবা পেতে গেলে নাগরিকদের অনেক লুকনো খরচের মুখোমুখি হতে হয় অথবা এমন জটিল আমলাতান্ত্রিক অলি-গলি পেরোতে হয় যে পরিষেবাটি তাঁদের অনেকেরই নেওয়া হয় না। নিয়মাবলি সরল করতে গেলে কিছু ধুরন্ধর মানুষ সরকারি সুবিধা এবং অর্থ নিজের খুশিমতো ব্যবহার করেন। অপরপক্ষে নিয়মাবলি অতি জটিল রাখার সুবিধা হল অনেক মানুষ সরকারি ব্যবস্থাকে এড়িয়ে বেসরকারি পরিষেবা নিতে যান, যার ফলে সরকারি কেন্দ্র ও কোষাগারের ওপর চাপ কমে।
  5. “কোষাগার” ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দায়িত্ব পালন করতে গেলে গৃহস্থের মতোই সরকারেরও প্রয়োজন হয় অর্থ। অবশ্য “সদিচ্ছা” শব্দটিও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেটির অভাবে গৃহস্থ সোমরসের পিছনে এবং সরকার নিজের পিঠ চাপড়ানোর খাতে যাবতীয় অর্থ ব্যয় করতে পারেন, যার ফলে পরিবার বা দেশের স্বাস্থ্য-শিক্ষা ইত্যাদির জন্য ব্যয়-বরাদ্দে টান পড়ে। কারণ যাই হোক, যেসব দেশে সরকার খাদ্য, পানীয় জল, বাসস্থান, পয়ঃপ্রণালী ইত্যাদি আবশ্যিক নাগরিক প্রয়োজনগুলো মেটাতে হিমসিম খাচ্ছে, সেইসব উন্নতিশীল বা অনুন্নত দেশগুলির সরকার উচ্চ-প্রযুক্তি নির্ভর ব্যয়বহুল আধুনিক চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে পারবে, এই আশায় বুক বাঁধা কঠিন।
  6. স্বাস্থ্য পরিষেবার বেসরকারিকরণ ধনতন্ত্রের সামগ্রিক আধিপত্যের একটি অংশমাত্র। অতএব বিশ্ব জুড়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ তথা বাণিজ্যিকীকরণ চলছে ধনতন্ত্রের শর্ত মেনেই। ভারতের মতো দেশগুলিতে এই পরিবর্তন এসেছে আচমকা অভিঘাতের মতো। আমাদের দেশে সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি ও মূল্যবোধের অবসান হয়ে ধনতন্ত্রের জমি প্রস্তুত হতে দেরি হয়েছে, বা বলা ভালো, সেই প্রক্রিয়া অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বণিকেরা যখন বাজার দখল করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ভারতের আম-নাগরিক সেই স্রোতে ভেসে পড়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। অথচ সময় ও জোয়ার কারও জন্য অপেক্ষা করে না। বাজারি জোয়ার অতর্কিতে আমাদের উঠোনে উঠে এসে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে হাল বৈঠা ছাড়াই। আমরা তাই এই পরিবর্তনে বিহ্বল, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, যুগপৎ প্রলুব্ধ ও আতঙ্কিত।

একটু ভেবে দেখা যাক, স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের ভূমিকা কী হতে পারে বা হওয়া উচিত? জীবনের শুরু থেকে শেষ অব্দি প্রত্যেক নাগরিকের যাবতীয় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত দায়িত্ব কি সরকারের নেওয়া উচিত? উচিত হলে তা করা কি বাস্তবে সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তাহলে কোন ধরনের দায়িত্ব কতটা পরিমাণে সরকারকে অবশ্যই নিতে হবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার আগে জানতে হবে স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যসেবা বলতে আমরা কী বুঝি?

পরিচিত কয়েকজন শিক্ষিত মানুষকে প্রশ্ন করলাম এই বিষয়ে তাঁরা কী ভাবছেন? তাঁরা জানালেন, সরকারি হাসপাতালে সবাই বিনা পয়সায় দেখাতে পারবে, বিনা পয়সায় ওষুধ পাবে-এরকম হলে ভালো হত। কোন ধরণের রোগের কতদূর অব্দি চিকিৎসা হবে, কোন মানের পরিষেবা দেওয়া হবে, দক্ষ কর্মীদের নিয়োগ করা হবে কিনা, তাঁদের আকর্ষণ করার  জন্য কী ব্যবস্থা নেবে সরকার, বিনামূল্যে বিতরণের ওষুধ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কি সরকার বেসরকারি প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে বাজার দরে কিনবে, তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে সরকার কী ব্যবস্থা নেবে… এসব বিষয়ে তাঁদের বিশেষ ভাবনা নেই দেখা গেল। আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াই না আমরা সচরাচর। স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের ভূমিকা বলতে কি শুধু হাসপাতাল খুলে রাখা আর চটজলদি হাতে বিনে পয়সার ওষুধ ধরিয়ে দেওয়া বোঝায়? হাসপাতালে যাতে আপনাকে কম যেতে হয়, তার বন্দোবস্ত করবে কে?

সাধারণত “চিকিৎসা” বলতে আমরা যা বুঝি, তা সুস্বাস্থ্যের পথে একটা অংশ মাত্র। স্বাস্থ্য পরিষেবার তিনটি পর্যায়।

মূলত দুই নম্বর অংশটিতে বেসরকারি উদ্যোগ ও বিনিয়োগ সর্বাধিক, কারণ এই অংশটিই লাভজনক। অথচ জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক নম্বর অংশটি এবং সেই পর্যায়েই সবচেয়ে বড় ভূমিকা সরকারের। দুঃখের ব্যাপার, আমরা আমাদের মননে এই অংশটিকে গুরুত্ব দিই না। আমাদের যাবতীয় স্বপ্ন, চা-চক্র বিপ্লব, আশঙ্কা, প্রস্তুতি ও ভাঙচুর উৎসব দ্বিতীয় অংশটিতেই আটকে যায়। বুদ্ধিমান রাষ্ট্রনেতারা বোঝেন, সুস্থতা এদেশের মানুষের কাছে গৃহবধূর মতো “টেকেন ফর গ্রান্টেড”। একমাত্র অসুস্থতাকেই আমরা টের পাই, সুস্থতাকে নজরই করি না। সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যের যদি উন্নতি হয়, গড় আয়ু বাড়ে বা রোগ কম হয়, তাহলে ভোটদাতারা তা খেয়ালই করবেন না। বদলে সহসা অসুস্থ হয়ে পড়া মানুষের বাড়ির দরজায় জনপ্রতিনিধির নামাঙ্কিত অ্যাম্বুলেন্সের প্রাণ কাঁপানো সাইরেন আর হাসপাতালে ফোন করে স্থানীয় যুবনেতার নাটকীয় হাঁকডাক অনেক বেশি প্রভাব ফেলবে ভোটের বাক্সে। সরকার তাই ক্রমশ এক নম্বর ধাপে ঢিলে হয়ে যান এবং চাপ বাড়ে দুই নম্বর অংশের উপর। যথারীতি সরকারি হাসপাতাল সেই চাপ সামলাতে পারে না। ফলে রোগীরা ছোটেন বেসরকারি হাসপাতাল। তাতে বেসরকারি বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।

ইদানীং সরকারও নীতিগতভাবে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্বের কথা মেনে নিচ্ছেন (বিশেষত জাতীয় সরকার)। মুশকিল হল, এটা দার্শনিক বা রাজনৈতিক স্তরে মেনে নেবার পর রোগ প্রতিরোধ কর্মসূচি আরও ঢিলে হয়ে যেতে বাধ্য। ধনতন্ত্রের শর্তানুযায়ী পুঁজি বিনিয়োগ করা হয় মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই। অতএব বণিক গোষ্ঠীরা বা তাদের উন্নতিকল্পে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সরকার কখনো এমন প্রকল্পে মনোনিবেশ করতে পারে না, যা মুনাফার সম্ভাবনা হ্রাস করে। অবশ্যই কোনও বহুজাতিক কোম্পানি জিকা ভাইরাসের টীকা তৈরি করে বহুমূল্যে বাজারজাত করতে পারে, কিন্তু পরিচ্ছন্নতা, পরিশ্রুত পানীয় জল বা সুষম আহারের জোগান, জীবন-শৈলীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, ইত্যাদিতে সরকারি ও সামাজিক নজর কমে যায়। চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য পর্যবসিত হয় ক্রয় ও বিক্রয়যোগ্য পরিষেবায়।

বস্তুত বেসরকারি চিকিৎসা নিয়ে আমাকে লিখতে বলার সময় সম্পাদক এসব ভাবছিলেন না, আমি নিশ্চিত। এমনকি পাড়ার প্রাইভেট প্র‍্যাক্টিশনার চিকিৎসকের চেম্বারে ব্লাড প্রেশার মাপিয়ে ওষুধ কেনার কথাও ভাবছিলেন না। ভাবছিলেন বড় কর্পোরেট হাসপাতালে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, ক্যান্সারের চিকিৎসা করানো মানুষের কথাই। বৃহৎ ব্যামো বনাম বৃহৎ পুঁজি। ক্যারম বোর্ডের অপর দুই প্রান্তে সরকার ও রোগ। এই অংশটুকুতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক।

রোগী দুই প্রকার। একদল প্রান্তিক, অসহায়। তাঁরা জানেনই না তাঁদের কী রোগ, তার উপশম আদৌ হয় কিসে, হলে কী চিকিৎসা হতে পারে, রোগী তথা মানুষ হিসেবে কী তাঁদের অধিকার! পঞ্চায়েত প্রধান, এমএলএ-র ছোট ছেলের ছোটবেলার বন্ধু, ওঝা, ডাক্তার, ওলাবিবি… ইত্যাদি বিভিন্ন দেবতার ওপর ভক্তি ও ভরসা নিয়ে তাঁরা জীবন সমুদ্রে কোনওমতে ভেসে আছেন। কর্মজীবনের বেশিরভাগটা এঁদের সঙ্গেই কাটিয়েছি। গত কয়েক বছরে নাগরিক ভারতের আরেক নতুন শ্রেণির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। এঁরা ছয় মাস অন্তর স্মার্টফোনের নবতম মডেলটি কেনার জন্য ছটফটিয়ে ওঠেন এবং সাধ্যে না কুলোলে ইন্টারনেট মারফত অ্যান্টি-ডিপ্রেসান্ট কেনার চেষ্টা করেন। এঁরা যখন রোগী হয়ে হাসপাতালে আসেন, তখন ঝকঝকে ফ্লোর টাইলস থেকে শুরু করে এম-আর-আই কম্প্যাটিবল লিডলেস পেসমেকার (যার দাম সাধারণ পেসমেকারের কয়েকগুণ)  অব্দি অনেককিছু তাঁদের প্রয়োজন হয়। সরকারের পক্ষে এসব জোগানো সম্ভব হয় না। ফলে বেসরকারি হাসপাতাল। সেখানে এঁদের দামি জিনিস গছানোর জন্য বিশেষ পরিশ্রম করতে হয় না, স্রেফ “আরো ভালো” জিনিসটার খবরটুকু দিলেই চলে। অতঃপর বহুবছর ধরে তৈরি হওয়া উওভোক্তা সত্ত্বা ও সেরাটা না নিতে পারা মানেই সর্বনাশের মুখে পড়ার ভয় (যা আমাদের বৈজ্ঞাপনিক সংস্কৃতি সযত্নে সৃজন ও লালন করে চলে) বাকিটা এঁদের দিয়ে করিয়ে নেয়। কর্পোরেট হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসা রোগীদের একাংশ আসলে উত্তম ক্রেতা। তাঁদের সংস্পর্শে আসা পরিচিত মধ্যবিত্তদের মধ্যেও তৈরি হয় উচ্চমানের স্বাস্থ্যসেবা কিনতে পারা না পারা নিয়ে মানসিক সংকট। সেই সংকটকে মূলধন করে ফুলে ফেঁপে ওঠে স্বাস্থ্য বাণিজ্য।

স্বীকার করে নেওয়া যাক, স্বাস্থ্য পরিষেবায় বেসরকারি খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণের কিছু বাস্তব সুবিধা আছে। প্রচুর অর্থ বিনিয়োগের ফলে উন্নততর পরিষেবা প্রদান সম্ভব হয়, নিত্যনতুন ওষুধ, যন্ত্র ও পদ্ধতির প্রয়োগ বাস্তবায়িত হয়। ক্রেতা হবার সুবাদে রোগীর কিছু অধিকার জন্মায় এবং সুবিধা হয়। নিজের পছন্দমতো হাসপাতাল, চিকিৎসক, দেখানোর দিন ও সময়, এমনকি কিছুক্ষেত্রে পছন্দ অনুযায়ী চিকিৎসা পদ্ধতিও তাঁরা নির্বাচন করতে পারেন, যা বেশ গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত। কিন্তু সমস্যা হল, এইসব সুবিধে বিশুদ্ধ সফেদ বর্ণে আসে না।

সুবিধের উল্টো দিকটা দেখা যাক। চিকিৎসাক্ষেত্রে কর্পোরেটোক্রাসির প্রতিষ্ঠা বৃদ্ধির সঙ্গে চিকিৎসার খরচ বেড়ে যাওয়া সমানুপাতিক। বড় বাণিজ্যিক খেলোয়াড়েরা নিজেদের মধ্যে যে প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ছে, তা স্বাস্থ্যসেবায় বেমানান। মুনাফা বৃদ্ধির জন্য এবং প্রতিযোগিতায় বাকিদের থেকে এগিয়ে থাকার জন্য কিছু কিছু বড় কর্পোরেট সংস্থা চিকিৎসকদের ওপর নানারকম চাপ সৃষ্টি করে, এমন কথাও প্রায়শ শোনা যায়। চাপ সহ্য করতে না পেরে এবং তার বিরুদ্ধে লড়তে না পেরে চিকিৎসকদের চাকরি ছেড়ে দেওয়া, অবসাদগ্রস্ত হওয়া, এমনকি আত্মহত্যা করার ঘটনাও অজানা নয়। যেসব কর্পোরেট সংস্থাগুলির “ম্যানেজমেন্ট” (যাঁদের অনেকেই আদতে মধ্যবিত্ত কর্মচারী মাত্র) এব্যাপারে কিছুটা হলেও নীতিবাদী, তাঁদের অন্যরকম চাপের মুখোমুখি হতে হয়। মাসের শেষে বারবার লোকসান বা কম মুনাফার হিসেব পেশ করতে করতে অনেকের চাকরি যায়, অনেককে সময় বুঝে ইস্তফা দিয়ে অন্যত্র কাজ খুঁজতে হয়। যেখানে স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রটিকে এখন “হেলথ ইন্ডাস্ট্রি” বলা হয়, সেখানে বিনিয়োগকারীরা মুনাফার জন্য ম্যানেজার স্তরের কর্মচারীদের উপর সরাসরি চাপ সৃষ্টি করবেই।

এক মুহূর্ত পড়া থামিয়ে ভেবে দেখুন, আপনিও হয়ত এরকম কোনও কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে রেখেছেন স্টক মার্কেটে। আপনিও ডিভিডেন্ড পেতে চান, অথবা চান চড়া দামে শেয়ারগুলি বিক্রি করে লাভবান হতে। তা না পেলে ক্ষুব্ধ হবেন আপনিও। অর্থাৎ বিনিয়োগকারী হিসেবে এই চাপ দেবার প্রক্রিয়ায় আপনিও সামিল। এই প্রবল চাপের মধ্যে কিছু সংখ্যক শিক্ষিত চাকুরিজীবী মানুষ বেশিদিন মূল্যবোধের নিশান বইতে পারবেন কিনা নিশ্চিত নই। আগামী দিনে স্বাস্থ্য-বাজারে মানবিকতা ক্রমশ দুর্মূল্য হয়ে উঠবে আপনার কেনা শেয়ারগুলির দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।

গবেষণা ও আবিষ্কারের কথা যদি ধরি, তবে মানতেই হবে যে ব্যবসায়িক পুঁজির মদতে একমাত্র সেই গবেষণাই চলতে পারে, যার উজ্জ্বল বাণিজ্যিক ভবিষ্যৎ আছে। এমন বহু উদাহরণ আছে, যেখানে পেটেন্টের আওতায় না থাকা কার্যকর ওষুধ নিয়ে গবেষণা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং নতুন আবিষ্কৃত অগ্নিমূল্য ওষুধের পক্ষে যাবতীয় “বৈজ্ঞানিক তথ্য” জোগাড় করে (কিছু ক্ষেত্রে উৎপাদন করে) সারা বিশ্বের চিকিৎসকদের সেই ওষুধ ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের বিষয়ে এ এক মনোগ্রাহী তথ্য, যে বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়।

এসব নেতিবাচক দিক সত্ত্বেও চিকিৎসা পরিষেবা দানের ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগের কিছু অবদান আছে, কিন্তু ভারতের মতো দেশে চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগগুলি এখন পর্যন্ত মূলত বিষ-ফলই ফলিয়েছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলিতে অর্থের বিনিময়ে যাঁরা শিক্ষা ক্রয় করতে আসেন, তাঁদের পাশ করিয়ে দেবার দায় থাকে কলেজের অধিকর্তা ব্যবসায়ীদের এবং একইসঙ্গে থাকে শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচ করে মুনাফা বৃদ্ধির প্রবণতা। এই দুয়ের যোগফল, হাতে গোনা দু-চারটি ভালো প্রাইভেট কলেজ ছাড়া বাকি বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলিতে বিপুল ক্যাপিটেশন ফি-র বিনিময়ে ন্যূনতম প্রশিক্ষণে নিশ্চিত পাশের গ্যারান্টি। বহু কোটি টাকার বিনিময়ে এভাবে যাঁরা ডিগ্রি কিনতে শুরু করেছেন, তাঁদের জীবনের অনেকটা সময় যাবে ক্রমশ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে চিকিৎসাবিদ্যার জ্ঞান আহরণ করতে এবং ঋণের টাকা শোধ করতে। তাঁদের পক্ষে বাণিজ্যিক চাপের ঊর্ধ্বে উঠে বিজ্ঞানসম্মত মানবিক চিকিৎসা করা দুরূহ বলেই মনে হয়।

অর্থাৎ চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সুযোগ নিয়ে পরিষেবা আপনি কিনতে পারলে বেশ কথা, নইলে ভগবান ভরসা। চিকিৎসাক্ষেত্রে যাবতীয় উন্নয়ন মূলত তাঁদের কথা মাথায় রেখেই হচ্ছে, যাঁরা অর্থমূল্যে তা কিনতে সক্ষম। ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ইন্সিওরেন্স ইত্যাদি আছে, যা অতি রহস্যময় ব্যবস্থা। সে বিষয়ে লেখার দায়িত্ব নিয়েছেন ডঃ পুণ্যব্রত গুণ, তাই পুনরুক্তি এড়িয়ে যাচ্ছি।

এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে সরকার কী করতে পারে?

প্রথমত স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয় বাড়াতে পারে, যা অবশ্য কর্তব্য। বহু দেরি করে পাশ হওয়া ন্যাশনাল হেলথ পলিসিতে শেষ অব্দি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বর্তমান ১% থেকে বাড়িয়ে জিডিপির ২.৫% ব্যয় বরাদ্দ করার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে, যা অনেকটা কানা মামার মতো, যা নেই মামার চেয়ে ভালো হলেও আদতে কানা এবং সেটুকুও কবে বাস্তবায়িত হবে, তা জানা নেই। আপাতত এতেই সন্তুষ্ট হওয়া ছাড়া গতি নেই। এই মুহূর্তে তো একথাও বলতে পারব না যে রাফাল না কিনে স্বাস্থ্য কেনার কথা ভাবতে পারত সরকার, কারণ সীমান্তে উড়ছে পাকিস্তানের এফ-১৬ এবং আকাশ যার মুলুক তার, ইত্যাদি আপ্তবাক্যের চেয়ে বড় সত্যি ভোটমুখী ভারতে আর কিছু হতেই পারে না। পরবর্তী প্রশ্ন হল, এই বরাদ্দ টাকা নিয়ে সরকার ঠিক কী করবে? কী করা উচিত?

  1. অনেকগুলো বড় বড় অট্টালিকা বানিয়ে ফেলতে পারে এবং গ্রামে গ্রামে রেডিয়োথেরাপি বা নিউরোসার্জারি ইউনিট খোলার স্বপ্ন দেখতে পারে। কিছু বিরল রোগের চিকিৎসার জন্য বহু-কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশ থেকে ওষুধ আনিয়ে দু-চারজন মানুষকে কোনওক্রমে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। এর প্রত্যেকটাই সাধু উদ্যোগ, কিছু ক্লিষ্ট মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তাঁদের আশীর্বাদ পেতে পারবে সরকার। কিন্তু সীমিত আর্থিক ক্ষমতা এবং বহুজনহিতায় নীতি মাথায় রাখলে তর্ক উঠতেই পারে, এটা সঠিক পরিকল্পনা কিনা।
  2. সরকার মূলত প্রাথমিক চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষার উপর নজর দিতে পারে। প্রাথমিক স্তরে রোগ নির্ণয় এবং সুচিকিৎসা হলে জটিল হয়ে ওঠা রোগীর সংখ্যা কমবে। পাশাপাশি গ্রাম, মহকুমা, জেলা ও রাজ্যস্তরের সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার মধ্যে সুন্দর সমন্বয় ও বৈজ্ঞানিক রেফারাল ব্যবস্থা গড়ে তুললে শহরের হাসপাতালগুলির ওপর চাপ কমানো যায় এবং সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েই সাধারণ মানুষের চিকিৎসার অনেকটা সামাল দেওয়া যায়। ভারতের অনেকগুলি প্রদেশে বলিষ্ঠ প্রাথমিক স্বাস্থ্য নেটওয়ার্ক ছিল, যা ধ্বসে গেছে, কিন্তু এখনও তাকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব।
  3. প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের শ্রমকে কাজে লাগিয়ে সরকার প্রতিরোধযোগ্য রোগগুলিকে মূলেই নাশ করার চেষ্টা করতে পারে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজে লাগানো যায় বিস্তৃত সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাটিকে। সুষম আহার, পরিশ্রুত পানীয় জল, স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান, নিকাশি ব্যবস্থা, ইত্যাদির দিকে নজর দেওয়া যায়।

এই ২ ও ৩ নম্বর কাজগুলি তর্কাতীতভাবে সরকারের দায়িত্ব এবং এসবে সরকারের অংশগ্রহণ নেই, এমন কথা কোনও নিন্দুক বলতে পারবে না। কিন্তু যতটা করা দরকার, তার কাছাকাছি কিছু করা হয় না বা হবে না, কারণ করলে তা হবে পুঁজিপুতিদের স্বার্থবিরুদ্ধ। এসবের বদলে সরকার দরিদ্র জনগণকে বেসরকারি ক্ষেত্রগুলি থেকে স্বাস্থ্যসেবা কিনে দিতে আগ্রহী। অপেক্ষাকৃত অল্পমূল্যে হলেও বেসরকারি সংস্থাগুলি কিন্তু মুনাফা রেখেই স্বাস্থ্য বিক্রি করবে এবং কোন পরিস্থিতিতে কোন সেবা আপনাকে বিক্রি করা হবে, একবার অনেকটা কিনে ফেলার পর সেই বছরে দ্বিতীয়বার মারণ রোগে আক্রান্ত হলে আপনি আর আরোগ্য ক্রয় করতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে বিস্তর সংশয় থেকে যাবে। এই সংশয়ের মধ্যেই স্বাস্থ্যবীমা নামধারী শিখণ্ডীর আড়ালে লুকিয়ে ক্রমাগত শরক্ষেপণে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা নামক বৃদ্ধ পিতামহকে বধ করা হবে। ন্যাশনাল হেলথ পলিসি থেকে শুরু করে ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন বিল, সর্বত্র এই মনোভাব স্পষ্ট যে স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং চিকিৎসা-শিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকরি বিনয়োগকারীদের বাণিজ্যের মুক্তাঞ্চল উপহার দিতে সরকার আগ্রহী।

একটি প্রশ্নে শিক্ষিত সাধারণ মানুষ বিচলিত… সরকার এই কর্পোরেট স্বাস্থ্য-বাজারটিকে নিয়ন্ত্রণ করে না কেন? ভারি আশ্চর্য প্রশ্ন। আজকের অর্থনৈতিক দর্শনে এই নিয়ন্ত্রণের ভাবনা সোনার পাথরবাটির মতো। সরকার সিগারেট ও মদ বিক্রেতাদের বাণিজ্যেও উৎসাহ দেয় এবং তাদের উপার্জন থেকে খুশি মনে ট্যাক্স নেয়, এদের উৎপন্ন পণ্য জনস্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর জেনেও। সরকার নিজে লটারির ব্যবসা করে, তা মানুষকে ভাগ্যবাদী, পরিশ্রমবিমুখ, জুয়াপ্রবণ করে এবং সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয় জেনেও। তাহলে? আজ যদি সুনীল জামদানি নামের কোনও কাল্পনিক ব্যবসায়ী যুদ্ধবিমানের ব্যবসা ছেড়ে স্বাস্থ্য-ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন, তাহলে সরকার হঠাৎ নীতিবাগীশ হয়ে উঠবে কোন যুক্তিতে? কিছু নীতি, কিছু নিয়ন্ত্রণ থাকবে, কিন্তু তা ওয়েলফেয়ার স্টেটের চরিত্র অনুযায়ী যতটা হবে, তার চেয়ে বেশি হবে বাজারের নিজস্ব নীতি মেনে। অবশ্য “ক্রোনি ক্যাপিটালিজম”-এ এমনকি ধনতন্ত্রের বিবেকটুকুও পাত্তা পায় না।

এইখানে একটু খটকা লাগছে। সরকার বড় ব্যবসাগুলিকে সুবিধে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বটে, তা বলে কি বেসরকারি হাসপাতলগুলির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ একেবারেই নেই? হাজার গণ্ডা জুজু সৃষ্টি করে রাখা হয়নি কি? তাহলে বেসরকারি হাসপাতালে আমরা চিকিৎসকেরা প্রতিদিন অজানা আশঙ্কা বুকে নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হই কেন? বিক্ষুব্ধ মস্তানের লাথি ও লাঠি ছাড়াও লেজিসলেশন ও লিটিগেশনের “ল”-যুগল আমাদের ঠিকমতো “ল” (আইন) না জানা ললাটে লটকে থাকে সারাক্ষণ, সেকি এমনি এমনি? আছে, আইন আছে। প্যাঁচ-পয়জার আছে, এবং তা আছে বাজারের শর্ত মেনে, বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে।

মামলায় ফেঁসে যাবার ভয় চিকিৎসকদের মনে এমনভাবে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, যে তাঁরা নিজেদের চিকিৎসার যাথার্থ্য প্রমাণের জন্য যথেষ্ট প্রমাণ সংগ্রহ মানসে প্রচুর পরিমাণে পরীক্ষা করাতে বাধ্য হচ্ছেন। মাননীয় ন্যায়ালয় একের পর এক রায়ে কোথাও আল্ট্রাসোনোগ্রাফি, কোথাও ইকোকার্ডিওগ্রাফি না করানোর অপরাধে চিকিৎসককে দোষী সাব্যস্ত করে বিশাল অঙ্কের জরিমানা করে চলেছেন, যা জানার পর সব চিকিৎসক সেই ধরণের সব রোগীর ক্ষেত্রে ওই পরীক্ষা নিশ্চিতভাবে করাবেন, যেখানে তা হয়ত বাস্তবে একশ জনের মধ্যে পাঁচজনের প্রয়োজন হত। এই ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে বা ঘটবে বড় শহরের কর্পোরেট হাসপাতালে, যেখানে অধিকাংশ রোগী চিকিৎসকের পূর্বপরিচিত নন। কারণ নতুন রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক ইদানীং শুরুই হচ্ছে অবিশ্বাসের ভিত্তিভূমিতে।

হাসপাতালে কী কী ব্যবস্থা থাকতে হবে, কী কী ফর্দ মানতে হবে, কী কী খাতে সরকারকে নিয়মিত ফি দিতে হবে বা অনুমতি নিতে হবে, তার তালিকা এত দীর্ঘ, জটিল এবং ব্যয়সাপেক্ষ, যে বড় প্রাইভেট হাসপাতালগুলি ছাড়া ছোট বা অ-লাভলজনক বেসরকারি উদ্যোগগুলির পক্ষে সৎ পথে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। জেলা বা মহকুমা স্তরে কিছু নার্সিং হোম হয়ত উৎকোচের বিনিময়ে উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়াই ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে, যদি তাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ ভালো হয়, কিন্তু মারোয়াড়ি রিলিফ সোসাইটি, ভারত সেবাশ্রমের মতো হাসপাতালগুলো কোনওদিন উঠে গেলে অবাক হব না। ক্রমশ এমন আইন ও রায় আসছে যে ফোঁড়া কাটার মতো অপারেশন করতে গেলেও আইসিইউ-এর ব্যবস্থাযুক্ত নার্সিংহোমে করতে হবে, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি থেকে শুরু করে যাবতীয় রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। অর্থাৎ পাশ করা ডাক্তারের হাতে ফোঁড়া কাটাতে গেলে আপনার মাস মাইনেটি যাবে, নইলে ভরসা নাপিত। এই পর্যায়ে এসে আপনার মাথায় একমাত্র ত্রাতা হিসবে স্বপ্নাদেশ দেবেন স্বাস্থ্যবিমার বুদ্ধিমান এজেন্ট। এভাবে ক্রমশ স্বাস্থ্য পরিষেবায় প্রায় সব স্তরে বৃহৎ পুঁজির এবং তার পিছু পিছু বিমা ব্যবসার অনুপ্রবেশ ঘটছে।

চিকিৎসকের চেম্বারের বিষয়ে নানা আইন করে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হল কয়েক বছর আগে, যে বহু চিকিৎসক ব্যক্তিগত ছোট্ট চেম্বারটি তালাবন্ধ করে পলিক্লিনিকে যোগ দিলেন পুলিশ ও রাজনৈতিক তোলাবাজদের হাত থেকে বাঁচার জন্য। এই স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গে শুধু যে পলিক্লিনিকের ভাড়া মেটানোর এবং স্ট্যাটাস বজায় রাখার দায়ে তাঁদের ভিজিট বেড়ে গেল, তাই নয়, বিক্রি হয়ে গেল তাঁদের স্বাধীনতার অনেকটা। পলিক্লিনিকের স্বার্থ দেখতে মুখের ওপর অস্বীকার করলে ক্লিনিকের মালিক যেকোনওদিন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে উৎখাত করতে পারেন। প্রবীণ, নামী চিকিৎসকদের সঙ্গে এমনটা করতে না পারলেও, কম বয়সী এবং কম প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসকদের সঙ্গে এমন হয়েই থাকে। আপনার পাড়ার ডাক্তার-কাকু এভাবেই বেপাড়ার অচেনা ডাক্তারবাবু হয়ে গেলেন।

বস্তুত বিগ বাজার, রিলায়েন্স, অ্যামাজন, ফ্লিপ কার্ট যেভাবে রিটেল বাণিজ্যের দখল নিয়েছে, যেভাবে কোণঠাসা করেছে খুচরো ব্যবসায়ীদের, হাতিবাগানের ফুটপাতে সেলাই মেশিন নিয়ে সংসার চালানো দর্জিকে, সেভাবেই কর্পোরেট পুঁজি ক্রমশ দখল নিচ্ছে স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার। এই দখলদারি আরও সর্বগ্রাসী, আরও ভয়াবহ হতে চলেছে। এক্ষেত্রে কোণের দিকে ঠেলে দিতে হচ্ছে মূলত স্বাধীন ঘাড়-ত্যাড়া চিকিৎসকদের, কারণ রোগীসাধারণকে সম্পূর্ণ কর্পোরেট চিকিৎসা-ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে এবং সম্পূর্ণ অসহায় বোধ করতে বাধা দেয় একজন পরিচিত চিকিৎসকের উপস্থিতি, যা ভারতীয় ব্যক্তিগত সম্পর্কভিত্তিক সংস্কৃতির কল্যাণে এখনও বেশ শক্ত একটা জায়গা। রোগীদের সম্পূর্ণ অসহায় করে ফেলতে গেলে তাই প্রথমেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে যাতে কর্পোরেটের ছত্রছায়া ছাড়া বাঁচতে ভয় পান চিকিৎসকেরা। যেহেতু হাতিবাগানের দর্জিটির চেয়ে একজন চিকিৎসকের প্রতিরোধক্ষমতা কিছুটা বেশি, তাই শুধুমাত্র আর্থিক চাপ তৈরি করে তাঁকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া কঠিন। সেই কারণেই প্রয়োজন কিছু শক্ত আইন, নিরন্তর রাজনৈতিক আক্রমণ এবং দশকের পর দশক ধরে প্রচারমাধ্যমকে সুকৌশলে কাজে লাগিয়ে রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের পারস্পরিক বিশ্বাসকে ধ্বংস করা। এই কাজটি অনেকদূর এগিয়েছে। রোগীর রক্ষাকবচ হয়ে ওঠার ক্ষমতা এবং ইচ্ছা, দুটোই অনেকাংশে হারিয়ে ফেলেছেন বহু চিকিৎসক।

ভারতীয় সমাজে একধরনের আর্থিক, সামাজিক লেনদেন ছিল প্রাক-ব্রিটিশ যুগে, আর ছিল কয়েক সহস্র বছর ধরে গড়ে ওঠা এক স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা, যা অনাধুনিক হলেও ছিল অনেক বেশি “ইকুইটেবল”। ব্রিটিশরা আমাদের অনেক কিছুকে বিস্মৃতির গুহায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমাদের জাতীয় সত্ত্বাকেই বদলে দিয়েছে, কিন্তু তারাও রেখে গিয়েছিল একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা যা কিছুটা হলেও ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তার মধ্যে সরকারের দায়িত্ব আর মানুষের অধিকার, ইত্যাদি ছিল। এখন সেই সবকিছু ভেঙে এক নতুন ব্যবস্থাকে সর্বাত্মক করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে, যা অনেকটা মার্কিন মডেলের অনুকরণ। এখানে আপনার সামনে অনেক তথ্য, অনেক সুযোগ… বেশ কিছু অধিকারও আপনি পাবেন, কিন্তু মানুষ বা নাগরিক হিসেবে নয়, ক্রেতা হিসেবে। বাজার আপনাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে সমাজ বা রাষ্ট্র আর আপনাকে লুফে নেবে না পতনমুহূর্তে। এই ব্যবস্থার মধ্যে অনেকেই অনেক কিছু পাবার স্বপ্ন দেখছেন। তাঁদের সেলাম, তাঁদের আশাবাদকে কুর্ণিশ। আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে… না, মার্ক্স ঠাকুরের কোটেশন বা রবি ঠাকুরের কবিতা নয়, একটি হিন্দি সিনেমার গানের দুই কলি।

হর খরিদ্দার কো বাজার মে বিকতা পায়া,
হম ক্যা পায়েঙ্গে, কিসিনে য়াঁহা ক্যা পায়া?