Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মঙ্গল শোভাযাত্রা— যাদবপুর, বহরমপুর, রায়গঞ্জ

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

দুই বাংলার নানা শহরে-মফস্বলে পয়লা বৈশাখে অনুষ্ঠিত 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'র উদযাপন হুজুগে বাঙালির নিছক চতুর্দশতম পার্বণ নয়। বরং অন্য নানা ধর্মীয় পার্বণের চেয়ে এর গুরুত্ব বৃহত্তর, রাজনৈতিকও বটে। শুধুমাত্র ধর্মসম্প্রদায়চিহ্নিত উৎসবপালনের বাইরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে অসাম্প্রদায়িক কৌমচেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, দুই বাংলায় ক্রমশ বাড়তে থাকা মঙ্গল শোভাযাত্রা তারই এক মূর্ত রূপ। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রনেতা হোসেন মহম্মদ এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে ওদেশের জনগণের প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে যে উদযাপন শুরু হয়েছিল, আজ এপার বাংলার অস্থির রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পরিবেশে একই উৎসবের অন্য মাত্রা আবিষ্কার করা যাচ্ছে। রামনবমীর অস্ত্র ঝঙ্কারকে রুখে দিতে পারে মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে উঠে আসা সহজিয়া লোকগান। পশ্চিমবাংলায় 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'র তৃতীয় বার্ষিকীতে এই উৎসবের ইতিহাস ভূগোল ও ভবিষ্যৎকে তুলে আনলেন উৎসবেরই আপনজনেরা। তিন বছর আগে গাঙ্গুলিবাগান-যাদবপুরে শুরু হয়েছিল এপার বাংলার প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা নিয়ে লিখলেন উৎসবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বুদ্ধদেব ঘোষ। বহরমপুরে অনুষ্ঠিত মঙ্গল শোভাযাত্রার কথা শোনালেন ভাস্কর গুপ্ত। রায়গঞ্জে প্রথমবার মঙ্গল শোভাযাত্রা হওয়ার উদ্দীপনা উঠে এল আরেক প্রতিষ্ঠাতা ঈশিতা দে সরকারের কলমে।

 

মঙ্গল শোভাযাত্রা— এক অলিখিত মানচিত্রের খোঁজে

বুদ্ধদেব ঘোষ
যাদবপুর

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। সূর্যের তেজকে পরোয়া না করে নাচে-গানে-ঢোলে-দোতারায় মাতোয়ারা নানা বয়সের কয়েক হাজার মানুষ। এই শহরের নাগরিক কবিয়াল প্রতুল মুখোপাধ্যায় গাইছেন, ‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই।’

হ্যাঁ, এই আবহমান বাংলাকে, বাংলার অসাম্প্রদায়িক লোককৃষ্টিকে তুলে ধরার সহজ উৎসব ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’— যা এপার বাংলায় শুরু হয়েছিল ১৪২৪ বঙ্গাব্দে (২০১৭) দক্ষিণ কলকাতার গাঙ্গুলিবাগান থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত৷ বাকিটা ইতিহাস।

এমসিকিউ-এর যুগে এটুকু সংজ্ঞায়ণে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’-র অধরা মাধুরীকে কি স্পর্শ করা যায়? বা কোনও সংজ্ঞা হয় কি আদৌ? এ তো এক অর্থে বোধের বিস্তার। সম্প্রীতি, অসাম্প্রদায়িক বাঙালিয়ানা এসব কথা মঙ্গল শোভাযাত্রার লিফলেটে লেখা থাকে কেন? আনন্দ প্রকাশের এই সহজ পরবেও কি সমাজ-রাজনৈতিক কোনও গন্তব্যস্থল আছে? মাথা ঝিমঝিম করার কিছু নেই। জন্মমুহূর্তেই তো মঙ্গল শোভাযাত্রা লোকজীবনের অর্জনগুলোকে শিল্পসুষমায় উপস্থিত করেছিল রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো ধ্বংসের চক্রান্তের বিরুদ্ধে। সালটা ১৯৮৯, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন জন্ম নিয়েছিল ৫২-র ভাষা আন্দোলন।

ক্যাম্পাসের নতুন প্রজন্ম সবসময় তারুণ্যের স্বাক্ষর রাখতে চায় সময়ের ক্যালেন্ডারে। এরকম একটি ঘটনা ঘটেছিল ঢাকা চারুকলায়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিনে একটি সংক্ষিপ্ত মিছিল ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। তাতে বাংলা ঢোল ছাড়াও কিছু মুখোশ ছিল বলে জানা যায়। মজা পায় ছাত্রছাত্রীরা। এইসব অসংগঠিত উদ্যোগ চারুকলার আড্ডায় নানা সম্ভাবনা উপস্থিত করতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে যশোর চারুপীঠের উদ্যোগে নববর্ষের দিনে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’-র কথা উঠে আসে। চারুকলায় খ্যাপা খেপির অভাব নেই। ‘কিছু একটা করতে হবে’ তাজা প্রাণগুলোতে এই অসহ্য যন্ত্রণাই স্বাভাবিক। বিশেষ একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করার রাজনৈতিক চাতুরি আহত করেছিল চারুকলার শিল্পীসমাজকে। ঠিক হয়, পয়লা বৈশাখ বর্ষবরণের দিনটিকেই বেছে নেওয়া হবে। ১৩৯৬ বঙ্গাব্দ (ইং-১৯৮৯) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে প্রথম শোভাযাত্রা ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামেই ছিল। নাগরিক সংস্কৃতিতে বর্ষবরণের উৎসব বলতে ঢাকায় ছিল ছায়ানটের বর্ষবরণের সঙ্গীতানুষ্ঠান। রমনার বটমূলে। এ ছাড়া বিরাট মেলাও বসত। ছায়ানটের বর্ষবরণের কর্মসূচি ৬০-এর দশক থেকেই চলে আসছে। কিন্তু আত্মপ্রকাশের মুহূর্ত থেকে চারুকলার ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ এইভাবে নগরবাসীকে মাতোয়ারা করে দেবে, এতটা বোধহয় প্রত্যাশা ছিল না। কয়েক বছর পরে অভিভাবকতুল্য সিনিয়র শিল্পীদের পরামর্শে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির এই উৎসব ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম গ্রহণ করে।

জীবনের প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রায় হাঁটার অভিজ্ঞতা আজও মনে আছে। প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে বাংলাদেশের মফস্বল শহর বরিশালে। ঢাক-ঢোল, লোকজ শিল্পকলার নানা মোটিফ— প্যাঁচা-ঘোড়া-বাঘ আরও কত কী! আমার পাশে একদল তরুণ গলা ফাটিয়ে গাইছে— “জ্বালাইয়া গেলা মনের আগুন নিভাইয়া গেলা না!” রঙিন আনন্দ ছাড়া ওই বয়সে আর কিছুই মনে হয়নি।

বাংলাদেশে গেলে কলকাতায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ করার তাগাদা আসত শিল্পী আমিনুল হাসান লিটু, সুশান্ত ঘোষ— এঁদের কাছ থেকে। তাঁদের বক্তব্য ছিল— এটা এমন এক উৎসব যা ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করবে৷ অসাম্প্রদায়িক বাঙালিয়ানা নিয়ে কথা উঠেছিল শাহবাগ আন্দোলনের বন্ধুদের কাছ থেকেও।

কয়েকবছর আগে, ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বাড়ি যে পাড়ায়, সেই ধানমন্ডি লেকের পাড়ে আড্ডা, মতবিনিময় হচ্ছিল শাহবাগ আন্দোলনের এক পদাতিক লেখকের সঙ্গে। কথাপ্রসঙ্গে সে বলে, “দাদা, পশ্চিমবাংলা আমাদের কাছে গর্বের। সেইখানে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় বিভাজন বাড়তাছে, এটা আমাদের দুঃখ দ্যায়।” আমি মাথা নিচু করে মারুফ রসুলের আকুতি শুনছিলাম। সুন্দর করে বলছিল। “দাদা, সাম্প্রদায়িকতা খারাপ জিনিস, এইটা বলাটাই যথেষ্ট না। ধর্মের বিভিন্নতা থাকলেও আমরা এক জাতি, ভাষা এক, কাজেই অসাম্প্রদায়িক বাঙালিয়ানাকে তুইল্যা ধরাটাই আমাদের কাজ। আমাদের দেশে এই রাস্তায় কিছুটা সাফল্য পাইছি। এখনও অনেক পথ হাঁটতে হইব।”

ঠিক যেভাবে ভাবছিলাম, ভাবনার ময়ুরপঙ্খী নাও-এ যেন তুলির কারুকাজ করল মারুফ। নব্বইয়ের দশকে অসাম্প্রদায়িক বাঙালিয়ানার উত্থানের একটা চেষ্টা করা হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রতন বসু মজুমদারের নেতৃত্বে ‘ভাষাশহিদ স্মারক সমিতি’ তৈরির মাধ্যমে। সেখানে কর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি পদ্মার এ পারেও একটা আকাঙ্খা এখনও আছে। যাই হোক, পশ্চিমবঙ্গের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’-র প্রথম আনুষ্ঠানিক মিটিং বসে ঢাকায় একটি ঐতিহাসিক দিনে। ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। শিল্পী আমিনুল হাসান লিটু, ইমরান হোসান পিপলু, চিন্ময়ী শিকদার, ঈশিতা দে সরকার, সেলিম মণ্ডল, এবং বুদ্ধদেব ঘোষ— এই ছয়জনের মিটিং। যাবতীয় পরিকল্পনা শেষে ৪ মার্চ, ২০১৭ প্রথম আনুষ্ঠানিক সভা হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিতা ব্যানার্জি মেমোরিয়াল হলে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাথুদার ক্যান্টিন, প্রযুক্তিভবন, মিলনদার ক্যান্টিন, যাদবপুর কফি হাউস— অজস্র টুকরো টুকরো পরিকল্পনার সাক্ষী। পরিকল্পনায় ছিল আমার আবহমান বাংলাকে কীভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রার (গাঙ্গুলিবাগান থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) মাধ্যমে তুলে ধরতে পারি। বাংলাদেশে কত বর্ণাঢ্য হয়, আমরা পারব তো মানুষের আস্থা অর্জন করতে। প্রাক্তন সহ উপাচার্য ড. সিদ্ধার্থ দত্তকে আহ্বায়ক করে একদল মানুষের অপরিসীম পরিশ্রম এবং সর্বোপরি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে গাঙ্গুলিবাগান থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মঙ্গল শোভাযাত্রা দারুণ সাড়া জাগাল। কয়েক হাজার মানুষের জনকল্লোলে শুধু হরেক গান, হরেক নাচ– নানা বর্ণময় সাজপোশাক। বাংলার বিষ্ণুপুরের ঘোড়া, পেঁচা, হাতি, ওরাও সেদিন বাঙালি হয়ে উঠেছিল। শ্রদ্ধেয় পবিত্র সরকার ব্যানারের নান্দীমুখ রচনা করলেন– “এই দেশ মানুষের ভালোবাসায় বাঁচুক।”

মঙ্গল শোভাযাত্রা এ বাংলায় তৃতীয় বছর। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গ’-র পক্ষ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে গোটা পশ্চিমবাংলায় ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এ বছর পশ্চিমবাংলার দশ-এগারোটা জায়গায় শোভাযাত্রা হয়েছে। বহরমপুর রায়গঞ্জ মঙ্গল শোভাযাত্রাকে অন্য উচ্চতায় উপস্থিত করেছে। সুদূর সুন্দরবনের নামখানা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে এই উৎসব। একেক বছর একেক স্লোগানকে উপস্থিত করে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। প্রথম বছর শ্রদ্ধেয় পবিত্র সরকারের প্রস্তাবমতো স্লোগান ছিল— “এই দেশ মানুষের ভালোবাসায় বাঁচুক”। দ্বিতীয় বছর “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”। এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার কথা ছিল “ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু”। বাংলাদেশ বুক উজাড় করা ভালোবাসা নিয়ে সাহচর্য নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মঙ্গল শোভাযাত্রার পাশে আছে। শুধুমাত্র পদ্মার ওপারে বা এপারে নয়, ‘যেখানে বাঙালি সেখানে মঙ্গল শোভাযাত্রা’— বাংলাদেশের মতো এই লক্ষ্য নিয়ে আমরাও কাজ করছি। আগামী দু-এক বছরের মধ্যে পশ্চিমবাংলার সব জেলায় আমরা পৌঁছে যাব— এ বিশ্বাস রাখি।

এ বাংলা অবন-গগন-জয়নুল-জসীমুদ্দিনের। জাতপাতের বিরুদ্ধে লালন আর চৈতন্যের সমন্বয়ের মাটি আমাদের ভূমিজ ইতিহাস। এখান থেকেই উচ্চারিত হয়েছিল— “সবার উপরে মানুষ সত্য”। আবহমান কাল ধরে চৈত্রের পরব এবং নানা ঢঙে বর্ষবরণ হয়ে আসছে বাংলার ধূলিমাটিতে। সেইসব লোকায়ত ঐতিহ্যকে ধারণ করেও মঙ্গল শোভাযাত্রা এক নাগরিক বাংলামি। এ যেন আমাদের নাভিমূলে শায়িত দর্পণ– যা সঙ্কেত দেয় লালনের উত্তরপুরুষ কখনও বিভাজনের চর্চা করতে পারে না। ভোরের আজান আর কীর্তন ভাসান গানে, পীরের দরগায় আর চড়কের মেলায় বাংলা একাকার।

শুধু ধর্মীয় মৌলবাদ নয়, আরেক ধরনের মৌলবাদ বাঙালিকে তার শেকড় থেকে উপড়ে ফেলতে চাইছে। বাজার মৌলবাদ। শিক্ষা-সংস্কৃতির সমস্ত জায়গায় বাজারের স্বার্থে জবরদস্তি চলছে একমুখী ছাঁচে সমস্তটা সাজানোর। ‘সম্মতি নির্মাণ’-এর এই প্রচেষ্টায় মিডিয়াও অংশীদার। ভুবনীকরণের সাতরঙা ফানুস যখন বিজ্ঞাপিত করে আমাদের দৈনন্দিন যাপনকে, সেই পৃথিবী নামক গ্রামে একের পর এক ভাষার মৃত্যু হচ্ছে কেন? ভাষার মৃত্যু হলে সংস্কৃতি বাঁচবে? আমার জারি, সারি, হালুয়া-হালুয়ানি, বোলান-গম্ভীরা, এ কি শুধুমাত্র লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রে সমীক্ষার অ্যাকাডেমিক বিষয় হয়ে দাঁড়াবে? তা নির্ভর করে আমাদের জীবনচর্যার উপরে।

মঙ্গল শোভাযাত্রা যদি শুধুমাত্র বছরের একদিন লোকসংস্কৃতির ভদ্রচর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়বে। সরাশিল্পী, পাটশিল্পীদের পরের প্রজন্ম এইসন নান্দনিক শিল্পকর্মে আসছেন না কেন? যথেষ্ট বাজার নেই বলে। দূর থেকে ‘দারুণ’ ‘অসাধারণ’ বলাই যথেষ্ট নয়। লোকশিল্পী না বাঁচলে লোকশিল্প বাঁচবে না। আমাদের যাপনে, উপহারে, গৃহসজ্জায় লোকশিল্পের প্রচলন ঘটলে এক বিকল্প বাজার তৈরি হবে, এও এক বাংলাবাজার।

নগর আর গ্রাম একাকার হয়ে যাক। রাতজাগা আলপনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ যখন দোতারায় গেয়ে ওঠে “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!”— মধ্যরাতের পথচারী থমকে দাঁড়ায়। এটাই আমার বাংলা। ভালোবাসার অনেক নাম, সবচেয়ে সবুজ নাম— বাংলা। প্রতুলদা যতদিন বাঁচবেন, দুই বাংলার বাঙালিকে গাইতে শেখাবেন, “আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ!” কানের কাছে মাতাল ঋত্বিক বলে ওঠেন, “চোপ শালা, বাংলা কখনও দুটো হয় না!” এই অলিখিত মানচিত্রের হাহাকারও মঙ্গল শোভাযাত্রায় উচ্চারিত হয় কিনা জানি না।

 

মঙ্গল শোভাযাত্রা ১৪২৬

ভাস্কর গুপ্ত
বহরমপুর

সারাদেশে রাজনীতির উত্তাপ যখন বেশ উঠছে নামছে,ক্ষমতার কালো সাদা ছকের বোর্ডের মত মানুষ যখন ইচ্ছায় অনিচ্ছায় ভাগ হয়ে যাচ্ছে রং ধর্ম ছোঁয়াছুঁয়ির ছক কাটা ঘরে, তখনই পৃথিবীর নিজ কক্ষপথে সৌর পরিক্রমার এক হিসাব ধরে আর ফসলি খাজনার জমা খরচের সুবিধা করতে যে দিন, মাস, বছরের শুরুর যে দিনটা বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে নববর্ষ, সেই দিনটাতে নবাবী গন্ধ মাখা বহরমপুর, মেতেছিল আনন্দে। অজস্র নদীর আল্পনা আঁকা যে ভূগোলকে বলি বাংলা, যেখানে এসে বিদ‍্যাপতির ব্রজবুলি, চর্যার চর্চাপথে চলে চৈতন‍্য লালনের স্রোতে রবীন্দ্রনাথ নজরুলের ঐতিহ‍্যে পৌছয়, সেই বাংলাভাষী অববাহিকার ইতিহাসের আধুনিক পতন সংগঠনের এক খণ্ড সময়কালের নাটমঞ্চ আমাদের জেলা মুর্শিদাবাদ, যেখানে ইতিহাস আর বাঙালির অতীত এবং বর্তমানের যুগ সন্ধিক্ষণের চেতনা পথের পাশে পাশে, হাত ছুঁয়ে দেখা যায় দেশীয় সামন্ততান্ত্রিক ব‍্যবস্থার ভোগবিলাস আর বেনিয়া মুৎসুদ্দি সংস্কৃতির প্রথম সকালের স্পর্শ, আবার এই মুর্শিদাবাদই বৌদ্ধ, শাক্ত, বৈষ্ণব আর লোকায়ত সাধনার আবহমান স্রোতে ময়ুরপঙ্খী ভাসিয়েছে ময়ূরাক্ষী আর ভৈরবের ঘোলা জলে। মুর্শিদাবাদ, এমন এক জনপদ, যা এই উপমহাদেশের ভূ রাজনৈতিক বিন‍্যাসের দুটি অক্ষেরই পতাকা উত্তোলনের ইতিহাস বয়ে পথ চলে। বহরমপুর এমনই এক শহর, যার হৃদয়স্থলের সবুজ মাঠের ঘাসগুলো ফিসফিস করে শোনায় জঙ্গে আজাদির প্রথম হুঙ্কারের প্রতিধ্বনি। যে মুর্শিদাবাদের নবাবী মসনদ ভারতে বণিকের মানদণ্ডের রাজদণ্ড হয়ে ওঠার প্রথম ইঙ্গিত, সেই নবাবী শাসনে সবচাইতে বড় উৎসব ছিল ‘বেরা ভাসান’ মিলনের উৎসব। এই ইতিহাসের বহতা নদীতেই আজকের এই জনপদের প্রবহমানতা। রেজাউল করিম, গুমনী, রাধারাণী দেবী, সুধীন সেনের সাংস্কৃতিক উদারমনস্কতার আজকের শহর বহরমপুর গত ১৪২৫ সন থেকেই বাংলাভাষী মানুষের শিকড়ের খোঁজের চিরন্তন পথচলার সাংস্কৃতিক যাপনের উৎসব ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’য় পথে নামে।

যে ভূগোলে নদীর নাম কপোতাক্ষ, ফুলকে বলি রাধাচূড়া আর কালো মেয়ে কৃষ্ণকলি, সেই জনপদের ভাষা আর সংস্কৃতির ভাগবাঁটোয়ারা করেছে শাসক আর শোষণের কারবারিরা, জাতীয়তাবাদ থেকে মৌলবাদের পথ পেড়িয়ে আবার এই বাঙালি মানুষই নিজের রক্ত দিয়ে অর্জন করেছে ভাষার অধিকার, কাঁটাতারের বাধা পেড়িয়ে এখনও পদ্মা গঙ্গার জল মেশে বাংলার সাগরে। বাঙালির নিজস্ব চেতনা পথ দেখিয়েছিল মুক্তির সংগ্ৰামে, উপমহাদেশের শ্রমজীবী আর মানবিক সহজিয়া সংস্কৃতির পীঠস্থান এই ভৌগোলিক খণ্ডই আবার আর্থসামাজিক জটিলতার এক গোলকধাঁধায়  বিভাজিত হয়েছে, আপাত শক্তিশালী ধর্মচেতনার কালবৈশাখী ভাগ করেছে আকাশ, জল আর মাটি, তবুও কবি বলেছেন ‘ভাগ হয় নাই নজরুল’, এই আবহমান সংস্কৃতির ডিএনএ-ই বাংলা ভূখণ্ডের অন্তরাত্মা, যুগ সন্ধিক্ষণের চেতনা, তাই একমাত্র পৃথিবীতে বাংলাভাষীরাই প্রমাণ করেছে ধর্মবন্ধনহীন ভাটিয়ালি আর বাউল, সত‍্যপীর আর গাজন, নবান্ন আর নববর্ষের চেতনা, খণ্ড বিভাজনের ঋতুর চেয়ে তীব্র। দেখতে দেখতে পেরিয়েছে সময়, গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে বয়ে গেছে অজস্র স্মৃতি, আর্থ-সামাজিক বিশ্বায়নের মাঝে দাঁড়িয়ে নাটোর থেকে নোতরদাম, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নিশ্চিন্তিপুর, জাতি-ধর্ম-বর্ণ হাজারো ভেদাভেদের মাঝে বাঙালি খুঁজে ফিরছে তার আত্মপরিচয়। আমরা এক অশান্ত সময়ের অধিবাসী। যখন শিকড় থেকে মানুষের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ছিঁড়ে এনে এক পণ্যায়িত কালচারের পথচলা, যেখানে নিছক সংখ‍্যা আর আপাত জনপ্রিয়তা আর মোহ দিয়ে ভিন্ন স্বর এবং বৈচিত্র্যকে দমন করাই প্রবণতা। ভিন্ন মত এবং পথের সাথেও সহাবস্থানের যে সহজ সংস্কৃতি আমাদের বহুকালের, সেই শিকড়েই আজকের আক্রমণ।

প্রতিনিয়ত, প্রতিমুহূর্তে বাঙালি তার যাবতীয় স্মৃতি-সত্তা দিয়ে রুখেছে বিভাজনের হাতছানি। আমাদের সংস্কৃতি সেই স্পর্ধিত চেতনার রক্তিম দিনলিপি, আমাদের ভাষা আর আত্মার একাত্মতার অমর উত্তরাধিকার, আমাদের আত্মপরিচয়ের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। প্লুরালিজমের যে আদর্শে ইদম শাহের পাশেই গান বাঁধেন বিজয় সরকার, চিত্তপ্রসাদ আঁকেন মেহনতী মানুষের প্রতিরোধ, সাহাবুদ্দিনের ক্যানভাস ভরে যায় মুজিবের রক্তে। যে ভাষায় আলোর নাম ‘কনে দেখা’, চালের নাম ‘ভাসামানিক’, যে ভাষায় শহিদের নাম ‘প্রীতিলতা’— সে ভাষার স্পর্ধিত চেতনাই আমাদের আত্মপরিচয়, আমরা বাঙালি। ১৯৮৯ সাল থেকে প্রতিবেশী বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অঙ্গ হিসেবে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ইউনেস্কো এই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ অনুষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। এপার বাংলায় কলকাতা সমেত বিভিন্ন জেলাতেও বাঙালিয়ানার উৎসব হিসেবে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে গত কয়েকবছর ধরে।

ইতিহাসের পথ বেয়ে, মিলন আর সম্প্রীতির আদর্শে, ধর্ম বন্ধনহীন সমাজ, সংস্কৃতি আর মানবতার চর্চাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতেই, রাজা কৃষ্ণনাথ আর রেজাউল করিমের এই জেলায়, মোহনলাল মীরমদনের মাটিতে মঙ্গল শোভাযাত্রার পথ চলা। প্রিয় শহর বহরমপুর, নাটকের শহর, সংস্কৃতি চর্চার শহর, বহরমপুর মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন আর উদ‍্যোগের সহায় হয়েছেন সাধারণ মানুষ, আমরা গিয়েছি মানুষের কাছে হাত পেতে, সংস্কৃতির টানে শিকড়ের সন্ধানরত মানুষের দানে সংগ্ৰহ লক্ষাধিক টাকা। সুদৃশ্য মুখোশগুলি বাংলার মানবজমিনের প্রতিটি প্রতীককে তুলে ধরেছে, সেগুলি তৈরি করেছে শহরের শিল্পীরা, ব্রতীন, সৌমেন, পী্যূষ, বিকাশের সাথে বেশ কিছু কচিকাঁচার হাতে জীবন্ত হয়েছে শিল্পকর্মগুলি। শহরের সংস্কৃতিকর্মীরা পথে পথে গানে কবিতায় মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন আরও বেঁধে বেঁধে থাকার ডাক, হাতে হাত ধরে, বাংলাভাষী মানুষের ঐক্যের আহ্বান।তরুণদা, শ্রীনন্দার মত শিল্পীদের সঙ্গে শোভাযাত্রার পথ-প্রচার হয়েছে এক সপ্তাহ সময় জুড়ে। একটি সুদৃশ্য ময়ুরপঙ্খী, নবাবী মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্য আর এই ভূখণ্ডের নিপুণ শিল্পীদের দক্ষতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে আমাদের এক পক্ষকালের শহর জুড়ে ট‍্যাবলো প্রচারে। খুঁটিনাটি অজস্র প্রস্তুতি আর ছোটাছুটিতে তৌফিকদা, সুগতদা, সুমনাদি আর চিরযুবক আশীষকাকুর সঙ্গে একদল যুবক, শিকড়ের টান সংস্কৃতির চেতনা যে আজও এই প্রজন্মের কাছেও আপনের চেয়েও আপন, তারই প্রমাণ, যে ছেলেটি টিউশন পড়ায় দুইবেলা সেও এই চৈত্র রোদে দৌড়েছে শোভাযাত্রার প্রস্তুতিতে। আর এই শহরের সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলি, শোভাযাত্রার পথ তো তাদেরই কচিকাঁচার দল আর আনন্দমুখর উপস্থিতিতে মুখর জীবন্ত। শোভাযাত্রায় ছিলেন সেই মানুষগুলোও যাদের কবিগুরু বলেছেন সভ‍্যতার পিলসুজ, স্থানীয় আদিবাসী রমণীরা নিজেদের উদ‍্যোগে ডুরে শাড়ি পরে এসেছেন কলসি মাথায়, এসেছেন বাউলের দল আর রায়বেঁশের শিল্পীরা। ঘোড়া নাচের বোলে নেচেছে শহর, ঢাকের মাতন সেদিন আট থেকে আটচল্লিশ সকলেরই পায়ে চমক লাগিয়েছে। বাংলার বৈশাখের প্রথম দিন পয়লা, পথে শোভাযাত্রার সহযাত্রীদের জলসত্রের বাতাসা আর জল বিতরণে মর্নিং গ্লোরি ক্লাবের জলসত্রও যেন একটা রূপকল্প, যেখানে আবহমান সেই ট্রাডিশন আমাদের চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়।

আমাদের রূপকথা আমাদের বলে নীলকমল আর লালকমলের কথা, যাদের জাগ্ৰত চেতনা রাক্ষসের চক্রান্ত থেকে রাজকন‍্যাকে বাঁচিয়ে আনে, খোলা তলোয়ার হাতে ‘লালকমল আর নীলকমল জাগে’ জেগে থাকে বাংলার সমাজ চেতনা, হুমায়ুন আজাদ আর নীললোহিতের লেখায়, আব্বাসউদ্দিন আর নির্মলেন্দুর গানে। ফিরোজা আর মোহরের সুরে। এই শোভাযাত্রা আজকের ঈষাণ কোণের কালো মেঘের ঝড়ের কাছে বিনীত অথচ আত্মপ্রত‍্যয়ী এক ঘোষণা, অশ্বমেধের ঘোড়ায় চড়ে যারা এই কোমল গান্ধারের মুর্ছনার তারকে ছিঁড়তে চায় তাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের রাম নবদূর্বাদলশ্যাম, আমাদের ঈশ্বরী পাটনি দৈবী অনুগ্ৰহে রাজ ঐশ্বর্য নয়, চায় কেবল সন্তানের দুধেভাতের নিশ্চয়তার নিরুপদ্রব জীবন, তাই এই ভৌগোলিক বোধের বাসিন্দা আমরা পান্তা আর পোস্তে থাকতে চাই, বাঁচতে চাই একসাথে ঐক‍্যের চেতনা নিয়ে, এই চেতনার পথ চলাই আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। তাই আবার পরের বছরের অপেক্ষা, চরৈবতী.. চরৈবতী।

 

রায়গঞ্জ মঙ্গল শোভাযাত্রা: ‘থতমত এই শহরে রডোড্রেনড্রন’

ঈশিতা দে সরকার

ঘাসের নীচে মুখ নামিয়ে সাঁইজি রেখে গেলেন খমক, ডুবকি, দোতারা, একতারার সংবিধান। কুষ্টিয়ার একতারার সেই থেকে একবগগা বুলি, “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি…।” একবগগা হলে পারা যায়। কোনও না কোনওভাবে পৌঁছে যাওয়া যায় অচিনপুরের অনাবিষ্কৃত উঠোনে। যে উঠোনের চারধারে মানুষের শুধুমাত্র মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠার ছোটবড় পাতাবাহার। মানুষ মানে শুধু মানুষ, এই একটামাত্র সত্যকে দুহাতে ধরে পেরিয়ে আসা যায় পার্থক্য আর বিভেদের উঁচুনিচু টিলা-পাহাড়।

বাংলাদেশ পেরেছিল। ১৯৮৯ সাল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করলে প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন বাংলাদেশের মুক্তচিন্তা, শুভবুদ্ধির মানুষেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-প্রাক্তনীরা ঠিক করলেন বাংলার লোকজীবনের শিল্পকর্মের উপস্থাপনার মাধ্যমে তাঁরা বাংলার সম্প্রীতি-সমন্বয়ের রূপ তুলে ধরবেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, আবহমান বাংলার লোকসংস্কৃতির মধ্যে যে সমন্বয়ের বার্তা আছে, তাকেই চারুকর্মের মাধ্যমে তুলে ধরা হল বাংলা নববর্ষের দিনে। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’য়। যদিও এর আগে যশোর চারুপীঠ ‘আনন্দ যাত্রা’ বা ‘বর্ষবরণের শোভাযাত্রা’-র উদাহরণ রেখেছিল। সব জাতির মানুষের নিজস্ব নববর্ষ আছে, আছে তাকে কেন্দ্র করে উৎসব। তাই বাঙালির বাংলা নববর্ষের দিনটিকেই শিল্পীরা বেছে নিলেন বিভেদের বিরুদ্ধে সম্প্রীতি ও মঙ্গলের বার্তা দিতে। বাংলাদেশে এখন গণউৎসবের চেহারা নিয়েছে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। পেয়েছে ইউনেস্কোর তরফ থেকে বিশ্বঐতিহ্যের মর্যাদা।

কাঁটাতার ডিঙিয়ে এপারেও এসে লাগে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’-র ঢেউ। ১৪২৪ (ইং ২০১৭)-এর পয়লা বৈশাখ গাঙ্গুলিবাগান থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৭-র একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশিষ্ট চারুশিল্পী আমিনুল হাসান লিটুর বাড়িতে, পশ্চিমবঙ্গে কীভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত করা যায় তার প্রথম আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন এপার থেকে বুদ্ধদেব ঘোষ, সেলিম মন্ডল ও এই অধম।

সেদিনের সেই আলোচনার পর থেকে, আজ পর্যন্ত মঙ্গল শোভাযাত্রা ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জনপদে। বাদ রইল না আমার শহর। মঙ্গল শোভাযাত্রা-র সংক্রমণ ছুঁয়ে দিল আমার প্রিয় রায়গঞ্জকেও। উত্তরদিনাজপুরের ছোট্ট এই শহরে ‘নেই’-এর তালিকা দীর্ঘ হলেও যা আছে তাই আমাদের অমূল্য ধন। এ শহর অন্যের বিপদে পথে নামতে পারে। আনন্দে গাইতে পারে উচ্ছাস গান। এ শহর নিজের মতো করে অসংখ্য প্রতিকূলতাকে সরিয়ে চালিয়ে যায় সুস্থ সাংস্কৃতিক-সামাজিক যাপন। এই শহরের এমন সব প্রাণভোমরার ওপর ভরসা করে আমরা সাহসী হলাম ‘রায়গঞ্জ মঙ্গল শোভাযাত্রা’র আয়োজনে। বাংলাদেশ মঙ্গল শোভাযাত্রা ও গাঙ্গুলিবাগান থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মঙ্গল শোভাযাত্রার পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত সাহস, ভরসা ও দিশা পেয়েছি আমরা। এর আগে ১৪২৪ ও ১৪২৫-এ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চের উদ্যোগে পয়লা বৈশাখের সকালে দুবার বর্ষবরণ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘বৈশাখী শোভাযাত্রা’ সেই শোভাযাত্রাকেই মঙ্গল শোভাযাত্রার আঙ্গিকে তুলে ধরা হল এ বছর। ১৪২৬ পয়লা বৈশাখ, প্রথম অনুষ্ঠিত হল ‘রায়গঞ্জ মঙ্গল শোভাযাত্রা’।

কিন্তু কীভাবে সম্ভব হল এই স্বপ্নের নির্মাণ, তা লিখতে গিয়ে আবেগে কলম শ্লথ হয়, নাগাড়ে শব্দের তোড় ছুটে আসে। ভেসে যাই, আবার কোনও একটা পাড়ে গিয়ে উঠি। এ আনন্দ আয়োজনের গল্পকথা সীমিত শব্দে ধরা আর অধরা মাধুরীকে ছুঁয়ে থাকা বুঝি খানিকটা এক।

২৪ মার্চ, ২০১৯। রায়গঞ্জ স্টুডেন্টস হেলথ হোম ও তার লাগোয়া একটু ঘেরা জায়গায় শুরু হল রায়গঞ্জ মঙ্গল শোভাযাত্রার লোকজ অনুষঙ্গের কর্মশালা। অংশ নিলেন শহরের নবীন-প্রবীণ শিল্পী, সঙ্গে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী। এপাড়া ওপাড়া থেকে এসে জুটেছে মানুষ। কেউ তার ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া ড্রয়িং খাতা খুঁজে নিল এই কর্মশালায়। কেউ বা মুখোশের চোখের নিচে রাখল জীবনের প্রথম তুলির টান। মঙ্গল শোভাযাত্রা এমন অনেক হারিয়ে যাওয়া ঠিকানা খুঁজে দেওয়ার পোস্টম্যান। ওয়ার্কশপ চলছে, চলছে গান, আড্ডা, আলাপ আলোচনা। পথচলতি মানুষ এসে দেখছে, যোগদান করছে বিরাট কর্মকাণ্ডের রঙিন আতুঁরঘরে। দিনরাতের হিসেব উড়িয়ে, নিজ নিজ পেশা, রুজিরোজগারের কথা ভুলে গিয়ে একেকজন শিল্পী এখানে জন্ম দিচ্ছে তাঁদের ভাবজ সন্তানকে। মুখগুলো মনে পড়ছে ভীষণ। পৃষ্ঠা ভরিয়ে তুলতে ইচ্ছে করছে সেইসব ক্লান্তিহীন নামগুলোর নামাবলীতে। কোনওদিন সুযোগ হলে, লিখে রেখে যাব সেইসব নাম, যারা রায়গঞ্জকে পৌঁছে দিল ইতিহাসের পাতায়।

খোলা আকাশের নিচে প্যান্ডেল বেঁধে ওয়ার্কশপ চলছে ভরা চৈত্র মাসে। প্রায় রাত্রিতেই ঝড়বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে নির্মীয়মান ২০ ফুট নীল নীলকণ্ঠ পাখি, ২৫ ফুট মাছের শরীর। দুশ্চিন্তায় রাত জাগছে রায়গঞ্জের মঙ্গল শোভাযাত্রা পরিবার। সকাল না হতেই অক্লান্ত হাতগুলো সারিয়ে তুলছে রং চটে যাওয়া মাছ, নীলকণ্ঠকে। এই নিঃস্বার্থ কাজের ডাকনাম আদর ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। কর্মশালাসহ পুরো মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন। উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেরিয়েছে সবাই, তরুণ তরুণী, কিশোর কিশোরীরা, সঙ্গে প্রবীণ স্ট্রিট কর্নার করে চাঁদা তুলেছে। চৈত্র সেলের বাজারে চিৎকার, নির্বাচনী প্রচারের ঢক্কানিনাদকে ছাপিয়ে আমাদের তরুণ ব্রিগেড গেয়ে চলেছে–

গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু মুসলমান,
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম

সেই সুন্দর দিনের স্বপ্ন দেখায় মঙ্গল শোভাযাত্রা, দুচোখে ভরা স্বপ্ন নিয়ে প্রতিটি মানুষ এক-একটা ইঁট দিয়ে প্রস্তুত করেছে রায়গঞ্জ মঙ্গল শোভাযাত্রার রংমহল। মঙ্গল শোভাযাত্রা এই যৌথকর্মের প্রাইমারি স্কুল।

সমস্ত আয়োজন প্রায় শেষ, মধ্যরাতের রায়গঞ্জের পথে জেগে আছে কয়েকটা তারা। জেগে আছে প্রসেনজিৎ দাস, বিজয় চক্রবর্তীর মতো আরও রং-তুলির ক্ষ্যাপাক্ষেপিরা। সারারাত জেগে রাস্তার বুকে আঁকল আলপনার মরম। রাস্তা তখন এক রঙিন এক দরবেশি চাদর, রাস্তা তখন কীর্তনের খোল করতালের, ভোরের আজানের আর্তি। রাস্তা জুড়ে ‘বসন্ত বাহার’ গাইল ওরা।

সকাল নটা। রায়গঞ্জ বিবেকানন্দ মোড়। মানুষ আর মানুষ। আনন্দে মাতাল মাতোয়ারা মানুষ। ২৫ ফুট মাছ, ২০ ফুট নীলকণ্ঠ পাখি, মনসার ভাসানের অনুষঙ্গ, খনগান, বুড়াবুড়ি নাচ, হালুয়া হালুয়ানি, বিয়ের বাদ্য, পালকি, গোয়ালঘরের গান, ঢাকের বাদ্য, দোতারা, একতারা, গিটার, সমস্ত সাংস্কৃতিক দলকে সাথে নিয়ে আপামর মানুষ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। শরীর কেঁপে উঠছে, ভিজে উঠছে চোখ, আমার কতকিছু না পাওয়ার এই শহর তখন ‘সব পেয়েছির দেশ’। হেঁটে চলেছে রঙিন পাঠশালা। পেছন থেকে মৎস্যরাণী আগলে রেখেছে সমস্তটা। চলার পথে শিখিয়ে দিচ্ছে এভাবেই একসাথে চলার সহজ পাঠ। সুউচ্চ নীলকণ্ঠ পাখি মাথা তুলে সবার আগে নেতৃত্ব দিচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রার। বাংলার মাটি পীরের, মন্দিরের, গীর্জার। বাংলার মাটি চৈতন্য, লালন, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, শাহ আব্দুল করিম, হাছন রাজার, জীবনানন্দের। এ মাটিতে বিভেদের ছেঁড়া দাগ পড়তে দেওয়া যাবে না, নীলকণ্ঠ পাখির দুচোখের এই ভাষা বুঝে নিয়েছে সকলে, মুখোশেরা লুটিয়ে পড়েছে আহ্লাদে, আনন্দে। সমস্ত সীমানা, ভাগাভাগির উর্ধ্বে উঠে আজ তাদের পরস্পরের দেখা, “বন্ধু, কী খবর বল!” যে মানুষেরা পথ হাঁটল, তাদের কেউ হয়ত কাঁটাতারের ওপারের ফেলে আসা উঠোনটিকে খুঁজে পেল বাঙালির সবচেয়ে বড় এই মিলন উৎসবে। সাহসী নবীনের সাথে প্রবীণের ছায়া, প্রশ্রয়ের ডালপালা মেলে এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সুন্দর করে তুলেছে রায়গঞ্জের সববয়সি মানুষ। যাদের নামগুলো লেগে থাকবে চোখের তারায়।কালের কলমে। চারপাশে সাম্প্রদায়িক হানাহানি, মানুষে মানুষে দূরে সরে যাওয়া, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ধর্মীয় অস্ত্রমিছিলের বিপরীতে দাঁড়ানো এক ‘দৃপ্ত স্লোগান’ এই মঙ্গল শোভাযাত্রা।

রায়গঞ্জ মঙ্গল শোভাযাত্রা পেরেছে। সমস্ত বিভেদপন্থা উড়িয়ে আপামর বাঙালির প্রাণের উৎসবকে সার্থক করতে। বাঙালি যেখানে খুঁজে পায় শেকড়ের দুধ রঙ, চেতনার পুষ্টি। ইংরেজি বর্ষবরণের ধুন্ধুমার স্বর পেরিয়ে ক্যালেন্ডারে একলা হতে থাকা পয়লা বৈশাখকে আলোর নিশানা দিতে মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ এক অনন্য পন্থা। রায়গঞ্জ মঙ্গল শোভাযাত্রা নিজেকে নিংড়ে চেষ্টা করেছে। রায়গঞ্জ মঙ্গল শোভাযাত্রা এ শহরের প্রতিটি মানুষের নিঃশ্বাস ঘর, যা আগামীতে আরও ‘বেঁধে বেঁধে’ থাকার বাতিঘর এনে দেবে। রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে আরও কাছে টেনে নেবে আরও নরম সহজিয়ায়। মানুষ, আহা মানুষ! একবগগা হলে পারা যায়। রায়গঞ্জ মঙ্গল শোভাযাত্রা পারল। সাঁইজির একতারা এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে-

মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি….