দেবব্রত শ্যামরায়
অক্টোবরের কোনও এক অলস সন্ধ্যায় বেশ একটা কাব্যিক প্রতর্ক ভেসে বেড়াচ্ছিল আমাদের কারও কারও সময়রেখায়। ‘হেমন্ত মানেই এত বিষণ্ণতা কেন? বছরের এই সময়টা এলেই এমন আদিগন্ত মনখারাপ আমাদের ঘিরে ধরে কেন?’ চোখ পড়তেই কিছুটা একমত, কিছুটা সন্দিগ্ধ হই, এখানে আমাদের মানে ঠিক কাদের কথা বলা হচ্ছে? আমরা মানে কী শুধুমাত্র শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তরা যারা একদা দু-পাতা জীবনানন্দ দাশ পড়েছি? আমাদের, যাদের মাথার ভেতরে, উদ্বৃত্ত সময়ে, বিষণ্ণতার ছাই ছাই মেঘ উড়ে বেড়ায়? ‘আমাদের’ এই মনখারাপের বিস্তৃতিটাই বা কতদূর? না, এইসব উপপ্রশ্নের কোনও উত্তর ওখানে ছিল না। তবে মূল ভাবনার যে ব্যাখাটি ছিল তা কম কৌতূহলকর নয়। বিষয়টা এইরকম—
হেমন্তে নতুন ফসল কাটা ও গোলাজাত করা
শুধু কৃষিনির্ভর ভারতে নয়, প্রায় সারা পৃথিবীতেই একটি সাধারণ ঘটনা। বছরের এই নির্দিষ্ট সময় কৃষক নতুন শস্য ঘরে তোলে বটে, তবে তারপর সারাদিনরাত তার চোখের ওপর জেগে থাকে হেমন্তের খাঁ খাঁ মাঠ। যে শূন্যতা তাকে বিষণ্ণ করে। আর এই হাজার বছরের বিষণ্ণতা প্রজন্মবাহিত হতে হতে আমাদের রক্তে মিশে গেছে, এক সুবিশাল জনগোষ্ঠীর কৌমচেতনার অংশ হয়ে গেছে। আর এই বিশাল জনগোষ্ঠী অর্থাৎ কৃষকেরা আমাদের প্রায় সকলেরই পূর্বপুরুষ, কারণ আমাদের বেশিরভাগের পিতৃপুরুষেরা একদিন কৃষক ছিলেন, তাঁদেরই সমষ্টিগত স্মৃতির অংশ আমরা আজও অবচেতনে বহন করে চলেছি। তাই আজও আমরা যারা শহুরে, তারা চোখের সামনে হেমন্তের ফাঁকা মাঠ দেখতে না পেলেও, সেই আদিম বিষণ্ণতা যেন আমাদেরও পিছু ছাড়ে না।
অক্টোবরের সেই শীতসন্ধ্যা আমরা পেরিয়ে এসেছি ক’মাস আগেই। রাজনীতির ময়দানে এখন চড়া রোদ। দেশে সাধারণ নির্বাচনের দামামা বেজে গেছে। ঠিক এই মুহূর্তে ভারতের কৃষিক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে দেখছি, সেখানে বিলাসী ‘মনখারাপ’ নেই, বরং বিপন্নতা আছে। অথচ এই বিপন্নতা থাকার কথা ছিল না। এই মুহূর্তে সারা দেশে খাদ্যশস্যের ফলন উল্লেখযোগ্য ও বিপুল, বাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে, কাঁচা বাজারে একজন মানুষের গড় ব্যয়ের পরিমাণ সামান্য হলেও কমেছে। কিন্তু এরই পাশাপাশি, নানা জায়গা থেকে দুঃসংবাদ আসছে, প্রবল হতাশায় কৃষকরা তাঁদের সারা মরসুমের উৎপন্ন রাস্তায় ফেলে বাড়ি ফিরে আসছেন। রাস্তায় পড়ে থাকছে বস্তা বস্তা নতুন আলু, পেঁয়াজ, গম। পেঁয়াজের কথাই ধরা যাক। এক কেজি পেঁয়াজ ফলাতে চাষির খরচ হয়েছে কমবেশি বারো টাকা, সেখানে বাজারে প্রতি কেজিতে তিনি দাম পাচ্ছেন মেরেকেটে দু’টাকা। দিনশেষে অবিক্রিত আলু বা পেঁয়াজ আবার পয়সা খরচ করে গাড়িভাড়া করে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানে নেই কোনও। এখনও দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষের জীবন ও জীবিকা কৃষির ওপর নির্ভরশীল, তাদের পরিবারপিছু গড় আয় কমছে। শহরাঞ্চলে একটি অদক্ষ ঠিকা শ্রমিকের রোজ যেখানে কমপক্ষে তিনশ টাকা, সেখানে কোনও কোনও কৃষক পরিবারের সারা মাসের রোজগার চাষের খরচ বাদ দিয়ে মাত্র দুশ টাকায় এসে ঠেকেছে। ঋণের দায়ে জর্জরিত কৃষক আত্মহত্যা করছেন, ভূমিহীন কৃষি-মজুর শহরে পা বাড়াচ্ছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক হিসেবে, খোলা আকাশ ও মাঠের জীবন ছেড়ে রূপান্তরিত হচ্ছেন ঘিঞ্জি, অস্বাস্থ্যকর বস্তির প্রান্তিক নাগরিকে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৪ সালে ৫৬৫০ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছিলেন, অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১৫ জন, যদিও এর একটা বড় অংশের আত্মহত্যাকে দাম্পত্য কলহের ফলাফল হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছিল কেন্দ্র সরকার। অবশ্য এর পরের বছর থেকেই এই অস্বস্তিকর পথের কাঁটাটিকে সমূলে উপড়ে ফেলে প্রশাসন। ২০১৬-তে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা শূন্যতে নেমে আসে, তার কারণ ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা নথিবদ্ধ করা বন্ধ করে দেয়। মোদি সরকারের ধারণা যে অন্ধ হলে, অথবা বলা ভালো জনগণকে কোনওক্রমে অন্ধ করে দেওয়া গেলে, প্রলয় বন্ধ করে দেওয়া যায়। যদিও যেসব বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দেশের কৃষিক্ষেত্রে নিবিড়ভাবে কাজ করে চলেছেন, তাদের কাছে থেকে পাওয়া তথ্য বলছে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা কমে যায়নি মোটেই। তার পরোক্ষ প্রমাণ, গত চার বছরের মধ্যে কৃষক অসন্তোষের ঘটনা প্রায় ৩০০% বৃদ্ধি পেয়েছে। হ্যাঁ, কোনও ছাপার ভুল নয়, সংখ্যাটা তিনশই। গত দু’মাস আগেও দেশের নানা শহরে একইসঙ্গে সাতাশটি জায়গায় কৃষক বিক্ষোভ সংঘটিত হচ্ছিল। এমনকি এই লেখাটি যখন লিখিত হচ্ছে, ঠিক এই মুহূর্তে খবর আসছে তামিলনাড়ুর কৃষকরা নিজেদের দাবিদাওয়ার কথা বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহারে সংযোজনের দাবি জানাচ্ছেন। নচেৎ বারাণসীতে খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন কেন্দ্রে তামিলনাড়ুর ১১১ জন কৃষক ভোটে দাঁড়িয়ে সরাসরি তাঁর বিরুদ্ধে লড়বেন!
অর্থাৎ কৃষিক্ষেত্রের এই তীব্র সংকট ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে ছাপ ফেলছে ও ইতিমধ্যেই তার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। ২০১৮-এ গুজরাট বিধানসভা ভোটে শাসক দল বিজেপির বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ ভোট খোয়ানো এর প্রথম সংকেত ছিল। সেই নির্বাচনে বিরোধী দল কংগ্রেসের প্রায় ৭০ শতাংশ ভোট গ্রাম থেকেই এসেছিল, যা মাত্র কয়েকবছর আগেও বিজেপির অটুট ভোটভিত্তি ছিল। অতি সম্প্রতি গো-বলয়ের তিন রাজ্য, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড় ও রাজস্থানের বিধানসভা নির্বাচন পুরোপুরি কৃষিসংকটের ইস্যুর ওপর ভিত্তি করে হয়েছে। তিন রাজ্যেই পাশা পাল্টেছে। ছত্তিশগড়ে ভোটের আগে বিরোধী দল কংগ্রেসের একটিমাত্র ঘোষণা, ভোটে জিতলে তারা কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সুনিশ্চিত করবে, তাদের দুই-তৃতীয়াংশ আসন এনে দিয়েছে। এমনকি মধ্যপ্রদেশের মালওয়া অঞ্চল, যা দীর্ঘদিন ধরেই বেশ বর্ধিষ্ণু কৃষি এলাকা, যেখানে ক্যাশ কর্পের ফলন বেশি, সেখানকার ভোটও শাসক দল বিজেপির বিরুদ্ধে গেছে। রাজস্থানে কৃষি সংকট ছাড়াও গো-হিংসা সংক্রান্ত ঘটনার পর পশুপালন ও পশুমাংস বিপণন প্রভূত ধাক্কা খেয়েছে যার ঋণাত্মক প্রভাব পড়েছে ভোটবাক্সে৷ অতএব, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে শাসক দলের এই মুখ থুবড়ে পড়া পরিষ্কার বলে দিচ্ছে এই তিন রাজ্যের ভোটাররা খুশি নন। এই তিন রাজ্যের শতকরা ৭০ ভাগ কেন্দ্রই গ্রামীণ এবং যার ৮০ শতাংশ ভোটার কৃষিজীবী, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, তাঁরা মূলত সমস্যাজর্জর কৃষক, সেখানকার ভোটে বিজেপির এই পরাজয় বুঝিয়ে দিচ্ছে শুধুমাত্র কৃষিসংকটের মূল ইস্যুতেই এই তিন রাজ্যে ভোট হয়েছে এবং সেখানকার সরকার গ্রামীণ জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে চূড়ান্ত ব্যর্থ। এই তিন রাজ্যের ভোটের ফল ও দেশজুড়ে ক্রমশ বাড়তে থাকা কৃষক অসন্তোষ ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিমুখ নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে।
পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯
মনে রাখার মতো বিষয়, এই তিন রাজ্য থেকেই বিজেপি গত লোকসভার এক তৃতীয়াংশ আসন পেয়েছিল। তবে, আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে এই তিন রাজ্যের ভোট সমীকরণ কি বিজেপির দুর্ভাগ্য ডেকে আনতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর তেইশে মে জানা যাবে। তবে একথা ঠিক, যা কিছুদিন আগে পর্যন্ত তিন বা চার রাজ্যের সীমাবদ্ধ সমস্যা ছিল, তা আজ গোটা ভারতবর্ষের সংকট। এবং দেশের কৃষক সমাজ একযোগে রাজনৈতিক প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছেন। মধ্যপ্রদেশ বিজেপি সরকার এই হাওয়া বদল বুঝতে পেরে ভোটের কিছুদিন আগে তড়িঘড়ি সহায়ক মূল্যের কথা ঘোষণা করেছিল বটে, তবে তা প্রয়োগের ত্রুটি ও তৎপরতার অভাবে কৃষকদের সমস্যার কোনও সুরাহা হয়নি। ইভিএম-এ তার ফল ফলেছে। এমনকি আজও, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সরকারের মূল লক্ষ্য কৃষি সমস্যার সমাধান নয়, বরং ভোটের মুখে খাদ্যদ্রব্যের দাম যেনতেন প্রকারে নিয়ন্ত্রণে রাখা, তাই যোগান অব্যাহত রাখতে বাইরে থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করা হচ্ছে। অন্যদিকে মহারাষ্ট্রের চাষিভাইটির উৎপাদন, সরকারি পরিকল্পনা ও পরিকাঠামোর অভাবে, খোলা আকাশের নিচে পচছে।
তাই সাধারণ নির্বাচন আসবে, যাবেও। রাজনৈতিক চাপানউতোর চলবে। শাসকের বদল হবে, অথবা হবে না। কিন্তু এই সমস্ত কিছুর চেয়ে অনেক বড় সমস্যা হিসেবে জেগে থাকবে কৃষিজীবী ভারতের দীর্ঘমেয়াদি সংকট, যার দিকে এতদিন শাসকের উপযুক্ত নজর পড়েনি। নজর পড়েনি দেশের শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের, যারা শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত বহুজাতিকের স্টোরে ঘুরে ঘুরে সতেজ সবজি কেনেন, অথবা বাড়িতে বসে মোবাইলে অ্যাপ টিপে চাল ডাল বেছে নেন, অথচ এসবের আসল উৎপাদকের কথা তাদের কোনওদিন মনেও পড়ে না। আর কত প্রজন্ম পেরোলে ভারতবর্ষের দুই তৃতীয়াংশ মানুষের এই দুঃসহ যাপন বিষণ্ণতার চেতনা হয়ে আমাদের দেশের মধ্যবিত্তের রক্তে মিশবে?
আদৌ মিশবে কি?
এই রোমান্টিকতার অপেক্ষা বা পরোয়া কোনওটাই করেন না কৃষকরা। তাঁদের হাতে বিষন্ন হওয়ার কোনও ‘অপশন’ নেই। কোনওদিন ছিল না। তাঁরা ক্রুদ্ধ হচ্ছেন, উঠে দাঁড়াচ্ছেন, জোট বাঁধছেন। ওই যে, তাঁদের দেখা যাচ্ছে আবার, অদূরে। দিল্লির প্রগতি ময়দানে। মুম্বইয়ের রাজপথে। তামিলনাড়ুর অলিতে গলিতে। তাঁদের পায়ে পায়ে মহানগরীর ধুলো উড়ছে। এক টুকরো রক্তাক্ত মেঘ নিঃশব্দে ঢুকে পড়ছে আমাদের ঘুমন্ত, ব্যক্তিগত শহরে।
আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের ফল যাই হোক না কেন, ভারতবর্ষের কৃষককে অবহেলা করার সাহস আগামী শাসকের হবে না।