Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

লাফটার, দ্য মোস্ট এক্সপেন্সিভ কমোডিটি : ইউটিউবারদের গল্প

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

উপত্যকা। শীত। যুদ্ধ। টেনশন। বাড়ির ভেতর। পিতা, পুত্র। সকালে ছেলেকে ঘুম থেকে ডাকতে গিয়ে খুঁজে পান না বাবা। একটার পর একটা লেপ তুলতে থাকেন। ছেলের মুখ, এই তো ভেসে উঠবে কোনও একটার ভেতরে। নেই। ভয়। পুলিশকে ফোন। ওদিকে থেকে ঠান্ডা সাড়া। বাবার কান্না। ঠিক এই সময় খাটের উল্টোদিক দিক থেকে লেপ খুলে জেগে উঠল ছেলে। জড়সড় হয়ে শোয়া। এতক্ষণ অন্য দিক খুঁজছিলেন বাবা।

এটুকুই। রাজনীতি, সাম্প্রতিকতা, সমাজ এসবের বাইরে আসলে নির্ভেজাল হাসি। মাহি আমীরের ইউটিউব চ্যানেল কে আর, ওরফে কাশ্মিরি রাউন্ডার্স। ট্যাগলাইন ‘আসিভ তে লাসিভ’, যার অর্থ ‘স্মাইল অ্যান্ড প্রস্পার’। জন্ম ২০১৭। এখন সাবস্ক্রাইবার কত? মাহীর চকচকে চোখে উত্তর, তিন লাখ। উদ্দেশ্য? উপত্যকার মানুষদের নির্মল আনন্দ দেওয়া। ওরা একটু হাসুক। ভয় না কাটালেও, লুকোক অন্তত।

অথবা কাশ্মিরি কালখারাব (কে কে)। অর্থ, কাশ্মিরি হেড-কেস। ২০১৮-র জানুয়ারি থেকে আজ অবধি ৩.৫৫ লাখ সাবস্ক্রাইবার। কীভাবে শুরু? মনে করলেন পারভেজ। কেকে-র প্রতিষ্ঠাতা। আব্দুল হামিদ। পারভেজের বাবা। বছর ৪৫। উত্তর কাশ্মিরের পাঞ্জিনারা গ্রাম। সিকিউরিটি চেক পয়েন্টে হেনস্থার শিকার। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। পুলিশের হিন্দির উত্তরে আব্দুলের কাশ্মিরি। কখনও ইশারা, ইঙ্গিত। শেষমেশ এতসব দুর্বোধ্যতার বাইরে চলে গিয়ে আব্দুলের গায়ে পিঠে অসম্ভব পুলিশি মার। বছর পেরিয়েছে। এখনও ঘুমের ভেতর উঠে বসেন আব্দুল। শরীরে, মনে যন্ত্রণা। ছেলে পারভেজ কিছু একটা খুঁজছিলেন। কিছু একটা। একটু হাসি। একটু রিলিফ। আরও অনেক আব্দুল আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাঁদেরও। একদিন গ্রামের দোকানে শওকত, মানে পারভেজের এক বন্ধু ঢুকে আইডিয়া দিল। ‘দাদা, আমাকে ডিল করতে দেবেন? খদ্দেরদের সঙ্গে?’ দোকানি কী যেন একটা ভেবে রাজিই হলেন। বাকি বন্ধুরা গোপনে ভিডিও করতে থাকলেন। একটি বাচ্চা চুইংগাম কিনে চলে যাচ্ছিল, ডেকে মৃদু ধমকাল শওকত, খেয়ে মুখ থেকে ফেলে এখানেই দিয়ে যাস, আমরা ওটা দিয়ে দড়ি তৈরি করি। ছেলেটা তাজ্জব। কিংবা একজন খদ্দের ৫০০ টাকার খুচরো চাইলে শওকত কয়েন বের করে গুনতে শুরু করল। খুচরো। অবাক দোকানি, খদ্দের। বিরক্তি অথবা হাসির ফোয়ারা। এই ভিডিওই বাজারে ছাড়ল। বাজারে মানে ফেসবুকে। তিন দিনে তিন লাখ ভিউ। এখনও অবধি যা এক মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। তার ঠিক পরেই কাশ্মিরি কালখারাব। ছোট্ট বাস্তব এক মজার ফেসবুক ভিডিও থেকে স্থায়ী ইউটিউব কমেডি চ্যানেল। সাত সদস্য। মাসে সাতটা করে মিনিট পনেরোর ভিডিও তৈরি করে কেকে। ছড়ায় ভাইরাসের মতো। বিষয়? পারভেজ হাসলেন। হাসি। আবার কী? এই রাজ্যে যন্ত্রণার জন্য, কান্নার জন্য অনেক কিছু আছে। হাসার জন্য কিচ্ছু নেই। আমরা হাসি ছড়াই। যদিও শেকড় থাকে সাম্প্রতিক কাশ্মিরের মধ্যেই। যেমন, ইন্টারনেট ব্যান হওয়া এক কাশ্মিরি যুবকের এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ানো, গাড়ির তেল নষ্ট করা। শেষমেশ সবজি কেনার জন্য বাবার দেওয়া সমস্ত টাকা খরচের এক মজার অথচ করুণ গল্প। অথবা বয়স্ক বাবাকে ধান চাষে সাহায্য না করে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে আঠার মতো মগ্ন দুই ছেলের কথা, বাবার বাড়ি ফিরে আসার পর আরও মজার অথচ, ওই যে বললাম, কঠোর করুণ পরিসমাপ্তি। ছোট্ট ভিসুয়াল স্কিট। আড়ালে কাশ্মিরিদের ওপর চলা টর্চার, জমাট বাঁধা উগ্রপন্থা, নিখাদ ভারতীয়তা সবকিছুই। পারভেজ, মাহীরা আসলে যে ভারতবর্ষের কথাই বলেন।

মানুষ কতটা সাড়া দেন? কিছুটা বলা আছে। সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যায়। তার বাইরেও থাকে অন্য কিছু। বছর তিনেক আগে গণ-প্রতিবাদে নিজের ভাইকে হারানো এক নারী তার ছেলেকে দিয়ে কেকে-র সঙ্গে দেখা করে। হাত রাখে। তিন বছর পর সেই নারী হাসি ফিরে পায়। অথবা ডক্টর শারাফাত আহমেদ। কেকে-কে পাঠানো চিঠিতে তাঁর কথা, তাঁর হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষদের মধ্যে হাসি ছড়িয়ে পড়ছে। এ এক অন্য চিকিৎসা। শারাফাত তৃপ্ত। গর্বিত। কেকে-র জন্য।

সেই কাশ্মির। এখানে এতটুকু কাজও সন্দেহের চোখে। তীব্র নজরদারির চোখে। বিনোদনের জায়গা কোথায়? ব্যান্ডপ্যান্থার কিংবা লেডি শাহ, এরম কিছু ফোক থিয়েটার থাকলেও, অসম্ভব বাধায় কাজ প্রায় অনিয়মিত হয়ে আসছে। শিল্পীরা ভয়ে মঞ্চে আসতে পারছেন না। পলিটিকাল স্যাটায়ার? কাশ্মিরে? নেক্সট টু ইম্পসিবল। এখানেই ইউটিউবারদের সুযোগ। আর এখানেই কৃতিত্ব। সচেতনতা, নিজেদের কথা বলার বাইরে একটা হাসির পোশাক। যদি কাজে লাগে। আর সেখানেই কেল্লা ফতে। ২০১৬ অবধি যে রাজ্যে প্রায় ১.৮ মিলিয়ন মানুষ গুরুতর মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। হ্যাঁ, ১.৮ মিলিয়ন। মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ। যাঁদের মধ্যে ১৯ শতাংশই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে ভুগছেন। যা সংখ্যায় ৭৭১০০০। এই যন্ত্রণার কাশ্মিরে পারভেজদের কেকে, মাহীদের কেআর। ইউটিউব। প্রযুক্তি। আলো।

ইউটিউবাররা আলো দিক। উপত্যকার মানুষ হাসুক। শুধু মিলিটারি না, শুধু বন্দুক না, গোলাপের তোড়াও আসুক। হাসি আসুক। হাসি। পারভেজের ভাষায় যা কাশ্মিরের সবচেয়ে দামি জিনিস। ‘মোস্ট এক্সপেন্সিভ কমোডিটি’।