Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এমনিতেও তো মরে যাব… চাকরি না পেলেও মরে যাব…

শতাব্দী দাশ

 

ছয় সাত বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। তাকে আন্দোলনের আকার নিতেই হত৷ দু’হাজার বারো থেকে উনিশ৷ অনিয়মিত এসএসসি পরীক্ষা৷ প্রতি বছরের বদলে পরীক্ষা হয়েছে শুধু ২০১২ ও ২০১৬ সালে৷ তার উপর নিয়োগে বিস্তর গলদ পেয়েছেন পরীক্ষার্থীরা৷ আদালতে অনেক মামলা। মৌখিক আশ্বাস পাওয়া গেছে অনেকবার৷ সেসব শুধুই কথার কথা। তাই শিক্ষামন্ত্রী মৌখিক আশ্বাস দিলেও এবার অনশন মঞ্চে অনড় আন্দোলনকারীরা৷

ভোটের আগে নিয়োগে কিছু রেস্ট্রিকশন তো আছে। এই মুহূর্তে ঠিক কী হলে অনশন তুলবেন আপনারা?

সঞ্চিতা বললেন,

উনি ঠিক কী করতে চাইছেন আমাদের বিষয়ে? ভেকেন্সি লিস্ট কি আপডেট করবেন? সব কিছুর লিখিত প্রতিশ্রুতি চাই৷

একটা কমিশন গঠন হচ্ছে নাকি!

তাতে ভরসা পাচ্ছি না। কমিশন গঠন হচ্ছে বলেই উঠে যাব না। কমিশন কী বলে, তা দেখে সিদ্ধান্ত হবে।

ওঁরা না খেয়ে আছেন আজ চব্বিশ-পঁচিশ দিন৷ গর্ভপাত হয়েছে দুজনের। স্বাভাবিকভাবেই, তাঁরা আর অনশন মঞ্চে নেই৷ শ্বশুরবাড়িতে ভীষণ গঞ্জনায় আছেন তাঁদের একজন, শোনা গেল।

সন্তানকে নিয়ে একুশ দিন মঞ্চে ছিলেন এক মা৷ ফুটপাথে। মাকে চোখে হারায় ছেলে। ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে ঠান্ডা লেগে। বাড়ি ফিরে গেছে।

অনিতার বর এসেছে দেখা করতে। অনিতা কাল অসুস্থ ছিল। আজও ঢলে পড়ল একজনের কোলে৷ শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের স্বেচ্ছাসেবী ডাক্তার এসে দেখে গেলেন৷ ওষুধ দিলেন৷ ওষুধ খালি পেটে খাওয়া যায় না৷ বিস্কিট খেতে ওঁরা রাজি নন৷

অনিতার প্রেসার মোটামুটি। তবে কী সমস্যা? জানা গেল, ইউরিনারি ট্র‍্যাক্ট ইনফেকশন৷ প্রস্রাবে প্রচণ্ড জ্বালা ওর৷ মেয়েরা কম-বেশি রক্তাল্পতায় ভুগছেন সকলেই৷ যাঁদের পিরিয়ড চলছে, তাঁদের চেঞ্জ করারও একমাত্র জায়গা ওই নোংরা সুলভ।

বুদ্ধদেব কাল থেকে অসুস্থ। এখনও ফেরেননি হাসপাতাল থেকে৷ তাকে নিয়ে সমবেত দুশ্চিন্তা৷ হাসপাতালে যেতে কী এক অজ্ঞাত কারণে ভয় পাচ্ছেন সকলে। অথচ ডাক্তাররা এইখানে এসে চিকিৎসা করলে আপত্তি নেই৷ হাসপাতালে পাঠানো যেন দলছুট করে দেওয়া৷ বেঁধে বেঁধে থাকতে চাইছেন তাঁরা৷ কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না৷

পড়ুন — যে যেখানে লড়ে যায়

এক হাতে চ্যানেল, অন্য হাতে স্যালাইনের বোতল নিয়ে হেঁটে গেল যে, সে তানিয়া। কাল হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল। গভীর রাতে, একটা নাগাদ, বাড়ি ফিরেছে৷

–বাড়ি?

‘বাড়ি’ কথাটা বলে ফেলে ও শুনে ওঁরা নিজেরাই হেসে ফেললেন৷ কেউ এসেছেন নদীয়া থেকে। কেউ বর্ধমান৷ কেউ মেদিনীপুর। দিনাজপুর। মালদা৷ কলকাতা। বীরভূম৷ এখন সবার এটাই ‘বাড়ি’। মেয়ো রোড। প্রেস ক্লাবের সামনে।

রোগা চেহারার তানিয়া স্যালাইন হাতে কোথায় যাচ্ছিল? শহিদ মিনারের উল্টোদিকের সুলভ শৌচালয়ে। যদি মাথা ঘোরে? তাই পিছনে যাচ্ছিল দুই পুরুষ আন্দোলনকারী৷ শৌচালয়ের দরজায় অপেক্ষা করবে৷ বন্ধুতার দায়৷

অন্তত পনের দিন ত্রিপলও ব্যবহার করতে দেয়নি পুলিশ৷ রোদ পুড়েছেন৷ বৃষ্টিতে বসে থেকেছেন ছাতা মাথায়। এখন ত্রিপল আছে-টাছে৷ এখন জনসমাগম৷ সিপিএম। কংগ্রেস। বিজেপি-ও। এবিটিএ মিছিল করে এল৷ টাকা উঠছে কিছু। ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক উদ্যোগে। ওষুধ আসছে। স্যানিটারি ন্যাপকিন৷ মশার ধূপ৷ ওআরএস।

গত রাতে মশারি কেটে জিনিসপত্র চোরে নিয়ে গেছে৷ নতুন মশারি চাই খান দশেক। টাকা তোলা গেল৷

নিউমার্কেটে রবিবার বেডিং-এর দোকানে ঝাঁপ ফেলা। কালকের আগে ব্যবস্থা হবে না৷ অথচ আজও বড় বড় টেডি বিয়ার৷ আলো৷ বারিস্তা৷ চির-উৎসব।

ফিরলাম যখন, তখন ইমার্জেন্সির আলোয় ফাইল খুলে কাগজপত্র গোছানো চলছে৷ দুটি ছেলের কাছে মাথা নেড়ে নেড়ে বুঝে নিচ্ছে তানিয়া। এবিপি আনন্দ পঁচিশ দিনের মাথায় গাড়ি পাঠাচ্ছে। আজ প্রাইম টাইম পাবে এসএসসি আন্দোলন৷ এক ঘণ্টার সময়সীমায় তানিয়ারা যুক্তিনিষ্ঠভাবে বোঝাবে, কেন আন্দোলন? কোথায় কোথায় গাফিলতি?

একটি ডকুমেন্ট দেখানো হল। এক হেডমাস্টারমশাই জানাচ্ছেন তাঁর স্কুলে অযাচিতভাবে সায়েন্স গ্রুপের জন্য ইলেভেন টুয়েলভ ক্লাসের শিক্ষক এসেছেন৷ তাঁদের সায়েন্স স্ট্রিমই নেই৷ একাদশ-দ্বাদশে আর্টস পড়ানো হয় শুধু৷ আর্টস সাবজেক্টের শিক্ষক চেয়েও পাচ্ছেন না৷

আরেকটি ডকুমেন্ট৷ শিডিউল্ড কাস্ট লিস্টে প্রথম স্থানাধিকারী মেয়েটি, দেখা যাচ্ছে, কমবাইন্ড লিস্টে জায়গাই পায়নি৷ বেশ কথা৷ কিন্তু শিডিউল্ড কাস্ট লিস্টে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী কী করে যেন সেই লিস্টে জায়গা করে নিয়েছে!

আবার একটি ডকুমেন্ট৷ মুর্শিদাবাদের ভেকেন্সি লিস্ট৷ আরটিআই করে বের করা হয়েছে। কয়েক হাজার শূন্যপদ৷ কিন্তু চাকরি পাচ্ছেন না ওয়েটলিস্টেডরা৷

এইসব আজ রুগ্ন শরীরে টিভির পর্দায় হাজির করবেন এঁরা, জনতার দরবারে৷ সাতটা নাগাদ বিষণ্ণ অন্ধকার ত্রিপলের তলায়৷ বন্ধুদের বক্তব্য এঁদের শোনা হবে না৷ কিন্তু আশা নিয়ে বসে থাকবেন ৷ বন্ধুরা ‘বাড়ি’ ফিরলে শুনে নেবেন বুদ্ধিজীবীদের মতামত।

পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯

শহরবাসীর ভিড় পাতলা হচ্ছে আস্তে আস্তে৷ কাল আবার আসার আশ্বাস, কাল আবার পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস। কিন্তু দিনের শেষে আমাদের ভাগে রইল খাট, বিছানা, নৈশাহার। ওঁদের ভাগে শূন্যতা৷

‘আপনি’ এতক্ষণে ‘তুমি’ হয়ে গেছে।

কতদিন চলবে এভাবে?

যতদিন না দাবি মানছে।

মানবে৷ আশা করি, এক-দুদিনের মধ্যে। কিন্তু ধরো যদি দেরি করে? ধরো যদি নবনির্মিত কমিশনের গড়িমসিতে…

তাহলে মরে যাব৷ এমনিতেও তো মরে যাব৷ চাকরি না পেলেও মরে যাব৷