Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

একতারা সাঁঝ

তারাসুন্দরীর কথা

দীপমালা গঙ্গোপাধ্যায়

 

তারাসুন্দরীর কথা আমার প্রায় মনেই পড়ে না। খুব অবরে সবরে পড়ে। সে অবিশ্যি কিছু মনে করে না। এত ব্যস্ত জীবনে এত রঙিন জীবনে এত জনবহুল জীবনে একলা থাকা একমাথা সাদা চুল আর দুচোখে কালো অন্ধকার নিয়ে বাঁচা তারাসুন্দরীর কথা মনে নাই থাকতে পারে। তারাসুন্দরীরও বয়েই গেছে এসব কথা ভাবতে। সে থাকে তার মতো। না একলা থাকে না, সঙ্গে থাকে গান আর একটা রেডিও। যখন রেডিওটা বাজে না, তখনও গান বাজে তার মনে।

গলায় এখন আর গান খেলে না, মনে খেলে মেজজেঠিমার ছবি। বড়জেঠিমার মত বড় টিপ, মুখে পান, মোটা শাঁখা পলা নয়, আবার ছোটকাকিমার মতো ক্ষীণজীবী, একটু কুচুটে, সবসময় অম্বল চোঁয়ানো মুখ নয়, কেমন যেন একটা ছিমছাম ছিপছিপে সহজ আনন্দে মাখা ছিল মেজজেঠিমা। সংসারে থেকেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে জানতেন মানুষটি। কাঠফাটা রোদে ধানের মড়াই ঝাঁট দিতে দিতে গান গাইতেন। গুনগুন করে। বাড়ির ছেলেরা যেন শুনতে না পায়। তারাসুন্দরী জানে সেই গানটা ছিল, ‘থই থই শাওন এল ওই, পথহারা বৈরাগীরে তোর একতারাটা কই’।

বৃষ্টির গান গাওয়ার লোক আরও ছিল তারাসুন্দরীর জীবনে। আনোয়ার চাচা। পুববাংলার মানুষটা আসত বাড়িতে মুনিষ খাটতে। দুপুরবেলায় বড় একটা সানকিতে বেড়াল ডিঙোতে পারে না এমন পরিমাণ ভাতে ডাল তরকারি সব একসাথে মেখে সাপটে সুপটে খাবে বলে বসত পেয়ারাতলার নিচটাতে। ভেতরটা গোলাপি হয়ে থাকা কাশীর পেয়ারা। মায়ের যদি ভাত আনতে একটু দেরি হত, সেই অবসরে আনোয়ার চাচা তার দ্যাশের বাড়ির খাল বিল ঝিল উপচানো গলায় গান ধরত, ‘আল্লা ম্যাঘ দে, পানি দে’।

তারাসুন্দরীর একটা মজা আছে। কাগজে কলমে ক্যালেন্ডারে পঞ্জিকায় সে সত্তর ছুঁইছুঁই, কিন্তু তার মন তো বলে না সে কথা। রোজ সক্কালবেলা উঠে চোখা নাকটা বাড়িয়ে গন্ধ শুঁকে সে নাকি বোঝে আজ বাতাসে রোদ্দুর, না সোঁদা, না গুমসো আলো, নাকি টকটক গন্ধ। সেইমতো বয়েসটাকে ঠিক করে নেয় সে। কোনওদিন অষ্টাদশী, কোনদিন উঠোনে কিতকিত খেলা নয় বছর, কখনও ৪৫ বা এই ৭০। তেমনভাবে, তেমনই বাঁচে সেদিন। মাঝেমাঝে নিজেকে প্রশ্নও করে, ‘ও তারাসুন্দরী! আজ তুমি কে?’ উত্তরও তার নিজের মায়ের কাছে শোনা ‘খাসদখল’ নাটকের গান, ‘আমি যেন ছবিটি, ললিত-লবঙ্গ-লতা কবিটি!’

তারাসুন্দরীর মনে পড়ে মায়ের সঙ্গে সেই তর্কের ছবিটা। ইসকুলে রচনা লিখতে দিয়েছে, ‘বড় হয়ে তুমি কী হবে?’ তারাসুন্দরী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সে লিখবেই বড় হয়ে সে সাজাহান নাটকের সেই অন্ধ ভিখিরির মেয়ে হবে। মাকে কিছুতেই ভিশ্যুয়ালাইজ করানো গেল না তার ওই অমন দীর্ঘদেহী সটান চেহেরার ঝকঝকে স্বামীটি শতচ্ছিন্ন পোষাকে এক হাতে লাঠি আর অন্য হাতে মেয়েকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে গাইতে গাইতে যাচ্ছে, ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে…’

দিন আসে দিন যায়। সন্ধেও আসে প্রতিদিন তার মতো করে। আলো থেকে আঁধার হওয়ার বদলটা আর চোখে ঠাহর হয় না আজকাল। আশপাশের বাড়ি থেকে টিভি সিরিয়ালের গানে তারাসুন্দরী বোঝে এখন গোধূলি না সন্ধে। কিন্তু চিরটাকাল তো এমনি ছিল না। শাঁখের ফুঁয়ে, ধুনোর গন্ধে, তুলসিতলার পিদিমের আলোতে সন্ধে আসত মহাসমারোহে। তারাসুন্দরীরা পাঁচ ভাইবোন আর তুতো দাদাদিদিরা আরও পাঁচজন মিলে রোজ গান হত। কোনদিন ‘তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে’, কোনদিন ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল কর’ আবার কোনও দিন ‘কী গাব আমি কী শোনাব’। বাদ দেবার জো ছিল না। বড়জেঠিমার হুকুম আর মেজজেঠিমার প্রধান গাইয়ে হওয়া দুটোই অপরিহার্য ছিল জীবনে।

এখন সন্ধেবেলায় তারাসুন্দরী মাঝেমাঝে গায়, ‘সবাই চলে গেছে, একটি মাধবী তুমি……’ ইত্যাদি ইত্যাদি। অবিশ্যি সবাই চলে গেছে-টা পুরোপুরি ঠিক না। ওর ঠিক ওপরের দিদি তো থাকে ওর সঙ্গে। শেষ বয়েসের সন্তান বলে এদের দুজনের আর অন্য গতি করে যেতে পারেনি বাবা। দিদি সেলাইটা বড্ড ভাল জানত। হরেক রকম ফোঁড়, হরেক রকম কাট। কোনও বেণীমাধব দিদির জীবনে এসেছিল কিনা জানে না তারাসুন্দরী। কারণ সেসব কথা খুলে বলার আগেই তো স্কিজোফ্রেনিক হয়ে গেল দিদিটা। মাঝে মাঝে বেসুরো গলায় গায়, ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’।

এই গানটা শুনলেই তারাসুন্দরীর মনে পড়ে ফুলবিবির কথা। বেশিরভাগ সবুজ কালো চৌকো চৌকো শাড়ি পড়ে মাথায় একটা ঝুড়ি নিয়ে হাজির হত সে। এসে সে ওদের মস্ত উঠোনটাতে বসে হাঁক পাড়ত, ‘চলে আসো, চলে আসো দিদিরা বৌদিরা! পরভুলানি স্বামী-সোহাগি মন-উদাসি বেলোয়ারি চুড়ি দিখবে তো চলে আসো! মুক্তোর মালা এনেছি, পরে লিয়ে সব রাজাবাবুদের পাশে বিবিরাণি লাইগবে গ!’ এ বাড়ির তো বটেই আশপাশের বাড়ির মেয়ে বউরাও আসত। সবাই যে কিনত তা তো নয়, কিন্তু ওই রঙিন পুঁতির মালা, কাঁচের চুড়ির ঠমক সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হত রক ম্যাজিক্যাল মোমেন্ট।

এই ফুলবিবির কাছ থেকে কেনা একটা সাদা পুঁতির মালা গঙ্গাজলে ধুয়ে হরিসভায় নিয়ে গিয়েছিল ঠাকুরমা, গোপালকে পরাবে বলে। ঠাকুরমার পিছু নিত তারাসুন্দরী। কী সুন্দর রাধাকষ্ণের যুগল মূর্তি, কর্পূরের গন্ধ, ধুনোর সঙ্গে চন্দনের গন্ধ মিশে তৈরি হত এক অপার্থিব আবেশ। ছোট্টখাট্টো চেহারার ঠাকুরমশাই হাতে কোনওদিন ধরাতেন বাতাসা আবার কোনওদিন তিল, নারকেল বা ক্ষীরের নাড়ু। তবে আসল আকর্ষণ ছিল অন্য জায়গায়। এক পাগল থাকত হরিসভার নাটমন্দিরে। সে যেন নিজেই নিজের রাজা। কাউকে পরোয়া নেই, কারুর দয়ার প্রত্যাশী নয়, একেবারে মেজাজে থাকত। হাতে থাকত একটা কাঠের টুকরো যেটাকে বাঁশির মতন ধরত ঠোঁটের কাছে। রাংতা ডিয়ে তৈরি করত মুকুট। কখনও টগর, কখনও নীলকণ্ঠ আবার কখনও বা জবার মালা পড়ত। সবাই বলত ওকে সাক্ষাৎ ‘ভগবান’ মেনে সেইসব মালার যোগান দিত কমলা ফুলওয়ালি। পাগলটা নাকি ওকে ডাকত ললিতা বলে! শহরের নামকরা সঙ্গীতশিল্পী মনোরঞ্জন দাশগুপ্ত, যার নামের পাশে ব্র্যাকেটে ‘রেডিও’ লেখা থাকত, তিনি ছিলেন ভক্ত মানুষ। জন্মাষ্টমী, রাসলীলা এইসব উৎসবে যখন ভক্ত সমাগম হত হরিসভায় তখন একটার পর একটা গান শুনিয়ে যেতেন মনের আনন্দে। তার কাছে শোনা একটা গান তারাসুনন্দরী ভাবত, এটা পাগলটার জন্য, ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে’। কিন্তু এখন তারাসুন্দরী অন্য একটা গান বরাদ্দ করেছে সেই পাগল্টাকে, ‘বনমালী তুমি, পরজনমে হইও রাধা’।

রাধা কাঁদত বুকের ভেতর। ‘আমি যত বলি তবে, এবার যে যেতে হবে, দুয়ারে দাঁড়ায়ে বলে না, না, না’ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিনটে ‘না’ তেত্রিশবার ধাক্কা দিত, যতবার শুনত ততবার, আজও। এই গানে রাধা কাঁদত তারাসুন্দরীর বুকের ভেতর। কলেজ থেকে ফেরার পথে প্রায় রোজই ঢুঁ মারত দোরগোড়ায়। ছেলেটার জানা ছিল মেয়েটাকে ঠিক দেখতে পাবে। কেউ কাউকে বলত না, বলার দরকারও হত না যে আমি তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। কোনওদিন প্রেমের কথা ভালোবাসার কথা হয়নি। কিন্তু দুজনেই জানে এর থেকে বেশি ভালো আর বাসা যায় না। চোরাশিকারির মতো এক উত্তুরে হাওয়া এসে নিষ্পত্র করে দিয়েছিল সম্পর্কটাকে। মুখের রেখা নড়েনি, শুধু নিঃশব্দ রক্তক্ষরণ থাবা বসিয়েছিল বিভিন্নভাবে, দুজনের জীবনেই। তবে কণিকার ওই গান রেডিওতে বাজলে তারাসুন্দরী সেন্টার বদলে দেয়, আজও।