দেবব্রত শ্যামরায়
হীরকরাজার মূর্তির আবরণ উন্মোচন হবে। চারিদিকে সাজো সাজো রব। দুনিয়ার বৃহত্তম প্রজাতন্ত্রের ভরসাফূর্তির দিন সমাগত। এরই মাঝে একটি নতুন টিভি চ্যানেলের জন্ম হল। যার সম্ভবত কোনও বৈধ অনুমতিপত্র নেই। এবং যাকে নিয়ে আচারবিধির বাধ্যবাধকতায় সামান্য কদিন জলঘোলা হল বটে, কিন্তু আটকানো গেল না। আসলে এইসব ছোটখাট নিয়মকানুনগুলো ‘অচ্ছে দিন’-এর সুপারহাইওয়েতে সামান্য কিছু উটকো গণতান্ত্রিক খোঁচ। অতএব পরিত্যাজ্য।
তো এই নয়া চ্যানেলটির নাম নমো (NaMo TV) টিভি। একটি চব্বিশ গুণ সাত স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল। আর কেউ নয়, চ্যানেলের বিষয়বস্তু শুধুমাত্র তিনি, খোদ নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। কী দেখানো হচ্ছে নমো টিভিতে? প্রধানমন্ত্রী মোদির ২০১৯-এর সবকটি নির্বাচনী প্রচারের সরাসরি সম্প্রচার, প্রতিটি জনসভা থেকে লাইভ। বিভিন্ন নির্বাচনী মঞ্চে মোদির গা-গরম করা পুরোনো বক্তৃতার ঝলকিয়া। গত লোকসভায় নানা সেশনে মোদিজির ভাষণ। এনডিএ সরকারের সাফল্যের নানা পরিসংখ্যান। মাঝে মাঝে যোগব্যায়াম, একটি দুটি সিনেমা। মোদিময় এই চ্যানেলে মাঝে মাঝে অন্য নেতার মুখও যে ভেসে উঠছে না তা নয়, ঘুরেফিরে আসছে জিএসটি নিয়ে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির ভাষণ, অমিত শাহ-এর রোড শো।
গত মার্চ মাসের একত্রিশ তারিখ থেকে ডিটিএইচ পরিষেবার গ্রাহকদের কাছে এই চ্যানেল লভ্য। যদিও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকে নথিভুক্ত দেশের ৯০১টি বৈধ উপগ্রহ চ্যানলের তালিকায় এর নাম নেই। দেশজুড়ে লাগু হওয়া নির্বাচনী আচরণবিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে স্যাটেলাইট সেবায় ও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সম্প্রচার চলছে নমো টিভির। ফেসবুকে নমো টিভির পেজে ফলোয়ার সংখ্যা ইতিমধ্যে পনেরো লাখ। আচরণবিধির এহেন লঙ্ঘন সত্ত্বেও ভারতের নির্বাচন কমিশনের এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না, অথবা মাথাব্যথা থাকলেও তা প্রকাশের সাহস ছিল না। আপ ও কংগ্রেস লিখিত অভিযোগ করার পর অবশ্য নমো টিভির বৈধতা নিয়ে তথ্যমন্ত্রকের রিপোর্ট চেয়েছে কমিশন।
নমো টিভির ওয়েবসাইটে লেখা ছিল, নমো টিভি নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে আপনাদের নিজস্ব হিন্দি সংবাদমাধ্যম, ভারতীয় রাজনীতির নানা সাম্প্রতিক খবরের আধার। বিতর্কের শুরু ঠিক এখান থেকেই। ভারতবর্ষের আইনে একটি উপগ্রহভিত্তিক সংবাদসংস্থা কাজ শুরু করতে পারে যদি কোম্পানির মোট অর্থমূল্য বিশ কোটি বা তার বেশি হয়। সংস্থাটিকে একগাদা বৈধতা পেতে হবে, যেমন আপলিঙ্ক হাব স্থাপনের অনুমতিপত্র, ভারতে আপলিঙ্ক সম্প্রচারের অনুমতি এবং ভারতের ওয়ারলেস কমিশন থেকে সবুজ সংকেত। কোম্পানিকে তার শেয়ারহোল্ডারদের নাম ও শেয়ারহোল্ডিং প্যাটার্ন জানিয়ে দিতে হবে যা কোম্পানি আইনে ভারতের জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নথি। এছাড়াও সবচেয়ে জরুরি হল ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে সুরক্ষা সংক্রান্ত ছাড়পত্র যা ছাড়া সংবাদ সম্প্রচার শুরু করা যায় না।
এইসব বিধিবদ্ধ নথিপত্র কি নমো টিভির আছে? সহজ প্রশ্ন, তবে এর কোনও উত্তর নেই, অথবা উত্তর দেওয়ার মতো কেউ নেই। যদিও উত্তরটি খুব সম্ভবত একটি স্পষ্ট ‘না’, কারণ সমস্ত বৈধ অনুমতিপত্র থাকলে ডিটিএইচ তালিকায় ৯০১টি চ্যানেলের সঙ্গে নমো টিভির নাম থাকত নিশ্চয়ই। তা তো নেই। নমো টিভির কর্তারা অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি, অথবা তারা নিশ্চিত ছিলেন আইনত অনুমতি নেবার চেষ্টা করলে তা আচরণবিধির ফাঁদে পড়ে যাবে ও নির্বাচনের আগে এই টিভি চালু করার তাঁদের যে উদ্দেশ্য তা সাধিত হবে না।
তার মানে কি আমরা ধরে নিতে পারি, এক্ষেত্রে আইনের ওপরেও এমন কেহ বা কাহারা আছেন, যিনি বা যারা ইচ্ছেমতো আইন বেঁকাতে পারেন? হাতে কোনও প্রমাণ নেই। সাদা হোক বা কালো, এর কোনও প্রমাণ থাকে না। তবে ধূসরতা রয়েছে। কারণ কমিশনের উত্তরে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রক গতকাল জানিয়েছেন— নমো টিভি কোনও সংবাদ চ্যানেল নয়, একটি বিজ্ঞাপনী প্ল্যাটফর্ম মাত্র, যা প্রচারের জন্য ডিটিএইচ পরিষেবা সংস্থাগুলির কোনও সরকারি ছাড়পত্র প্রয়োজন হয় না। অর্থাৎ নমো টিভির বৈধতা নিয়ে সরকারি বয়ান নমো টিভির পূর্ব ঘোষণাকেই সরাসরি পরাস্ত করল। বুঝহ সুজন যে জন জানহ সন্ধান…।
এখানেই শেষ নয়। নমো টিভির ফেসবুক পেজ জানাচ্ছে, এই পেজ তৈরি হয়েছে ২০১৭ সালের ১৪ আগস্ট। এবং শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি ২০১৯ থেকে মার্চ ৩০, ২০১৯ পর্যন্ত এই পেজ থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ খরচা হয়েছে ৮২,২৩৫ টাকা। হতেই পারে। কিন্তু এই বিজ্ঞাপনের খরচটি বিজেপি-র দলীয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট অথবা শ্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে হওয়া উচিত, যদি তা না হয়ে থাকে তবে তা আরেকটি নির্বাচনী বিধিভঙ্গের আওতায় পড়বে।
বস্তুত, নমো টিভির সম্প্রচারের ঘটনা প্রমাণ করে ২০১৪ বা তারও আগে থেকে ব্র্যান্ড মোদির যে সুচতুর নির্মাণ শুরু হয়েছিল, ২০১৯-এ তা তীব্রতার চরম লগ্নে এসে পৌঁছেছে। ‘হিন্দুহৃদয়সম্রাট’ থেকে শুরু করে ‘জনতার প্রধান সেবক’ হয়ে হালের (HAL-এর নয়) ‘চৌকিদার’, রাজনীতির প্রয়োজন অনুযায়ী বদলে বদলে গেছে এই নির্মাণের ভাষ্য। না, দলীয় অনুমোদনে ও ভোট-রাজনীতির স্বার্থে একজন নেতার ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রায়ন বেআইনি নয় মোটেই। বরং ভারতের মতো অর্ধপক্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশে, যেখানে ক্যারিশমার মোহ থেকে আজও বেরোতে পারেননি দেশের নির্বাচকেরা, সেখানে এই ঘিষাপিটা ফরমুলার প্রয়োগ তো শাসক-বিরোধী ছোট-বড় সব দলেই। (প্রসঙ্গত, এ মাসের ১১ তারিখ, দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের প্রথম দিন মুক্তি পাচ্ছে বিতর্কিত ছবি, প্রধানমন্ত্রীর জীবনীচিত্র, পি এম নরেন্দ্র মোদি। এই মুক্তি স্পষ্টত নির্বাচনী বিধি ভাঙছে, কিন্তু ঘুরপথে অর্থাৎ আইনের ধূসর প্রদেশ দিয়ে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে।)। কিন্তু এক্ষেত্রে যা সবচেয়ে ভয়ের, তা হল, ব্যক্তির এই নির্মিতি বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হতে হতে গিলে নিচ্ছে দলকে, ক্রমে একের পর এক আইনকে, অর্থাৎ খোদ সাংবিধানিক কাঠামোটাকেই। এক চা-বিক্রেতার নম্র কাহিনি দিয়ে যে উত্থানের শুরু হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ হচ্ছে এক ফ্যাসিস্ট একনায়কের দশলাখি স্যুটে পৌঁছে। ইচ্ছে ও উদ্দেশ্যে, সাধ ও সাধনায় আর কোনও আড়াল রাখছেন না নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। ইতিহাস অন্তত এই একটি কারণে তাঁকে ধন্যবাদ দেবে।
প্রসঙ্গত, শ্রী লালকৃষ্ণ আদবানি বোমা ফাটিয়েছেন। সে বোমায় ঝাঁঝ নেই, আলোর ঝলকানি নেই, যেটুকু আছে তা শেষ বিকেলের মরা আলো। তিনি তাঁর দলকে (পড়ুন মোদিকে) মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘Nation First, Party Second, Self Last’। মোদি কিছু পরই সোশাল মিডিয়ায় প্রভূত বাহবা দিয়েছেন তাঁর সিনিয়র নেতাকে, দলের মার্গদর্শন ঘটানোর জন্য। আমরা অবশ্য জানি না আদবানিজির ব্লগ পড়ে মোদিজির প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কী ছিল। তিনি সেই মুহূর্তে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলেন কিনা, অথবা দাঁত-কিড়মিড়টুকু গিলে ফেলছিলেন কিনা। কিন্তু তিনি ভালো করেই জানেন, ব্র্যান্ড মোদির অবিসংবাদী নির্মাণের পথে সব কাঁটাগুলি ইতিমধ্যে বেছে ফেলা গেছে, এগুলি তাদের মধ্যে একটি-দুটির শেষ মরণখোঁচা মাত্র। এসব আপ্তবাক্যে তাঁর আর প্রয়োজন নেই। কারণ দেশ ও দল ব্র্যান্ড মোদিতে এসে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। দেবদেউল-লাঞ্ছিত এই দেশ আগমার্কা গণতন্ত্রের জন্য এখনও পুরোপুরি তৈরি নয়, এই দেশ একজন সার্জিকাল স্ট্রাইকার চায়। তাই আপাতত Nation নয়, Self ফার্স্ট, নরেন্দ্র মোদি সেটা জানেন, বোঝেন, এবং অসম্ভব ধূর্ততায় তা এক্সপ্লয়েট করেও চলেন, এবং চলবেন।
তিনি হয়তো খেয়াল করছেন না, মূর্তির মাঠে, রাতের অন্ধকারে, একটি-দুটি করে মানুষের ভিড় ক্রমশ বাড়ছে।