Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কলকাতায় কবে আসবে, আনন্দ

আনন্দ মল্লিগাভাদ

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

দেড় মাস ঠিক কতটা দীর্ঘ সময়? দেড় মাসে কী কী কাজ করে ফেলতে পারি আমরা? উত্তর হতে পারে, অনেক কিছুই। কিন্তু যদি আরও সরাসরি করা যায় প্রশ্নটা? যদি জিজ্ঞেস করা যায়, একটা গোটা পুকুর পুনরুদ্ধার করে ফেলতে পারেন কি না? এ প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলার মানুষ খুব বেশি পাওয়া যাবে না, নিশ্চিত।

একজন আছেন এমন। যিনি মাত্র ৪৫ দিনের মধ্যে, কার্যত একার হাতে একটি জলাশয় পুনরুদ্ধার করে ফেলেছেন। এবং, এখানেই থামতে রাজি নন তিনি। বেঙ্গালুরুর যুবকটির ধনুকভাঙা পণ, ২০২৫-এর মধ্যে এমন আরও ৪৫টি ‘মরতে বসা’ জলাশয়কে প্রাণ ফিরিয়ে দেবেন তিনি।

মানুষটির সঙ্গে পরিচয় করার আগে, একটু পেছনে নিয়ে যাব আপনাদের। কেম্পেগৌড়ার হাতে বেঙ্গালুরু শহরটির জন্ম প্রায় ৫০০ বছর আগে। তিনি নিজের হাতে প্রচুর ছোট-বড় জলাশয় দিয়ে সাজিয়েছিলেন এই ‘সিটি অফ লেক্‌স’-কে। কিন্তু সে শহর বড় হওয়ার নিয়মে ক্রমে তার সেই সৌন্দর্য হারিয়েছে। যেমন অধিকাংশ শহরের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। শহরের পুরবিভাগের দেওয়া হিসেব অনুসারে, ১৯৬০-এও অন্তত ২৬২টি জলাশয় ছিল এ-শহরে। তার মধ্যে আজ, মাত্রই ৮১টি অবশিষ্ট। আর জীবিত মোটে ৩৪টি। নগরজীবী সভ্যতার অত্যাচারে শহরের স্বাভাবিক সৌন্দর্য আপাতত ঘোর বিপদে।

এ-পর্যন্ত পড়ে নিশ্চিত বলবেন, এ আর নতুন কথা কী? আমাদের খাস কলকাতাতেই তো নিত্যদিন পুকুরচুরির ঘটনা ঘটছে। একশ্রেণির অসাধু প্রোমোটারের হাতে পড়ে কলকাতাতেও গত তিন-চার দশকের মধ্যে অসংখ্য ছোট-বড় জলাশয় স্রেফ নেই হয়ে গিয়েছে। আর, তার সঙ্গে নষ্ট হয়ে গিয়েছে জলে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শহরের নিজস্ব বাস্তুতন্ত্রের বিপুল একটা অংশ।

কলকাতার গল্পটা আফশোসের হলেও, বেঙ্গালুরুর অভিজ্ঞতা কিন্তু বেশ আনন্দের। আক্ষরিক অর্থেই। কেম্পেগৌড়ার হাতে-গড়া সেই শহরে একজন আনন্দ রয়েছেন যে! আনন্দ মল্লিগাভাদ। একার হাতে বেঙ্গালুরুর ‘শুকিয়ে আসা’ গল্পটিকে আমূল বদলে দেওয়ার পণ করেছেন তিনি। বেশ কয়েকমাস ধরে এই শহরের সমস্ত জলাশয় নিয়ে সমীক্ষা চালানোর পর, ৩৮ বছর বয়সী আনন্দ মল্লিগাভাদ মাঠে (নাকি, জলে?) নেমেছেন ২০২৫-এর মধ্যে শহরের ২৫টি জলাশয়কে নতুন জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা সম্বল করে।

আনন্দর কাজ শুরু হয়ে গেছে। সাফল্যও এসেছে দেড় মাসের মধ্যেই। প্রথম যে জলাশয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি, সেটি হল কালাসনাহালি লেক, আনেকালের কাছে। বেঙ্গালুরুর ইলেকট্রনিক সিটির কিছু কর্মীর সাহায্যে এই লেকটিকে মাত্র ৪৫ দিনে পুরোনো চেহারায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন আনন্দ।

“সানসেরা ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে প্রায় ১ কোটি ১৭ লাখ টাকার অনুদান নিয়ে আমাদের কাজ শুরু হয় ২০১৭-র ২০ এপ্রিল। সাহায্যের দরকার তো ছিলই। পাশের গ্রামেরই এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক, বি মুথুরামনের সাহায্যে আমরা গ্রামের প্রায় ৪০০ বাড়ির লোকের মধ্যে ধীরে ধীরে এই বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা গড়ে তুলি। ক্রমে লোকজন জড়ো হয়, কাজও শুরু হয় আমাদের। এক-একদিনে বেশ কয়েক ঘণ্টা কাজ করে তবে অবশেষে লেকটিকে তার আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনা গিয়েছে,” একমুখ হাসি নিয়ে জানান সানসেরার সিএসআর বিভাগের প্রধান আনন্দ মল্লিগাভাদ।

মুথুরামনের ডাকেই সাড়া দিয়েছিলেন আনন্দ। তিনি টাটা স্টিলের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৪-এ অবসর নেওয়ার পর, কালাসনাহালি লেকের ধারে বাড়ি কিনে থাকতে এসে জলাশয়ের এই অবস্থা দেখে যারপরনাই ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। শুকিয়ে যাওয়া জলাশয়টিকে নিয়ে কী করা যায় ভাবতে গিয়ে আনন্দের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। তারপর যেটা হয়, সেটা অভাবনীয়। পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আনন্দ, কোনও ডিগ্রিপ্রাপ্ত প্রকৃতিবিশারদের সাহায্য ছাড়াই, শুধুমাত্র স্থানীয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মাত্র দেড় মাসের মধ্যে এই জলাশয় থেকে চার লক্ষ কিউবিক মিটার মাটি তোলেন। কাজে লাগানো হয় তিনটি আর্থ মুভার এবং ছ’টি ট্র্যাক্টর।

মাটি তোলার পরের কাজটা ছিল জল ভরা। দু’টি খালকে দিকবদল করিয়ে নিয়ে আসা হয় এই লেকে। তার পর বর্ষার শেষেই কানায় কানায় ভরে ওঠে কালাসনাহালি লেক! দেখে কে বলবে, গত ৩৫ বছর ধরে শুকিয়ে প্রায় মৃতপ্রায় পড়ে ছিল এটি!

পাহাড়প্রমাণ উদ্‌বৃত্ত মাটি দিয়ে জলাশয়ের মধ্যেই তৈরি হয় পাঁচটি খুদে দ্বীপ। মাত্র দশদিনের মধ্যে। এই দ্বীপগুলি এখন পাখিদের আস্তানা। প্রত্যেকটি দ্বীপের ঠিক মাঝখানে একটি করে প্রকাণ্ড গাছ, তাতে পাখিরা বাসা বেঁধেছে। আশেপাশে পোঁতা হয়েছে নানা ফল ও ফুলের গাছ। এই মুহূর্তে এই লেকের মাঝের দ্বীপগুলিতে রয়েছে প্রায় ১৮ হাজার চারাগাছ, ২২ রকমের প্রায় তিন হাজার ফলের গাছ, তিন হাজার প্রজাতির দেশি গাছ, মায় দু’হাজার আয়ুর্বেদিক গুণসম্পন্ন গাছগাছালি।

জাপানি প্রথায় দুটি মিয়াওয়াকি জঙ্গলও তৈরি হয়েছে চারাগাছ দিয়ে। মাত্র পৌনে দু’ঘন্টায়, প্রায় ১৫০০ স্বেচ্ছাসেবীকে নিয়ে ২৫ হাজার স্কোয়ার ফিট এলাকায় পোঁতা হয় প্রায় পাঁচ হাজার চারা! এই সবকিছুই করা হয়েছে দ্বীপগুলোকে স্থায়ী চেহারা দেওয়ার জন্য, যাতে গাছপালা আর ঘাসের শিকড় দিয়ে বেঁধে রাখা যায় মাটি, আটকে দেওয়া যায় ভূমিক্ষয়।

“আমি প্রথম যখন এখানে আসি, এই বিশাল জলাশয়টি পুরো শুকিয়ে গিয়েছিল। গ্রামের লোকজন স্রেফ জঞ্জাল ফেলার জন্য ব্যবহার করতেন জায়গাটা। আজ আমরা সেখানে এক মরূদ্যান তৈরি করে ফেলেছি!” আনন্দ জানান।

“আমরা এখানেই থামিনি। আশেপাশে যেহেতু প্রচুর চাষিভাইয়েরা বাস করেন, যাতে তাঁরা চাষের জন্য জলাশয়ের জল ব্যবহার করে জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্র নষ্ট না করেন, সে-কথা মাথায় রেখে আমরা চারদিকে ১৮৬ টি কুয়ো খুঁড়ে দিয়েছি।”

আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবস, ২০১৭-র ঠিক আগেই কালাসনাহালি লেকের ভোলবদল ঘটানোর কাজ পুরো শেষ হয়। এবং আনন্দ বুঝতে পারেন, ঠিক এই কাজটাই তিনি করে যেতে চান আজীবন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে, জোরকদমে নেমে পড়েন জলে।

এরই মধ্যে জীবন ফিরে পেয়েছে ভাবাসন্দ্রা ও কোনাসন্দ্রা লেকও। বাকি ৪২ টির মধ্যে পরবর্তী টার্গেট গাভি এবং নঞ্জপুরা লেক। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে যে শুধুমাত্র টাকাপয়সা নয়, প্রয়োজন সদিচ্ছা, মনের জোর ও সামগ্রিক প্রচেষ্টা, তা দেখিয়ে দিয়েছেন আনন্দ।

আমাদের আফশোস, কলকাতায় কোনও আনন্দ নেই। নাকি আছে, আমরা এখনও যাঁর খবর পাইনি?

ওঁর কাজে আপনিও যোগ দিতে পারেন। যোগাযোগ করুন এই ই-মেল আইডি-তে m.anand161980@gmail.com