Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

উন্নয়ন বিষয়ে দু-চার কথা

উন্নয়ন বিষয়ে দু-চার কথা -- সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

 

কথাশিল্পী সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সাহিত্যরচনার পাশাপাশি দীর্ঘ সময় ধরে নানা পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন তাঁর জীবনের ছোটবড় স্মৃতিচিত্র। তাতে উঠে এসেছে নানা নামী-অনামা ব্যক্তিত্বের স্মৃতিচারণ, নানা সামাজিক ঘটনার নিয়ে লেখকের প্রতিক্রিয়া, অথবা ধর্মীয় বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রসঙ্গ। এইসব অতীত কথার সংকলন 'কথামালা' নামে প্রকাশ করেছেন 'কারিগর' প্রকাশনা৷ নীচের লেখাটি আজকাল দৈনিকে ২৮ এপ্রিল ২০০৯-এ প্রকাশিত হয়েছিল। বানান মূলত অপরিবর্তিত রাখা হল।

উন্নয়ন শব্দটা কানের পরদায় এসে আঘাত করলেই চমকে উঠে চারদিকে তাকাই৷ বয়স তো আশি ছুঁইছুঁই, এখন চারপাশে যা দেখছি সবই একটা স্বপ্নের মতো মনে হয়। বিগত শতকের ৬০-এর দশকের মাঝামাঝি কলকাতায় পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য অনুপ্রবেশই করেছিলাম। খুব সন্তর্পণে এবং সংকোচে। এই ২০০৯ সালে যে কলকাতকে দেখছি সে কলকাতায় তো আমি আসিনি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়- আমি কোনও জাদুপুরীতে এসে পড়িনি তো!

হ্যাঁ, ‘উন্নয়ন’! উন্নয়নের আর কি কোনও মানে আছে? দিকে দিকে প্রসারিত উজ্জ্বল, ঝকমকে একটা জাদুপুরীর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবি সেই প্রথম আসার সময়ে দেখা কলকাতা কি এটাই? এই চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর রূপান্তর কি অধোগমন। অন্ধদের কিবা দিন কিবা রাত! তাদের এগুলো চোখে পড়ে না?

শুধু কলকাতা নয়, গ্রামের কথাও কিছু বলা দরকার। কতকটা হীনমন্যতার চাপেই কলকাতায় আমৃত্যু থাকার মতো কোনও বাসস্থান না করে গ্রামেই বাড়ি করেছিলাম, ৮০-র দশকের মাঝামাঝি। যে-আমার কেটে গিয়েছিল জীবনের পঁয়ত্রিশটা বছর গ্রামবাংলার একেবারে ভেতর দিকে, সেই আমি যখন গ্রামে বাড়ি করছি তখনই চমকে উঠে দেখেছিলাম এ আমি কোথায় ফিরে এসেছি? সেই অর্ধনগ্ন মানুষেরা হারিয়ে গেছে অতীতের অন্ধকারে। রিকশাওয়ালার বউ শায়া-শাড়ি-ব্লাউজ পরে নতুন ছন্দে পা ফেলে হাঁটছে গ্রামের লাল টুকটুকে মোরাম রাস্তায়। পাশের ছোট্ট টালি-চাপানো ঘর থেকে রোশন শেখের বউ সবাইকে শুনিয়ে বলছে- ‘হাঁসগুলান প্রেস্টিজ পাংকচার করে দিল।’ ক্রমশ চমকে উঠি যখন পাড়ার কোনও চাষিবউ এসে ঝকমকে শাড়ি পরে তার আরববাসী স্বামীর ভিসা-পাসপোর্ট নিয়ে ঝামেলার কথা নির্ভুল উচ্চারণে টেকনিক্যাল শব্দগুলো বলে আমার কাছে সুরাহা চায়! আমি নড়ে উঠেই শ্বাস ছেড়ে বলি – কী আশ্চর্য এই উত্থান!

বললাম উত্থান, কিন্তু এটাই তো উন্নয়ন! সেই মেয়েটির একটা মারুতি গাড়িও আছে, যা সে ভাড়া খাটিয়ে রোজগার করে, তাও।জানাতে সে ভোলেনি। আর এতক্ষণ ধরে এই কথাগুলো বললাম, সবই কিন্তু লিখেছিলাম গ্রাম থেকে ফিরে এসে আনন্দবাজার পত্রিকায় (তখন আমি আনন্দবাজারের সাংবাদিক)। প্রতি বছর চার বা পাঁচ বার করে ৩৪ নং জাতীয় সড়ক ধরে গ্রামের বাড়িতে গেছি এবং প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার পথের দু’ধারে লক্ষ করেছি একের পর এক ইটের বাড়ি তৈরি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে পেট্রল পাম্প, ছোটোবড়ো কলকারখানা। রাস্তার পাশের বাজার হয়ে উঠছে বিস্তৃত ও বর্ণাঢ্য। এগুলো যদি উন্নয়ন না হয়, তাহলে আমি জানি না উন্নয়ন কাকে বলে! কোনও কোনওবার ইচ্ছে করেই ঘুরপথে কলকাতায় ফিরেছি। কখনও উত্তরে এগিয়ে মোরগ্রাম-দুর্গাপুর মসৃণ হাইওয়ে ধরে ইলামবাজার, পানাগড় হয়ে ঘুরতে ঘুরতে কলকাতা। ওই রাস্তার দু’ধারে যে গ্রামগুলো পড়ে তা একদা আমার হাতের তালুর মতো চেনা ছিল, কিন্তু এখন আর চিনতে পারি না। সব গ্রাম শহর হয়ে যাচ্ছে। গত অক্টোবরেই ওই ঘুরপথে কলকাতা ফিরেছিলাম। এবার আমি যেন গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে গেলাম। ছায়া-ঢাকা খড়, টিন বা টালির ছাওয়া ঘর-গেরস্তি কোথায় উবে গেল? তার বদলে দু’পাশে পাকা বাড়ি, দালানকোঠা, ভিড়ের বাজার। অজয় নদের ওপর লোচনদাস সেতু পেরিয়ে যেতে যেতে খুঁজে দেখছিলাম কোথায়, কতদূরে আমার কৈশোর-যৌবনের চারণভূমি?

কোথায় কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কোগ্রাম আর কালো জলের নদী কুনুর, যে নদীতে আমি মঙ্গলকোটে পিসিমার বাড়ি গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সাঁতার কাটতাম। বেড়াতে আসতাম নতুন হাট-বাজারে। কিন্তু কোথায় গেল সব? যতদূর চোখ যায় ডাইনে-বাঁয়ে-সামনে ক্রমাগত পাকাবাড়ি, দালানকোঠা হল্লা-জেল্লা ভিড়, মোটরসাইকেল আর চারচাকার রঙ-বেরঙের গাড়ি। মঙ্গলকোটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে চিনতে পারলাম না ১৯৫৬ সালে বউকে নিয়ে পিসিমার বাড়িতে আসার সময়ে যে নিভৃত ছায়াঢাকা বড়তলায় যে গোরুরগাড়ি অপেক্ষা করছিল আমাদের নিয়ে যেতে, সেখানে শহরের নিপুণ আদলে গড়া উজ্জ্বল বাজার।

এই যে আমার প্রতি বছর চার-পাঁচবার করে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া, আর প্রতিবারই গ্রামগুলোর রূপ বদল হয়ে গ্রামনগরীতে রূপান্তর, এগুলো কি উন্নয়ন নয়? চাষির ছেলেও জিনস, টিশার্ট পরে। মোটরসাইকেলের পিছনে বউকে নিয়ে যাতায়াত করছে। আমারই গ্রাম খোশবাসপুরের কথা বলছি। যতবারই যাই দেখি মুসলমানপাড়ার অসংখ্য ছেলেমেয়ে স্কুলের পোশাক পরে অদূরে গোকর্ণের হাইস্কুল-গার্লস স্কুলে পড়তে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, মেয়েরা নতুন নতুন সাইকেল চেপেও যাতায়াত করছে। এই দৃশ্য যে আমার কাছে কী প্রচণ্ড বিস্ময় তা অন্যরা বুঝবেন কী করে? তাঁরা তো আমার মতো আবার গ্রাম বা সেখানকার মানুষজনকে দেখেননি। আমার গ্রামেরই পাশে কান্দি-বহরমপুর পিচ-রাস্তার মোড়ে সোনা ফলানো ধানের জমিগুলো গড়ে লাখ টাকা কাঠা দরে বিক্রি হয়ে গড়ে উঠছে একের পর এক পাকাদালানের দোকান। রাহুল গান্ধী তো এ গ্রামে জন্মাননি, তিনি হয়ত বলবেন – আহা, এই সব ছোটোখাটো ইটের বাড়িতে বাস করে?

এবার বলি এই উন্নয়নের পিছনে একটা প্রধান অবদান যে জমিতে বিঘেপিছু বছরে ফলত মাত্র ৭-৮ মন ধান, এখন উচ্চফলনশীল ধান বছরে দুবার বৈদ্যুতিক নলকূপের জলে সেচ পেয়ে ফলাচ্ছে আগের হিসেব-মতো দুবারে বিঘে-প্রতি ২৪ মন করে ধান। কৃষিতে একদা যারা উদ্বৃত্ত হয়ে জন-মজুর খাটত, তাঁদের অনেকেই পিচ-রাস্তার ধারে চা বা খাবারের দোকান করেছে। অনেকেই পাড়ি জমিয়েছে মোরাদাবাদ-দিল্লি-মুম্বই। আবার আরও কিছু লোক গেছে আরবে, শেখদের উট বা ছাগল চরাতে। প্রতিবন্ধীরা গেছে নিছক ভিক্ষার জন্য।

এইসব বিচিত্রমুখী উন্নয়ন ক্রিয়া বা পদ্ধতির পেছনে অবশ্যই বামফ্রন্ট সরকারের ৮০ শতাংশ অবদান আছে। কৃষি-সংস্কার, ব্যপক বিদ্যুদয়ন, রাস্তা-ঘাট তৈরি, পানীয় জলের ব্যবস্থা ও চাষের পদ্ধতিতে নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার ফল গ্রামসমাজের এই বিপুল উন্নয়ন। বিশেষ করে, বিগত এক দশকে এই উন্নয়নের গতি আবার আগের দুটি দশকের তুলনায় দু-গুণ থেকে তিন-গুণ তা আমি চোখ বুজেই বলতে পারি। কেন পারব না? এই তো মার্চ মাসে আমার লড়ঝড় মার্কা ২০ বছর বয়সী পেট্রল-খেকো অ্যাম্বাসাডর আমাকে গ্রামে নিয়ে গিয়ে আরও চমকে দিয়েছে। তার কারণ কলকাতা থেকে ঘরে পরার চটিজোড়া নিয়ে যেতে আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভুলে গিয়েছিলাম। আমরা ঘরে ঢুকেই ব্যাপারটা আবিষ্কার করার পর দুজনেই মুখ তাকাতাকি করছি, আমার ভাইপো নীলাঞ্জন বলে উঠল, ‘কই টাকা দিন, আমি তেমাথার দোকান থেকে চটি এনে দিচ্ছি’। কিছুক্ষণের মধ্যেই নামি কোম্পানির চটি পেয়ে আরামে পা-গলিয়ে চাপা হেসে বললাম- ‘হ্যাঁ রে অঞ্জন! একেই কি বলে উন্নয়ন?’

নীলাঞ্জন হাসতে হাসতে বলল- ‘আপনি জানেন এখন আমাদের এই মুসলিম পাড়ার কথাই বলছি, প্রায় প্রতিটি ঘরেই রঙিন টিভি। কোথাও ডি ভি ডি প্লেয়ার চলছে। আপনার মানুর ছেলে সি ডি আর ভি সি ডি-র দোকান করেছে। আর লক্ষ করবেন, ছোটোবড়ো মেয়েপুরুষ সবার হাতে মোবাইল ফোন।’

ঠিক কথা। এভাবেই তো সব দেশে উন্নয়ন ঘটে।

 

[আজকাল। ২৮ এপ্রিল, ২০০৯]