Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

 সত্যব্রত ঘোষ

 

সম্প্রতি CAG-র একটি রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে পুনের ন্যাশনাল ফিল্মস আর্কাইভ অফ ইন্ডিয়ার মহাফেজখানা থেকে একত্রিশ হাজারের বেশি দুর্লভ ছবির রিল হারিয়ে গেছে অথবা ধ্বংস হয়েছে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের গরম হাওয়ার মাঝে এই সংবাদে বিচলিত হবেন, এমন মানুষ স্বল্প। তবুও, সিনেমা এবং সিনেমার ইতিহাসের প্রতি যাদের আগ্রহ আছে, যারা অনুভব করছেন যে, সেলুলয়েড ছবির অস্তিত্ব বিপন্ন, তাদের কাছে এটি অশনি সংকেত।


অন্যান্য পাঠকদের সুবিধার্থে ব্যাপারটা একটু বিস্তৃতভাবে বলা যাক। ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুনেতে ন্যাশনাল ফিল্মস আর্কাইভ অফ ইন্ডিয়া (NFAI) প্রতিষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের একটি স্বাধীন দপ্তর হিসেবে সংস্থাটির কাজ ছিল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা, পোস্টার, স্লাইডস, প্রেস ক্লিপিংস, বই, ফটোগ্রাফস, রেকর্ড, অডিও এবং ভিডিও ক্যাসেট, ডিভিডি ইত্যাদি সংরক্ষণ করা, যার মধ্যে দিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিগত ১০৬ বছরের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। CAG দ্বারা পরিচালিত এই সাম্প্রতিক হিসাব নিরীক্ষণটিতে শুধুমাত্র সিনেমার রিলগুলি খাতায় কলমে মেলানো হয়েছে। বাকি জিনিসগুলির হদিস নিয়ে এযাবৎ কোনও হিসাব মেলানো হয়নি, তা স্বয়ং কর্তৃপক্ষই জানিয়েছে। কনট্রাক্টরের পাঠানো বিল এবং দেয় অঙ্কের হিসাব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে মহাফেজখানায় খাতায় কলমে ১,৩২,০০০ ফিল্ম রিল থাকলেও মাত্র ১,০০,৩৭৭টি রিলেই বার কোড লেবেল তাঁরা দিয়েছেন। অর্থাৎ, হিসাবমতো, ৩১,২৬৩টি রিল হয় হারিয়েছে নয়তো নষ্ট হয়েছে। CAG রিপোর্টটিতে আরও বলা হয়েছে যে আইটেম ধরে ধরে বার কোড স্টিকার দেওয়া হয়নি। মানে, কোন কোন জিনিস যে হারিয়েছে বা নষ্ট হয়েছে তা সম্পর্কে কারও ধারণাই নেই। NFAI-র অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম যে এই মুহূর্তে বিকল, তা বলাই বাহুল্য।

পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯

একজন মানুষের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নতুন প্রজন্মের মানুষরা সংরক্ষণের কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এমনটা ভাবা হয়তো বোকামি। তবু শিবেন্দ্র সিং দুঙ্গারপুরের মতো খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সিনেমা সংরক্ষণের কাজটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেছেন। কাজটি যথেষ্ট ব্যয়বহুল। এবং সরকারি সংস্থার সাধারণ কর্মজীবীদের মতো ‘চাকুরে’ মনোবৃত্তি নিয়ে গয়ংগচ্ছ পদ্ধতিতেও পুরোনো সিনেমার প্রিন্ট সন্ধান, সংগ্রহ এবং তার সংরক্ষণ সম্ভব নয়। অর্থের পাশাপাশি এর জন্য অসীম ধৈর্য এবং অধ্যবসায় প্রয়োজন। এবং সিনেমার প্রতি গভীর প্রেম। নিজের কর্মজীবনে পরমেশ কৃষ্ণান নায়ার (১৯৩৩-২০১৬) যার জাগ্রত নিদর্শন। ভারতীয় চলচ্চিত্রে পি কে নায়ারের অবদান বুঝতে হলে শহর কলকাতার ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু পরমেশ্বরন থাঙ্কাপ্পান নায়ারের নিবিষ্ট রূপটি মনে আসে। এঁরা কি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম? যাঁদের নমস্যজ্ঞানে শ্রদ্ধা প্রদর্শনেই অনুসরণের ইচ্ছার নিবৃত্তি ঘটে?


পি কে নায়ার হেরিটেজ ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত “Yesterday’s Films for Tomorrow” বইটি থেকে স্মৃতিচারণের একটি অংশের তর্জমা তাদের জন্য, সিনেমার মায়াবী ছায়ায় যারা আজও সেলুলয়েড ফিল্মের সেই অবিচ্ছেদ্য রাসায়নিক গন্ধটি খোঁজেন।

১৯১৩ মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতের প্রথম কাহিনীচিত্র ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’র শেষ প্রিন্টটি কয়েক বছর পরেই আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। ১৯১৭ সালে ফালকে আবিষ্কার করেন ছবিটির নেগেটিভও আর নেই। তিনি আবার প্রতিটি শট নতুন করে নিয়ে, দৃশ্যগুলির মাঝে উপযুক্ত টাইটেল কার্ড বসিয়ে ছবিটি নতুন করে বানান। এমনভাবেই হারিয়ে গেছে ভারতবর্ষে বানানো উল্লেখযোগ্য বহু ছবি। হয় নেগেটিভগুলি অযত্নে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে, নতুবা আগুনে ছাই হয়েছে। বহু ক্ষেত্রে সিলভার হ্যালাইড মাখানো নেগেটিভগুলি থেকে রুপো আহরণ করবার জন্য সেগুলিকে নির্বিচারে চেঁচে পরিষ্কার করে দেওয়া হত। আবার মেয়েদের চুড়ি, ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি বানানোর কাঁচামাল হিসেবে এই সেলুলোজ ফিল্ম পৌঁছে যেত কুটিরশিল্পগুলিতে। ১৯৫০-এর আগে তৈরি অন্তত সত্তর শতাংশ ছবি এইভাবে হয় হারিয়ে গেছে। নয়তো, সময়বিশেষে উদ্ধার হলেও সেই ছবিগুলিকে আর মেরামত করা যায়নি। এর একটি অন্যতম কারণ, অধিকাংশ ছবির প্রযোজক যে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, তাদের কাছে মুনাফা ছাড়া আর কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রেক্ষাগৃহে ছবি চালিয়ে যতদিন পয়সা তোলা যাবে, ততদিনই ছবিগুলিকে তাঁরা যত্নে রাখবেন। তারপর ছবির নেগেটিভ বা পজিটিভ প্রিন্টের কী দশা হল, সেই বিষয়ে তারা নির্বিকার। তাছাড়া নাইট্রেট ফিল্মের মতো অতি দাহ্য পদার্থের রক্ষণাবেক্ষণের উপায়গুলি শিখে তা বাস্তবে ব্যবহার করবার মতো সময় বা আগ্রহ কোনওটাই তাঁদের ছিল না। স্বাধীনতার অব্যহিত আগে এবং পরে স্টুডিয়োগুলি বছরে ১০-১৫টা ছবি প্রযোজনা করত। তাদের নিজস্ব গুদামে রাখা হত ছবিগুলির রিল। প্রয়োজনমাফিক বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহেতে সেগুলির আসা-যাওয়া চলত। এরপর, রাজ কাপুর, বিমল রায়, দেব আনন্দ এবং গুরু দত্তের মতো স্বাধীন প্রযোজকরা নিজেদের সংস্থার মাধ্যমে যে ব্যবসা চালাতেন, তাতেও বানিজ্যিক দিক থেকে সফল ছবির প্রতিই তাঁদের যতটা যত্ন ছিল, অন্যান্য ছবির ক্ষেত্রে তা ছিল না বললেই চলে।

১৯৫১ সালে এস কে পাটিল কমিটির রিপোর্টে প্রথম আর্কাইভ তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়। সেই রিপোর্টে বলা হয়, চলচ্চিত্র শিল্পের বিভিন্ন দিকগুলির উৎকর্ষতাকে ভাবী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণের জন্য এমন প্রত্যেক ছবির একটি পজিটিভ প্রিন্ট আর্কাইভে রাখা উচিৎ, যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে এবং যেগুলি নষ্ট হলে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এর জন্য আলাদা একটি দপ্তরও খোলা হয় তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকে।

শুরু থেকেই আমি NFAI-এর সঙ্গে যুক্ত। প্রথমেই খোঁজ চালাই ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’র। তার কোনও প্রিন্ট কি অক্ষত আছে? ফালকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করবার পর দাদাসাহেবের মেয়ে মন্দাকিনীর থেকে ছবির একটি রিল জোগাড় হল। কয়েক বছর বাদে ১৯৬৯ সালে ফালকে-র বড় ছেলে নীলকন্ঠ ফালকে-র বাড়িতে পৌঁছে ছবিটির পজিটিভ প্রিন্টের একটা অংশের হদিস মেলে। পরীক্ষা করে দেখা গেল সব মোটামুটি ঠিক আছে। খুশি হয়ে ভাবলাম, যাক পুরো ছবিটা পাওয়া গেল। কিন্তু, আসলে সেটি ছিল শুধুমাত্র ছবিটির চতুর্থ রিল। অর্থাৎ দ্বিতীয় এবং তৃতীয় রিলগুলি খুঁজে বার করতে হবে। জানা গেল দাদাসাহেবের ছোট ছেলে প্রভাকর নাসিকে পৈত্রিক বাড়িতেই থাকেন। সেখানে পৌঁছে একটি কাঠের বাক্সে রাখা জং ধরা ক্যানগুলি থেকে ফিল্মের নামে যা উদ্ধার হল, তা ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোনও গতি নেই।

বস্তুত, ১৯১৩ থেকে ১৯৩২ – এই উনিশ বছরে প্রায় ১৫০০ নির্বাক ছবি তৈরি হয় ভারতে। সেগুলি উদ্ধার করবার জন্য দেশের সর্বত্র ঘুরতে হয়েছে। মুদির গুদাম এবং গোয়ালঘরগুলিতেও। দেশের বাইরেও গেছি ভারতীয় ছবি সংগ্রহ করবার কাজে। এইভাবে মোট দশটি ছবি আর্কাইভের জন্য সংগ্রহ করা গেল। অনেক ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র প্রযোজকের পরিবারের সদস্য অথবা উত্তরাধিকারীরা মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন এই বলে, “খবর্দার, এই বাড়িতে ‘ফিল্ম’ শব্দটি উচ্চারণ করবেন না।” একটি মুদি তার গুদামে রাখা কাঠের বাক্সটি দেখিয়ে জানতে চায়, “কত টাকা দেবেন?” অঙ্ক পছন্দ না হওয়ায় বাক্সটি হাতছাড়া করেনি দোকানদার। কয়েক বছর বাদে তার ছেলে যখন বাক্সটি আর্কাইভে পাঠায়, দেখা গেল, সংরক্ষণের যোগ্য আর কিছুই তাতে নেই।

১৯৪১ সালে কেদার শর্মা নির্মিত ‘চিত্রলেখা’ ছবিটির একটি প্রিন্টের খোঁজ মেলে কলকাতার একটি গোয়ালঘরে। বর্ষণমুখর এক দিনে তা উদ্ধার করে পুণে নিয়ে আনা হয়। ক্যানের মধ্যে রাখা ফিল্ম তখন জমাট পাথর। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ছবির প্রতিটি ফ্রেম রেস্টর করার পর তার থেকে একটি কপি তৈরি করা হয়। ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে আর্কাইভে অগ্নিকাণ্ডের ফলে একটি বাদে ছবির বাকি রিলগুলি নষ্ট হয়ে যায়।

পুণের প্রভাত ফিল্ম কোম্পানির জমি অধিগ্রহণ করে সরকার ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট নির্মাণ করে। কিন্তু সরকারি বিধিনিষেধের কারণে জমির সঙ্গে তাদের প্রযোজিত মারাঠি ছবি ‘সন্ত তুকারাম’ এবং অন্যান্য ছবির প্রিন্ট কিনে নেবার প্রস্তাবটি প্রথমে গ্রাহ্য হয়নি। সেগুলি রাখা হয় সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইণ্ডিয়ার ডেকান জিমখানা শাখার ভল্টে। ১৯৬১ সালে পানসেট বাঁধ ভাঙে। ফলে জলের নিচে চলে যায় সেই ভল্ট। অবস্থা বেগতিক বুঝে পরিবেশক মি: নামাডে নামমাত্র মুল্যে ছবির নেগেটিভ বেচে দেন চেন্নাইয়ের মি: মুদালিয়রকে। তিনি তামিল, তেলেগু, কান্নাডা ভাষায় ছবিগুলি ডাব করে দক্ষিণ ভারতের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির ব্যবস্থা করেন। কিন্তু দর্শকদের থেকে আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে মুদালিয়র অন্য পথ খোঁজেন। সেই সময়েই প্রভাতের ৪৩টি ছবির পজিটিভ প্রিন্টের জন্য NFAI একটি চুক্তি করেন মুদালিয়রের সঙ্গে। চেন্নাইয়ের একটি ফিল্ম ল্যাবরেটরিতে গোটা ছয়েক ছবির প্রিন্ট হতে না হতেই প্রভাত ফিল্ম কোম্পানির তৎকালীন মালিক আনন্দরাও দামলে এবং প্রতিষ্ঠাতার এক ছেলে চেন্নাই এসে মুদালিয়রের পরিবর্তে নিজেদের নাম চুক্তিপত্রে লেখান। তারপর যাবতীয় নেগেটিভ নিয়ে পুণে ফিরে যান। এর ফলে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউটের ল্যাবরেটরিতেই বাকি ছবিগুলির প্রিন্ট হয়, যেখানে একদা ছবিগুলি প্রথমে প্রিন্ট হয়েছিল। ‘সস্তার তিন অবস্থা ’ প্রবাদটি এক্ষেত্রে যথার্থ।

১২৩টি পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবির সংগ্রহ দিয়ে ১৯৬৪ সালে NFAI-র কর্মকাণ্ড শুরু হয়। ১৯৯১ সালে যখন অবসর নিই, তখন সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ১২,০০০। কিন্তু যে পরিমাণ ছবি ভারতে প্রতি বছর তৈরি হয়ে এসেছে, সেই তুলনায় এই সংখ্যাটি নগণ্য।

আধুনিক ভারতে সংস্কৃতির একটি ঐতিহ্য হিসেবেই সিনেমা নিজের স্থান করে নিয়েছে। অথচ তাৎক্ষনিক মনোরঞ্জনের বাইরে তার আবেদন সীমিত। নথি হিসেবে মুখে যতই আলোচনা চলুক না কেন, কার্যকরভাবে ভারতীয় সিনেমার ঐতিহাসিক উপাদানগুলিকে সংশ্লিষ্ট মহল যথেষ্ট স্বীকৃতি দেয়নি। ডিজিটাল প্রযুক্তি আসবার পর সংরক্ষণে ঢের বেশি সুবিধা থাকা সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে এই বিষয়ে অজ্ঞতা এবং উদ্যোগের অভাবও প্রকট। নীতি নির্ধারকরা হয়তো বা ভাবছেন, আবর্জনার মতো পুরনো যা কিছু, তা সরিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রাযুক্তিক উন্নয়নে গা ভাসিয়ে দেওয়াটাই শ্রেয়। এমন পরিস্থিতিতে সেলুলয়েড ফিল্ম এখন যেন রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠানের মতো। যাকে ভোলবার আপ্রাণ চেষ্টায় নির্মমভাবে পূর্ণচ্ছেদ ব্যবহার করেছিলেন কবি।

হেথা হতে যাও পুরাতন।
হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে।

অথচ তাঁর কলমে ও তুলিতে বারবার ফিরে এসেছেন সেই মায়াময়ী।