বিশ্বরূপ কোনার
স্বেচ্ছায় স্ব-ভূমিকা নির্বাচনের প্রশ্ন এসেছে হ্যামলেটের সামনে, অত্যাচার কি মুখ বুঁজে সহ্য করবেন, না সমুদ্রপ্রমাণ বাধাবিপত্তির সঙ্গে অস্ত্র হাতে নিয়ে (take arms against a sea of troubles) সংগ্রাম করতে করতে আত্মবিসর্জনই শ্রেয়।… বারেকের তরেও হ্যামলেট ভুলতে পারছেন না ডেনমার্ককে, কারাগারে পরিণত সমাজকে, নূতন রাজার ধর্ষণে পরিক্লিষ্ট মানবগোষ্ঠীকে :
‘কালের এই উপহাস, এই কশাঘাত, পীড়কের অন্যায় আর দর্পিতের অবজ্ঞা, উপেক্ষিত প্রেমের যন্ত্রণা, আইনের শম্বুকগতি, পদাধিকারের ঔদ্ধত্য, আর অযোগ্য শাসকদের যত লাঞ্ছনা ধৈর্যশীল গুণীদের ভোগ করতে হয়— ।’
—উৎপল দত্ত, শেকসপীয়ারের সমাজ-চেতনা, ‘যোদ্ধা’ পরিচ্ছেদ থেকে উদ্ধৃত— হ্যামলেট নাটকের ‘টু বি অর নট টু বি’ স্বগতোক্তির প্রসঙ্গে
কাশ্মিরের কোনও এক চকে দাঁড়িয়ে হ্যায়দার, আলিগড়ে উচ্চশিক্ষা পাওয়া হ্যায়দার, না-খোঁজ হয়ে যাওয়া পিতার মৃত্যুসংবাদ পাওয়া হ্যায়দার সমবেত জনতাকে বলেছিল— “চুতস্পাহ্ হো গয়া হামারে সাথ।” শব্দটার অর্থ বোঝাতে গিয়ে বলেছিল এক ব্যাঙ্ক ডাকাতের কথা, যে এক কাউন্টার থেকে টাকা লুটে পাশের কাউন্টারে গিয়ে বিনীতভাবে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলার ফর্ম চায়।
বুঝতেই পারছেন, আমি হ্যামলেট-প্রভাবিত হ্যায়দার ছবির কথা বলছি।
খবরের কাগজ থেকে জেনেছিলাম, বুরহান ওয়ানি নাকি তার পনেরো বছর বয়সে সেনার হাতে নাকাল হবার ক্ষোভে হিজবুলে নিজের নাম লিখিয়েছিল। তার সাত বছর পর, ২০১৬ সালে তার মাত্র বাইশ বছর বয়সে সে নিহত হলে প্রত্যক্ষদর্শীর জবান অনুযায়ী তার জানাজায় জড়ো হয় প্রায় দুই লক্ষ মানুষ।[i] মৃত্যুর কিছুদিন আগে একটি ইউটিউব ভিডিও প্রকাশ করে সে জানায় ভারতের সেনাকে সাহায্য করবে যারা, তারা কাশ্মিরের শত্রু। তার জানাজায় জড়ো হওয়া মানুষ কি এ ইঙ্গিত দেয় না, যে তার মতের সমর্থনকারীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়? এরা যে স্পষ্টতই ভারতের সেনার শাসনের বিরুদ্ধে— বা হয়তো ভারত নামক রাষ্ট্রটিরও বিরুদ্ধে— ভাবের ঘরে সহস্র চুরি করলেও এই কথা বিশ্বাস না করে আর উপায় থাকে কি?
বিশেষজ্ঞদের মতে, কাশ্মিরের অশান্তির কালকে মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করা যায়। এক, গোড়ার থেকে ১৯৯০। দুই, ১৯৯০ থেকে ২০১৬-র জুন। আর তিন, সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত। ছোট করে বলতে গেলে, ১৯৯০-এর আগে পর্যন্ত কাশ্মির সমস্যা ছিল কাশ্মিরিদেরই সমস্যা। আজাদির পক্ষে সওয়ালকারীদের দাবি ছিল কাশ্মিরের আজাদি। ১৯৯০-এর পর থেকে লড়াইয়ে লাগে সাম্প্রদায়িকতার রঙ। কাশ্মিরিদের ধর্মও লড়াইয়ের নিয়ামক হয়ে ওঠে (সুধীজন একে ইসলামি সন্ত্রাসের রূপ বলেও ধরে নিতে পারেন। সুবিধা পাবেন)। এরপর ২০১৬-র জুন মাসে সেনার হাতে নিহত হন বুরহান।
বুরহানের জঙ্গি হয়ে ওঠার কারণ যা-ই হোক না কেন, তার মৃত্যুতে কাশ্মিরে সন্ত্রাসের ছিন্ন পালে যে নতুন করে বাতাস লাগে সে-নিয়ে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই। ১৯৯৯-এর কার্গিল যুদ্ধ ও ২০০১ সালে ভারতীয় সংসদ আক্রমণের পর থেকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের কিছুটা উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কাশ্মিরেও বিচ্ছিন্নতার ঘটনা কমে আসতে থাকে। মনে রাখতে হবে, এর মধ্যে ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে কাশ্মিরে চালু হয়ে গেছে আফস্পা আইন। আর, ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪-এর মধ্যে ভারতীয় সেনা ও সুরক্ষা বাহিনীর নামে অপবাদ লেগেছে অনেকগুলো গণহত্যার— গাওয়াকাডাল, হান্দওয়াড়া, জাকুরা, তেঙ্গপোরা, হাওয়াল, সোপোর, বিজবেহাড়া এবং কুপওয়াড়াতে। ইচ্ছেতে হোক বা অনিচ্ছায়, বা ভুলে, এই সমস্ত হত্যারই লক্ষ্য ছিল কাশ্মিরের সাধারণ মানুষ বা সিভিলিয়ান। ‘মূল’ ভারতের মিডিয়া এইসব খবর বেশি চাউর না করলেও কাশ্মিরের খবরের কাগজগুলোর পুরনো ইস্যুতে চোখ রাখলে এখনও জানতে পারা যাবে প্রত্যক্ষদর্শীদের হাড় হিম করা বয়ান।
অবশ্য এইসব বয়ানকে আপনি অস্বীকার করতেই পারেন। বলতেই পারেন, এই সবই সরহদ পারের টাকা খেয়ে বলা কথা। হ্যায়দার ফিল্ম সম্পর্কে এমন কথা কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি বৈকি!
বিষয়টা সরাসরি কাশ্মিরের সঙ্গে যুক্ত না-হলেও, ভারতের মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের WRIT PETITION (CRIMINAL) NO.129 OF 2012-তে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বলবৎ আফস্পা (AFSPA) সম্বন্ধে মন্তব্য দেখতে পাচ্ছি। এখানে মাননীয় বিচারালয় প্রশ্ন রাখছেন—
What would be the consequence if normalcy is not restored fora prolonged or indeterminate period? In our opinion, it would be indicative of thefailure of the civil administration to take effective aid of the armed forces inrestoring normalcy or would be indicative of the failure of the armed forces ineffectively aiding the civil administration in restoring normalcy or both. Whateverbe the case, normalcy not being restored cannot be a fig leaf for prolonged,permanent or indefinite deployment of the armed forces (particularly for publicorder or law and order purposes) as it would mock at our democratic process …
অর্থাৎ, বাপু হে, এই ‘গোলমাল থামছে না’ কথাটাকে লজ্জাস্থানের পত্রাবরণ বলে দেখিয়ে সেনার শাসন চালিয়ে যাওয়াটা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। এই বক্তব্য রাখার আগে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট নজরে রেখেছেন এইসব রাজ্যে— যেখানে আফস্পা বলবৎ রয়েছে— মানবাধিকার হননের অসংখ্য ঘটনা।
এত কিছু সত্ত্বেও ২০১৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় ভারতীয় সেনার অভূতপূর্ব সাহসিক ভূমিকা কাশ্মিরিদের চোখ এড়িয়ে যায়নি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম সেনার এই বীরত্বের কথা শতকণ্ঠে প্রচার করেছে, এবং সেই প্রচারের একটা ক্ষুদ্র অংশ হিসাবে আমরা দেখেছি কীভাবে উপচে পড়েছে স্থানীয় কাশ্মিরিদের কৃতজ্ঞতা।
কিন্তু একটু আগেই যে কথা বলছিলাম, ওই ওয়ানির মৃত্যু পরবর্তী কাশ্মিরের অবস্থার কথা, সেই কথায় ফেরাটা জরুরি।
কাশ্মিরের মরহুম নেতা মুফতি মহম্মদ সাইদ একটা কথা বলতেন, যার মর্মার্থ— বিপক্ষের হাতে সহজে মৃত সংগ্রামীকে তুলে দিও না। বুরহানের ক্ষেত্রে এটাই হল, এবং এমন জনরোষের সৃষ্টি হল, যে পরের দিনই বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষোভরত উনিশজন সাধারণ কাশ্মিরি— সিভিলিয়ান কাশ্মিরির মৃত্যু হল ভারতীয় সেনার গুলিতে।
এর পরের ঘটনা সর্বজনবিদিত। এক, কাশ্মিরিদের আত্মসম্মানে আরও এক ঘা ছিল জিপের সামনে বেঁধে রাখা এক সাধারণ কাশ্মিরির ছবি, যার সমর্থনে উদ্বাহু হয়েছেন আমাদের মূল ভূখণ্ডের অনেকেই। আর দুই, পেলেটবৃষ্টির ঘটনা। এতদিন যা দেখা যায়নি— সম্ভবত ‘ডোভাল ডকট্রিন’-এরই সুবাদে সেটা দেখা গেল। বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে পেলেটবর্ষণ। এর শিকার সব বয়সের মানুষ— সর্বকনিষ্ঠটির বয়স নাকি দুই। সে-ও বিক্ষোভকারী! সরকারি সূত্র-অনুযায়ী, জুলাই ২০১৬ থেকে অগাস্ট ২০১৭ পর্যন্ত শটগান পেলেটের আঘাতে মৃত্যু হয়েছে সতেরোজনের, আর আহত হয়েছেন ছয় হাজার দু’শো একুশজন। আহতদের অনেকেই অংশত বা পূর্ণত অন্ধ হয়েছেন।
কিন্তু এই অন্ধজনে আলো ও মৃতদেহে প্রাণসঞ্চার তো আর ডোভাল ডক্ট্রিনের উদ্দেশ্য নয়।
পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯
অজিত ডোভাল, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শদাতা, কেরল ক্যাডারের আইপিএস। ২০১৪ সাল থেকে ডোভালসাহেব সামলাচ্ছেন এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ২০০৫ সালে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর নির্দেশক হিসাবে অবসর নেবার পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন-এর প্রধান থাকাকালীন সময়ে ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে ভারতের হিন্দু ঐতিহ্য ইত্যাকার বিষয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা এই ডোভালসাহেব। যা হোক, ২০১৪ সালে সরকারি পদে এসেই তিনি প্রথমে যেই কাজটি করেন, তা হল দিল্লির পুরানা কিলা রোড থেকে United Nations Military Observer Group for India and Pakistan (UNMOGIP)-এর অফিসটি উঠিয়ে দেওয়া, অর্থাৎ যে বাংলোয় এঁদের অফিস ছিল সেই বাংলোটি খালি করার আদেশ দিয়ে দেওয়া। ওই বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করেন— পাকিস্তানের কাজ কেবলমাত্র ভারতের রক্তক্ষরণ ঘটানো। পাকিস্তান-প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন— শত্রুকে আটকানোর তিন উপায়— এক, রক্ষণশীল থাকা, দুই তার সঙ্গে কিছু আক্রমণাত্মক পদ্ধতি মেলানো, আর তিন, পুরোপুরি আক্রমণের পথে যাওয়া। এই তিন উপায়ের প্রথমটি এতদিন চলেছে। এবার দ্বিতীয় পদ্ধতি ‘আপনানোর’ সময়। তৃতীয় পদ্ধতির বৃত্তান্ত অবশ্য তিনি কিছু জানাননি। “You throw a stone when you want, you have peace when you want, you have talks when you want”— মোটামুটি এ-ই তাঁর বক্তব্য। তাঁর স্পষ্ট কথা— পাকিস্তানকে আমাদের চাই না! অতএব, হে ভোটার পাঠক, আপনি যদি বৃহত্তর উপ-অঞ্চলীয় সমন্বয়ের স্বপ্ন দেখে থাকেন, সে-গুড়ে আপাতত বালি স্বীকার করুন। যত আন্তর্জাতিক যোগাযোগব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল আপনি শুনছেন, সকলই আদতে আপনার নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখতে। ইহা একান্তই কাকতালীয়, যে এই সকল প্রকল্পেরই উদ্যোক্তা আমেরিকা ও ইউরোপ। ডোভালই প্রথম ভয় দেখান— একটা মুম্বাইয়ের বদলা একটা বালোচিস্তান, যার প্রতিধ্বনি আমরা পরে শুনলাম লাল কেল্লায়, আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে।
ডোভালের মতে, কাশ্মিরের সমস্যা ‘সন্ত্রাসবাদ’। অর্থাৎ কাশ্মিরের থেকে সন্ত্রাসবাদকে বিয়োগ দিলেই পাওয়া যাবে বিশুদ্ধ ভারতসিদ্ধ কাশ্মির, যে কাশ্মির ভারতের একেবারে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৫ সাল নাগাদ কাশ্মিরে বেড়াতে আসা পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৪২ লক্ষের মতন। ২০১২ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ২৫ লক্ষে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালের শেষে পর্যটকের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৭৩ লক্ষে[ii]। এমতাবস্থায়, কাশ্মিরে চলতে-থাকা ঘটনাবলী যে অবস্থাটার দিকে আমাদের, মানে আমদেরই কাউকে কাউকে, তাকাতে বাধ্য করে তা হল, কাশ্মিরের আঞ্চলিক অর্থনীতির আরও সংকোচন, এবং সাধারণ কাশ্মিরির আরও দুর্ভোগ এবং বেঁচে থাকার জন্য তীব্রতর লড়াই, যে লড়াইয়ে অবধারিতভাবে চলে আসে শাসকের প্রতি ঘৃণা, যার বর্তমান নাম দেশদ্রোহ।
একদিকে ডোভালের রণনীতি, অন্যদিকে কাশ্মিরের সাধারণ মানুষের সমস্যার গভীরীভবন যা কিনা তাদের মূল ভূখণ্ডের প্রতি ক্ষোভের নির্ণায়ক, এই দুইয়ের মাঝে পড়ে ভূস্বর্গের চুরি আরও কতটা ত্বরান্বিত হয় সেটাই এখন দেখার।
হ্যায়দার ছবির শেষে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের একটি কবিতার গায়ন ছিল, যার নাম ‘ইন্তেসাব’। ফয়েজ লিখছেন—
উন্ অসিরোঁ কে নাম
জিন্ কে সিনোঁ মেঁ ফরদা কে শব-তাব গওহর
জেলখানোঁ কি শোরিদা রাতোঁ কে সরসর মেঁ
জল জল কে অঞ্জুম-নুমা হো গ্যায়ে হ্যায়
আনেওয়ালে দিনোঁ কে সফিরোঁ কে নাম
বো জো খুশবু-এ-গুল কি তরহ্
অপনে প্যায়ঘাম পর খুদ্ ফিদা হো গ্যায়ে হ্যায়…
সেই বন্দির জন্য, যার বুকের ভেতর আগামীর দুঃখ জেলখানার রাতের উন্মত্ততার কনকনে বাতাস পেয়ে তারার মতন জ্বলে উঠবে। আগামীর সেই দূতের জন্য, গোলাপ যেমন নিজের সুগন্ধে বিভোর থাকে, সেই গোলাপের মত যে তার কর্তব্য, স্বপ্নের জন্য বিভোর…
আগামীর সেই দূত আমাদের চোখে ভারতীয়, না কাশ্মিরি, না মুসলমান উগ্রপন্থী— কীভাবে বিবেচিত হবেন, সময়কে দিয়ে সেই কথা আমরা যেমন করে বলাব সময় ঠিক তেমন করেই বলবে, এ-কথা আমরা যেন ভুলে না যাই।
[i]https://thewire.in/politics/the-funeral-burhan-wani
[ii]https://www.tribuneindia.com/news/jammu-kashmir/tourism-in-doldrums-footfall-down-in-last-6-yrs/528148.html