সোমেন বসু
একজনকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী আখ্যায়িত করে আর একজন এই ভোটের বাজারে কিছু আন্তর্জাতিক পয়েন্ট কুড়োতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই বাড়া ভাতে আপাতত চিনা ছাই!
মাসুদ আজহার আর নরেন্দ্র মোদি। এক ভস্ম আর ছার…
কিন্তু হুতোমি কায়দায় যে এই অ্যাক নোতুন বলব তারও জো নেই। নরেন্দ্র মোদির এহেন বহ্বাস্ফোট এবং তার চিমসে যাওয়া পরিণতি গত পাঁচ বছরে আমাদের বহুবার প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। কারণ, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী। ঘরে তো বটেই— সে সবার ব্যাঙ্কে ১৫ লাখ টাকা থেকে বছরে দু কোটি চাকরি, যাই হোক না কেন— বাইরেও। দুম করে গিয়ে প্রতিবেশী প্রধানমন্ত্রীকে হ্যাপি বাড্ডে জানিয়ে বা যেখানে সেখানে আ গলে লাগ যা করে গিমিক হয় হয়তো ষোল আনার ওপর আঠারো আনা, কিন্তু চিন পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশীদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েনে জর্জরিত সম্পর্ক শুধরানো যায় না। কিন্তু সে কথা নরেন্দ্র মোদিকে কে বোঝাবে? তিনি নাটকবাজিতেই বিশ্বাসী। বা, ভণিতা না করে বলা যায়, নাটকবাজিই তাঁর সম্বল।
আপাতত কথাটা চিন নিয়ে। মাসুদ আজহারের সঙ্গে চিনের প্রেমপিরিতির কারণটা কী? কেন চিন এই প্রশ্নে প্রায় একঘরে হয়ে গিয়েও গোঁয়ারের মতো ভেটো দিয়ে চলেছে? দিয়ে চলেছে, কারণ এবার নিয়ে চতুর্থবার এই ঘটনা ঘটল। অবশ্য ভেটোর সঙ্গে একঘরে কথাটার কোনও বিরোধ নেই। কারণ রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচ স্থায়ী সদস্য যখনই ভেটো প্রয়োগ করেছে, একঘরে হয়েই করেছে। এবারের ভোটে যেমন ভারতের প্রস্তাবের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদের ফল ১৪-১[1], এবং তারপর চিনের ভেটো, অতীতে কাশ্মির প্রশ্নে রাশিয়াকে বা ইজরায়েল প্রশ্নে আমেরিকাকেও আমরা একই অবস্থায় একই কাজ করতে দেখেছি। সেগুলির রাজনৈতিক কূটনৈতিক কারণ ছিল, আমরা জানি, এখন সে নিয়ে আলোচনা অবান্তর। আপাতত চিনের এই মাসুদ-সখ্যের কারণটা একটু দেখা যাক।
এবং এটা মাসুদ-সখ্য নয়। মাসুদ আজহার নামক একটি ব্যক্তির সঙ্গে আলাদা করে চিনের মতো একটা দেশের কোনও সখ্য থাকা আপাত দৃষ্টিতেই অসম্ভব। যদিও এমন ঘটনাও যে হয় না, তা না। স্মর্তব্য আমেরিকা-ওসামা বিন লাদেন সম্পর্ক[2]। কিন্তু চিন মাসুদ আজহারকে দিয়ে সেরকম কোনও কার্যসিদ্ধি করতে চায় বলে এখনও অব্দি কিছু বোঝা যায়নি। একটা সম্ভাবনাই এর সপক্ষে কারও কারও মাথায় আসতে পারে, সেটা হল ভারতকে চাপে রাখা। হলে হয়তো একটু ল্যাজ ফোলানো যেতে পারত, কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ বড়ই কষ্টকল্পনা। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চিন এখন আমেরিকার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে, ভারতকে সে বড়জোর এক বেয়াড়া প্রতিবেশী মনে করতে পারে, কিন্তু প্রতিপক্ষ মনে করে না[3]।
ফলে এ সম্ভাবনা দাঁড়ায় না। এবং আমরা আমাদের পুরনো কথাতেই ফেরত আসি, চিনের সখ্য ব্যক্তি মাসুদের সঙ্গে নয়। চিনের এহেন পদক্ষেপের পেছনে রয়েছে বিশুদ্ধ অর্থনীতি, কিছুটা নিজের রাজনৈতিক স্বার্থও। আসলে সমাজতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে চিন দীর্ঘদিন ধরে তার সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ইদানীং তো জ্যাক মা-দের মতো পুঁজিপতিদের জন্যও খুলে দেওয়া হয়েছে খোদ কমিউনিস্ট পার্টির দরজা[4]। এই অভিমুখেই দেখতে হবে চিনের এই সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপটিকেও। নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষার জন্যই চিন মাসুদদের ঘাঁটাতে চায় না।
কেমন? একটু ভেঙে বলি।
শি জিনপিং-এর একটা স্বপ্নের প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। এই প্রকল্পের মাধ্যমে চিন সড়ক, রেল এবং জলপথে এশিয়া, ইওরোপ এবং আফ্রিকাকে জুড়তে চায়। এই প্রকল্পের একটি অন্যতম প্রধান অংশ হল চায়না পাকিস্তান ইকনমিক করিডর বা সিপিইসি। এই সড়ক প্রায় পুরো পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে গিয়ে চিনের জিংজিয়ান প্রদেশের কাসঘরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করবে পাকিস্তানের গোয়াদরের গভীর সমুদ্র বন্দরের। এই সড়ক সম্পূর্ণ হলে চিনকে আর গোটা ভারত চক্কর দিয়ে মালাক্কা প্রণালীর মাধ্যমে সমুদ্রে পৌঁছতে হবে না, এবং হরমুজ প্রণালীর মধ্যে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেল অঞ্চলের সঙ্গেও তার সান্নিধ্য অনেক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবে। পরিষ্কার, কতটা গুরুত্বপূর্ণ চিনের কাছে এই প্রকল্প? এবং এই সিপিইসি-কে কেন্দ্র করে চলা ৪৫টি প্রোজেক্টে চিনা পুঁজিপতিরা প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে বসে আছে, যার অর্ধেকের বেশি কাজ শেষ।
স্পষ্টতই, চিন এই প্রকল্পে কোনও ব্যাঘাত চায় না।
তাই ব্যক্তি মাসুদ আজহার নয়, বরং এই অঞ্চলের প্রায় সমস্ত জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির সঙ্গেই চিনের এই অলিখিত চুক্তি বর্তমান। তোমরা আমাকে ঘাঁটিও না, আমরাও তোমাদের ঘাঁটাচ্ছি না।
তাও যদি ঘাঁটিয়ে ফেলে? যেমন একবার বালুচ মুক্তিকামী ভাষান্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এবং একবার পাকিস্তানি তালিবানরা করেছিল? সেসবের জন্য রয়েছে চিনের ‘অল-ওয়েদার’ মিত্র পাকিস্তান। ২০১৫ সালে পাকিস্তানের ফৌজ এবং আধা-সামরিক বাহিনী থেকে ২০০০০ বিশেষ প্রশিক্ষিত জওয়ান নিয়ে একজন মেজরের নেতৃত্বে শুধু এই সিপিইসি-কে রক্ষা করার জন্য পাকিস্তান একটি বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী তৈরি করে দিয়েছে।
এবং তা সত্ত্বেও চিন যে এ নিয়ে কতটা উদ্বেগে রয়েছে সেটা বোঝা যায় যখন তারা এই কিছুদিন আগে সরাসরি নিজেরাই বালুচদের সঙ্গে দর কষাকষিতে বসে[5]।
তবে? এত কিছু করে একটা ভেটো দেওয়া যাবে না?
আর এখানেই একটা রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। জিনজিয়াং-এর উইঘুর সম্প্রদায়— যাঁরা মুসলিম ধর্মাবলম্বী, ঘটনাচক্রে— তাঁদের ওপর চিন দীর্ঘদিন ধরেই দমনপীড়ন চালিয়ে আসছে[6], এবং তার প্রতিরোধও হচ্ছে যথানিয়মেই। চিন এটাও চায় না যে জৈশের মতো সংগঠনগুলি সেদিকে নজর দিক। ফলে আগে যে ভদ্রলোকের চুক্তির কথা বললাম, তার আরও একটি অংশ হল— উইঘুরদের সঙ্গে আমাদের যা চলছে তোমরা তাতে নাক গলিও না, আমরাও তোমাদের ঘাঁটাব না!
তাই, এই প্রেক্ষাপটে, চিন যা করেছে, একদম স্বাভাবিক।
আর প্রেক্ষাপটের বাকিটুকু পূর্ণ করে দিয়েছে ভারত। মানে চিন-ভারত সাম্প্রতিক সম্পর্ক।
গত ৯ই ফেব্রুয়ারি মোদি অরুণাচলে ভোট প্রচারে গেছিলেন। চিন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলে, এ ধরনের বিতর্কিত জায়গায় প্রধানমন্ত্রীর যাওয়া তারা ভালোভাবে দেখছে না। ভারতের বিদেশমন্ত্রকও জবাব দেয় অরুণাচল যেহেতু ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী সেখানে যেতেই পারেন[7]। ভালোই করেছে, কিন্তু প্রেক্ষাপটে ওই কাঁটাটা তো রয়েই গেছে!
পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯
অতএব, আবারও ঐ কথাটা, নরেন্দ্র মোদির হাগপ্লোমেসি দিয়ে ডিপ্লোমেসির বরফ গলছে না। বরং এই সরকারের লাগাতার ভুল পদক্ষেপে চিন দক্ষিণ এশিয়ায় রীতিমতো জাঁকিয়ে বসেছে। সাংবিধানিক সঙ্কট নিয়ে নেপাল, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে মায়ানমার ও বাংলাদেশ, সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা নিয়ে মালদ্বীপ— সমস্ত জায়গা এবং ঘটনাতেই ভারত কোনও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ এবং সেই ব্যর্থতার সুযোগ দু হাতে নিয়ে গেছে চিন[8]। এবং সে এখন বাইরে থেকে রীতিমতো ভেতরে ঢুকে পড়েছে। নাগরিকত্ব বিলের[9] বিরুদ্ধে উত্তর-পূর্বে বিক্ষোভ চলছে, এবং মিজোরাম এবং ত্রিপুরায় বিক্ষোভকারী জনগণের হাতে “হ্যালো চায়না/বাই বাই ইন্ডিয়া” লেখা প্ল্যাকার্ডও দেখা গেছে[10]!
তবে হ্যাঁ, ভালো খবর কি কিছুই নেই? আছে!
ফ্রান্স মাসুদ আজহারের ওপর স্যাঙ্কশন জারি করে ফ্রান্সের মাটিতে তার যাবতীয় সম্পত্তি ক্রোক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে[11]।
প্রধানমন্ত্রী এখন একটা টুইট করতেই পারেন— “যদি রাফাল হাতে থাকত, চিনের ভেটো দেওয়া বের করে দিতাম!”
[1] https://thewire.in/diplomacy/chinas-message-is-clear-it-does-see-masood-azhar-as-a-terrorist
[2] https://en.wikipedia.org/wiki/Allegations_of_CIA_assistance_to_Osama_bin_Laden
[3] একটা তথ্য দিয়ে রাখা যাক। ভারতের মোট ফরেন এইড বাজেট ২ বিলিয়ন ডলার, যেটা চিনের ৩০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। (https://www.foreignaffairs.com/articles/india/2018-03-08/modis-foreign-policy-revolution)
[4] https://www.4numberplatform.com/?p=9839
[5] https://www.dawn.com/news/1390520
[6] https://www.vox.com/2018/8/15/17684226/uighur-china-camps-united-nations
[7] https://www.scmp.com/week-asia/opinion/article/2186044/why-india-anxious-about-role-china-could-play-its-upcoming
[8] https://moderndiplomacy.eu/2018/02/17/prime-minister-narandera-modis-hug-diplomacy-fails/
[9] https://www.4numberplatform.com/?p=10138
[10] https://www.scmp.com/week-asia/opinion/article/2186044/why-india-anxious-about-role-china-could-play-its-upcoming
[11] https://www.thehindu.com/news/international/france-freezes-assets-of-jaish-e-mohammad-founder-masood-azhar/article26542539.ece