প্রিয়ক মিত্র
পূর্ব প্রকাশিতের পর
“একটু ছিলিম টানবি না কি রে ন্যাবা!”
ইন্দ্রকমল সিংহের কুঠিবাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান নব খানিক চমকাল। তারপর পেছনে ফিরে নন্দলালকে দেখে খানিক ধাতস্থ হল।
“তোর আবার এখানে কী মতলব রে হতচ্ছাড়া! কার হাঁড়ির খবর নিতে এয়েছিস?”
জিভ কাটল নন্দলাল।
“না না ওসব কিছু নয়।”
তারপর একটু চারপাশ দেখে মুখ নামিয়ে এনে নীচু গলায় বলল, “ওই দুই সাহেবকে নিয়ে এসেছি। ওদের একটু বিশেষ দরকার রাজাবাবুর সঙ্গে।”
নব অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল দুই সাহেব নন্দলালের পেছনে দাঁড়িয়ে। তার মধ্যে এক সাহেবকে দেখেই সাহেব বলে বোঝা যায়। আরেকজন তো খুব সম্ভব এদেশি। যদিও সাহেবের পোষাক পরিহিত সেও। তা সে সাহেবের ভড়ং ধরা এদেশির তো অভাব নেই এখন। তবে কালো সাহেবও এখন কলকাতা শহরে আকছার দেখা যায়। এ তাও হতে পারে। যদিও এত খবরে নবর কোনও দরকার নেই।
সে ভ্রূ কুঁচকে নন্দলালকে জিজ্ঞেস করল, “রাজাবাবুর সঙ্গে আবার কী দরকার!”
“সেসব ওনারাই বলবেন! কীসব কেনাবেচার বিষয় আছে…”
নব নন্দলালের কথার মাঝেই খেঁকিয়ে উঠল।
“কেনাবেচা আবার কী! রাজাবাবু কি এখানে হাট বসিয়েছেন না কি! ওসবের দরকার হলে রমাকান্তর হারেমে যাও না বাপু! এসব বিকিকিনিতে রাজাবাবু নেই!”
“আহা বড় বাজে কথা বলো! সেসব কেনাবেচায় এই বাবুদের কোনও তালুক নেই। এরা ভদ্দরলোক!”
নব বিশ্রীভাবে হেসে উঠল। অত রাতে আহিরীটোলার গলির ভেতর ওর হাসিটা প্রতিধ্বনিত হল জোরে।
“ভদ্দরলোক! ওরম অনেক ভদ্দরলোক দেকা আছে! পা পিছলোনোর জন্য কলার খোসা লাগে না বাপু! এমনিও অনেকে হড়কায়!”
নন্দ এবার অস্থিরভাবে প্রায় খেঁকিয়ে উঠল।
“ইহহ! এমন ভাব দেখাচ্ছ যেন রাজাবাবু শুদ্ধ তুলসীপত্র!”
নবর চোখদুটো হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠল। নন্দর গলাটা তার লোহার মতন হাতে চেপে ধরে সে তাকে সেঁটে দিল দেওয়ালের সঙ্গে।
“খবরদার! এই শহরে রাজাবাবুর নামে কুচ্ছো করার সাহস কোনও বাপের ব্যাটা দেখায় না! জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব!”
নন্দ ওই অবস্থাতেই ক্ষীণ গলায় ব্যঙ্গ করে বলল, “এই শহর তোমার রাজাবাবু ইজারা নিয়ে রাখেনি! আহিরীটোলাতেই পক্ষীর গানের দল পারলে রাজাবাবুর ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি করে, আর উনি এসেছেন গোটা শহরের হয়ে তদ্বির করতে…”
“তবে রে! যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!”
নব প্রায় ঘুঁষি পাকিয়ে ফেলেছিল।
এমন সময় নবর হাতটা চেপে ধরল আরেকটা লোহার মতন শক্ত হাত। জেমসনের হাত।
নন্দর টুঁটি ছেড়ে দিল নব’র হাত। নন্দ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
কালীনাথ চোখ খুলতেই অন্ধকার দেখল প্রথমে। তারপর একটু একটু করে ধাতস্থ হল।
মুখের ওপর লণ্ঠনের আলো খেলে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যেই সে অস্পষ্ট হলেও চিনতে পারল চার্লির ধূর্ত হাসিমাখা মুখ।
একটু একটু করে মনে পড়ল কালীনাথের। তাকে গ্রেফতার করে হাঁটিয়ে নিয়ে আসছিল দেবীলাল ও তার সঙ্গী দারোগা ও হাবিলদাররা। কালীনাথ হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সজাগ হল।
তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নীলকুঠির দিকে।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।
দেবীলাল আর দারোগা দুজনেই থেমে ঘুরে তাকাল। ভ্রূ কুঁচকে।
এক হাবিলদার হালকা ঠেলা মারল কালীনাথকে কনুই দিয়ে।
কালীনাথ সেই ধাক্কা অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে রইল।
দেবীলাল তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “এসব বেয়াদবির মানে কী?”
কালীনাথ তার চোখের ওপর চোখ রাখল। স্থির। দেবীলালের চোখে সংশয় এবং রাগ দুই জমাট বেঁধেছে।
কালীনাথ ধীর স্বরে বলল, “আমায় নীলকুঠিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন? ওই কি তোমাদের নতুন থানা?”
দেবীলাল কালীনাথের জামা খামচে ধরে সামনের দিকে টেনে নিয়ে বলল, “যেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চুপচাপ সেখানে যাবে। প্রশ্ন করার আস্পদ্দা হয় কী করে?”
কালীনাথের চোখের চাপা আগুন এবার ঠিকরে বেরোল।
“এখনও আমাদের জমিদারি ফুরিয়ে যায়নি দেবীলাল,” কালীনাথ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তারপরেই তার মুখে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল। দেবীলালকে একবার আপাদমস্তক জরিপ করে সে বলল, “আর তোমার শরীর থেকেও এখনও চাষার গন্ধ যায়নি দেবীলাল। কাদের সঙ্গে তোমার শত্রুতা? কাদের দালালি করছ তুমি?”
দেবীলাল রাগে বিস্ময়ে অস্থির হয়ে উঠল।
“যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!”
দেবীলালের দশাসই হাত একটি বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়ের ছাপ বসিয়ে দিল কালীনাথের গালে।
কালীনাথ চোখ নামিয়ে ফেলল। যখন চোখ তুলে তাকাল তখন নিজের অজান্তেই দু’কদম পিছিয়ে গেল দেবীলাল। কালীনাথের চোখের দৃষ্টি দেখে রীতিমত ভয় হল দেবীলালের। এমন করাল দৃষ্টি সে আশাই করেনি।
কালীনাথ বলল, “এর জবাব তুমি সময়মতন পাবে দেবীলাল। এই হাতকড়ার জন্য আমি তোমায় এক্ষুনি উচিত শিক্ষা দিতে পাচ্ছি না। আগে রক্তচোষা নীলকরদের তাড়াই। তারপর তোমার বন্দোবস্ত হবেখন।”
দেবীলাল রাগে থরথর করে কাঁপছিল। সে পেয়াদাদের হুকুম দিল এবার, “এই! ওকে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে নিয়ে চলো নীলকুঠিতে!”
“নীলকুঠিতে আমি সজ্ঞানে যাব না দেবীলাল!”
শান্ত স্বরে বলল কালীনাথ।
“পেয়াদা!” দেবীলাল হুংকার দিল।
কালীনাথকে চেপে ধরতে গেল এক হাবিলদার। কিন্তু কালীনাথের কনুই তার বুকে সজোরে আঘাত করতে বুক চেপে বসে পড়ল সে।
কালীনাথ হো হো করে হেসে উঠে বলল, “সেপাইরা কেন মিউটিনি করেছিল বুঝি। এই হাবিলদারগুলোকে খেতে না দিয়ে দিয়ে এমন দশা করেছে যে ফুলের ঘায়ে মূর্ছা…”
কথা শেষ হল না কালীনাথের। তার আগেই চোখের সামনে সে অন্ধকার দেখল। আরেকজন হাবিলদার তার বেটনের ঘা মেরেছিল কালীনাথের মাথায়।
“ঝক্কি বাড়ল!” বলল দেবীলাল। “চলো, একে তোলো!”
পাঁজকোলা করে কালীনাথের দেহ নিয়ে এগিয়ে গেল হাবিলদাররা মঙ্গলগঞ্জের কালান্তক নীলকুঠির দিকে।
কালীনাথের আবছা দৃষ্টি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতেই গাঁটে গাঁটে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করল সে।
বুঝল ঘুমন্ত অবস্থাতেই তার ওপর তুমুল নির্যাতন চলেছে। কয়েকটা কালসিটে তার চোখেও পড়ল।
এই নরাধমরা তাকে অর্ধ উলঙ্গ করে শারীরিক অত্যাচার চালিয়েছে। অপমানে যন্ত্রণায় শরীর রি রি করে উঠল কালীনাথের।
কালীনাথ একটা যন্ত্রণাসূচক “আহ্” শব্দ করে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে বিশ্রীভাবে হেসে উঠল চার্লি।
“কী কালীনাথ! টুমি না খি শম্ভুর বউকে এখান হইতে রেসকিউ করিয়া লইয়া যাইবে! এখন টোমাকেই আমরা ব্যান্ডি করিয়াছি। বেটনের ঘা খাইলে এসব রেবেলের শখ ঘুচিয়া যাইবে!”
কালীনাথ চার্লির দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে সাহেব। এবার শাস্তি পাওয়ার সময় তোমার।”
চার্লি ধমকে বলল, “শাট আপ ব্লাডি নিগার!”
“এই নিগাররাই তোমার কফিনে শেষ পেরেক পুঁতবে উজবুক!”
চার্লি একমুহূর্ত থমকাল। তারপর কালীনাথের মুখের ওপর তার হাতের পাকানো রুমাল দিয়ে সজোরে আঘাত করল।
কালীনাথের মুখ যাতনায় বিকৃত হল। সে অনুভব করল, তার মুখে কিছু ক্ষতচিহ্ন আগে থেকেই রয়েছে। তার ওপর আঘাত করছে এই জানোয়ারটা।
কালীনাথ ওই অবস্থাতেই বলল, “শম্ভুর বউ কোথায়?”
চার্লি আবার বিশ্রীভাবে হেসে উঠে বলল, “উহার ভাবনা টুমার না করিলেও চলবে। সে এখন হামাদের সার্ভিসে লেগে আছে।”
কালীনাথ যদি এভাবে বাঁধা না থাকত তাহলে সে এই অসহ্য পশুটিকে খুনই করে ফেলত আজ। এখানেই।
একজোড়া পদশব্দ শোনা গেল এবার।
ঘরে আরও একটা লণ্ঠনের আলো বাড়ল। ঘরে ঢুকেছে প্যাটন, এবং তার পিছু পিছু লণ্ঠন হাতে দেবীলাল।
মেয়েটিকে বেহুঁশ অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছিল। এখন স্নান করানো হচ্ছে। মেয়েটি বোবা হলে কী হবে! ওর গলায় জোর আছে! এই রাতে পাড়া মাতালে বিপদ! তাই ওর মুখ বেঁধে রাখা হয়েছে।
ওকে সাজানো হচ্ছে। ইন্দ্রকমলের জন্য।
রাধামোহন নজর রাখছিল গোটা বিষয়টায়। এমন সময় নব এসে দাঁড়াল তার সামনে।
ভ্রূ কুঁচকে রাধামোহন বলল, “কী হল আবার!”
“এজ্ঞে! দুজন সাহেব এয়েছেন রাজাবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বলে।”
রাধামোহন বিরক্তিতে অস্থির হয়ে গেল। মাঝরাতে এ আবার কী উপদ্রব!
“সাহেব!”
“এজ্ঞে!”
“কী প্রয়োজনে!”
“এজ্ঞে রাজাবাবুর বুলবুলি কিনতে চান!”
রাধামোহন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল রাগে, বিরক্তিতে এবং বিড়ম্বনার আশঙ্কায়।
“গাঁজা টেনেছিস হতভাগা! মাঝরাতে বুলবুলি কিনতে এসেছে সাহেব! সিংহদের কুঠিতে!”
নব কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “এজ্ঞে আপনার যদি বিশ্বাস না হয়…”
রাধামোহন এক ধমক দিয়ে বলল, “কই তারা?”
ক্রমশ