শুভাশিস মৈত্র
ভয় দেখানো হচ্ছে। খুব সুপরিকল্পিতভাবে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি বলেছেন, ভোটে দাঁড়িয়ে বন্দে মাতরম না গাইতে পারলে সেই প্রার্থীর জমানত জব্দ হোক। মানে দাঁড়ায় এই যে, ভারতীয় মুসলিমরা, যাঁরা ঈশ্বর ছাড়া আর কারও বন্দনা করেন না এবং সেই কারণে এই গান নিয়ে তাঁদের আপত্তির কথা স্বাধীনতার আগে থেকেই আছে, সেই মুসলিম প্রার্থীদের প্রতি একটা হুমকি। যাতে ভয় পান দেশের সংখ্যলঘুরা। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু দেশটা দু’ভাগ হয়ে গেল।
যে আইনে গৌতম নওলখা, ভারভারা রাওদের গ্রেফতার, গৃহবন্দি করে রাখা হচ্ছে, ইংরেজ আমলের সেই সেডিশন আইন বাতিলের দাবি যেখানে বহু দিনের, বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং বলেছেন, তাঁরা ফের ক্ষমতায় এলে ওই আইনকে এমন কঠোর করা হবে যে শুনলেই মানুষের শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বইবে।
বলছেন কারা? যাদের কোনও ভূমিকাই নেই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। এভাবেই ভয় দেখানো হচ্ছে।
এই পর্যন্ত আমরা সবাই জানি। কিন্তু প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। এর বিরুদ্ধে কি দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষ, মধ্যবিত্ত মানুষ প্রতিবাদে মুখর? দেশ জুড়ে মানুষ কি রাজনাথ-নরেন্দ্র মোদিকে ছি ছি করছে? না, করছে না।
গণতন্ত্রকে যারা সঙ্কুচিত করতে চায়, গণতন্ত্রের সুগন্ধী মেশানো ফ্যাসিবাদ যাদের আদর্শ, আমাদের দেশে তাদের একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। এমন হতেই পারে, এবারে লোকসভা ভোটে তারা ক্ষমতায় আসতে পারল না। কিন্তু পরের ভোটে দ্বিগুণ ক্ষমতা নিয়ে তাদের ফিরে আসার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভারতে এই যে গণতন্ত্রের সুগন্ধী মেশানো ফ্যাসিবাদী আদর্শের উত্থান, তা পরাজিত হবে না জয়ী হবে, আমরা এখনও জানি না। আমাদের দেশে যে সব আঞ্চলিক দল এই ধরনের আদর্শের বিরোধী, তারা বিষয়টিকে খুবই হালকা করে দেখছে। যৌথভাবে রুখে দাঁড়ানোর ভাবনা কারও মধ্যেই দেখা যাচ্ছে না। সন্দেহ নেই অত্যন্ত প্রগতিশীল একটি ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেছে কংগ্রেস, কিন্তু কংগ্রেস রাজ্যে রাজ্যে জোট নিয়ে যে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় ইতিমধ্যেই দিয়েছে, তারা ভাবতে পারছে না, এই পথে হাঁটলে দলটা ভবিষ্যতে ভাই-বোনের পার্টিতে পরিণত হবে। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের অযৌক্তিক দাবির কাছে মাথা না নুইয়ে সিপিএম জোট থেকে বেরিয়ে এসেছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে মনে হতে পারে, ভুল পদক্ষেপ। বিজেপি কিন্তু জেতা আসন ছেড়েছে ভিন্ন রাজ্যে জোটের স্বার্থে। সিপিএম এই যে আপাত সঠিক কারণে জোট থেকে সরে গেল, এই সিদ্ধান্ত আর একটি ঐতিহাসিক ভুল হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে ভবিষ্যতে। এর ফলে রাজ্যে, যা ২০১৪, ২০১৬-তে সম্ভব হয়নি, বিজেপি পাকাপাকিভাবে রাজ্য-রাজনীতিতে দ্বিতীয় স্থান দখল করে প্রথমের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করবে। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হলে যদি বামেরা একটি আসনও না পেত, তবু বিজেপিকে কার্যত চার নম্বরে আটকে রাখা যেত।
ফের মূল বিষয়ে ফেরা যাক। যে ফ্যাসিবাদী শক্তি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা করায়ত্ত করতে চাইছে, আগেই বলেছি, আমাদের দেশে তাদের জন্য কিছুটা অনুকূল পরিস্থিতি, একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। কেন? প্রধান কারণ, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গণতন্ত্র-পন্থী রাজনৈতিক দলগুলির শাসনে দীর্ঘদিন শাসিত হয়ে, তাদের সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপোষণ দেখে দেখে মানুষ বিভ্রান্ত। এটা ডান-বাম, সব ধরনের দলের ক্ষেত্রেই কম-বেশি সত্যি। দ্বিতীয় কারণ ভোটে দুর্নীতি, ভোটে টাকার খেলা, গায়ের জোরে ভোট করা এসব দেখে দেখেও মানুষ ক্লান্ত এই সব দলের উপর। তৃতীয় কারণ মধ্যবিত্তকে আয়বৃদ্ধির ব্যাপারে সন্তুষ্ট করতে না পারা। দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মির সমস্যাকে অবহেলা করা, এমন একটা ধারণার জন্ম দেওয়া যে ওই সমস্যা আলোচনায় মিটবে না, কঠোর সরকার আর বন্দুকই মেটাবে সমস্যা।
টাকার ব্যাপারে বিজেপি সবার উপরে। সেটা কিন্তু এই মুহূর্তে মানুষ দেখছে না। দেখতে চাইছে না। যেভাবে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক থেকে লোপাট হয়েছে, তার সিংহভাগই হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। বন্ডে যা টাকা তুলেছে রাজনৈতিক দলগুলি, তার সর্বোচ্চ ভাগ গিয়েছে বিজেপির কোষাগারে। প্রায় ২০০ কোটি। ওই ব্যাঙ্কের টাকা লোপাটে যারা অভিযুক্ত, যাদের নাম নরেন্দ্র মোদি সরকার কিছুতেই প্রকাশ করতে চাইছে না, তারাই কি রিটার্ন গিফট হিসেবে বন্ডের মধ্যমে টাকা দিয়েছে? আমরা জানি না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বন্ডের বিস্তারিত তথ্য জমা পড়লে হয়তো জানা যাবে কারা টাকা দিয়েছেন বিজেপিকে বন্ডের মাধ্যমে।
ঠান্ডাযুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার শেষ হওয়ার পর সারা পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা বেড়েছিল। গত ২০০০ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে দেশে দেশে গণতন্ত্র সঙ্কুচিত হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত দেবেশ কাপুর, মিলন বৈষ্ণভ সম্পাদিত ‘কস্টস অফ ডেমোক্র্যাসি’ বইয়ের (অক্সফোর্ড) একটি তথ্য এই ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০০০ সাল থেকে ২০১৫, এই ১৫ বছরে ছোট-বড় ২৭টি দেশ থেকে গণতন্ত্র বিদায় নিয়েছে। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু প্রধান কারণ অবশ্যই, গণতন্ত্রের ভালো ভালো কথার সঙ্গে বাস্তবের অমিল, গরিব-বড়লোকের আয়ের মধ্যে সীমাহীন ফারাক, মধ্যবিত্তের আয়বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। বইটির ভূমিকায় দেবেশ কাপুর, মিলন বৈষ্ণভ ফ্র্যান্সিস ফুকুয়ামাকে উদ্ধৃত করে এই কথা বলেছেন। লেখকদের আরও মত, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে টাকার খেলাটা বন্ধ করা সম্ভব হয় না আর সে সুযোগটা গণতন্ত্রবিরোধীরা ক্ষমতা দখলে ব্যবহার করে থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পণ্ডিত ল্যারি ডায়মন্ড তাঁর ‘ডেমক্র্যাসি ইন ডিক্লাইন’ বইয়ে একটি উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ২০১২ সালের পরে সারা পৃথিবীতে মোট ৯০টি আইন হয়েছে বা আইনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে জমায়েতের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। এছাড়া গোটা দুনিয়া জুড়ে শুরু হয়েছে ইন্টারনেট এবং অনলাইনের উপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। এই বিষয়ে একটি হাতে গরম উদাহরণ রয়েছে। ২০১২ সালে চিনের এক পলিটব্যুরো সদস্যের ছেলে কয়েক কোটি টাকা দামের ফেরারি গাড়ি চড়ে বেড়ানোর সময় দুর্ঘটনায় পড়ে। এই খবর চাউর হতেই এই গাড়ির বিষয়ে জানতে চিনের নাগরিকেরা ইন্টারনেটে সার্চ করতে শুরু করেন। রাষ্ট্র সঙ্গে সঙ্গে ফেরারি সাইটটা ব্লক করে দেয়। কমিউনিস্ট পার্টির নেতার ছেলে কত দামের গাড়ি চড়ছিল সেটা যাতে কেউ জানতে না পারে।
দেশে দেশে গণতন্ত্রের এই যে উল্টোরথযাত্রা, সেই যাত্রায় আমাদেরও কি সামিল করার চেষ্টা চলছে? যে ফ্যাসিবাদী দলটি ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফিরতে চাইছে, তারা কিন্তু সুযোগ পেলেই সংবিধান বদলে দেবে। যে কথাটা বলা হচ্ছে, এরা ক্ষমতায় এলে আর ভোট হবে না, সেটা এই মুহূর্তে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে, কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই অবাস্তব উদ্বেগ নয়। যে নির্বাচন আমাদের দেশে চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিত এরকম। একটি গণতন্ত্রবিরোধী ফ্যাসিবাদী শক্তি বিপুল অর্থ নিয়ে ক্ষমতা দখলে নেমেছে, সঙ্গে রয়েছে দেশাত্মবোধের জনমোহিনী মুখোশ। উলটো দিকে যারা, সন্দেহ নেই তারা গণতন্ত্রের পথিক, কিন্তু তাদের একটা বড় অংশ পরস্পরবিচ্ছিন্ন, অনেকে জাত-পাত নির্ভর, অনেকে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত। এই সুযোগই নেয় ফ্যাসিবাদ। নিতে শুরু করেছে।
পথ একটা আছে। এবং সেটা দেখা যাচ্ছে। এই ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কখনও ক্যাম্পাসের পড়ুয়ারা, কখনও ডাক্তার, কখনও বিজ্ঞানী, কখনও নাটকের মানুষেরা, কখনও সিনেমার বিশিষ্টরা, কখনও অবসরপ্রাপ্ত আমলারা, কখনও অবসরপ্রাপ্ত সেনারা, সর্বত্র একটা প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। পানসারে, লঙ্কেশদের খুন করা সত্ত্বেও এই প্রতিবাদ হচ্ছে। কৃষকদের দীর্ঘ মিছিল হচ্ছে। কানহাইয়া কুমার-সহ এক ঝাঁক নতুন তরুণ নেতা চলে এসেছেন সামনের সারিতে। এটাই আমাদের যা ভরসার কথা।
ভবিষ্যতই বলবে জয়শ্রীরামের থেকে ইনকিলাব জিন্দাবাদের জোর বেশি কিনা!