সফিউল
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বেশ কিছু সদস্য ক্রাইস্টচার্চ টেস্ট ম্যাচের আগে যখন শুক্রবারের নমাজের জন্য কাছের আল নূর মসজিদে ঢুকতে যাচ্ছিলেন তখনই এক মহিলা চিৎকার করে তাদের ভিতরে যাওয়া থেকে থামান। কারণ, ভিতরে তখন গুলিবৃষ্টি হচ্ছিল। তারপরেই বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কয়েকজনকে রক্তাক্ত হয়ে ছুটে বেড়িয়ে আসতে দেখেন। ক্রিকেটাররা টিম বাসে আশ্রয় নিয়ে মাথা নিচু করে এই আকস্মিক বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে যান। কাছাকাছি দুটি মসজিদে সন্ত্রাসবাদী হানায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে দিনের শেষে প্রায় ৫০ ছুঁয়ে ফেলে। গোটা পৃথিবীতে তখন এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে।
এই সন্ত্রাসবাদী হামলা, মিডিয়াতে এই ঘটনার উপস্থাপনের পদ্ধতি এবং এতগুলি মৃত্যু-পরবর্তী শোক ও উল্লাস মানুষের কাছে দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজের ছবি তুলে ধরে। ঘটনার দিন বিকালে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্য মুশফিকুর রহমান এই ঘটনায় বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের কোনও ক্ষয়ক্ষতি না হওয়ার জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তার মানে সন্ত্রাসবাদী হামলায় মৃত হতভাগ্য ৫০ জন মানুষ কেন আল্লাহর কৃপা পেলেন না সেই বিষয়ে আমরা চিন্তিত নই। এছাড়াও এই মৃত্যুর ঘটনা শুনে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদেরই দেশেরই কিছু সহনাগরিকের– যাক, ক’জন মুসলিম ‘পোকামাকড়’ মরেছে– ধরনের প্রতিক্রিয়া আমাদের সত্যি সত্যি আতঙ্কিত করে। আর এখানেই আতঙ্কবাদীরা নৈতিকভাবে জয়লাভ করে যায়।
ঘটনার পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় সাদা চামড়ার আধিপত্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য যে সংগঠিত সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ পশ্চিমের দেশগুলিতে ঘটে চলেছে সেটি আড়াল করার সুচতুর প্রয়াস মিডিয়া দেখিয়েছে। একটি সাদা চামড়ার সন্ত্রাসবাদী মসজিদে ঢুকে ৪৯ জন সাধারণ মানুষকে গুলি করে খুন করে কত হাজার মানুষের মধ্যে হিমশীতল আতঙ্কের বীজ ঢুকিয়ে দিয়েছে সেই নিয়ে কিন্তু গাঁক-গাঁক টিভির আর্তনাদ নেই। ফেসবুকে ডিপি ফিল্টার বা মার্কড সেইফ গোছের কার্যকলাপ নেই। অথচ পৃথিবীর নানা প্রান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ‘ওয়ার অন টেরর’-এর আবশ্যিক অংশ হিসাবে অস্ত্রের ঝনঝনানি অহরহ শোনা যাচ্ছে।
সন্ত্রাস সবসময়েই একটি অর্গানাইজড কার্যকলাপ যার জন্য পরিকল্পনা, সংগঠন তৈরি, ব্লু প্রিন্ট নির্মাণ ও পরিকল্পনার যথাযথ এগজিকিউট করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন লেভেলের ও কারিশ্মার মানুষজনের প্রয়োজন হয়। এই ঘটনার আগের যে ঘনঘটার খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে, সন্ত্রাসবাদীরা ৭৪ পাতার একটি কর্মসূচি প্রকাশ করে “The Great Replacement” শিরোনামে, যেখানে পূর্বের তিনটি দেশকে সম্ভাব্য শত্রু জাতি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জাতি হিসাবে রোমানি, আফ্রিকান, ইন্ডিয়ান, তুর্কি ও সেমিটিক মানুষদের প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছে। হত্যাকাণ্ডের পর অস্ট্রেলিয়ার একজন সেনেটরও ইমিগ্রেশন সমস্যাকে দায়ী করে বক্তব্য রাখেন, যার বিরুদ্ধে এক কিশোর ডিম ছুঁড়ে প্রতিবাদ করেন। এই সন্ত্রাসবাদীরাও ইমিগ্রেটেড মানুষদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তারা যে দেশ থেকে বা যে সময়েই ইউরোপে আসুক না কেন তাদের ইউরোপ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। কয়েক শতক ধরে এশিয়া আফ্রিকা থেকে বিপুল সম্পদ লুঠ করে যে ইউরোপের গরিমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এখন সেখানকারই সাদা চামড়ার সন্ত্রাসী সংগঠনগুলি ভারত, চিন, তুর্কি থেকে অভিবাসনের আশঙ্কায় আশঙ্কিত হচ্ছে। তাদের আশঙ্কা ইউরোপের টালমাটালের সময় প্রায় আগত, এবং পূর্বের দেশগুলি ক্রমশ ক্ষমতার শিখরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। তাই এখনই দ্রুত ব্যবস্থা হিসাবে ইউরোপের সীমানা থেকে এশিয়ান, আফ্রিকান ও কালো বা বাদামী চামড়ার মানুষদের নিকেশ বা বিতাড়ন করতে হবে। বৃহত্তর দিক থেকে এশিয়ান, আফ্রিকানদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও পৃথিবী জুড়ে যে ইসলামোফোবিয়ার এক সচেতন নির্মাণ রাষ্ট্রনেতারা ও বৃহৎ মিডিয়া করে চলেছে তারই আশু ভিক্টিম হিসাবে নিউজিল্যান্ডের ১% মুসলিম জনসংখ্যাকে টার্গেট করা হয়েছে। সীমানার দখল ও নিয়ন্ত্রণ যে কী ধরনের আতঙ্ক ও আতঙ্কবাদ ছড়াচ্ছে এই ঘটনা তা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করে দিচ্ছে। প্রকাশিত কর্মসূচিতে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরওয়েতে কয়েক বছর আগে ৭৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা সাদা চামড়ার প্রভুত্ববাদী অ্যান্ডার্স ব্রেইভিক-এর ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। এইভাবেই পৃথিবী জুড়ে পরিবর্তনশীল রাষ্ট্র ও জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তাহীনতাবোধ কীভাবে নতুন নতুন হিংসার দিক উন্মোচন করছে তা বিশেষভাবে লক্ষ করার বিষয়।
পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯
৯৯% অমুসলিমদেরকে সংখ্যালঘু বানিয়ে তাদের উপর প্রভুত্ব করে ফেলতে পারে এই মুসলিমরা! এই আতঙ্কটা কিছুটা চেনা চেনা লাগছে না? আমাদের দেশে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার নিরন্তর এই প্রোপাগান্ডাই রাস্তায় ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্যানভাসিং করছে এবং এর মাধ্যমে অন্য ধর্মের মানুষের ভিতরকার পশুকে জাগিয়ে তোলার প্রক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত নিয়োজিত রয়েছে। “সাদা চামড়ার লোকেরা আশু বিপদের সম্মুখীন” বা “পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু সংখ্যালঘু” বা “হিন্দু খাতরে মে হ্যায়”– এইভাবেই প্রোপাগান্ডা চলে ও নতুন নতুন সন্ত্রাসবাদীর জন্ম হয়। ইন্টারনেটের সাহায্যে সোশ্যাল মিডিয়াতে নেটওয়ার্ক গড়েই কারও বাড়িতে বা কোনও প্রতিষ্ঠানে হামলা করে মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে বা কয়েকশো মানুষকে আতঙ্কিত, অপদস্ত বা হত্যা করা যেতে পারে। কিছুদিন আগে কাশ্মীরে সেনাদের উপরে আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় দেশের নাগরিকদের বাড়িতে বাড়িতে ফেসবুকের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে হামলার সন্ত্রাস দেখতে পাই। সন্ত্রাসবাদ মাদ্রাসায় সংগঠিত হচ্ছে নাকি ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংগঠিত হচ্ছে তার বাছবিচার করা অর্থহীন। এর প্রতিটিই সংগঠিত সন্ত্রাসবাদ।
তবে আশার বিষয় ও আমাদের দেশের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের মোটাদাগের পার্থক্য সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। জেসিন্ডা আর্ডেন, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ঘটনার পর মৃত মানুষদের পরিবারের কাছে তাদেরই মতো পোশাক হিসাবে হিজাব পরে (মাথায় ওড়না জাতীয় কিছু থাকলেই তাকে হিজাব বলে সমালোচনা বা প্রশংসা করা যায় কিনা সেটা ভিন্ন বিষয়) যে বক্তব্য রেখেছেন সেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। “যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁরাই আমরা। তাঁদের আশ্রয় আমরা। যে হামলা চালিয়েছে, সে আমাদের কেউ নয়।” প্রধানমন্ত্রীর পোশাক নিয়ে আমাদের দেশের সোশ্যাল মিডিয়াতে আইটি সেলের তরফ থেকে সমালোচনা ও কুযুক্তির বন্যা শুরু হয়ে গেছে। আমার কাছে পোশাক কখনওই গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হল প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য। যিনি প্রথমেই চিন্তা প্রকাশ করেন আতঙ্কবাদী ব্যক্তিরা অস্ত্রের সহজতর যোগান কীভাবে পাচ্ছে তা নিয়ে, তার বিরুদ্ধে তিনি ব্যবস্থা নেবেন বলেছেন, আতঙ্কবাদীরা দেশের সীমানা পেরিয়ে কীভাবে আক্রমণ করল সেটা নিয়েও চিন্তিত হয়েছেন। তুলনা করুন আমাদের দেশের ঘটনার সঙ্গে। সীমানার এপার ওপারের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের তরুণ সাংবাদিক রবি হোসাইন-এর একটি বক্তব্য, “সীমানার নিরিখে মানুষকে ভাগ করে জাতীয়তাবাদী পরিচয়ে হওয়া খুনগুলো এক পক্ষের জন্যে বিজয়ের, অন্য পক্ষের কাছে বেদনার।” ধর্মের খুনগুলোও অনেকটা তাই। নিজের মতবাদকে শ্রেষ্ঠতর ভাবতে গিয়ে মানুষকে মানুষ ভাবতে না পারার খুনগুলোও ধর্মের একটি পক্ষের কাছে বিজয়ের, অন্য পক্ষের কাছে ক্রোধের। সেই ক্রোধ পাল্টা ক্রোধে আরও লাশের সৃষ্টি। লাখো লাখো লাশের উপর দাঁড়ানো এই সভ্যতায় হেরেছে মানুষ। বাংলাদেশ থেকে দ্রুত উত্তরে অসমে ঢুকে গেলে দেখতে পাব গত কয়েক মাস ধরে লাখ লাখ মানুষকে কীভাবে আতঙ্কিত করে রাখা হয়েছে, সেই আতঙ্ক থেকে মৃত্যুর মিছিলও আমরা দেখেছি। অথচ দেশের মধ্যেই নাগরিকদের ভেতর থেকে ডাইনি খুঁজে আতঙ্ক ছড়ানোর অপর নাম এনআরসি, সেই প্রক্রিয়া শুরু করার আগে প্রথম প্রশ্ন আসার কথা ছিল দেশের সীমানায় অতন্দ্র প্রহরী হিসাবে সেনা, আধাসেনা বা সীমা রক্ষী বাহিনীর কাজে কোনও খামতি আছে কিনা তা দেখতে হবে। সীমানায় সেনারা প্রশ্নাতীত দক্ষতায় কাজ করে চলেছেন আবার পিপীলিকার মতো বাইরের দেশ থেকে মানুষ অস্ত্রশস্ত্র, থালা-বাসনপত্র, বাক্স প্যাঁটরা পুঁটলি নিয়ে এদেশে ঢুকে যাচ্ছে। দুটো তো একসঙ্গে বলা যায় না। প্রতিবেশী দেশের মানুষ আমাদের দেশে বিনা বাধায় প্রবেশ করে অনায়াসে আমাদের স্টেবিলিটি বিঘ্ন করতে পারলে বুঝতে হবে আমাদের সিকিউরিটি ব্যবস্থায় বড়সড় গলদ আছে। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে যেই সন্ত্রস্ত করবে তাকেই সন্ত্রাসী বলা উচিত, সেটি কোনও নির্বাচিত সরকার করলে সেই সরকারকেও সন্ত্রাসবাদী সরকার বলা উচিত। যে কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলায় ভিক্টিমদের যত্ন নেওয়ার পরেই প্রাথমিকভাবে সুরক্ষায় কোথায় খামতি আছে সেটা খুঁজে দেখার দরকার, তা না করে মুহূর্মুহূ জাতীয়তাবাদী অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ করা হচ্ছে, যা কোনও সমাধান নয়। এখানেই নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী একজন যথাযথ রাষ্ট্রনেতার পরিচয় দিয়েছেন।