কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
কিচ্ছু টের পাওনি? কোনও আঁচ? টুকরো বেফাঁস মন্তব্য, ঘাড় ঘোরানোর ভঙ্গি, গলা খাঁকারি থেকে কোনও আভাস পাওনি?
শুরুতে সত্যিটা বলতাম। তারপর চুপ করে গেলাম। আমি হলেও কি বিশ্বাস করতে পারতাম? চারচারটে গ্রীষ্ম বর্ষা বসন্ত শীত একজনের সঙ্গে গোটা জীবন মাখামাখি করে থাকার পরও না জেনে থাকা সম্ভব? থাকা সম্ভব একে অপরের কাছে এতখানি অচেনা?
অন্যদের প্রশ্ন এড়িয়ে যাই, কিন্তু নিজের প্রশ্নের মুখে তো আগল দেওয়া যায় না। বসে বসে ভাবি। নিজেকে দোষারোপ করি। আমিই কি অন্ধ হয়ে ছিলাম? দেখতে চাইনি বলেই পাইনি? কখনও কখনও অন্যদের ধরে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করতে মন চায়। এমন তো নয় আমি একা দেখেছি? সংসার, সন্তান, রোজকার মিলমিশ ওঠবোস, কিছুই তো লোকচক্ষুর আড়ালে ঘটেনি। তোমরা টের পেয়েছিলে?
ঘুমঘোরে কেঁদে ওঠে কেউ, পাশ ফেরে। বিছানার ওপর গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে ওরা। আমাদের সন্তান। আমার সন্তান। ছোট ছোট হাত পা জড়িয়েমড়িয়ে। আদুড় পেট শ্বাসপ্রশ্বাসের তালে তালে উঠছেনামছে। অল্প ফাঁক হওয়া ঠোঁটের কষ ভিজে ভিজে। আমি ওদের হাত পা সরিয়ে গুছিয়ে দিই। চুমু খাই। মাথায় হাত বুলোই। শ্বাসপ্রশ্বাস ফের স্তিমিত, গভীর হয়ে আসে। কী নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে ওরা। জানে, মা আছে। আমার বুকের ভেতর কেমন করে। হৃদপিণ্ডের ওপর পাথর চাপে। ওদের যদি কিছু হয়ে যেত? কেবল আমি কিছু টের পাইনি বলে? কেবল নিজের সৌভাগ্যে অন্ধ হয়ে ছিলাম বলে?
ওদের ঘুমন্ত শরীরে নাক ডুবিয়ে শান্ত হই। জানালার ধারেফিরে আসি। আদিগন্ত প্রান্তরে প্রেতাত্মার মতো দৃশ্যেরা ভেসে বেড়ায়। কচি গলার উল্লাস। তোমাকে ঘিরে দৌড়চ্ছে ওরা, ঘাড়ে কাঁধে উঠে দস্যিপনা করছে। সব অত্যাচার তুমি হাসিমুখে সইছ। কী যত্ন নিয়ে ওদের সঙ্গে খেলছ, যাতে ওরা ব্যথা না পায়। কী করে বুঝব আমার কূলছাপানো ওই সুখের ছবির আড়ালে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে?
কেউ কেউ বলে, যা হয়েছে হওয়ারই ছিল। কারও ক্ষমতা ছিল না আটকানোর। তাছাড়া এ জিনিস আগেও ঘটেছে তো। সম্প্রতি না ঘটলেও, কেউ নিজে চোখে না দেখলেও, এ জিনিস যে ঘটে সে তো সকলে শুনে আসছে জন্মে থেকেই।
তারপর গলা নামিয়ে জানতে চায়, বাড়ির কেউ ছিল এ রকম? রক্তের দোষ? সম্বন্ধ করার আগে খোঁজ নেওয়া হয়েছিল ভালো করে?
দিগন্তে টিলাটা জেগে আছে আমার মতোই, নির্ঘুম। চুড়োর ওপর কেউ কি দাঁড়িয়ে? দ্রুত পলক ফেলে জলের পর্দা সরিয়ে ফের তাকাই, ছায়া উবে যায়। চোখের ভুল।
সেদিন ভুল হয়নি। ভুল হওয়ার সুযোগই ছিল না। দুর্দান্ত গ্রীষ্মের দুপুর ছিল। রোদের আঁচড়ে খরাজীর্ণ প্রান্তর ফালাফালা হয়ে গিয়েছিল। শুকিয়ে এতটুকু হয়ে যাওয়া দিঘির চারপাশে ঠান্ডা জলের খোঁজে জড়ো হয়েছিল অনেকেই, কেউ কেউ গাছের তলায় জিরোচ্ছিল। আমি কী করছিলাম, ঘরের কাজ, নাকি নিজেকে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখছিলাম জলের আয়নায়, ভুলে গেছি। খালি মনে আছে কার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে ঘাড় ঘোরানোর মাঝপথেই টিলার মাথায় দৃষ্টি আটকেছিল।
অনেকেই দেখেছিল। সূর্য আড়াল করে টিলার চূড়ায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকা শরীরটা। তাকিয়ে আছে আমাদের গ্রামের দিকে। যে যার হাতের কাজ ফেলে, গুটি গুটি জড়ো হয়েছিলাম বড় বাবলা গাছটার নিচে।
তুমি নেমে এলে। ত্বরাহীন পায়ে এগোলে আমাদের জটলা লক্ষ করে। প্রতি পদক্ষেপে তোমার দীর্ঘ, শক্তিশালী চেহারা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হল। আমরা একে অপরের আরও গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। তুমি সামনে এসে দাঁড়ালে। তোমার সারা শরীর থেকে সংযত শক্তির বিচ্ছুরণ আমাদের চুপ করিয়ে দিয়েছিল। শান্ত, গভীর, তীক্ষ্ণ চোখ মেলে তাকালে তুমি আমাদের দিকে।
সেই মুহূর্তেই সবাই নিঃসন্দেহ হয়েছিল, তুমি নেতা। তুমিই।
তুমি সবার থেকে শক্তিশালী ছিলে অথচ কখনও সে শক্তির আস্ফালন দেখিনি তোমার ভেতর। তুমি নিজের শক্তির মাপ জানতে, তাই কেড়ে নিতে চাওনি কিছুই। আমাকেও না। যে চেষ্টা আগে যে অনেকেই করেছে। যবে থেকে প্রকাশ পেয়েছে, আমার এই শরীরটা হাড়, রক্ত, মাংস, লোম, স্নায়ু, ঘাম এসব ছাপিয়ে আরও সুন্দর আরও রহস্যময় কিছুর বাসা, তবে থেকে চাঁদনি রাতে মহুল বনে নাচতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ পেয়ে এসেছি আমি। কতজন আমার সাড়া না পেয়ে হতাশ হয়ে অন্য সঙ্গিনী খুঁজে নিয়েছে, বেঁকা হেসে বলেছে, এত দেমাক ভালো না। বোঝাতে পারিনি, এ দেমাকের প্রশ্ন নয়। আমি বাছছি না, আমি অপেক্ষা করছি। আমার বোন, এ পৃথিবীতে আমার সবথেকে কাছের বন্ধু, বারবার জানতে চেয়েছে, কী চাই তোর, কেমন চাই, কাকে চাই? বলতে পারিনি। আমি জানতামই না আমার কাকে চাই। শুধু জানতাম, দেখামাত্র তাকে চিনে নেব।
নিলাম চিনে। আমার অপেক্ষা ফুরোল।
আমাদের ছোট্ট বসতিতে উৎসাহের জোয়ার এল। সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে তুমি। শিকারে যেতে। প্রাচুর্যের দিনে সবাই যাতে সমান সুখী হয়, সঙ্কটের দিনে কারও যাতে কম না পড়ে, সমান নজর রাখতে। ন্যায়নিষ্ঠ ছিলে, নীরস ছিলে না। গ্রামের সবক’টা বাচ্চা তোমার বন্ধু ছিল, প্রতিটি বুড়োবুড়ির তুমি সঙ্গী। উৎসবে সবার সঙ্গে পা মিলিয়ে নাচতে, গলা ছেড়ে গাইতে। ওই একটা কাজ তুমি পারতে না। তোমার বেসুরো চিৎকারে সবাই কানে চাপা দিয়ে হেসে গড়াত, তুমি বিন্দুমাত্র না দমে আরও উৎসাহে গলা ছাড়তে।
কেবল আমাকে দেখলে তোমার সপ্রতিভতায় টান পড়ত। আমি পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে তুমি খেই হারাতে, ঘামতে অল্প অল্প। আমার অবস্থাও খুব সুবিধের ছিল না। দূর থেকে তোমাকে আসতে দেখলে হৃদপিণ্ড ধড়াস করে উঠত। দৃষ্টি মাটি থেকে টেনে ছাড়াতে পারতাম না। যে খরখরে জিভের কুখ্যাতি ছিল পাড়া জুড়ে, তাতে তালা পড়ে যেত। পাশাপাশি হেঁটে গেলে তোমার শরীরের অত কাছ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার রোমাঞ্চ জাগিয়ে রাখত সারা রাত।
চোখে পড়েছিল সবারই। না পড়াই অসম্ভব। তোমার কথা জানি না, আমার মুখের ওপর কেউ কিছু বলার সাহস করেনি। শুধু বোন, ততদিনে সংসার পেতেছে কাছেই, গায়ে ঠেলা মেরে মুচকি হেসেছিল।
ঘুচেছে? অপেক্ষা?
চোখ না বুজেই দেখতে পাই, সেদিন বসন্ত এসেছিল বনে। গাছেদের মাথা নুয়ে পড়েছিল লাল হলুদ ফুলের ভারে, সুগন্ধে উতল হয়েছিল বাতাস। গাঢ় কমলা পশ্চিমের আকাশকে পেছনে রেখে তুমি আমার দিকে হেঁটে এসেছিল রাজার মতো। আমি এগিয়ে গিয়েছিলাম তোমার দিকে রানির মতো। অকুণ্ঠিত, নিঃসঙ্কোচ। যেন ওই পথটুকু আমরা পার করেছি জন্মের পর জন্মান্তর।
এর পরের দিনরাতগুলো তোমার সঙ্গে কালবৈশাখীর ঝড়ের পিঠে, শীতের ধুলোয়, বর্ষার বন্যায় ভেসে কেটে যাওয়ার। কিছুই কি টের পাইনি? সেদিনও না? জুড়ি বাঁধার পরের প্রথম পূর্ণিমার রাতে, সবাই নাচতে যাওয়ার তোড়জোড় করছিল, যখন তুমি আমার হাত ধরে বললে, ভিড়ের মধ্যে নাচতে যেতে তোমার ভালো লাগে না, যদি না যাই আমার খারাপ লাগবে? যেদিন আমার দু’হাত ধরে দু’চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলে, আমার দুঃখ হবে খুব?
হেসেছিলাম। সে হাসি এখনও খনখন করে বুকের ভেতর। দুঃখ? দুঃখের বাষ্পও তখন আমাকে স্পর্শ সাহস পেত না। হ্যাঁ, প্রিয়তমের সঙ্গে চাঁদনি রাতে মহুলবনে নাচতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি একসময়। সে তো একসময় ডানা মেলে উড়বও ভেবেছিলাম, কল্পনা করেছিলাম ডুবসাঁতার দিয়ে পার হব তেরো নদী সাত সমুদ্দুর। স্বপ্নে কী এসে যায়। স্বপ্ন তো স্বপ্নই। তুমি তো স্বপ্ন নও, তুমি আমার বাস্তব। আমার কোনও স্বপ্নে কোনওদিন এত সুখ ছিল না, যত প্রতিদিনের ঘরকন্নায়, আদরে, ঝগড়ায় ছিল। তোমার সঙ্গে কাটানো প্রতিটি রক্তমাংসের মুহূর্তে ছিল।
না না না, আমি কিচ্ছু টের পাইনি। কিচ্ছু না। মাঝরাতে তুমি আমার পাশ থেকে উঠে যাচ্ছে টের পেয়ে আধোঘুমে জানতে চাইতাম কোথায় যাচ্ছ, তুমি বলতে, ঘুম আসছে না একটু হাওয়া খেয়ে আসছি, কোনওদিন গলায় বিন্দুমাত্র প্রতারণার চিহ্ন পাইনি। চাঁদের আলোয় জানালার পাশ দিয়ে তোমার ছায়া গেছে কখনও সখনও, সে সরণে তঞ্চকতার আভাস পাইনি। মাঝরাতে তুমি ফিরে এসে কখন পাশে শুয়ে পড়েছ, সকালে উঠে চোখে গ্লানির ছায়া দেখিনি। তোমার শরীরে অচেনা গন্ধ, পাইনি পাইনি পাইনি।
ওরা পেয়েছিল। হয়তো আমার মতো অন্ধ ছিল না বলেই। ছোটটা তখন ভীষণ চঞ্চল, একমুহূর্ত স্থির থাকতে পারে না, আর পারে না তোমাকে ছেড়ে থাকতে। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বাবা বলে কেঁদে ওঠে, সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম জানতে চায় বাবা কোথায়, রাতে তোমার মুখে গল্প না শুনে চোখের পাতা এক করে না। একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে তোমাকে বেরোতে দেখে ঘুমপায়ে তোমার পিছু পিছু বেরিয়ে গিয়েছিল বোধহয়, আমি তখন সারাদিনের পর অঘোর ঘুমে, হঠাৎ বুকের ওপর ভীষণ জোরে কী একটা এসে পড়ল। ছোটটা। দৌড়ে এসেছে অনেকটা পথ, ছোট্ট বুক উঠছে নামছে ঝড়ের মতো। সারা শরীর থরথর কাঁপছে, ভয়ে চোখ ফেটে বেরিয়ে আসছে, আতঙ্কে কথা বেরোচ্ছে না।
অনেক কষ্টে শান্ত করলাম, আমাকে আঁকড়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কান্নার দাগ শুকিয়ে গিয়েছে গালে, দুঃস্বপ্নে ছোট শরীরখানা তখনও কেঁপে কেঁপে উঠছে মাঝেমাঝে, বুকে চেপে ধরে ফিসফিস করছি, ভয় নেই, আমি আছি।
তুমি ফিরলে শেষ রাতে। আমি জেগে থাকব আশা করোনি, থতমত খেলে। রাতজাগার ক্লান্তিতে কিংবা সন্তানের অমঙ্গলের আশঙ্কাতেই, ক্ষোভ চাপার চেষ্টা করিনি। ঝাঁঝিয়ে উঠেছিলাম, কোথায় ছিলে?
উত্তর দাওনি। চোখের তলায় গভীর কালি, দৃষ্টি এলোমেলো, যেন তুমি নিজের মধ্যে নেই। কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হলে চোখ পড়ল আমার কোলে।
কী হয়েছে ওর? উদ্বিগ্ন মুখে এগিয়ে এসে আমার কোল থেকে টেনে নিজের কোলে নিতে চাইলে তুমি ছোটকে আর গন্ধের ঝাপটাটা নাকে এল আমার। বোঁটকা, নাক পুড়িয়ে দেওয়া, গা গুলিয়ে দেওয়া গন্ধটা। ছোট চমকে জেগে উঠল, আর্তনাদ করে উঠল তোমাকে দেখে। সেঁটে গেল আমার বুকের ভেতর। আমি চেঁচিয়ে বললাম, ছোঁবে না তুমি ওকে! তুমি কুঁকড়ে গেলে, তোমার চোখে পাপের ছায়া পড়ল। সেই প্রথম।
কানাঘুষো শুরু হল। এ জিনিস চাপা থাকে না। আমার চোখে চোখ পড়লে সবাই চোখ নামিয়ে নিত। আমার একটা গভীর, গোপন সর্বনাশের কথা যেন সবাই জানে, সাহস পাচ্ছে না সতর্ক করে দেওয়ার।
আরও পনেরোবার সূর্য উঠল ডুবল, এল পূর্ণচন্দ্রের রাত। ঘুম আসছিল না কিছুতেই। কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। জঙ্গলে নাচের শব্দও না। একটা গুপ্ত চক্রান্তে যেন গুমোট সারা গ্রামের আকাশবাতাস।
পাশ থেকে তুমি উঠে পড়লে। কয়েকটা দমবন্ধ করা মুহূর্ত পর আমিও।
চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছিল চারদিক। পিছু নিতে কোনও অসুবিধেই হল না। একবার ঘাড় ঘোরালেই তুমি আমাকে দেখতে পেতে, ঘোরালে না। কোনওদিকে না তাকিয়ে জঙ্গলের দিকে চললে। টলছিলে অল্প অল্প। হোঁচট খাচ্ছিলে। একবার মুখ থুবড়ে পড়লে, মন শক্ত করে রইলাম, ছুটে গিয়ে তুললাম না তোমাকে। তোমার চলা ক্রমশ ধীর, এলোমেলো হল। অতখানি দূর থেকেও তোমার হাঁপের শব্দ পাচ্ছিলাম, যেন তুমি আর চলতে পারছ না। জঙ্গল শুরু হল। তুমি ততক্ষণে পড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়েছ, প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া শরীরটা হেঁচড়ে হেঁচড়ে চলেছ সামনের দিকে।
জঙ্গলের ভেতর ন্যাড়া জায়গাটায় গিয়ে থামলে শেষমেশ। এখানে একটাও গাছ নেই, অবিরাম ঝর্নার মতো চাঁদের আলো নেমে এসেছে আকাশ থেকে। মুখ তুলে তাকালে আলোর দিকে।
তোমার সারা শরীরে মিহি কাঁপন শুরু হল। ক্রমশ কাঁপুনি বাড়ল, গোঙাতে গোঙাতে আছাড়িপিছাড়ি করতে লাগলে তুমি। যেন তোমার শরীরের ভেতর অন্য একটা শরীর চাপা পড়ে আছে, তোমার শরীর ফাটিয়ে, দুমড়েমুচড়ে বেরোতে চাইছে। তোমার হাত পা পিঠ বেঁকেচুরে যাচ্ছিল। প্রত্যেকবার ছিটকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তোমার বাদামী ঘন লোমের গোছা খসে পড়ছিল চতুর্দিকে। অবশেষে একটা প্রাণপণ গোঙানির সঙ্গে সঙ্গে তুমি শিরদাঁড়া সোজা করে, দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালে।
আমি আর্তনাদ চাপতে পারিনি। তুমি চমকে তাকালে। তোমার থ্যাবড়া, কুৎসিত মুখ থেকে কুতকুতে দুই চোখ আমার চোখে স্থির হল। আমাকে চিনতেই পারলে না। আতঙ্ক ফুটল তোমার দু’চোখে। ভয় পেলে তুমি আমাকে। আমাকে! ভাবলে আমি তোমার ক্ষতি করব। নিচু হয়ে একটা ভাঙা ডাল তুলে নিলে। মাথার ওপর তুললে। আমি তখনও ঘোরের মধ্যে, কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না, চোখের সামনে যা ঘটছে তা কি সত্যি?
চাপা গরগরানিতে ঘোর ভাঙল। আমার পিছু নিয়ে কখন সারা গ্রাম চুপি চুপি এসে পৌঁছেছে এখানে। ধ্বকধ্বক করে জ্বলছে জোড়া জোড়া চোখ। জটলার একেবারে সামনে আমার বোন। আমাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সোজা তাকিয়ে আছে তোমার দিকে। ওর দু’চোখে অত ঘৃণা কোনওদিন দেখিনি। ওর শরীরের প্রত্যেকটা লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। কান টানটান, হাঁমুখের ভেতর ঝিকিয়ে উঠছে দাঁতের ফলা। লকলকে জিভের ডগা থেকে লালার বিন্দু ঝুলছে।
সামনের দু’পায়ে ভর দিয়ে শরীরটা সামান্য নিচু করল বোন।
‘না!’ চিৎকার করে আমি তোমার দিকে ছুটে যেতে চাইলাম, ওদের থেকে তোমাকে আড়াল করতে চেয়ে, তুমি বুঝলে না, হাতের ডালখানা ছুঁড়ে দিলে আমার মাথা লক্ষ করে, দু’চোখের মাঝখানে সেটা বিঁধে গেল। চোখের কোণে শূন্যে টানটান বোনের শরীর ঝলসে উঠল। উড়ে যাচ্ছে, তোমার টুঁটি লক্ষ করে।
চোখ খুললাম যখন, সব গর্জন থেমে গেছে। চারপাশে জঙ্গলের নৈঃশব্দ্য। দু’হাতে রক্ত মুছে নিতে দৃষ্টি স্পষ্ট হল। একটু দূরে চাঁদের আলোয় ন্যাতানো ঢিপির মতো একটা কিছু পড়ে রয়েছে।
হেঁচড়ে হেঁচড়ে এগোলাম। আমার শরীর দিয়ে ঢেকে দিলাম তোমার রক্তাক্ত, দুর্বল, দুপেয়ে শরীরটা। মানুষের শরীর। বিনা খিদেয় শিকার করা, অন্যের খাবার কেড়ে খাওয়া, প্রকৃতির সমস্ত নিয়ম অস্বীকার, অগ্রাহ্য, অশ্রদ্ধা করা করা ঘৃণ্য লুণ্ঠকের শরীর। তোমার দুর্গন্ধময়, বিজাতীয় রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে রইলাম সারারাত। অপেক্ষা করলাম। হয়তো চাঁদ ডুবলে এই নির্লোম কদাকার শরীরটা ফুঁড়ে আবার সামনে এসে দাঁড়াবে আমার সুন্দর, সবল সহচর। আমার নাম ধরে ডাকবে। আমাদের সন্তানদের বুকে তুলে নেবে।
এলে না। তোমার ফ্যাটফেটে চোখের বিস্ফারিত মণিতে চাঁদ ডুবে গেল।
*****
এখনও চাঁদ ওঠে। এখনও চাঁদের আলোয় ভেসে যায় পৃথিবী, মহুলের গন্ধে ছেয়ে যায় চরাচর। ওরা এখনও জুড়ি বেঁধে জঙ্গলে যায়, গান গায়, শরীরে শরীর, হৃদয়ে হৃদয় মিলিয়ে নাচে। আমি ঘরের কোণে অন্ধকারে নিঃসাড় শুয়ে থাকি। যতক্ষণ না ওরা ডেকে ডেকে ফিরে যায়। একটু পরে জঙ্গল থেকে উল্লাস ভেসে আসে। আমাকে ছুঁতে পায় না।
শুধু আজকের মতো চন্দ্রহীন, শব্দহীন রাতগুলোতে জানালার পাশে ঠায় বসে থাকি। দিগন্তের টিলার চুড়োর দিকে তাকিয়ে। হয়তো তুমি আবার উঠে আসবে ওপার থেকে। আমার অভিশপ্ত, চন্দ্রাহত নেকড়ে রাজকুমার। টিলার ওপর দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে আহ্বান করবে আমায়। তখন অন্ধকারের ছায়ায়, সবার চোখের আড়ালে, খাঁ খাঁ প্রান্তর জুড়ে আমি নাচব তোমার সঙ্গে। চিরজনমের, চিরমরণের, চিরমিলনের নাচ।
Ursula K. Le Guin-এর ছোটগল্প The Wife’s Story অবলম্বনে