প্রশান্ত ভট্টাচার্য
ইস্তেহার আসলে এক ধরনের ভোটুরে অঙ্গীকার। কোনও হলফনামা নয়। তাই ভোট মিটলে গদিতে আসীন দল সেই ইস্তেহার অক্ষরে অক্ষরে মানল, না ভাবে মানল, তা জানতে ভোটারদের বয়েই গেছে। কেননা, না মানলে তো কাউকে শূলে চড়ানো হবে না। মোদ্দা কথা, কেউ কথা রাখে না। ৭২ বছর হল কেউ কথা রাখেনি। তবু একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনী ইস্তেহারে কী প্রতিশ্রুতি দিল, তা বিবেচনা করাটা রাজনৈতিকভাবে জরুরি। যেমন বিজেপি ও কংগ্রেস, এই দুই দল তাদের ইস্তেহারে কী বলছে, সেটা চর্চা একটা জরুরি কাজ। বিজেপি এবারও তাদের ইস্তেহারে রামমন্দির নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর তাতে মহাখুশি তাদের প্রোডিগাল শরিক শিবসেনা। এছাড়াও, জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপের বিষয়ে বিজেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকেও পূর্ণ সমর্থন দিল উদ্ধব ঠাকরের দল। শিবসেনার মুখপত্র ‘সামনা’র সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘বিজেপি-র ‘সংকল্পপত্রে’ (এটি বিজেপির ইস্তেহারের গৈরিকী নাম) দেশের আবেগই প্রতিফলিত হয়েছে। এমনকী, শিবসেনারও দাবিদাওয়া এতে ঢোকানো হয়েছে। ফলে, আমরা একে ১০০-র মধ্যে ২০০ নম্বর দেব।’ ঠিক এখান থেকেই আমার প্রশ্ন বিজেপির আরেক শরিক নীতীশ কুমার ও তাঁর দল জেডিইউ কি এই ইস্তেহারে পূর্ণ সমর্থন দেবে?
আসুন আরও নির্দিষ্ট করে দেখা যাক, এই তথাকথিত ‘সংকল্পপত্রে’ নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা আর কী কী রেখেছেন। প্রথম দফার ভোটের তিন দিন আগে ৪৫ পাতার সংকল্পপত্রে ‘নতুন ভারত’-এর জন্য ৭৫টি অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছে বলে ঘোষণা করেন অমিত শাহ। বলা হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ, প্রধানমন্ত্রীর মন কী বাত অনুষ্ঠান এবং বিশেষজ্ঞ-সহ ৬ কোটি মানুষের পরামর্শের ভিত্তিতে নাকি আগামী ৫ বছরের জন্য বিজেপির এই সংকল্পপত্র তৈরি করা হয়েছে। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, দেশাত্মবোধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিজেপি। জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে কোনওরকম সমঝোতা করবে না তারা। জিরো টলারেন্স বজায় রাখবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। সরকার ফের গড়লে অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে আরও তৎপর হবে মোদি সরকার। একইরকমভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাশ করাবে সরকার। রামমন্দির ইস্যুর সমাধানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে সরকার। সংকল্পপত্রে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য ৬০ বছরের পর পেনশন এবং ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের রোজগার দ্বিগুণ করে দেওয়ার সেই পুরনো গীত শুনিয়েছে বিজেপি। কিষাণ সমৃদ্ধি নিধি প্রকল্পে প্রত্যেক কৃষককে বছরে ৬,০০০ টাকা সাহায্য দেওয়া হবে। যেমন কিষাণ ক্রেডিট কার্ডে নেওয়া ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণে এক বছর থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত সুদ থাকবে না। গ্রামীণ ভারতের উন্নয়নে ২৫ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করবার অঙ্গীকার রয়েছে সংকল্পপত্রে। এছাড়াও জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা অবলুপ্তির জন্য ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিলের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে গেরুয়া ইস্তেহারে। দেশের গত কয়েকবছর ধরে সবচেয়ে জ্বলন্ত বিষয় কৃষকদের সমস্যা বা বেকারত্বের মতো ইস্যুগুলিকে গুরুত্ব না দিয়ে দেশভক্তির তাস খেলে শুধুমাত্র জাতীয়তাবাদের আবেগকেই পুঁজি করা হয়েছে এই ইস্তেহারে। রামমন্দির নির্মাণ, ৩৭০ ধারা বাতিল এবং অভিন্ন দেওয়ানি বিধি— আরএসএসের হিন্দুত্বের রাজনৈতিক দর্শনের মূল তিনটি স্তম্ভকেই নিজস্ব মোড়কে তুলে ধরা হয়েছে এবারের সংকল্পপত্রে।
কোনও কোনও সমালোচক বলছেন, এই সঙ্কল্পপত্র কন্ট্রোল সি কন্ট্রোল ভি মেরে করা হয়েছে। অর্থাৎ পাঁচ বছর আগের ইস্তেহারেরই কপি পেস্ট। সবমিলিয়ে উগ্র হিন্দুত্বের আধুনিক প্যাকেজ। এই নিয়েই ‘নতুন ভারত গড়ার’ মোদি-শাহর মহার্ঘ ‘সংকল্প’। অটলবিহারী বাজপেয়ি, লালকৃষ্ণ আদবানিরা যা অতি দক্ষতায় কুলুঙ্গিতে তুলে রেখেছিলেন, তাকেই নামিয়ে এনেছেন শাহ-মোদি জুটি।
প্রচ্ছদ ছাড়া মোট ৪২ পৃষ্ঠার সঙ্কল্পপত্রে ১২ বার ‘কর্মসংস্থান’ শব্দটি এবং তিনবার ‘চাকরি’ শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু কর্মসংস্থান বা চাকরির সংখ্যা নিয়ে ইস্তেহারে একটি শব্দও খরচ করেননি বিজেপি নেতারা। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদি বছরে ২ কোটি নতুন চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বাস্তবে যা শুধু কথার কথাই থেকে গিয়েছে। তাই মোদিকে বিরোধীদের নিন্দার মুখে পড়তে হচ্ছে বারবার।
তাই এবারের ইস্তেহারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা তাঁর মুনশি অমিত শাহ চাকরির সুযোগ তৈরি নিয়ে নতুন কোনও অঙ্গীকারের পথে হাঁটলেন না। ক্ষমতায় ফিরলে নরেন্দ্র মোদি নিজের তৈরি বছরে দুই কোটি নতুন চাকরির লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে কী করবেন তাও নিরুচ্চারিত রইল।
চলতি লবজে যাকে বলে, চেপে যাওয়া, তাই করেছেন মোদি-শাহ। কেননা, ২০১৮-১৯ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) বেকারির হার বেড়ে হয়েছে ৯.১%। যা ২০১৭ সালে একই সময়ে ছিল ৭.৫%। এই সময়ে এঁদের মধ্যে স্নাতক বেকারের হার বেড়ে হয়েছে ১৫.৬% শতাংশ। গত বছর যা ছিল ১৪.৭%। অন্যদিকে, ২০ থেকে ২৪ বছরের যুবক-যুবতীদের মধ্যে বেকারির হার গত বছরের তুলনায় ৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৭%। এই সময়ে ২৫ থেকে ২৮ বছরের ভারতবাসীর মধ্যে বেকারির হার বেড়েছে ১২.২%। যা ছিল ১১.৪%। মোদি-শাহ কোম্পানি কোন দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদ দিয়ে চাপা দেবে যে দেশে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের চাকরি নেই বা অর্থ উপার্জনের কোনও ব্যবস্থা নেই। আর এই ব্যর্থতা ঢাকতেই দেশজুড়ে বিরোধীদের দেশদ্রোহী বলে দাগিয়ে দিতে চাইছে বিজেপি। এবারের সংকল্পপত্রে ২০১৪ সালের সেই গালভরা প্রতিশ্রুতি যে প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা ঢুকিয়ে দেওয়া হবে নিয়ে একটিও বাক্য নেই। পাঁচ বছর আগে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কালোধন উদ্ধারের। এবার সে প্রসঙ্গ একবারও ঝিলিক দিল না। মোদি জমানায় কালো টাকা উদ্ধার তো দূরঅস্ত, উলটে ঋণের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের টাকা লুট করে দেশ ছেড়ে বেপাত্তা নীরব মোদি, ললিত মোদি, বিজয় মালিয়ারা। ফলে সংকল্পপত্রে কোনও কালো টাকার গল্প নেই। যেমন নেই নোটবন্দি নিয়ে কোনও আস্ফালন।
নেই ঢক্কানিনাদে মধ্যরাতে দেশবাসীকে জাগিয়ে রেখে চালু করা জিএসটি নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য। কার্যত মোদি সরকার ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর রাতে আচমকা ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে যে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা আনার ধ্বজা উড়িয়েছিল, তা একেবারে ব্যর্থ হয়েছে। উলটে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি সন্ত্রাস জারি করেছে। কালোটাকা উদ্ধার তো হয়নি পরন্তু সব কালোটাকা সাদা হয়ে রাজকোষে ফিরে এসেছে। যা দেশের ফিসকাল পলিসির পক্ষে এক ঘোর বিপদ। অর্থনীতির সাধারণ ছাত্র মাত্রই জানেন এই হঠকারিতার পরিণাম কী। এখন তো জানা যাচ্ছে ভারতের অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তারা মোদির নোটবাতিলের সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেননি, বরং নিষেধ করেছিলেন। আরএসএস ঘনিষ্ঠ কিছু অর্থনীতিবিদের পরামর্শেই মোদি দেশের পক্ষে আত্মঘাতী পদক্ষেপ করেছিলেন। নোটবাতিলের পর মোদি সরকারের সবচেয়ে বৈপ্লবিক কাজ জিএসটি। কিন্তু প্রায় দু’ বছর ঘুরে আসতেই দেখা যাচ্ছে এটা কোনও দাওয়াই নয়, বরং অর্থনৈতিক বিপর্যয়। নোট বাতিল ও জিএসটি, মোদি সরকারের এই দুটি নাড়া দেওয়া সিদ্ধান্তের ফসল— ছোট ও মাঝারি ব্যবসা লাটে উঠেছে, কর্মহীন হয়েছে বিপুল সংখ্যক মানুষ, নতুন করে হয়নি কর্মসংস্থান। কান পাতলেই মোনা যাচ্ছে কর্মহীনের হাহাকার।
আর এই স্নায়ুস্পন্দন ধরতে পেরেই কংগ্রেসের ইস্তেহারে রাহুল গান্ধি কর্মসংস্থানের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন।
এককথায় বললে কংগ্রেস ইস্তেহার মনমোহনীয় ছায়া থেকে সরে একটা বামপন্থী ফ্লেভার চাপিয়েছে। ২০১৪’র লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেস যে ইস্তেহার প্রকাশ করেছিল এবার তা থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছে। রাহুল গান্ধির ইস্তেহারে গরিব মানুষের অ্যাকাউন্টে বছরে ৭২ হাজার টাকা ঢুকিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন যেমন আছে তেমন সিটিজেনশিপ বিল প্রত্যাহারের মতো প্রতিশ্রুতিও রয়েছে।
কংগ্রেসের ইস্তেহারে স্বাধীনতা পূর্ব জওহরলাল-প্যাটেলদের কংগ্রেস যেমন দাবি করত, তার ছোঁয়া পাওয়া গেল। ইস্তেহারে ঘোষণা করা হয়েছে বিচারাধীন বন্দিদের মুক্তির কথা। যার সুফল পাবেন বহু রাজনৈতিক বন্দি। বহু জেল-আটক মাওবাদীও এর ফলে উপকৃত হবেন। এমনকী, সমাজকর্মীরা। কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একবার লিখেছিলেন, ‘বিনা বিচারে বন্দী ব্যবস্থাটাই পরাধীনতার গ্লানিকে স্পষ্ট করে দেয়।’ কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের শাসনেও তা লোপ পায়নি। এমনকী, রাহুলের ‘দাদি’ ইন্দিরা গান্ধির জমানায়, তা আরও প্রকট হয়েছে মিসা, এসমার নামে। এই আইন বিলোপের দাবি বিভিন্ন সময়ে বামপন্থীরা জানিয়েছেন। এপিডিআর জন্মলগ্ন থেকে জানিয়ে আসছে। এবার অন্তত ইস্তেহারে কংগ্রেস সেই দাবি জানাল। এটাই এই মোদিশাহর তানাশাহিতে ইতিবাচক প্রাপ্তি। শুধু এটাই না, ইস্তেহারে কংগ্রেস ইঙ্গিত দিয়েছে যে ইংরেজরা মূলত ভারতীয়দের কলমবাজি স্তব্ধ করতে যে দেশদ্রোহ বা সেডিশন আইন করেছিল সেই আইন বাতিলের। পাঠক মনে রাখবেন, ১২৪এ, এই কলঙ্কিত আইন সব জেনেশুনেও এতদিন কংগ্রেস লালন-পালন করেছে। এই আইনেই বামপন্থী কবি ভারভারা রাও, মানবাধিকার কর্মী শ্রমিক নেত্রী সুধা ভরদ্বাজ ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির প্রাক্তন সম্পাদক গৌতম নওলখা এখনও জেলে রয়েছেন। এই আইনেই মামলা হয়েছিল কানহাইয়া কুমারের বিরুদ্ধে। যাক মতি হয়েছে রাহুলদের! আর সেই মতি থেকেই আফস্পা নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল ইস্তেহারে। ‘উপদ্রুত’ ঘোষিত এলাকায় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এই বিশেষ আইনে এতদিন সেনাকে প্রশ্নাতীত ছাড় দেওয়া হত। এই আইনের বিরুদ্ধ ১৬ বছর অনশন করে শর্মিলা চানু আজ বিশ্বে একটা নাম। ২০০৪ সালে তৈরি হওয়া জীবন রেড্ডি কমিটি এই আইন সম্পূর্ণ বিলোপের প্রস্তাব দিয়েছিল। কংগ্রেস ইস্তেহারে এবার সেই আইন সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও কারাগারে বন্দিদের সম্পর্কে মানবাধিকার আন্দোলনের দীর্ঘ দিনের কিছু দাবির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে রাহুলের ইস্তেহারে। এমনকী, মানহানি সংক্রান্ত আইনের ৪৯৯ ধারা বাতিলের প্রতিশ্রুতিও রয়েছে কংগ্রেস ইস্তেহারে। এর ফলে মানহানির মামলায় কারও আর জেল হবে না। এই লেখাটা যখন লিখছি, তখনই খবর পেলাম ভারভারা রাও ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের মুক্তির দাবিতে কনভেনশন করছিলেন বলে হায়দরাবাদ থেকে তেলেঙ্গানা পুলিশ অধ্যাপক হরগোপাল, বেণুগোপাল, কাত্যায়নীসহ কয়েকশ’ শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে। ভাবছি, জনতার রায়ে কংগ্রেস তাদের ইস্তেহার রূপায়ণের সুযোগ পেলে এই নির্যাতনগুলোর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যেতে পারে। অন্তত যে স্তরে প্রস্তাব হয়েছে, তাতে বিচার ব্যবস্থায় বড় রকমের সংস্কারে যদি রাহুলরা দ্বিধা না করেন, তবে আশা পূর্ণ হতে পারে।
২০১৪-র মনমোহনীয় ইস্তেহারেও কংগ্রেস পরিকাঠামোয় প্রচুর বিনিয়োগ, এক কোটি চাকরি, সব ধরনের রফতানি কর প্রত্যাহার, ১০০ দিনের মধ্যে জিএসটি রূপায়ণের মতো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এবার যেন কংগ্রেসের সেই পুরনো ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। যাকে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলতেন বাম ঝোঁক বা লেফট অফ দ্য সেন্টার অবস্থান, তা ফুটে উঠেছে। এই অবস্থান গত কয়েক দশক আকবর রোডের ম্যানেজাররা ভুলেই গিয়েছিলেন।
দরিদ্রদের মধ্যে দরিদ্রতমদের ২০ শতাংশ মানুষের ন্যূনতম রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প বা ন্যায়-এর ঘোষণা, ব্যাঙ্ক ঋণখেলাপি কৃষকদের গ্রেফতার না করার প্রতিশ্রুতি উপরন্তু কৃষকদের জন্য পৃথক বাজেট পরিকল্পনা ইঙ্গিত রয়েছে যে ইস্তেহারে তাকে জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদ, জঙ্গিহানার বিপদ আর স্থায়িত্বের কথা দিয়ে বিজেপি যতই ঠেকাতে চেষ্টা করুক, খুব সহজ হবে না। কংগ্রেস দারিদ্র্য, কৃষকের সমস্যা আর ব্যাপক বেকারির তাস নিয়েই কল্যাণমূলক অর্থনীতিরই আপাত ফেরি করবে। যদিও কল্যাণমূলক খাতে ব্যয়ের যে প্রতিশ্রুতি কংগ্রেস নির্বাচনী ইস্তেহারে বলা হয়েছে, তা বাজার ও শিল্পক্ষেত্রে যে আশঙ্কা তৈরি করবে তা বলে দিতে হবে না। এই খাতে টাকা জোগানের ব্যাপারে রাহুল যতই নির্বাচনী সভায় জনপ্রিয় কথা হিসেবে বলুন, ‘অনিল আম্বানির পকেট থেকে টেনে আনব’, বাস্তবে কিন্তু সম্পদ সৃষ্টি ও কল্যাণমূলক ব্যয়ের ভারসাম্য রাখা চাড্ডিখানি কথা নয়!
বাস্তবিক প্রসঙ্গ হারিয়েছে তবু সংসদীয় রাজনীতিতে বৃহত্তম কমিউনিস্ট দল সিপিএম নিয়ে একটু আলোচনা করতেই হয়। সিপিএম তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে এবারও প্রত্যাশা মতোই কৃষক ও শ্রমিকদের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি সাজিয়ে রেখেছে। রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা বজায় রাখা, আফস্পা বাতিল, মৃত্যুদণ্ড বাতিল-সহ নিরাপত্তা ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ের ওপরেও জোর দেওয়া হয়েছে সীতারাম ইয়েচুরির ইস্তেহারে। একইসঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার কথা বলা রয়েছে। বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা, সংসদ ও বিধানসভায় মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ, নারী ও শিশু সুরক্ষার বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ, বেকার ভাতা-সহ নানা জনমুখী কথা রয়েছে সিপিএমের ইস্তেহার। যার কোনও একটিকেও বাঁ হাতের ইঙ্গিতে সরিয়ে রাখতে পারে না কোনও গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমুখী সরকার। কিন্তু কথা হচ্ছে সিপিএম বা বামপন্থীদের এইসব ভাল ভাল কথার কোনই মূল্য নেই বর্তমান রাজনৈতিক সমীকরণে। সিপিএম এই নির্বাচনে সাংসদ সংখ্যায় দুই অঙ্কে পৌঁছোতে পারবে না বলেই রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা মনে করছেন।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সেই বিজেপি আর কংগ্রেস। আমাদের আলোচনায় এটি স্পষ্ট যে ইস্তেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতির দিক থেকে প্রায় বিপরীত অবস্থানে রয়েছে বিজেপি ও কংগ্রেস। দুটি প্যারাডাইম তৈরি হয়েছে। ভোটের ফল যাই হোক, একটা পরিস্থিতি আমরা দেখছি, ১৯৯৯ সাল থেকে কেন্দ্রে হয় এনডিএ সরকার নয় ইউপিএ সরকার চলছে। এবার জনাদেশে যারই সরকার হোক, বিজেপি বা কংগ্রেস কেউ কি তার ইস্তেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মতো সরকার চালাতে পারবে! নরেন্দ্র মোদির মতো ফ্যাসিস্ট মানসিকতার লোক সরকার চালালে শরিকদের পাত্তা না দিয়েই নিজেদের নাগপুর বা আরএসএস অনুমোদিত অ্যাজেন্ডা রূপায়ণে তৎপর হবেন। বিপরীতটা হলে, রাহুল গান্ধি বা তাঁর সহযোগীরা অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি নিয়ে এগোবেন। সেই নিরিখে কোনও দলেরই নির্বাচনী ইস্তেহার আজ আর কোনও ম্যাটার করে না।