Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জসিন্তা কেরকেট্টার কবিতা

তুষ্টি ভট্টাচার্য

 

জসিন্তা কেরকেট্টা ঝাড়খণ্ডের ওঁরাও আদিবাসী সমাজের একজন হিন্দিভাষী নবীন কবি। তিনি একজন সোসাল ওয়ার্কার, ফ্রিল্যান্স লেখিকা ও সাংবাদিক। ওঁর দুটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৬ সালে প্রথম সংকলন আদিবাণী, কলকাতা প্রকাশনী থেকে ‘অঙ্গোর’ ও ২০১৮ সালে দ্বিতীয় সংকলন ‘জড়ো কী জমীন’ ভারতীয় জ্ঞানপীঠ, নিউ দিল্লি থেকে প্রকাশিত। দুটি সংকলনই হিন্দি ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই এক সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল। দুটি বইয়ের জার্মান অনুবাদ যথাক্রমে ‘গ্লুট’ ও ‘টিফহ বর্জুলেন’ নামে দ্রৌপদী বেরলাগ, জার্মানি দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৮ সালে ‘অঙ্গোর’ সংকলনের ইতালীয় অনুবাদ ‘ব্রাচে’, মিরাজী প্রকাশনী, তুরিনো, ইটালি দ্বারা প্রকাশিত হয়। এই বছরেই এই সংকলনের সাঁওতালি অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছিল।

 

আদিবাসী মেয়েরা (आदिवासी लड़कियां)

 

কোনও আদিবাসী গ্রামে ঘুরতে যাওয়া কিছু লোক
কবিতায় খুঁজতে থাকে
নদীতে স্নানরত কোনও আদিবাসী রমণীর খোলা পিঠ
এক কাপড়ে লেপ্টে থাকা তার পুরো শরীর
ভেজা কাপড়ে ঘরে ফেরা কোনও জোয়ান মেয়েকে

কেউ এখন কবিতায় খোঁজে ঘোটুল(১),
ধুমকুড়িয়া(২), দুরন্ত চারাগাছ:
আর আগুনের চারপাশে রাতভোর নাচতে থাকা লোক
হলুদ আলোয় সোনার মতো চকচকে বুক
আর আগুনের ফুলকির মতো উচ্ছল হাসি

সকালে দেয়ালের আড়াল থেকে
মেয়েটির ভীরু দুই চোখ উঁকি দিয়ে
এক আগন্তুককে দেখে ফেলে
ফের ঘরের ভেতরে চলে যায়।

যখন ও ধীরে ধীরে বাইরে আসে
হাসে, কথা বলে
আর কথায় কথায় হাসতে গিয়ে
তার কথা ছুঁয়ে দিয়ে যায়
তখন সে বোঝে
খুব সস্তা এই সহজতা
আর পিছন ফিরে ওর পিঠের ওপর
তার আঙুল আঙুল ঘুরতে থাকে

অনেক বছর বাদেও তার সুখনিদ্রায়
সে ওই মেয়েটির পিঠ খুঁজতে থাকে
কথায় কথায় ছুঁয়ে দেওয়া ওর হাত
কিছু উচ্ছলতা
কিছু সহজতা
যাকে সে সবসময়েই সস্তা ভেবে এসেছে

ঘুম ভেঙে উঠে সে চমকে ওঠে
আর কোনও মেয়ের মধ্যে সে
এমন কবিতা খুঁজে পায়নি
কবিতা তার পিঠের ওপর হাসি ছুড়ে দেয়
ওর নোংরা আঙুল ভেঙে দেয়
আর চিৎকার করে বলে ওঠে
কবিতায় আদিবাসী মেয়েদের খোঁজা এবার বন্ধ কর!

 

এই নির্লজ্জ হাসি কার? (किसकी है यह निर्लज्ज हंसी?)

 

সেদিন ওকে অনেকবার ছুরি মেরেছিলাম
সেই থেকে
আমার হাত অবশ হয়ে
একদিকে ঝুলছিল
যেই আমি ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানা থেকে পড়ে গিয়ে চোখ খুলেছি
বুঝেছি, এটা কোনও স্বপ্ন
আমি স্বপ্নে রোজ ওকে হত্যা করি
আর প্রত্যেকবার রক্ত-মাংসের প্রত্যক্ষ রূপে
বাস্তবের মাটিতে
সকাল থেকেই ওকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়

একদিন আমি উত্যন্ত উদাস হয়ে নিজের ভেতরে তাকিয়ে দেখি
এক চুপচাপ, ভীরু, কাঁপতে থাকা কোণে
এক মেয়ে বসে ওইখানে
আমি ওকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছি
বল…বল…কাকে ভয় পাও তুমি বল?
ও কাঁপতে কাঁপতে ইশারা করে
ওর সমস্ত কথা গলায় এসে আটকে যায় কোথাও
ও হয়ত উগড়ে দিতে চেয়েছিল কিছু
যাতে নিজেকে স্বস্তি দিতে পারে
একটু শ্বাস নিতে পারে

কিন্তু কোনও পরিচ্ছন্ন থাকতে চাওয়া অদৃশ্য হাত চালাকি করে
ওর মুখ চাপা দিয়ে দেয় সব সময়ে
ওর পিছনে দাঁড়িয়ে থেকে বলতে থাকে
যদি এই দুনিয়ার সব মেয়েরা
এক এক করে পৃথিবীর বুকে সব কিছু উগড়ে দেয়
তাহলে কী হবে! পৃথিবী দূষিত হয়ে যাবে না?
আর আমি তো খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মানুষ

আমি এক ঝটকায় বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি
ওই অদৃশ্য পরিচ্ছন্ন হাত খুব কায়দা করে
সমস্ত নোংরা নিজের হাতের তালুতে লুকিয়ে ফেলেছে
প্রত্যকে মেয়ের মুখ বন্ধ করে
এখনও পর্যন্ত ও দাঁড়িয়ে
নির্লজ্জের মতো হাসছে আর হাসছে…

 

ভাগবাঁটোয়ারা করে খায় যারা (मिल बांटकर खाने वाले लोग)

 

ওর থালায় অনেক সুস্বাদু খাবার আছে
ভুঁড়ি বেড়েই যাচ্ছে দিনকে দিন
যদিও বড় ভুঁড়ি সামলাতে অসমর্থ
এত কিছু সুবিধে পাওয়ার পরেও
রাতের খাবারের পরে পাশের বস্তি থেকে
আমার মতো এক গরীব মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যায়

কখনও কখনও বলে পাঠায় অবশ্য
“নিজের মেয়েকে পাঠিয়ে দাও”
আর আমার ঘরের ভীত পুরুষরা
ওর দোরগোড়ায় আমাকে ছেড়ে আসে
আর বলতে থাকে ওদের মেয়ে এবার মরে গেল
তো সাহেব, এইরকম ভুল করেও ভাববেন না যেন
যে আমি কেবল ভ্রূণেই মরে যাই
এভাবেই সবাই মিলে ওরা আমাকে মেরে দেয়

উনি এতই সুশীল যে কী আর বলি
অন্য কিছু মিলেমিশে খেলেন কী না খেলেন
কিন্তু নারীকে ভাগ বাঁটোয়ারা করে খান
আমার শরীরের প্রত্যেক অংশে ওদের ভাগ থাকে
এক দিন কেটে গেলে পরের দিন
আমার কী জাত জিজ্ঞেস করে
নিজের মুখে বলতে লজ্জা পাই
কীকরে বলি পুরুষের চেহারা দেখে চেনা যায়
কিন্তু কুকুরের জাত বিচার করেই গুণতে হয়।

সকালে ঘর পরিষ্কার হয়, কাচাকুচি-স্নান হয়
আর আমাকে ঘরের বাইরের রাস্তা দেখিয়ে দেয়
আমি সারা জীবন এক ঘর খুঁজে গেছি
কিন্তু শুধু দরজাই পেয়েছি
ঘরের ভেতরে যাওয়ার জন্য, বাইরে আসার জন্য
যেই আমার গর্ভ হয়েছে
মেয়ে জন্ম দিয়েছি
পেছনের বাগানে পুঁতে দিয়ে এসেছে
ছেলে হলে অবশ্য কখনও কখনও
নিজের সন্তানহীন স্ত্রীকে দিয়ে এসেছে

আমি আজও এই শহরের কোথাও না কোথাও বেঁচে আছি
বিক্রি হয়ে যাওয়া আত্মাকে টুকরো করে, অনেক ভাগে কেটে
টাঙিয়ে রাখা হয়েছে
আমার কাছে ‘না’ বলার মতো ‘না’ নেই
‘হ্যাঁ’ বলার মতো ‘হ্যাঁ’ নেই
আমি কিছুই করতে পারব না গো বাবু
তোমরা ভাগবাঁটোয়ারা করে খাওয়া লোক
তো নিজেদের অকাজ কুকাজের কথা একসাথে কেন বল না?

শুনেছি তোমাদের নাকি শব্দের অভাব হয় না!

 

চিৎকার করা মেয়েরা (शोर मचाती लड़कियां)

 

ছোটবেলা থেকেই যে খুব কথা বলে
তার ওপর ফুঁ দিয়ে দাও এক মন্ত্র
“শান্ত মেয়েরাই সবথেকে ভালো”
আর এই মন্ত্রের প্রক্রিয়ায় নিজেকে সামলে নিয়ে
সেলাই করতে বসে সে নিজের মুখ
ভাষার স্যুপ থেকে বাছতে থাকে কাঁকড়
ভেতরের কোন গনগনে উনুনে
জ্বালাতে থাকে ছেড়ে যাওয়া শব্দদের ধীরে ধীরে
আর ঘর থেকে বেরনোর আগে
টেনে নেয় ‘ভালো মেয়ের ওড়না’ নিজের বুকে

অনেকক্ষণ ধরে যখন আমি ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি
ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় প্রচুর কথা বলা মেয়েরা
আমাকে বলে “হাহ! কেন এত বকবক করেই যাচ্ছ?”
ওরা সেই লোক
যারা পিঁপড়েদের খুন করে
স্রেফ এই জন্য
ওরা ওদের ভাষা বুঝতে পারে না
ওদের চেঁচানি, কথা বলা, চিৎকারকে
স্রেফ বলে দেয় “গর্জে ওঠা”

অনেক কথা বললে শব্দ দূষণ হয়
এই কথা বলে ওরা
সাফাই করার নামে তাকেই সাফ করে
যে কথায় কথায় সব রূঢ় সত্য বলে দেয়
কিন্তু মেয়েরা আর পাখিরা
যেখানেই জন্ম নিক, প্রচুর কথা বলবে
দুনিয়া ওদের ‘গর্জন’ বলতেই থাকবে
আর ওরা গর্জাতেই থাকবে…।

 

ধুলোয় খেলা করা মেয়েটি (धूल में खेलती लड़की)

 

ধুলো মাটিতে খেলা করা বাচ্চাদের মাঝ থেকে
একদিন ওকে কেউ টেনে নিয়ে গেল
ও জিজ্ঞেস করল কেন সে ওদের সঙ্গে খেলতে পারবে না
উত্তর এল যাদের সঙ্গে ও খেলছিল
ঘর-বাড়ি আর ডাল-ভাতের খেলা
ওরা সবাই ছেলে আর ও এক মেয়ে মাত্র

টিয়া পাখির আদলের পয়সা ফেলার ভাঁড় থেকে
সমস্ত পয়সা বের করে
আধ ঘন্টা হাঁটার পরে
যে মেলা থেকে ও কিনে এনেছিল
মাটির ডেকচি, কড়াই, থালা বাটি
একদিন ওই সব কোণায় ফেলে দিয়ে
আসল থালা, গ্লাস, ডেকচি মাজতে লাগল
লোকে বলল দ্যাখ কত ভালো মেয়ে ও
সবার এমনই মেয়ে চাই
যে সারাদিন ঘরভর্তি এঁটো বাসন মাজতে থাকবে
ঝাঁট দিতে থাকবে আর সবার জন্য রান্না করতে থাকবে

জানলার জাল দিয়ে ও দ্যাখে
যে ছেলেরা ওর সাথে কখনও খেলত
ওরা সবাই বেড়ে উঠছে
জোয়ান হয়ে উঠছে
আর এক মোটাসোটা বাচ্চাকে কোলে খেলাতে খেলাতে
বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে
বালির ঘর বানানোর, মাটির ভাত রান্না করা
আর ধুলোয় খেলা করার স্বপ্ন বুকে সাজিয়ে নিয়ে
একা ও পিছনে কোথাও হারিয়ে গেছিল

 

আমি এখন বহিষ্কৃত (अभी मैं बहिष्कृत हूं)

 

সেদিন আমার বিয়েতে
যারা জমিয়ে ভোজ খেয়েছিল
গলা পর্যন্ত মদে ডুবে ছিল
কাল আমার দেহে লাঠির আঘাতের চিহ্ন দেখে
হাত নেড়ে ওরা বলছে
“দ্যাখো, এ তো তোমার নিজের সমস্যা”

আমি চিৎকার করে ওদের জিজ্ঞেস করতে চাই
প্রেম, সম্বন্ধ, বিয়ে
গর্ভ, আস্থা আর আমার শরীর
এই সব কি আমার নিজের সমস্যা ছিল না?

সন্ধেবেলায় কেউ প্রার্থনা করে
যেন আমার স্বামীর মন ফিরে আসে
কিন্তু তাকে কখনও বলতে শুনিনি
গ্রামে মেয়েদের ওপর এমন হিংসা বরদাস্ত করা হবে না

কাল আমি আমার স্বামীকে উলটো মার দিয়েছি
আর ও পুরো গ্রামে ডঙ্কা পিটিয়ে এসেছে
“দ্যাখো, বউ হাত তুলেছে আমার গায়ে”
আজ পঞ্চায়েত বসেছে
নিদান দিয়েছে যে দণ্ড দিতে হবে
দণ্ড না দিলে এই সমাজ থেকে
আমি এখন বহিষ্কৃত হলাম…।