Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অযোদিয়া বুরু বাঁচাও সংহতি মঞ্চের ডাকে নাগরিক কনভেনশন: একটি কল্পবাস্তবিক রিপোর্ট

সৌরভ প্রকৃতিবাদী

 

তথ্য এবং লিখন সহায়তা — ইমন সাঁতরা

 

বিকেল পাঁচটা। ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির উল্টোদিকের ঐতিহাসিক সৌধটির সামনে অপ্রশস্ত ফুটপাথে জটলা বেড়েই চলেছে। পথচলতি মানুষের অসুবিধে হচ্ছে, কিন্তু তাঁরা এতে অভ্যস্ত৷ ১৮৭৬ সাল থেকে এই বাড়ির সামনে অধিকারের দাবিতে, স্বাধীনতার স্বপ্নে, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কত হাজারবার যে জড়ো হয়েছেন মানুষ! এই বাড়ি ইংরেজের নিপীড়নের বিরুদ্ধে বৃটিশ ভারতের রাজধানী শহরে প্রথম ভারতীয় নাগরিকদের নিজস্ব সভাগৃহ, ভারতসভা ভবন। আজও তেমনই কোনও নাগরিক জমায়েত আছে হয়তো বা।

ছেলেটি আর মেয়েটি সেন্ট্রাল থেকে মেট্রো ধরে ফিরে যাবে। দুজন নামবে দুটি আলাদা স্টেশনে। তারপর আবার কবে দেখা হবে জানে না। আজকের দেখা হওয়ার আশ্চর্য এক উপলক্ষ্য ছিল। ছেলেটি কেকেআর বনাম সিএসকে ম্যাচ দেখতে গিয়েছিল ইডেনে। সে কেকেআর’এর ডাইহার্ড ফ্যান। মেয়েটি ততটা ক্রিকেটপাগল নয়, কিন্তু ধোনির অন্ধভক্ত। ইডেন থেকে মেয়েটির জন্য সে জোগাড় করেছে এক মহার্ঘ উপহার। মেয়েটি নিজে হাতে ধোনির ছবি এঁকে যে টিশার্ট উপহার দিয়েছিল ছেলেটির জন্মদিনে, তার উপর এক কাণ্ড করে এনেছে সে; স্বয়ং মহেন্দ্র সিং ধোনির অটোগ্রাফ নিয়ে এসেছে। তা দেখে মেয়েটির হৃৎপিণ্ডটাই আরেকটু হলে লাফিয়ে পড়ত ছেলেটির হাতে।

সিকিউরিটির বেড়া গলে ধোনির কাছ পর্যন্ত পৌঁছনোর মহাকাব্যিক আলাপেই কেটে গেছে অনেকটা সময়। ভাত খেয়েছে সস্তার পথচলতি হোটেলে। তারপর একটা অবাস্তব জ্যোৎস্নারাত একসাথে কাটানোর পরিকল্পনা করতে করতে বৈশাখের খরদুপুরে কলকাতা শহরের শেষ কটা গাছ আর ইঁটকাঠের খাড়া দেওয়ালের ছায়া থেকে ছায়ান্তরে ঘুরে ঘুরে বেরিয়েছে। এই জায়গায় এসে ওরা কোনও একটা রাজনৈতিক দলের সভার ভিড় ভেবে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। তাদেরই বয়সী কয়েকজন ছেলেমেয়েকে ভারতসভার ততোধিক অপ্রশস্ত প্রবেশমুখের পাশে কাপড়ে লেখা ব্যানার টাঙাতে দেখে থমকাল তারা। ব্যানারে লেখা ‘পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে ঠুড়্গা পাম্পড স্টোরেজ প্রজেক্টের নামে প্রকৃতি ও মানবাধিকার ধ্বংসের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে অযোদিয়া বুরু বাঁচাও আন্দোলন সংহতি মঞ্চের ডাকে নাগরিক কনভেনশন। ২৪ এপ্রিল, বিকেল ৫টা, ভারতসভা হল’। দুজনে অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কেউ খেয়াল করল না প্রেমাতুর যুগলের সেই অভাবিত আশঙ্কার পারস্পরিক চাহনি। করলে জানত, সেই কাল্পনিক যুগলযাপনের জ্যোৎস্নাধোয়া স্বপ্নরাতটি তারা কোথায় কাটাবে তাই নিয়ে বিস্তর আলোচনার পর; দীঘা, মুকুটমণিপুর, তাজপুর, বকখালি নাকচ হতে হতে কিছুক্ষণমাত্র পূর্বে পুরুলিয়ার আদিম অযোধ্যার শাল্মলী অরণ্যানীতে থিতু হয়েছিল।

আজ শহর ও শহরতলি থেকে নানা আদর্শ মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির নাগরিকরা জড়ো হয়েছেন। রয়েছেন ছাত্রছাত্রী, ভ্রমণপিপাসু, পর্বতারোহী, বণ্যপ্রাণ সংরক্ষক, গণবিজ্ঞানকর্মী, লেখক-লেখিকা, কবি ও পত্রিকাসম্পাদক, প্রাইভেট ও সরকারি অফিসের সাধারণ কর্মচারী, স্কুলশিক্ষক, সমাজের আমূলরূপান্তরকামী মানুষজন এবং অযোধিয়া বুরুর ১২ জন অধিবাসী, এই অসম যুদ্ধের অকিঞ্চিৎকর সেনানী। এইসব পরিচয়-চিহ্নের বাইরেও অনেকে আছেন। যেমন ওই আশঙ্কাপীড়িত কুণ্ঠাজড়ানো প্রেমিকযুগল। দোতলার বিশাল হলঘরটায় ঢুকে তাদের অনভ্যস্ত চোখ চরকির মতন ঘুরে বেড়াল। প্রাচীন খড়খড়ি জানলায় ছাত্রছাত্রীরা ডবলটেপ দিয়ে রঙিন কাগজে রঙিন কালিতে লেখা-আঁকা পোস্টার সাঁটছে। ‘ঠুড়্গা কাঁদে, বাঁদু কাঁদে, কাঁদে কাঠলাজল,/ কাঁদবে এবার অযোধ্যাবাসী ঝরবে চোখের জল’। তলায় লেখা ‘অযোধ্যাবাসী’। মেয়েটি জিগেস করল ছেলেটিকে, এগুলো তো এখানকার ছাত্রছাত্রীরা লিখেছে। অযোধ্যাবাসী তো লেখেনি। তাহলে ওদের নামে চালাচ্ছে কেন?

ছেলেটিরও সে কথাই মনে হল। ইতিমধ্যে ওদের কে যেন বলেছে বসতে। ওরাও মঞ্চ থেকে দূরে আবলুসকালো বেঞ্চিগুলোর একটায় একেবারে দরজার দিক ঘেঁষে বসে পড়ল। কী হচ্ছে, ব্যাপার বুঝে এখুনি ওদের উঠতে হবে। বেশি রাত হলেই বাড়িতে উল্টোপাল্টা সন্দেহ করবে। ইতিমধ্যে একটি মেয়ে অ্যাটেন্ডেন্স শিটটা সই করার জন্য এগিয়ে দিল। ছেলেটি সই করল নম্বর দিল ইমেইল আইডি আর ঠিকানা লিখল। মেয়েটি নাম ঠিকানা লিখলেও ফোন নম্বরে অস্বস্তিবশত একটা ডিজিট ভুল দিল। সভা শুরু হল ঠিক সাড়ে পাঁচটায়। একদল ছেলেমেয়ে খালি গলায় হিন্দিতে যে গানটা গাইল তা ওরা শোনেনি কখনও। ‘গাঁও ছোড়ব নহি, জঙ্গল ছোড়ব নহি মায় মাটি ছোড়ব নহি লড়াই ছোড়ব নহি’। জঙ্গলের প্রাণে প্রাণ আদিবাসীরা প্রশ্ন করছে বাঁধ বানিয়ে গ্রামঘর বন ডুবিয়ে অভয়ারণ্য বানিয়ে তোমরা আমাদের সব কেড়ে নিয়েছ। আমাদের নদনদীকে বিষিয়ে দিয়েছ আবর্জনায়। আর তোমরা মাটির গভীর থেকে জল তুলে কেনাবেচা করছ বিসলেরি পেপসি কোকাকোলার বোতলে। শেষের দিকে গানের ভিতর থেকে কোটিকোটি আদিবাসী ডাক দেয় ‘বীরসা পুকারে একজোট হো, ছোড়ো ইয়ে খামোসি/ মাছওয়াড়ে আও দলিত আও, আওরে আদিবাসী/ ক্ষেতখনি সে জাগো রে, নাকাড়া বাজাও/ লড়াই ছোড়ে চারা নহি শুনরে দেশবাসী’। বিদ্যুৎশিহরণ খেলে যায় দুটি আকাঁড়া ছেলেমেয়ের শরীরে। এমন শিহরণ ওদের আগে একবারই লেগেছে যুগলে। হাতে হাত না রেখে এ ঢেউ সামলানো যায় না। তাই হলভরা মানুষের ভিড়েও দুটি হাত ছুঁয়ে থাকে আড়ালে।

আগত প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে খসড়া প্রস্তাব। সেটি মঞ্চ থেকেও পড়ে শোনালেন একজন। মঞ্চে রয়েছেন, ঠুড়্গা প্রকল্পের বিরুদ্ধে অযোধ্যাবাসী যে মামলা করেছেন তার উকিল অম্বর মজুমদার, প্রাণপ্রকৃতির উপর পুঁজি ও প্রযুক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার লেখক জয়া মিত্র, পরিবেশইতিহাসবেত্যা ও কর্মী শান্তনু চক্রবর্তী, পুঁজির একচেটিয়া আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী আশীষকুসুম ঘোষ এবং তিনজন লড়াকু অযোধ্যাবাসী। এদের সবার মধ্যে তাঁদের স্পষ্ট চেনা যায়। মধ্যমণি হয়ে স্থিরচিত্তে বসে আছেন ৭৩ বছর বয়সী রবি বেসরা। তাঁরা তিনজন এরপর গাইলেন নিজেদের সদ্যপ্রস্তুত গান; সাঁওতালি ভাষায় হাজার হাজার বছরের পারম্পরিক সুরে। ছোট গান, কিন্তু এত সুদূরপ্রসারী তার আবেশ, সকলেই কমবেশি আচ্ছন্ন হলেন। আবারও কেউ বুঝতে পারল না, দরজার দিকের বেঞ্চিতে জড়োসড়ো দুটি কপোত-হৃদয়ে কল্পিত শালবনানীর জ্যোৎস্নারাত নেমে এল যেন! গানটির ভাঙা ভাঙা বাংলা তর্জমা করে দিলেন সদ্য কৈশোর পেরনো অযোদিয়া যুবক ধীরেন। সহজ কথা— “আমাদের গাছ ছিল, তাই বৃষ্টি ছিল, তাই শস্য ছিল… এখন গাছ নেই, বৃষ্টি নেই, ফসল ফলে না…”

ধীরেন যোগ করল, একটা প্রজেক্টেই অর্ধেক পাহাড় গেছে, লাখ লাখ গাছ কাটা পড়েছে, ডুবে গেছে স্ফীতোদর ‘ড্যাম-সমুদ্র’ (পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজের জলাধারকে এ নামেই লিফলেটে লিখেছেন অযোধ্যাবাসী)-এর জলে। ঠুড়্গা প্রজেক্ট হলে বাকিটাও যাবে। শুধু শাল মহুয়া নয়, ওষুধবিষুধ গাছ, যা বিনি পয়সায় আদিবাসীদের রোগ সারায়, তাও শেষ হবে।

এরপর বলতে উঠলেন সুপেন হেমব্রম। অযোধ্যাবাসী মধ্যবয়স্ক মানুষটি কুণ্ঠিত স্বরে এমন কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন নাগরিক সভ্যদের ভিড়ে, শহুরে আল্ট্রাভায়োলেটে চামড়া একেবারে অসাড় না হয়ে গেলে ফোস্কা ফেলবেই। বামনি ঝোরার উপর প্রথম প্রকল্পটির বীভৎস ক্ষতির কথা শোনাতে শোনাতে উনি বললেন, ‘আপনাদের মানিব্যাগে এটিএম থাকে, যখন যেমন দরকার টাকার প্রয়োজন মিটে যায়। আমাদের এটিএম ওই অযোধ্যার বিস্তীর্ণ গোচারণভূমি। ওখানে পশুপালন করেই আমাদের দিন চলে, রাত বয়। ঠুড়্গা, তারপর বান্দু আর কাঠালজলে রাক্ষুসে প্রজেক্ট হলে কোথায় যাবে আমাদের চারণভূমি! আমরা কোথায় যাব?’ সাথে জুড়ে দিলেন কয়েকটা বেসামাল করা তথ্য। আদিবাসীর ঘরে ফ্রিজ লাগে না, এসি লাগে না। একে আপনারা পিছিয়ে পড়া বলুন, আদিবাসীরা কিছু মনে করবে না। তবু তো, আমাদের কাছে দিন দিনের মতো আলোকিত, রাত রাতের মতো অন্ধকার। আপনাদের শহরে সকলে দিনকে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং-ব্যানারে ঢেকে দিতে ব্যস্ত। আর রাতকে দিনের মতো ফর্সা করে রাখেন। পাখিরা এখানে ঘুমোয়? এখানে আইপিএল খেলা হয় রাতে। কত বিদ্যুৎ খরচ হয়? মানুষ ভুলেই গেছে ক্রিকেট সকালের খেলা। আর বছরে একদিন আমাদের শিকার উৎসব নাকি অশ্লীল ব্যাপার, অপরাধ। আদিবাসী নারী-পুরুষ অযোধ্যা থেকে ১৫ কিলোমিটার হেঁটে যায় বাঘমুন্ডি, জ্বালানি কাঠ বেচতে। কতটা কার্বন-জ্বালানি বাঁচে হিসাব করবেন কেউ?

লম্বা শিক থেকে ডানা ছড়ানো ‘উষা’ কোম্পানির ফ্যানগুলো মুনিঋষির নিষ্ঠায় ঘুরে চলেছে। ছেলেটির ভ্যাপসা লাগে। এতক্ষণ বোধ হয়নি! ছেলেটির তালুর ভেতর গুটোনো তালুতে মেয়েটি অস্বাভাবিক কাঁপন অনুভব করে! মেয়েটি ঘুরে তাকায়। ছেলেটি ফিসফিস করে বলে, ইস্‌…। তার লজ্জা লাল মুখের চেহারাটা মেয়েটিরও চেনা। আজ তাদের দেখা হবার মূলে ছিল আইপিএল। মেয়েটি তার হাতটি ছাড়িয়ে নিয়ে ছেলেটির হাতের উপর রাখে, যেন অপরাধটা তার। অথচ আরেকটু তলিয়ে দেখলেই তারা বুঝত, আইপিএল নামক জঘন্য গড়াপেটার পেছনে রয়েছে ভয়ঙ্কর রাজনীতি। ক্রিকেট শুধু দিনের খেলা নয়, বোলারেরও। অথচ আইপিএলের মাধ্যমে খেলা দেখার অভ্যাসটাই বদলে দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ বল যাতে বিগহিটের জন্য ব্যাটে এসে লাগে, তার জন্য পিচে হাজার হাজার লিটার ভূগর্ভস্থ জল ঢালতে হয়। ব্যাটের ঢালাও জোগান নিশ্চিত রাখতে কত হেক্টর উইলো গাছের বন ফাঁকা হয়ে যায়।

সুপেন বলে যান, অযোধ্যার ৮৫টি টোলা বা জনপদে হাইস্কুল দুটি। স্বাস্থ্যকেন্দ্র একটি। এগুলোই কি তবে উন্নয়নের লক্ষণ? তারপরেই অযোধ্যার সাঁওতাল, হাইস্কুলের ভূগোলশিক্ষক সুপেনের স্পষ্ট ঘোষণা, ভূগোল পড়ার সময় মাস্টারমশায়ের শেখানো কথাটা মেনে চলি, মানুষ আর প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ছাড়া ভূগোল পড়া অসম্পূর্ণ। আমার আদিবাসীজন্ম আর ভূগোল পড়ার অভিজ্ঞতা বলে দেয়, অযোধ্যায় আর একটাও উন্নয়নী প্রজেক্ট আমরা চাই না। ঠুড়্গা প্রজেক্ট আটকাতে না পারলে অযোধ্যা বাঁচবে না, কারণ জঙ্গল আর মানুষ বাঁচবে না। আমাদের ভয় দেখাচ্ছে মাওবাদী বলে দাগিয়ে দেবে, যাতে সহজে নানারকম কেস দেওয়া যায়। বাইরে থেকে যারা আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে আসছেন, তাদের সাথে মিশতে বারণ করা হচ্ছে। আমি পুলিশকে বলেছি, জাপানের কোম্পানি জিকা পয়সা দিচ্ছে আমাদের অযোধ্যা বুরুতে প্রজেক্ট করার। ওরা অনুপ্রবেশকারী, ওরা বাইরের। আর যারা আমাদের আন্দোলনের পাশে থাকতে কলকাতা কী হাওড়া থেকে ছুটে আসছে, তারা আমাদের লোক।

নকুল বাস্কে বলছিলেন সাঁওতালের পারম্পরিক সামাজিক আদালত সুতানতান্ডির প্রতি সভ্য সরকারের ইচ্ছাকৃত অবহেলার গল্প। সুতানতান্ডি সারাদেশের আদিবাসী মানুষের কাছে শুধু পবিত্র তীর্থক্ষেত্র নয়, সাঁওতাল সমাজচালনের অপরিহার্য অংশ। সেখানে বছরের বিশেষ দিনে তাঁরা নিজেদের মধ্যে জমা হওয়া সমস্যার সমাধান করেন, আগামী বছর কীভাবে চলবেন তার রূপরেখা ঠিক হয়। এটা সাঁওতাল সমাজের সাধারণ সভা। তাই সুতানতান্ডির কাছেই থাকতে হয় পানীয় জলের ব্যবস্থা, যাতে আগত জনতা গায়ে হাতে জল দিয়ে ঠান্ডা হতে পারেন ও পিপাসা নিরসন করতে পারেন। এখান থেকে কোনও কাগজকলম ছাড়াই বিচারের বাণী সমাজের গভীরে বয়ে চলে। অথচ তার কোনও স্বীকৃতিই নেই অ-আদিবাসী মানুষের কাছে। তাকেই তিলেতিলে মেরে ফেলবে পরের পর উন্নয়নী প্রজেক্ট। তাঁরা যে লিফলেট ছড়িয়েছিলেন অযোধ্যা পাহাড়ে, সেখানেও একটা বিনম্র প্রশ্ন করেছিলেন, রাজারাজড়ার পুরনো সৌধ, অন্যান্য ধর্মের তীর্থক্ষেত্র সংরক্ষণে সরকারের উৎসাহের অভাব দেখি না, কিন্তু সুতানতান্ডি নিয়ে তারা এমন আশ্চর্য নীরব কেন? এমন কি ভ্রমণপিপাসু মানুষের যে কাতার নামে অযোধ্যায়, তাঁরা আপার ড্যাম বেড়াতে যান কিন্তু সুতানতান্ডির দিকে ফিরেও তাকান না কেন? অযোধ্যার সাঁওতাল সুতানতান্ডি সংরক্ষণের চেষ্টায় সরকারের কাছে দরবার করলে তাদের জোটে অপবাদ, তারা নাকি খাসজমির পাট্টা চাইছে।

ছেলেটি মেয়েটির মুখপানে চেয়ে আলতো ইশারা করে, চলো। মেয়েটি আলতো ঘাড় নাড়া দিয়ে অসম্মতি জানায়। অতএব ভারতসভা হলে আদিবাসীদের প্রবহমান হাহুতাশ আর সে হুতাশনকে সমস্ত চোখরাঙানির দিকে পালটা হুমকি হিসাবে ছুঁড়ে দেবার আয়োজনে এই রবাহূত যুগলকে আরও কিছুক্ষণ পাব আমরা।

শান্তনু চক্রবর্তী বলেন আইনরক্ষার দায়িত্বে থাকা সরকারের আইনকে বোকা বানানোর ফিরিস্তি। যেকোনও প্রজেক্ট করার অনুমতি পেতে পরিবেশের উপর তার কুপ্রভাব/অভিঘাত কতটা হতে পারে তা নিয়ে যে রিপোর্ট জমা করার নিয়ম, তাকে এনভেরনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) বলে। সমাজের উপর কী অভিঘাত আসতে চলেছে তারও অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে হয়। তা হল সোশ্যাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (এসআইএ)। এবং আশপাশে এ ধরনের প্রকল্প বা অন্য প্রকল্প হয়ে থাকলে তাদের জুড়ে সামগ্রিক কী কুপ্রভাব হবে তার একটা হিসাবও কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকে জমা দেবার কথা। তার নাম কিউমুলেটিভ ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (সিআইএ)। সেসবই করা হয়েছে, কিন্তু ধাপ্পাবাজিতে ভরপুর সেসব রিপোর্ট। ৪৭০ পাতার ইআইএ বানানোই হয়েছে যাতে আইনের ফাঁকে গলা যায়। সিআইএ’তে সমীক্ষাক্ষেত্র হিসাবে সুপরিকল্পিতভাবে বেছে নেওয়া হয়েছে ঠুড়্গা নালার উচ্চ ও নিম্নগতি। সেইমত হিসাব থেকে বাদ পড়েছে আড়াই কিলোমিটার দূরে গড়ে ওঠা পিপিএস প্রজেক্টের ভয়ঙ্কর ক্ষতির কথা। আলোচনাতেই আসেনি পরপর লাইনে থাকা ঠুড়্গা ছাড়া আরও দুটি পাম্পড পাওয়ার প্রজেক্টের হিসাব। ঠুড়্গা বামনি বান্দু মেশে সুবর্ণরেখা আর কংসাবতীতে। এরা মরলে গুরুত্বপূর্ণ নদী দুটিও আহত হবে সে কথাও উল্লেখিত হয় না।

মিথ্যা, গাজোয়ারি আর উন্নয়নের চিরচেনা খুড়োরকল ঝোলানোর নজির প্রজেক্ট-প্রস্তাব পাস করিয়ে আনার সমস্ত ক্ষেত্রে।

উকিল অম্বর মজুমদার যেমন বলছিলেন, ২৯৪ হেক্টর জায়গা সরাসরি গিলে ফেলবে যে প্রজেক্ট, সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে আটটি গ্রাম, তার জন্য গ্রামের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের নিয়ে গঠিত গ্রামসভার ৫০ শতাংশের অনুমতি লাগে। এটি সাংবিধানিক নিদান। সেখানে ঘরে ঘরে পায়খানা প্রকল্পের দোহাই দিয়ে পঞ্চায়েতে কিছু গ্রামবাসীকে ডেকে এনে টিফিন দেওয়ার নাম করে সাদা কাগজে সই করানো হয়েছে। তাকেই চালানো হয়েছে গ্রামসভার রেজোলিউশন বলে। এবং আটহাজার মানুষের মধ্যে ক’টা সই? ২৪টি। কত শতাংশ হয়? হাস্যকর। ছেলেটির রাগ হচ্ছিল। আর মেয়েটি খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বলল, এরকম বোকামি বাংলা সিরিয়ালেও করে না। অম্বরবাবু জলদগাম্ভীর্যে বলে চলেন, কোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশের কথা। এর পরেও সরকারপক্ষকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যদি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীদের সঠিক পুনর্বাসনে রাজি করানো যায় তাহলে সে আদেশ উঠে যাবে। আবার ড্রেজার জেসিভির পাথরভাঙার শব্দে কেঁপে উঠবে শান্ত অযোদিয়া বুরু। একরাশ ভয় নিয়ে উড়ে যাবে পাখির ঝাঁক, হাতির দল। রাগে কুঁচকে ওঠে ওরা। কিন্তু হলভর্তি মানুষের মনে পড়ে একটু আগেই সুপেন বলছিল, পুনর্বাসন আসলে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। বীরহোরদের উদাহরণ দিয়ে সে বলছিল, জঙ্গলে লেগে থাকা মানুষকে বন থেকে দূরে ঠেলার অর্থ, তারা মরে যাবে।

জয়া মিত্র প্রথমেই সকলকে সাধুবাদ দিলেন পার্টি-পলিটিক্স তথা মানবাধিকারের জানাচেনা সীমা ছাড়িয়ে প্রাণপ্রকৃতিকে রক্ষা করতে সকলে জড়ো হয়েছেন ব’লে। জোরের সাথে বললেন, এ আন্দোলন আযোধ্যাবাসীর নিজেদের। তাঁরাই ডেঁটে দাঁড়িয়েছেন। রাষ্ট্র-পুঁজির আঁতাত যেভাবে উন্নয়নী জাল বিছিয়ে দেশের প্রাণময় প্রাকৃত সমাজকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে ছিবড়ে করে ফেলছে, তার ইতিবৃত্ত শোনাতে গিয়ে তিনি বলে চলেন আদিবাসীদের উপর আবহমান কাল ধরে চলা অত্যাচারের কথা। কীভাবে ‘মূলধারা’র লোভ আদিবাসীদের লুঠেপুটে নিয়েছে তার আখ্যান।

আমরা আসলে চাহিদার চক্রব্যূহে পড়ে গেছি। বিদ্যুতের চাহিদার কোনও শেষ না থাকলে শেষপর্যন্ত অযোধ্যা পাহাড় বা অযোদিয়া বুরু বাঁচবে না। তার সাথে রয়েছে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নির্মাণশিল্পের জন্য গ্রানাইট বা নিস্‌ পাথরের লোভে পাহাড় কাটা। এটা কি কোনও বিদ্যুৎ প্রকল্প হচ্ছে আদৌ?! পাম্পড স্টোরেজ প্রযুক্তিতে যা বিদ্যুৎ তৈরি হয়, তার থেকে বেশি বিদ্যুৎ খরচ হয় জলকে উপরের রিজার্ভারে তুলতে। শহরে বা কারখানায় হঠাৎ বিদ্যুতের চাহিদা প্রচুর বৃদ্ধি পেলে বা মূল সরবরাহ ব্যহত হলে এই প্রকল্পে তৈরি বিদ্যুৎ দিয়ে সামাল দেওয়া হবে। এর সাথে অযোধ্যাবাসীর উপকৃত বা উন্নীত হবার কোনও সম্পর্কই নেই।

অযোধ্যার উজ্জ্বল জানাল পাহাড়ে ঠুড়্গা প্রকল্পের বিরুদ্ধে দেওয়াল লেখার অভিজ্ঞতা। আদিবাসী মেয়েরা কীভাবে এই কাজে জড়ো হয়েছে, পরিকল্পনা ও কর্মসম্পাদন করেছে তার গল্প শুনতে শুনতে সবচেয়ে আনন্দ পেল মেয়েটি। কী যে একটা ভালোলাগার মাতন লাগল। ওর মনে হল ওই মেয়েরা, মায়েরা, দিদিরা, বন্ধুরা ওর কতদিনের চেনা।

মেয়েটি এতদূর থেকে যাদের আত্মীয় ভাবছে, তাদেরই ঘরেদোরে বেড়াতে যান ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি। মূলত পাহাড় ও প্রকৃতির কোলে একটু আগলহীন হতে চাওয়া। তাঁরা কি কাছ থেকে দেখেও দেখেন অযোধ্যাবাসীদের? যদি দেখতেন, তবে কি আপার ড্যামের সুবিশাল জলরাশি দেখে সন্দেহ জাগত না, রুখাসুখা অযোধ্যা পাহাড়ে এত জল এল কোত্থেকে? তাহলে নিশ্চয়ই তাঁরা ওই জলের তলায় চাপা পড়া তিরতিরে বামনি নদীটিকে দেখতে পেতেন, দেখতে পেতেন সারসার গাছের কঙ্কাল আর কাটা পড়া ছ’টি পাহাড়? যদি তাঁরা অনুধাবন করতেন অযোধ্যার শান্তরূপ, তাঁরা কি মেনে নিতেন ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির বাড়বৃদ্ধি, প্রাচীন শালের স্বাভাবিক অরণ্য ধ্বংস করে কৃত্রিম বনসৃজন, পার্ক ও হোটেল তৈরি; অযোধ্যা জুড়ে লেইস কুড়কুড়ের প্লাস্টিক প্যাকেটের ডাঁই আর বিভিন্ন আকারআকৃতির মদের বোতল?

এরপর কনভেনশনের অংশীদাররা খসড়া প্রস্তাবের সংশোধনী হিসাবে নানা কথা বলেন। বণ্যপ্রাণ কর্মী বিশাল সাঁতরার থেকে জানা যায় অযোধ্যার বণ্যপ্রাণ সম্পর্কে তেমন করে জানবার আগেই চার-চারটি প্রকল্পের চাপে অযোধ্যা শেষ হতে বসেছে। তবে এই জঙ্গলে যে বেশ কয়েকটি সিডিউলড (বিলুপ্তপ্রায় এবং বিপন্ন) প্রজাতি রয়েছে এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। যেমন বনরুই হাতি ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র এই জঙ্গলেই পাওয়া যায় মাদ্রাজ ট্রি শ্রু বা গেছো ছুঁচো। অধ্যাপক রবীন মজুমদার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন, এই সংহতি মঞ্চ প্রকৃতির উপর সমস্ত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংহতি জড়ো করুক। প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও বললেন, এই আন্দোলন আসলে তাদেরও, আপামর পড়ুয়ার। শেষ বক্তা কনভেনশনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশীষকুসুম ঘোষ। আইনি রক্ষাকবচকে তিনি হাতির বাইরের দেখনদার দাঁতের সাথে তুলনা করেন। আর লড়াই-আন্দোলন হল হাতির চিবানোর দাঁত।

হঠাৎ ছেলেটি চমকে উঠে মোবাইলে টাইম দেখল ৯টা। মেট্রো কি পাবে ওরা আর? বাড়িতে এতক্ষণ কী হচ্ছে কে জানে! মেয়েটিকে বলতে যাবে, সে উঠে গেল যেদিকটায় টেবিল পেতে বসেছে উদ্যোক্তারা। ছেলেটি অধৈর্য হল এবার। একটু রাগও হল ওর উপর। দরজা দিয়ে ভিড় বেরিয়ে যাচ্ছে। এর আগে বেরোতে পারলে ভালো হত। মিনিট তিনেক পরে মুখে হাসি নিয়ে মেয়েটি ফিরে আসছে ছেলেটির দিকে। এই হাসি ও চেনে। তৃপ্তির হাসি। কিন্তু গোটা কনভেনশনে এত তৃপ্ত হবার মতো কিছু কি ঘটল?

—ওদিকে কোথায় গিয়েছিলে?
—সই-এর কাগজটা নিতে।
—কেন, সই করনি তখন!
—ফোন নম্বরে শেষের আগের ডিজিটটা নয়ের জায়গায় ছয় লিখেছিলাম। ঠিক করে দিয়ে এলাম। আর আমাদের দুজনের তরফে কুড়ি টাকা দিয়েছি। কত টাকা লাগবে এত সব করতে। আর হ্যাঁ, এই দেখো, বিদ্যুতের চাহিদা যোগান, এসব নিয়ে একটা চটি বিক্রি হচ্ছিল পাঁচটাকায়। ওটাও নিয়েছি। আমি আগে পড়ব। তারপর তোমায় দেব। সেদিনিই আমাদের আবার দেখা হবে।

ভুবনভোলানো হাসতে হাসতে মেয়েটি হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে ভিড় ঠেলে। বাড়ি ফিরতে পারবে কিনা, বকুনি খাবে কিনা— উদ্বেগ নেই। ছেলেটি তল পায় না।

এবারও নাগরিক চোখে একটা দৃশ্য পিছলে যায়। চোখ থাকলে, নিদেন প্রেমের চোখ, নিশ্চই এত দারুণ দৃশ্য চোখ এড়াত না। আজ মেয়েটির হাসিতে জ্যোৎস্না নেমেছে এককুচো। ও ছুটে নামছে, একে ঠেলে ওকে ঠেলে। সিঁড়ি যেন সিঁড়ি নয়, অযোধ্যার পাথুরে গড়ান। মেয়েটি কি ঠুড়্গানালা, গায়ে তার একটুকরো জ্যোৎস্নামায়ার অযোধ্যা পাহাড়! ছেলেটি তখন অন্য কথা ভাবছে। ওর একটা সিগারেট খাওয়াও তো প্রকৃতির ক্ষতি করে। ওর স্মার্টফোন, রাত জেগে আলো জ্বেলে পড়া, আইপিএল দেখতে যাওয়া— সবেতেই তো কিছু না কিছু চাপ পড়ছে প্রকৃতির উপর, যা হয়ত এড়ানোও যেত। এভাবে সকলে ভাবলে কি জঙ্গল পাহাড় নদী ঝোরা বাঁচানো যাবে? কমানো যাবে দূষণ? কিন্তু বিশাল বিশাল কারখানা, বিদ্যুৎপ্রকল্প এসবের দায় কতটা? মিথ্যে কথা বলে প্রকৃতিকে কেন ছিবড়ে করে দিতে চায় দেশের সরকার? কার লাভ? প্রকৃতি বিষয়ে সচেতনতা মানে কী? জল নষ্ট করব না, গাছ বসাব, আলো-পাখা-এসি প্রয়োজন ছাড়া অফ করব— শুধু এই, নাকি এর সঙ্গে এটাও বোঝা, যে প্রকৃতিকে লোভের-লাভের জিনিস হিসেবে কারা নিঙড়াচ্ছে তাদেরকেও চেনা?

‘এবার কীভাবে যাব?’ মেয়েটির কণ্ঠে হুঁশ ফিরল ছেলেটির। আর বেহুঁশ হলে চলবে না।