Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নাগরিক শিক্ষার রক্তক্ষরণ: ফিরে দেখা বিড়লা-আম্বানি রিপোর্ট

শুভার্থ মুখার্জ্জী

 

‘পড়াশুনো করে যে, গাড়ি চাপা পড়ে সে’ কিংবা ‘এরা যত বেশি পড়ে তত বেশি জানে তত কম মানে’ – এমন মজার ছড়াগুলোর পরেই মনে আসে যার কথা, সে রাশভারী হীরকের রাজা। তাঁর নির্দেশে উদয়ন পন্ডিতের টোল উঠে যায়। মগজ ধোলাই যন্ত্র কচিকাঁচাদের মাথায় ভরে দেয় আনুগত্যের অমোঘ বাণী – ‘যায় যদি যাক প্রাণ/হীরকের রাজা ভগবান’।

দিন পাল্টেছে। সেই হীরকের রাজা নেই। সেই বিশাল হীরার খনিও নেই। কিন্তু কেমন আছেন উদয়নরা? টোলগুলো কী আদৌ টিঁকে থেকেছে? শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কী স্রেফ গাড়ি চাপা পড়া নাকি আরো অন্যকিছু?

নব্বইয়ের দশকের শেষভাগ। কেন্দ্রে রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে বছরখানেক আগে। বিশাল পরিমাণ কর্পোরেট পুঁজির সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসীন সরকার। পুরোদমে চলছে অর্থনীতির উদারীকরণ, রমরমা খোলাবাজার। বেসরকারিকরণের হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে যথারীতি। বাদ থেকে গিয়েছিল শুধু একটা সেক্টর – শিক্ষা। শিক্ষাক্ষেত্র তখনও সরকারের দ্বারা সর্বাধিক নিয়ন্ত্রিত। শিক্ষার্থী কতটা পড়বে, কী কী শিখবে সিলেবাসে, বেতন, ভর্তি, কিছুকিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ – পুরোটাই শক্ত আইনকানুনে বাঁধা। ফলতঃ আর পাঁচটা পাবলিক সেক্টরের মতো এখানে আঁচড় কাটা ততটাও সোজা নয় – বুঝে গেছিলেন শিল্পপতিরা।

কিন্তু সর্বগ্রাসী থাবা সর্বগ্রাসী থাবা বেশিদিন আটকানো যাবে না, তা টের পাওয়া গেল ২০০০ সালে। তৎকালীন ‘Prime Minister’s Council on Trade and Industry’-এর কাছে সারা দেশে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের নীল নকশা পেশ করলেন দুই শিল্পপতি মুকেশ আম্বানি আর কুমারমঙ্গলম বিড়লা। লক্ষণীয়, এই দুজনের কেউই না শিক্ষাবিদ, না কোনোদিন জনশিক্ষা সম্পর্কিত কাজকর্মে যুক্ত। এদের প্রকাশ করা রিপোর্টেই আজ নির্ধারিত হতে চলেছে দেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ।

কী আছে এই রিপোর্টে?

শুরুতেই বলা হয়েছে এর উদ্দেশ্য ‘Knowledge based economy’; অর্থাৎ সোজাসুজি ভাষায় মেধা/জ্ঞানের পণ্যায়ন ও সেইসূত্রে বাণিজ্যিক মুনাফালাভ। প্রসঙ্গত, বর্তমানে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক লাভজনক রপ্তানি বিনোদন শিল্পের উৎপাদন। কোনও বস্তু নয়, মেধাজাত পণ্য (‘Weightless good’) হল বিশ্বায়নের যুগে সর্বাধিক লাভজনক ব্যবসার উপাদান। রিপোর্ট অনুযায়ী এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য দরকার ‘দেশের শিক্ষাক্ষেত্রের জড়তামুক্তি’। কেমন এই জড়তা? আগেই বলা হয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারী নিয়ন্ত্রণের কথা। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রটি এতদিন ছিল প্রায় পুরোটাই সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন। তাতে হয়তো ঝাঁচকচকে জৌলুস ছিল না, ছিল প্রান্তিক গাঁয়ের চাষার ছেলেটার উচ্চশিক্ষার সুযোগ। ছিল সাধ্যের মধ্যে সেমেস্টার ফি, কলেজ ক্যান্টিনে আয়ত্বের মধ্যে সুলভ মূল্যে খাবার, কমপয়সায় হস্টেলে মাথা গোঁজার জায়গা। বেসরকারী পুঁজির কোনও জায়গাই ছিল না সেই অর্থে। রিপোর্টে বলা হল সরকারি ও বেসরকারি মিশ্র উদ্যোগের কথা। কেমন হবে সেই মিশ্র উদ্যোগ?

‘Government must focus strongly on primary and secondary education and leave higher and professional education to private sector’.

অর্থাৎ ‘সাংবিধানিক বাধ্যতা অনুযায়ী কেবল চৌদ্দ বছর বয়স অব্দি’ শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার দায়ভার নেবে সরকার। তারপর বাকি গোটাটাই কর্পোরেটের জন্য খোলামাঠ। পরের গল্পটা সহজেই অনুধাবন করা যায়। লাগামছাড়া সেমেস্টার ফি, ডিজিটালাইজড উচ্চবিত্তের আয়োজনে শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে পয়সাওলার ছেলেমেয়ে বাদে বাকিরা পড়ার স্বপ্নটাও দেখে না। বাকিসব খোলামুকুচিরা অষ্টম শ্রেণী অব্দি রাষ্ট্রের জিম্মায় পড়ে বইপত্রের জগৎ থেকে পত্রপাঠ বিদায়। তাদের পরবর্তী শিক্ষা ও চাকরীর ভবিষ্যৎ অকূল পাথারে।

রিপোর্টে ঘোষিত লক্ষ্য ‘A knowledge revolution that induces a market oriented competitive environment’। কীভাবে আসবে সেই মেধা-প্রযুক্তি বিপ্লব, তার রূপরেখা ও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রিপোর্টে বিস্তারিতভাবে।

১. রাষ্ট্র প্রাথমিক ও দ্বিতীয়ক্রমিক শিক্ষার ভারটুকু গ্রহণ করবে, কিন্তু পরবর্তী অংশ ছেড়ে দিতে হবে বেসরকারিক্ষেত্রের হাতে। সেখানে সরকারের কোনওরকম নাকগলানো চলবে না।
২. নির্দিষ্ট রেগুলেশনের মাধ্যমে ক্রমান্বয়িক শিক্ষক প্রশিক্ষণ।
৩. ইনফর্মেশন টেকনলজির প্রয়োগে ও কর্পোরেট বিনিয়োগের সহায়তায় ‘স্মার্ট স্কুল’ তৈরী।
৪. সেনসরি লার্নিং পদ্ধতির প্রয়োগ।
৫. প্রয়োগ ও অভিজ্ঞতার উপর জোর দেওয়া, যেখানে শিক্ষক সহায়কের ভূমিকা পালন করবেন।
৬. বাধ্যতামূলক, নিবিড় ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে প্রায়োগিক জ্ঞানের বিকাশ।
৭. দূরশিক্ষার প্রসার।
৮. একটি জাতীয় সিলেবাসের ছাতার তলায় গোটা দেশের শিক্ষাকে নিয়ে আসা, যেখানে কিছুটা অব্দি আঞ্চলিক ভাষাগত পরিবর্তন ঘটানো গেলেও মূলসুর একই থাকবে।
৯. পেশাগত কোর্সগুলিতে ভর্তির জন্য কমন অ্যাডমিশন টেস্টপ্রথার সূচনা। মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট ব্যবস্থার বিলোপ। প্রফেশনাল ক্রেডিটের ভিত্তিতে পড়ুয়া এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে পড়তে যেতে পারবে।
১০. স্কুলস্তর থেকেই শিক্ষাব্যবস্থাকে বাজারের উপযোগী করে তোলা, যাতে উৎপাদিত মেধা খোলাবাজারে যথোপযুক্ত ব্যবহারের সর্বাধিক সম্ভাবনা সৃষ্টি করা যায়।
১১. সরকারি কোষাগারের শিক্ষাব্যবস্থায় বরাদ্দের পুরোটাই যাবে স্কুলস্তরে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সরকারি অনুদান ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনতে হবে।
১২. প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করার মধ্যেই সরকারের দায় সীমাবদ্ধ থাকবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আংশিক অনুদান চাইলে দিতেও পারে। উপযুক্ত ‘শিক্ষা-লোন’ – এর ব্যবস্থা করা।
১৩. সংসদে ‘প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বিল’ প্রণয়ন, যা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ণ স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করে।
১৪. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে রেটিংব্যবস্থা প্রণয়ণ।
১৫. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজিবিনিয়োগের রাস্তা খুলে দেওয়া।
১৬. ভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে উৎসাহপ্রদান; সেন্টার অফ এক্সেলেন্সগুলিতে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল প্রতিষ্ঠা।
১৭. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে যেকোনোরকম সাংগঠনিক/রাজনৈতিক/দাবিদাওয়াভিত্তিক ক্রিয়াকলাপ নিষিদ্ধ করা।
১৮. অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ আলগা করা।
১৯. বাজারে শ্রমশক্তির প্রয়োজন মেটাতে বিভিন্ন আঞ্চলিক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও ITI প্রতিষ্ঠা।

এসব হল অ্যাজেন্ডার ফিরিস্তি। ‘মিছরির ছুরির’র আড়ালে ছত্রে ছত্রে একটাই কথা ফিরে আসে বারবার – নাগরিকশিক্ষার দায়িত্ব থেকে সরকারের দায় ঝেড়ে ফেলা। রিপোর্টে বলা হয়েছিল ২০১৫ সালের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারী ব্যয় ১১৭০০০ কোটিতে নামিয়ে আনা। বর্তমানে সেটা ১৩৯০০০ কোটি।কাছাকাছি নামিয়ে আনা হয়েছে অনেকটাই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী মধ্যশিক্ষা, অর্থাৎ দ্বাদশ শ্রেণী পাশের পর উচ্চশিক্ষাগ্রহণে যাওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৬%। হ্যাঁ ঠিকই দেখছ। সংখ্যাটা দুই অঙ্কেও ঠেকেনি। তাহলে আগত ভবিষ্যতে যখন সরকার দায়মুক্ত হয়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রটি তুলে ধরবে শিল্পপতিদের মুখের সামনে, তখন তোমার পরের প্রজন্মের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎটা কোথায় ঠেকবে আন্দাজ করতে পারছ তো?

আবার অ্যাজেন্ডায় উল্লেখ আছে পড়াশোনার উচ্চ ব্যয় যদি কেউ বহন করতে না পারে, তার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।

লক্ষণীয়,মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলেটা বা মেয়েটা দীর্ঘ পাঁচ-ছয় বছরের ‘পড়াশোনার দাম’ শোধ করতে পারবে তখনই যখন পড়ার শেষে একটা চাকরি জুটবে, অর্থের সংস্থান হবে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেটারই নিশ্চয়তা কোথায়? তাহলে কী হবে পাহাড়প্রমাণ লোন কাঁধে নিয়ে থাকা বেকার পাশ করা ছেলেমেয়েগুলোর?

শিক্ষান্তে কর্মসংস্থানের দায়িত্ব না নিয়ে ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার নির্মম রসিকতাটা না করলেও হত!

ঘোষিতভাবে না হলেও কাজেকর্মে স্পষ্টতই লাগু হচ্ছে এই রিপোর্টের নির্দেশাবলি। অতি সাম্প্রতিক অটোনমি বিলে উঠে এসেছে রেটিং সিস্টেম। অটোনমাস স্ট্যাটাস দেওয়ার নাম করে তুলে নেওয়া হচ্ছে নতুন করে গবেষণা শুরু করার সরকারী অনুদান। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর আসনসংখ্যা প্রায় ১১০০ থেকে একলাফে কমিয়ে আনা হয়েছে ১৯৪। টাটা ইন্সটিটিউট অব ফান্ডামেন্টার রিসার্চে স্টাইপেন্ড কমেছে ৫০%। লোকচক্ষুর অন্তরালে চলছে আরো অনেক ফি হাইক, অনুদান হ্রাস। আইআইটি বম্বের সেমেস্টার ফি বেড়েছে ভয়ানকভাবে (হস্টেল রেন্ট ৩০০ শতাংশ, পরীক্ষা ফি ১০০ শতাংশ, মেডিকেল ৫০-৬০ শতাংশ, অতিরিক্ত মেস এস্টাবলিসমেন্ট চার্জ)। IISCর মতো উচ্চমানের গবেষণা-শিক্ষার কেন্দ্রে স্টাইপেন্ড কমে অর্ধেক হয়েছে, পড়াশোনার খরচ বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে – ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ নেই এমন বিষয়গুলিতে গবেষণা করতে গেলে মিলবে না আর্থিক সহায়তা। শিক্ষা হয়ে উঠছে বাজারমুখী। গলা টিপে শেষ করা হচ্ছে সোশিওলজি, উইমেন্স স্টাডিজের মতো মানবিক বিষয়গুলোকে।

আর আমরাও ভুলে যেতে বসেছি আমাদের মৌলিক চাহিদাগুলো। নিজের ইচ্ছেমতো বিষয় নিয়ে যতদূর খুশি শিক্ষাগ্রহণ করা আমার মৌলিক অধিকার আর তার দায় নিতেই হবে রাষ্ট্রকে – দৃপ্ত গলায় ধ্বনিত হোক দিকে দিকে। বাজারের প্রয়োজনে প্রশ্নহীন অনুগত শ্রমিক তৈরী করা শিক্ষার উদ্দেশ্য নয়। প্রকৃত শিক্ষা পারিপার্শ্বিককে চিনতে শেখায়। উপলব্ধি করায় সামাজিক দায়বদ্ধতা – সাধারণ মানুষের কাছে, উৎপাদকশ্রেণীর কাছে। শেখায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে চিরাচরিতকে প্রশ্ন করতে। সেই শিক্ষাকে বেচে দেওয়ার চক্রান্তকে ব্যর্থ করতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে-ক্যাম্পাসে গড়ে তোলো প্রতিরোধ।