তন্ময় চক্রবর্তী
“If more politicians knew poetry, and more poets knew politics I am convinced, that the world would be a better place in which to live.”
John F Kennedy
ভিলানিয়াসে তখন সোভিয়েত শাসন। এক কবি তাঁর যৌবনের শহর থেকে পালিয়ে চলে এলেন নাৎসি অধিকৃত ওয়ারশ’তে। সেখানে তখন সমাজতান্ত্রিক প্রতিরোধ চলেছে। কবি হয়ে উঠলেন ওয়ারশ’ প্রতিরোধের একজন। নাৎসি-বিরোধী গোপন কবিতা সংকলন করতেন রাতের অন্ধকারে। কবির নাম চেসোয়াভ মিউশ। আজন্ম প্রতিবাদী এই কবি পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেননি, কিন্তু নিজেকে পোলিশ কবি বলতেন। ‘ডেডিকেশন’ কবিতায় লিখেছিলেন,
‘What is poetry
Which does not save nations nor people?’
ফরাসি প্রতীকীবাদী কবিদের মত তিনি বিশুদ্ধ কবিতার রাজ্যে পালিয়ে যাননি। প্রথাগত নন্দনবোধ ও শিল্পভাবনার বাইরে তিনি তৈরি করলেন প্রতিবাদী দ্বন্দ্বের স্বর।
প্রতিবাদী কবিতা মানেই তাকে রাজনৈতিক হতে হবে এমন কোনও নির্ধারিত হিসেব নেই। প্রতিবাদের উৎস হতে পারে মানুষ। বিশেষ করে নিপীড়িত, প্রতারিত ও শোষিত অবহেলিত যারা। এমন এক কবি ছিলেন ল্যাংস্টন হিউজ। আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করেও কালো মানুষদের দাবির কথা বলেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। তাঁর ‘Negro speaks of River’ কবিতাটি পৃথিবীতে আলোড়ন ফেললেও তার প্রতিবাদে ছিল কালো মানুষদের আভিজাত্য, আত্মার গভীরতা ও বর্ণবিভক্ত সমাজের বিরুদ্ধে মূর্ত প্রতিবাদ।
ল্যাংস্টন হিউজ
‘আমি এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি
যেখানে মানুষ মানুষকে ঘৃণা করে না’।‘আমি এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি:’ ল্যাংস্টন হিউজ
প্রতিবাদী কবিতার ইতিহাস কালো কবিদের (ব্ল্যাক পোয়েটস) কলমের রক্তে মিশে আছে। এক নিগ্রো ক্রীতদাসী ছিলেন। ফিলিস হুইটলি। হঠাৎ করেই কাব্যগ্রন্থ লেখেন। ‘Poems on various subjects, religious and moral’. হইচই পড়ে যায়। এই কবিতার বই যেন তাঁর দাসত্বের প্রতিবাদ। বইটি লিখে দাসত্বের জোয়াল থেকে মুক্তি পান হুইটলি।
এক-আধটা ছোট ছোট প্রতিবাদে দু’একটা এমন কাণ্ড ঘটেই থাকে। কিন্তু তাতে সামাজিক নীতির কোনও পরিবর্তন হয় না। তাছাড়া লেখাপড়া জানা চাকর-ক্রীতদাস নিয়ে বড়লোক প্রভুদের অসুবিধেই হচ্ছিল। কাজেই আশ্চর্য আইনে বন্ধ হয়ে গেল কালো মানুষদের লেখাপড়া। অতএব বন্ধ হল কবিতার বই ছাপা। এখানে কবিতা মানেই প্রতিবাদ। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে লেখা হত কবিতা। ছাপা বন্ধ তাই, মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ত অলিতে গলিতে বাজারে কারখানায় আড্ডায়। আজন্ম ক্রীতদাস কবি ফ্রেডরিক ডগলাস জানালেন প্রথম প্রতিবাদ। যুদ্ধ করেছিলেন নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য। এই অন্ধকারের সময় কালো কবি লেখকদের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান ঘটে। যার পোশাকি নাম ‘হারলেম রেনেসাঁ’। নিউ ইয়র্ক শহরে তৈরি হয় ক্লাব। নাম, ডার্ক টাওয়ার। এইখানে বসে অজস্র প্রতিবাদী কবিতা তৈরির সময় নিগ্রো কবিরা দুঃখ করে বলতেন, সমালোচকরা তাঁদের কবি বলেন না। বলেন, নিগ্রো কবি, ব্ল্যাক পোয়েটস।
কবিতা, সে যখন প্রতিবাদ হয়ে ওঠে, তখন প্রাচীন লাতিন শব্দ ‘niger’ (কালো) আর স্প্যানিশ পোর্তুগিজ শব্দ ‘Negro’ নামে নিরপরাধ শব্দটি আমেরিকাতে জন্ম দেয় পল লরেন্স ডানবার, ক্লড ম্যাককে, জোসেফ সাইমন পটার, মেলভিন বি টোলসন, ফ্র্যাংক হর্ন… এবং আফ্রিকার ডেভিড ডিওপ, কালুঙ্গানো, ডেনিস ব্রুটাস এবং অ্যান্টনিও জ্যাসিন্টোকে।
‘ওই বিরাট খামারটাতে কোনও বৃষ্টি হয় না
আমারই কপালের ঘাম দিয়ে গছগুলোকে তৃষ্ণা মেটাতে হয়’‘মোনান গাম্বি:’ অ্যান্টনিও জ্যাসিন্টো
রাজনীতি এবং বিপ্লবের সঙ্গে প্রতিবাদী কবিতা মিশে গিয়েছিল এই বাংলাতেও। ষাটের দশকের মাঝামাঝি নকশালবাড়িতে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ। শহরে, গ্রামে নতুন আন্দোলনের ঢেউ। রাজনৈতিক তত্ত্ব ও প্রয়োগের মতবিরোধ। সাংবিধানিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, টালমাটাল সময়। ইতিহাস আজও চর্চা করে বরানগর কাশীপুর বারাসত বেলেঘাটার গণহত্যা। কাব্যগুণ ছন্দের নৈপুণ্য ভেঙে ক্রোধ প্রতিবাদ দুঃখ নিয়ে জন্ম হয়েছিল একরাশ প্রতিবাদী কবিতার। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অতনু চট্টোপাধ্যায়, নবারুণ ভট্টাচার্য, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, এমনই কয়েকটি নাম পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠে প্রতিবাদী কবিমুখ।
নবারুণ ভট্টাচার্য
‘কবিতার প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হোক
বাংলাদেশের কবিরাও লোরকার মতো প্রস্তুত থাকুক
হপ্তার শ্বাসরোধের লাশ নিখোঁজ হওয়ার
স্টেনগানের গুলিতে সেলাই হয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত থাকুক’‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না:’ নবারুণ ভট্টাচার্য
রাজতন্ত্র এবং বুর্জোয়া ব্যবস্থা যখন ভেঙে পড়েছে, রাস্তাঘাটে সোচ্চার মানুষ কবিতার পুরনো ধ্যানধারণাকে ভেঙে চুরমার করে কবিতায় আনলেন এক আশ্চর্য প্রতিবাদ, নতুন পদ্ধতি, আধুনিকতা। থাকতেন একটা ভাঙা বাড়িতে। চরম দারিদ্র্য। তার হাতে উঠে এল নতুন কবিতার নায়ক বিপ্লব। দস্তয়েভস্কি, পুশকিন যেমন গদ্যে, তেমনই কবিতায় মায়াকোভস্কি। তার কবিতায় শোষিত এবং সর্বহারার প্রতিবাদ, এসেছে পার্টি, অভ্যুত্থান, নতুন অর্থনৈতিক নীতি। শ্রমিকদের ভিড়ে কারখানার গেটে দাঁড়িয়েছেন, চিৎকার করে কবিতায় জানিয়েছেন তাঁর ক্ষোভ। প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিরোধে তাঁর কবিতায় এসেছে ব্যঙ্গ ও হিংস্রতা। তার কবিতাও অন্যরকমের প্রতিবাদী।
মায়াকোভস্কি আমাকে একটা প্রয়োজনীয় জিনিস বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
‘হাজার হাজার মানুষের জন্যই কবিতা।
সেই মানুষের জন্য, যাঁরা পৃথিবীটাকে বদলাতে চায়’ (লুই আরাগঁ)
৯ মার্চ, ১৯৫১। রাওয়ালপিণ্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি হলেন এক কবি। নির্জন সেল। কাগজকলম নেই। একটুকরো কাঠকয়লা সংগ্রহ করে দেওয়ালে ফুটিয়ে তুলতেন কবিতা। ফাঁসির দড়ি গলায় পড়েনি কিন্তু কাটিয়েছেন পনেরোশো দিনের বন্দি জীবন। জন্ম নিয়েছে প্রতিবাদের ভাষা ‘রাত দি রাত’।
‘সাধারণত বিপ্লবী কবিরা বিপ্লব নিয়ে হাঁকডাক আর ফাঁকা আওয়াজ তোলেন, বুক চাপড়ে হাহুতাশ করেন। কিন্তু বিপ্লবের গান কীভাবে গাইতে হয়, তা তাদের জানা নেই’।
‘বিপ্লবী কবিতা:’ ফয়েজ আফমেদ ফয়েজ
ট্রেঞ্চে গুলির আওয়াজের ভিতরে দাঁড়িয়েই কবি অনুভব করেন একটা উলঙ্গ লোক তাকে ডাকছে। তার জন্য ভোজসভা থেকে তিনি চুরি করে আনছেন রুটি। পাথরভাঙা হাতে লোকটি তা গোগ্রাসে গিলে শান্ত ঘুমিয়ে পড়ে। কবি তার পাহারাদার। জেলখানায় শ্রমিক মহল্লায় মার খাওয়া মানুষের জন্য প্রতিবাদ কবিতার শিল্প তৈরি করেছেন ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ।
‘আমার কালি ও কলম
ওরা কেড়ে নিয়েছে।
ক্ষতি কী?
আমার আঙুল আমি ডুবিয়ে নিয়েছি আমারই বুকের খুনে’‘কালি ও কলম:’ ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ
অনুবাদ- অমিতাভ দাশগুপ্ত
ফয়েজ আহমেদের প্রতিবাদী কবিতার কথা এলেই মনে পড়ে তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের কথা। দেশ ছেড়ে পালাতে হয় এই কবিকে। কামাল আতাতুর্কের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। তাঁর কবিতায় গ্রীসের আক্রমণকারীদের দেশের বুক থেকে বিতাড়ন করার আহ্বান ছিল। দিনের পর দিন নির্জন কারাগারে বন্দি ছিলেন। আনাতোলিয়ার জেলে বন্দি থাকাকালীন কৃষকদের সংস্পর্শে আসেন। জেলের মধ্যে লেখা কবিতাগুলি বাইরে পাঠাতে থাকেন। শাসকশ্রেণির হাতে তাঁর ফাঁসি হয়েছিল। কিন্তু বন্ধ হয়নি তাঁর প্রতিবাদী কবিতা। লিখেছেন জেলখানার চিঠি।
‘যারা ধবংস করে
যারা সৃষ্টি করে
কেবল তাদেরই জীবনবৃত্তান্ত মুখর আমার গানে’‘আমি জেলে যাবার পরঃ’ নাজিম হিকমত
অনুবাদ- সুভাষ মুখোপাধ্যায়
নাজিম হিকমত
আরেক কবি নেমে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মল্লভূমিতে কবিতার হাতিয়ার নিয়ে। পাবলো নেরুদা।
‘জাগো বেড়াভাঙা মানুষেরা জাগো’, ‘মাদ্রিদে পৌঁছল আন্তর্জাতিক প্রতিরোধ বাহিনি’, ‘কয়েকটা ব্যাপার বুঝিয়ে বলছি’ এরকম বহু কিছুই ছিল প্রতিবাদের অপর নাম। ১৯৩৬ সাল, স্পেনের কবি লোরকা অতর্কিতে নিহত হন ফ্যাসিবাদী ঘাতকের হাতে। কবিবন্ধুর নির্মম ওই রাজনৈতিক হত্যা প্রতিবাদী করে তুলেছিল এই কবিকে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন গণজীবনে কবি – Peoples Poet..
‘আরও তোমরা জানতে চাইবেঃ ওর কবিতা কেন বলে না
স্বপ্নের কথা কিংবা সবুজ পাতার কথা… এসো, দেখে যাও কত রক্ত ঝরেছে পথে পথে’
‘কয়েকটি ব্যাপার বুঝিয়ে বলছি’: পাবলো নেরুদা
অনুবাদ: অশোক রাহা
পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে প্রতিবাদী কবিতা লিখেছেন এদুয়ার্তো গালেয়ানো, মেহমুদ দারভিস, আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখছেন যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদী কবিতা। পাশের দেশ বাংলাদেশ। আবদুল গফফর চৌধুরী লিখেছেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদ প্রতিবাদী ছাত্রনেতা আসাদ। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন কবি শামসুর রাহমান ‘আসাদের শার্ট’। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রেডিওতে প্রচারিত হেলাল হাফিজের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ এক জীবন্ত প্রতিবাদ। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে রফিক আজাদ লিখেছেন প্রতিবাদী কবিতা ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব’।
সামাজিক প্রতিবাদে মুখর ছিলেন কলকাতার কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আস্ত একটা প্রতিবাদের কবিতার বই লিখেছেন সুবোধ সরকার। জেদি তরুণ কবি শ্রীজাতর কলমের আগুনে প্রতিবাদ ‘অন্ধকারের লেখাগুচ্ছ’। জয় গোস্বামীর বলিষ্ঠ কলম ‘পান্তাভাতে নুনের ব্যবস্থা’ করতে বলেছেন।
ময়দান ভারি হয়ে নামে কুয়াশায়
দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুট মার্চ
তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?
নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই
তোমার ছিন্ন শির, তিমির।‘আন্দোলন: তিমির বিষয়ে দু’টুকরো’— শঙ্খ ঘোষ
যতদিন সামাজিক বৈষম্য, যুদ্ধের হুংকার ও রাজনৈতিক হিংস্রতা থাকবে, ততদিন কোনও না কোনও কবির কলম প্রতিবাদী হবেই। সময় ও ইতিহাস ধরে রাখবে তাকে।