অনিমিখ পাত্র
নিশান বদল হল হঠাৎ সকালে
ধ্বনি শুধু থেকে গেল, থেকে গেল বাণী
আমি যা ছিলাম তাই থেকে গেছি আজও
একইমতো থেকে যায় গ্রাম রাজধানী– শঙ্খ ঘোষ
ভোট মানে গণতন্ত্রের উৎসব। এই পোশাকি অভিধা শুনে আজকাল বেশিরভাগ লোকেই মুখ টিপে হাসবেন। রাজনৈতিক লড়াই যত তীব্র হয়, ক্ষমতা যত আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে আমাদের জনজীবন, রুচি তত নীচে নামে, আস্তে আস্তে উৎসব তত মুছে যায়। তবু, আজও, ভোটকর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগ আমার কাছে বেশ একটা উত্তেজনার ব্যাপার। এক ভিন্নতর সামাজিক ভূমিকায় সেজে নেবার সুযোগ। অন্য একটা পৃষ্ঠতল থেকে দেশ দেখার দুর্লভ উপায়। শৈশবে ফেরার একটা টাইম মেশিন। এসব শুনলে, সহকর্মীরা নির্ঘাত চমকে যাবেন।
‘দেখার ইচ্ছা’ বলে যদি কোনও ইন্দ্রিয় থাকত, তাহলে বলতে পারতাম সেই ইন্দ্রিয়টা কোনও পরিস্থিতিতেই বন্ধ হয়না আমার। সে যতই পাহাড়প্রমাণ কাজের চাপ থাক না কেন। তা সে শরীর যতই ভেঙে আসুক না ক্লান্তিতে! দেশ মানে তো দেশের মানুষজন। আমি ভোটের দুদিন আমার ওই ইন্দ্রিয়টি দিয়ে প্রাণপণ আমার এই দেশটাকে দেখি।
আমার এপর্যন্ত সবরকম ভোট অভিজ্ঞতাই গ্রামের। শৈশব-কৈশোরে, গ্রামে, ভোট ছিল সত্যিই উৎসবের। বাবা ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী। ভোটের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ার উত্তেজনা ছিল। আমাদের বাড়ি থেকে নিকটবর্তী স্কুলের বুথে যাওয়ার রাস্তাটা নানা রঙের পতাকায় মোড়া। নানা দলের ক্যাম্প। তখন কটু কথা বলার চল ছিল না। এ গ্রাম ও গ্রামের কাকু-কাকিমা-দাদা-পিসিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতেন সেইসব ক্যাম্পে। এই একটি দিন বিপক্ষ শিবিরে বসা বন্ধু-দাদাদের সঙ্গে বেশি কথা বলা বারণ। তারপর সব মিটে গেলে ফের যুযুধান নেতা কর্মীদের চা খাওয়ানো, জর্দাপান বিনিময় আর অল্পবয়সীদের ক্রিকেট-ভলিবল। দেখতাম শ্রমিক সংগঠনের লোকেরা সারাদিন ধরে দূর প্রান্তের গ্রামগুলো থেকে অসুস্থ ও বয়স্ক মানুষদের বয়ে আনছেন ভোটকেন্দ্রে। দশজনের কাজ একাই অনায়াসে করে ফেলছে দীর্ঘদেহী পারি দিদি। পারি মুর্মু, পার্টি তাকে সম্মান দিয়েছিল। তার মরদ তাকে ফিরে যেতে চাপ দিয়েছিল জঙ্গলমহলে, সাঁওতাল গ্রামে। পারিদি স্বামী ছেড়েছিল, পার্টি ছাড়েনি। ভ্যান রিকশা ইউনিয়নের কর্মী ছিল দশরথ হেমব্রম। ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছিল। মৃত্যুপথযাত্রী, তবু সে চিৎকার করছে, নিজের পার্টিকে ভোট সে দিতে যাবেই। গ্রামে না থাকলে এইসব কীভাবে দেখতাম? সব ভালোই একদিন শেষ হয়। তারপর শৈশব হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রাজনৈতিক চিত্রটাও গেল হারিয়ে। যাক, এই দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে আজকের ভূমিকায় আসি।
চাকরি হল মফস্বল শহরে। ফলত ভোট নিতে যেখানে যেখানে যেতে হয় তা গ্রামই, কখনও কখনও বর্ধিষ্ণু গঞ্জ বড়জোর। মারাত্মক একটা বুলডোজার পিষে দেয় শরীর মনকে এই দুদিন। অব্যবস্থার কথা তো বলাই বাহুল্য। এসব ভোটকর্মী মাত্রেই জানেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা হয়। মাটির কাছাকাছি আসার অমন সুযোগ অন্যভাবে কক্ষনো মিলত না। নিজেকে এত সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ হিসেবে নিজেই চাক্ষুষ করার সুযোগও। গ্রাম-প্রকৃতির কাছেও এমনভাবে যাওয়া আর যেত না।
চাকরিজীবনে বেশ কয়েকবার ভোটে যেতে হয়েছে। প্রিসাইডিং অফিসারের ভূমিকাতেই মূলত। একবার ফার্স্ট পোলিং অফিসার। আর দুবার রিজার্ভ বেঞ্চে কাটিয়েছি। এই রিজার্ভ ডিউটি আবার এক মজার খেলা। একটি বিডিও অফিসে নিয়ে যাওয়া হবে। একটা হলরুমে (ডর্মিটরির মতো) ঢুকিয়ে দেওয়া হবে ভোটের আগের রাতে। ভোটের দিন সকাল থেকে দুপুর অবধি ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলতে হবে। কারণ, কোনও বুথে কোনও ভোটকর্মী অসুস্থ হয়ে পড়লে এই রিজার্ভ থেকে কাউকে না কাউকে নিয়ে যাওয়া হয়। এমন অকস্মাৎ ডাকে কেউই সাড়া দিতে চান না। তখন ঘুরে বেড়াতে হয় আশেপাশের রাস্তায়, পুকুরপাড়ে, চায়ের দোকানে। নিজের নামে ডাক শুনলেও এমন উদাসীন ভাবলেশহীন মুখ করে হেঁটে যেতে হয় যেন ওই নামটা আপনার নয়। আমার প্রথম ভোট অভিজ্ঞতাটাই এরকম, থেকেছিলাম পূর্ব মেদিনীপুরের কাজলাগড় বিডিও অফিসে। বিরাট একটা দীঘি, বহুদূর শেকড়ছড়ানো প্রাচীন অশ্বত্থ, লাল মোরামের রাস্তা, ভাঙা স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ফিরে, অনেককাল পরে, জেনেছিলাম, ওই কাজলাগড়েই প্রাশাসনিক কর্তা হিসেবে একদা কাজ করতেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। অনেকগুলি কালজয়ী গান তিনি রচনা করেছিলেন সেইসময়ে। এরকমই রিজার্ভ পোলিং অফিসার হয়ে একবার উপনির্বাচনে গেছিলাম হাজার বছরের পুরনো জনপদ ঐতিহাসিক ময়নাগড়ে। সে এক প্রাণজুড়নো জায়গায় থাকতে দেওয়া হয়েছিল আমাদের। রামকৃষ্ণায়ন অ্যাসোসিয়েশনের এক অত্যাশ্চর্য বিদ্যালয়ভবনে। সেখানে থাকে প্রায় একশো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। আছে তাদের তৈরি সামগ্রীর বিশেষ বিপণী। এক ছাতার তলায় রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয় কেন্দ্র, বিএড প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বাংলা ও ইংরাজি মাধ্যম স্কুল। লাইব্রেরি, খেলার মাঠ, পুকুর, দোলনা, গাছে গাছে ছাওয়া ফুলের কেয়ারি করা ঝকঝকে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। কোথাও কুটোটি পড়ে নেই। সন্ধ্যারতির বাজনা কিংবা আবাসিকদের বেসুরো প্রার্থনাগান আমার মতো নাস্তিকের কানেও মধুর ঠেকেছিল। সেখানে দেওয়ালগাত্রে পাশাপাশি আকীর্ণ রয়েছে শিবপার্বতী এবং ইসলামিক লিপি। লালন ফকির আর সহজ পাঠ। গৌতম বুদ্ধের অনিন্দ্যকান্তি মূর্তি। চারপাশে মাছের ভেড়ি। কেরালার ব্যাকওয়াটারের মতো নয়নলোভন। দূর মন্দিরের আলো জলে পড়ে অনুপম হয়ে আছে। চুলের সিঁথির মতো পিচরাস্তা আকাশমণির ছায়ায় ছায়ায় চলে গেছে বালিচকের দিকে। দূরের আসর থেকে পালাগান ভেসে আসছিল। পৃথিবীটা এখনও কত সুন্দর— মনে হয়েছিল এইরকম।
তবে, ভোটকর্মীর স্মৃতি সতত সুখের হতে পারে না কখনও। আমাদের এই বঙ্গে রাজনৈতিক রেষারেষি দিনে দিনে হয়ে উঠেছে উত্তপ্ততর। ভোট নেওয়ার কাজ হয়ে উঠেছে ক্রমশ চ্যালেঞ্জিং। আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়েছে। নিজের প্রাণটি বাঁচাতে তাই পরিস্থিতিমতো আপস করতেই হয়। ভোটের আগের দিন এবং ভোটের দিন আমাদের হাতে থাকে ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়ার। অথচ অসহায়তা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। আবার, ভোট ফুরনোমাত্র ভোজবাজির মতো সেই ক্ষমতা ভোঁ-ভাঁ। এ কী জাদুবাস্তবতা নয়? যেন – ‘কাল ছিল ডাল খালি/আজ ফুলে যায় ভরে’— এই লাইনদুটির ঠিক বিপরীত একটা আখ্যান।
ভোটকর্মী হিসেবে আমাদের রাজ্যে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হল পঞ্চায়েত নির্বাচন। ত্রিস্তরীয় নির্বাচন, ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণ, প্রার্থীসংখ্যা প্রচুর, পোলিং এজেন্টদের সংখ্যাও বেশি। রাজনৈতিক তাপ-উত্তাপও। ঘটনাচক্রে আমার প্রথম ভোটাভিজ্ঞতার হাতে খড়ি এরকম এক পঞ্চায়েত নির্বাচনেই।
সেবার, প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে ভোট নিতে যেতে হয়েছিল নন্দীগ্রামে। ছোট গাড়িতে করে ঝোপজঙ্গলময় রাস্তা ঠেলে বিকেল নাগাদ পৌঁছে দেওয়া হল লোকালয়ের শেষ প্রান্তে আমাদের বুথে। সে এমনই এক নিঝুম জায়গা যে একা ছেড়ে দিলে সেখান থেকে বড় রাস্তায় ওঠা দুষ্কর। গ্রামে বেড়ে ওঠা আমার কাছেও সে গ্রাম বড়ই রূপকথার মত প্রত্যন্ত ঠেকেছিল। যেখানে জলের উৎস কেবল পুকুর। নিবিড় গাছপালা আর মাঠ দিয়ে ঘেরা এক শীর্ণ প্রাইমারি স্কুল ছিল আমার ভোটকেন্দ্র। সম্ভবত জুন মাস, আর বর্ষায় যেমন হয়, সাপেরা ছিল দৃশ্যমান। আশেপাশের বাড়িঘর থেকে মৃদু দু-একটা মানুষের গলা অবচেতনের মত। সামান্য দু-এক গেরস্থালির আওয়াজ সভ্যতাসংলগ্নতার বোধ বজায় রাখছিল। ইলেকট্রিসিটি আছে বটে, তবে লোডশেডিংকেই তার প্রমাণ বলে ধরে নিতে হয়। সন্ধে নামতে ছোট বাহিনি সমেত এলেন স্থানীয় নেতারা, আমার কী করা উচিত সে সম্পর্কে কিছু পরামর্শ ও অন্যথায় কী হতে পারে তার চাপা হুমকি। শরীরে সাড় ফিরতে কিছুটা সময় লেগেছিল। আমাদের পোলিং পার্টির সদস্যরা কিছুদূরের দোকান থেকে তেলেভাজা মুড়ি নিয়ে এসেছিলেন। তেলেভাজা ঠান্ডা হল, মুড়ি মিইয়ে গেল। মনে পড়ে, আমরা ৫-৬ জনের দল বিহ্বল হয়ে হ্যারিকেনের আলোয় গোল হয়ে বসে ছিলাম ঘণ্টাখানেক। সরাসরি এমন প্রথম কিনা! দ্রুত নবপ্রযুক্ত ভূমিকায় নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকলাম। পরের দিন একতরফা ভোট হল। চোখের সামনে এক মধ্যবয়স্ক ইলেকশন এজেন্টকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মেরে বুথ থেকে বের করে দেওয়া হল। শাসকদলের নেতা আমার উপস্থিতিকে গ্রাহ্যেই আনলেন না। এক বৃদ্ধাকে দেখলাম ভোট দেওয়ার আগে পোলিং এজেন্টদের বেঞ্চের দিকে একবার তাকালেন, তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও দেখতে পেলাম সেই নেতার ঠান্ডা চাহনি, তারপর রীতিমতো কাঁপতে থাকলেন সেই বৃদ্ধা। বুথঘরের বাইরে তার ছেলে দাঁড়িয়ে। ছেলে বলছে মা’কে, ‘তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আমরা কি মরে গেছি?’ অনুমান করলাম, বহু রক্ত ঝরানো বহু উথালপাথালের সাক্ষী নন্দীগ্রামে এই পরিবারটি সম্ভবত ঘরছাড়া, ভোটের নিমিত্ত আজই ফিরেছেন। নিরাপত্তা নেই। সরাসরি ছাপ্পা না হওয়ায়, আগ বাড়িয়ে আমার কিছু করারও নেই। বুকে পাথর নিয়ে কাজ করে যেতে লাগলাম। ভোটগ্রহণের শেষে সেই নেতা দেঁতো হাসি হেসে আমায় অভিনন্দন জানাতে এলেন। রাত ৯টায় এই রাজনৈতিক প্রহসনটি মিটল। বুথঘর ছেড়ে এসে দাঁড়ালাম সেই পুকুরের পাড়ে। আর সাপের ভয় করছে না তখন। সাপ তো নেহাৎই প্রকৃতির জীব। সিগারেট ধরালাম একটা। অজস্র তারায় স্পষ্ট আকাশ তখন আরও বিরাট। আমার কানে তখন মানুষের শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসছে। যেন জামাকাপড় খুলে ফেলতে চাইছি আমি। যেন আমি ছিঁড়ে ফেলব বুকে ঝোলানো হাস্যকর এই আইডেনটিটি কার্ডটা।
আমার স্কুলেই বরাবর হয় তিনটি বিধানসভা ক্ষেত্রের পরিচালন কেন্দ্র। যাকে ভোটের পরিভাষায় বলে ডিসি-আরসি। ফলে প্রায় একমাস বিদ্যালয় থাকে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ আর কেন্দ্রীয় বাহিনির জওয়ানদের দখলে। চেনা স্কুল তখন রীতিমতো অচেনা ঠেকে। ভোটের দু’দিন অবশ্য এমনিতেও অন্য সমস্ত ব্যক্তিপরিচয় মুছে গিয়ে আমরা কেবলই ভোটকর্মী হয়ে উঠি। সম্বোধন পালটে যায়। সেবার বিধানসভা নির্বাচনে আমার ডিউটি জেলার অপেক্ষাকৃত রাজনৈতিকভাবে শান্ততর এলাকা মহিষাদল বিধানসভা ক্ষেত্রে। ভোটের আগের দিন, আমরা চারজন পোলিং অফিসার মালপত্র বুঝে নিয়ে পৌঁছে যাই আমাদের পূর্বনির্ধারিত ভোটকেন্দ্রে। স্কুলের দরজা খুলে ঢুকেই তো ধাঁধাঁ লাগে। একখানা মোটামুটি মাপের ঘরকে মাঝে প্লাইউডের ডিভাইডার দিয়ে দুইটি করা হয়েছে। উপরের কিছু অংশ খোলা। পাশাপাশি এই দুই জোড়াতালি ঘরে দুইটি বুথ। একটিমাত্র দরজাওয়ালা এই দশ ফুট বাই দশ ফুটে ‘প্রবেশ’ই বা কী আর ‘প্রস্থান’ই বা কী! নির্বাচন কমিশন আমাদের ট্রেনিং-এ যা শেখায় তার কত কিছুই যে বাস্তবে করা যায় না আরেকবার মালুম হয়।
এই দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরেই কাল গণতন্ত্রের উৎসব। আমরা ক’জন ভোটবাবু তাই মেঝেতে ঠেসাঠেসি করে শয্যা পেতেছি। শয্যা মানে সিমেন্টের মেঝের ওপর একটা বিছানার চাদর। একে অপরের গায়ে গা লেগে যাচ্ছে। সহজে ঘুম আসে না আমার। উঠে বাইরে পায়চারি করি। গ্রামে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন। কোথাও কোনও শব্দ নেই। কিছু আগে একচোট ধুন্ধুমার বৃষ্টি হয়ে গেছে। স্কুলের মাঠে টাঙানো শামিয়ানা চুঁইয়ে টুপটুপ করে জল পড়ছে। পাশে পানের বোরোজ। বাল্বের হলুদ আলোয় এক অন্য পৃথিবী যেন। দু’একটা কুকুর ঘুরছে শুধু। ভোট নিতে আসতে হয় বলেই এই অপার্থিবের দেখা পাই। এইই বা কম কী! ভোররাতে সামান্য একটু শুয়েই সাড়ে চারটেয় ফের উঠে পড়া হয়।
কেন্দ্রীয় বাহিনির জওয়ানদের সঙ্গে গল্প হয়। বিকানির থেকে এসেছেন একজন সিনিয়র অফিসার। বারবার বলছেন এই ভঙ্গুর কাঠের জানালার ঘরে আমাদের কাছে ইভিএম রাখতে ভরসা হচ্ছে না তার। তাই শেষমেশ নিয়েই গেলেন ভোটযন্ত্র নিজেদের কাছে, দুই জওয়ান বুকের পাশে ইভিএম রেখে শোবেন। আর একজনের বাড়ি ফরিদাবাদ। দশবছরের মেয়ে আছে বাড়িতে, তিনমাস ঘুরছেন তারা, কারণ আমরা মেতেছি ভোট উৎসবে। উৎসবে কি সান্ত্রী লাগে? এখানে একটি বাচ্চা মেয়ে ঘুরঘুর করছিল ঠাকুমার হাত ধরে, তাকে দেখে নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তার। মেয়েটিকে, মেয়েটির মা’কে কত গল্পই করছেন তিনি হিন্দিতে, তারা তো বুঝছেন না কিছুই। আমি খানিকক্ষণ বাংলায় তর্জমা করে দিই। ফেরার সময়ও বেশ বৃষ্টি, তার ভেতরেই রাইফেল মাটিতে রেখে শেষবার হাত মেলানোর উষ্ণতা মনে থেকে যায়।
সেবার, শান্তিপূর্ণ ও নিয়মমাফিক ভোট হয়েছে আমার বুথে। ছ’টা থেকেই মানুষ লাইন দিয়েছেন। এই একটা দিন তাদের যেন আপাতগুরুত্বের দিন। কত বৃদ্ধ বৃদ্ধা আসছেন, অসুস্থ মানুষ আসছেন— আজ তাদের ‘বিশেষ’ হবার দিন। অনেকেই ভোটযন্ত্রে কোথায় যে বোতাম, কোথায় চাপ দেবেন বুঝতে পারছেন না। তার ওপর ওদিকের ঘরের ভোটদানের যান্ত্রিক আওয়াজ এঘরের আওয়াজের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। ওই সামান্য কার্ডবোর্ড ঘেরা কক্ষটি তখন কঠিন এক পরীক্ষাগৃহরূপে দেখা দিয়েছে যেন। গ্রামের মানুষের কাছে ভোটদানের পদ্ধতিটিই আজও ঠিকভাবে প্রাঞ্জল করে তুলতে পারিনি আমরা। ফলে, কেউ কেউ যে পছন্দের প্রার্থীর জায়গায় ভুল করে অন্য কাউকে ভোট দিয়ে ফেললেন— এটা আন্দাজ করাই যায়। রাজ্যসড়ক থেকে মাত্রই দেড় কিলোমিটার ভেতরে বর্ধিষ্ণু অঞ্চলে এই বুথটি। ভারতের সংবিধান প্রতিষ্ঠার এতবছর অতিক্রান্ত— আজও কত মানুষ ভোট দিতে আসেন খালি পায়ে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এইসব বেয়াড়া চিন্তা মাথায় পেরেক ঠোকে। বেশ কয়েকজন অল্পবয়সী ভোটার ছিলেন অটিস্টিক। তাদের বাবা-মা জাপ্টে ধরে নিয়ে এসেছেন। তারা বুঝলেনই না ভোটটা কী, দিয়ে কী হয়, অভিভাবকদের নির্দেশ পালন করলেন কেবল। এইরকমই একটি ছেলে তো কিছুতেই আঙুলে কালি লাগাবে না। যেন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে সবাই। ধরেবেঁধে রীতিমতো যুদ্ধ করে কালি দেওয়া হল তার আঙুলে। ভাবছিলাম, বছরের বাকি দিনগুলো ওদের কেউ পাত্তা দেয় না, হয়তো ব্যঙ্গবিদ্রূপও করে সকলে। কিন্তু আজ তো ওরা শুধুই মানুষ নন, আজ ওরা ভোটার। আর ভোটার হিসেবে, গণতন্ত্রের খাতিরে, এই একদিন অন্তত ওদের সামাজিক গুরুত্ব বেশ ভারী।
স্বাভাবিক জীবনছক থেকে অ-নে-ক-টা বেরিয়ে আমাদের এই দু’দিনের জীবন। কখনও পুকুরে স্নান, কখনও টিউবওয়েল পাম্প করে করে হাতে ব্যথা, অপরিচ্ছন্ন গণ বাথরুমে কোনওপ্রকারে নিত্যকাজ, সেলফ-হেল্প গ্রুপের যে দিদিরা রান্না করে দেন তাদের কাছে ঠিকঠাক ব্যবস্থাপনার জন্য লাগাতার অনুরোধ, আসন্ন বিপদ সম্পর্কে আন্দাজ করতে থাকা, পুলিশ কিংবা জওয়ানদের সঙ্গে সৌহার্দের সম্পর্ক তৈরি… লিস্ট যেন ফুরোয় না। প্রায়ই ভোটঘরের মেঝেতে শুতে হয়। সারারাত্রি বিচিত্র নাসিকাগর্জনের প্রতিযোগিতায় ঘুম হয় না একমিনিটও। আরেকবারের কথা, তখন ভোর ৪:৫০। সবে আলো ফুটেছে। বাইরে এসেই দেখি, একজন লোক সামনের বারান্দায় বসে। আমাদের তো সারাদিনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ৭টা থেকে ভোট। তিনি প্রথম ভোটার হবেন। আমাকে দেখেই চাপা গলায় বলতে লাগলেন, গতবার অমুকদিদি ভোট দিতে পারেনি। খুব কাঁদছিল। আমি তাই ভোর ভোর চলে এসেছি। ভোট আমি দেবই।
ভোট পুরোদমে চলছে। এক নবতিপর বৃদ্ধা এলেন। লোলচর্মসার, পিঠ ধনুকের মতো বাঁকা। ভোটকক্ষের দিকে নিয়ে যেতে হাত বাড়ালাম। আমার হাত ধরলেন তিনি। ঠান্ডা হাত। গায়ের কাপড় ঠিক থাকছে না কিছুতেই। মনে হল, স্বয়ং ভারতবর্ষ হাত ধরল আমার।
অধিকাংশ মানুষের কাছে, বিশেষত গ্রামের মানুষের কাছে, ভোট দেওয়ার অধিকার তাদের জীবনের অন্যতম বড় অর্জন। বাম তর্জনিতে কালি তাদের অন্যতম জয়টীকা। সেকালে বা একালে, এ বুথে বা ও বুথে, সেই অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া গুরুতর অপরাধ। আর সেই অপরাধে হয়ত আমরা সবাই শামিল।