প্রতিভা সরকার
ভোটের ব্যাপারে সোনাগাছিবাসিনীদের দুভাগে ভাগ করা যায়। একদল ভোট দিতে যায় না, আরেক দল যাবেই।
যারা যায় না তাদের অনেক হতাশা। কাজের সময় নষ্ট হবে, কী লাভ ভোট দিয়ে। এক বিগতযৌবনা বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, ছেলে বৌয়ের অপব্যবহারে গৃহত্যাগ ইত্যাদি ব’লে বলে যে আবার পয়সা খরচ করে ভোট দিতে যাব সেই আরামবাগে! তাছাড়া ভোট পড়ে থাকে না, পার্টির ছেলেরাই দিয়ে দেয়। আরামবাগের মানুষ বলেই কিনা জানি না, পূর্বতন সরকারের ওপর এর বেজায় রাগ।
নদীয়ায় যে ভোট দিতে যাবে, সেই টিয়া এই এলাকার বেশিরভাগ মেয়ের মতোই আদ্যন্ত একজন মা। অর্থাৎ মাতৃত্বেই মুক্তি খোঁজা এক নারী। সে বার বার শিশুর সুরক্ষার কথা বলছিল। নিজের পড়া হয়নি ঠিকমতো, তার আগেই অসৎসঙ্গে পড়ে গেছি, এখন পড়াশুনো করে বাচ্চাকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য এত কষ্ট করছি, আর সরকার যদি সে ব্যাপারে সাহায্য না করে তাহলে সব চেষ্টাই তো বৃথা যাবে। এ মেয়ে পরিষ্কার বলে, আমি ভারতের নাগরিক, ভোট দেওয়া আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে। এর ওপরেই নির্ভর করছে আমার ব্যক্তি পরিচয়। এই ডকুমেন্টগুলো আপডেটেড রাখা আমার কাছে খুব জরুরি।
আমার একটু তর্ক করার বাসনা হয়। বলি একবার এপিক কার্ড তৈরি হলেই তো হয়ে গেল, আবার অত দূরত্ব উজিয়ে ভোট দিতে যাবার দরকার কী। উত্তরে সে বলে, না, যাওয়াটাও আমার কর্তব্য। অনেক জটিলতার মধ্যে আমরা থাকি। কত জনমের শত্রু সব চারপাশে। ঠিকঠাক লোক নির্বাচিত হয়ে না এলে জ্বালা আরও বাড়ে।
আর প্রত্যাশা হিসেবে সে বলে লোকালিটির উন্নয়ন। মানুষ বাস করার মতো পরিবেশ, রাস্তাঘাট, সিকিউরিটি। আমরা খুব ইনসিকিওরড লাইফ কাটাই জানেন তো নিশ্চয়।
এর কথায় ইংরেজি শব্দের খুব আধিক্য। পরিষ্কার ও সঠিক উচ্চারণ। প্রুভের নাউন প্রুফ-কে প্রুফই বলে জানায়, আমরাও যে মানুষ তা প্রমাণের জন্যও প্রুফ রাখতে হয়, এমনই জীবন।
আর একটি মেয়ে ভোট দিতে যাবে রানাঘাট। নির্বাচিত সরকারের কাছে প্রত্যাশা জিনিসপত্রের দাম কমানো। ওষুধের দাম প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। আর শিশুদের পড়ার খরচ। ভোট এর কাছেও সামাজিক পরিচিতি। এলাকার বাইরে যে পৃথিবী সেখানে কোনও সাধারণ স্বাভাবিক অধিকার প্রয়োগ সে করতেই পারে না। তাকে করতে দেওয়া হয় না। কিন্তু সে জানে সেতুবন্ধনে কাঠবেড়ালীরও অবদান ছিল। আর একটি নতুন কথা এই মেয়েটি বলে, তা হল মেয়েদের সুরক্ষা। রাস্তাঘাটে তাদের হেনস্থা হবার কথা।
তাহলে দেখা যাচ্ছে সামাজিক পরিচয় ছিনিয়ে নেবার ক্ষেত্রে ভোটধিকার প্রয়োগ যৌনকর্মীদের একটি হাতিয়ার। ভোটারের মতো সম্মানজনক আর একটি পরিচয়ই আছে সোনাগাছিতে। সেটি মাতৃত্ব। কারও মেয়ে, বৌ, প্রেমিকা তো এরা নয়।
একমাত্র যে পরিচয় স্বতঃপরিস্ফুট তা জননী পরিচয়। শাসকের কাছে চাওয়ার তালিকায় প্রথমে তাই সন্তানের শিক্ষার সুগমতা। অথচ ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে অন্য জীবন পেলে আর মাকে দেখে না। বরং এই বৃত্তিতে যারা থেকে যায় তারা মাকে তাও কিছু দেখে। নিজের নিষ্করুণ জীবনের পাঁকে হয়ত প্রাক্তন যৌনকর্মী মায়ের প্রতি কিছু করুণা সঞ্চিত থাকে। তবে অন্য মায়েদের মতো সোনাগাছি জননীরাও আর কবে সন্তানের ভবিষ্যত বিবেচনার তোয়াক্কা রেখেছে!
চাহিদার তালিকায় প্রথমেই ওষুধের দামের উল্লেখের কারণ খুব স্পষ্ট। এখানকার হান্ড্রেড পারসেন্ট মেয়ে রুগ্ন। যৌনব্যাধি তো বটেই, নোংরা পরিবেশে অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসে শারীরিকভাবে খুবই কাহিল থাকে এরা। নানা ওষুধ খাওয়া অভ্যাসে পর্যবসিত হয়। সবচেয়ে বেশি দরকার হয় মুঠো মুঠো ব্যথা কমাবার পিল। এদের শিশুরাও রুগ্ন। বৃত্তির কারণেই মা তেমনভাবে দেখভাল করতে পারে না। খুব ছোট বয়সে নানা নেশার ফাঁদে বাচ্চারা আকছারই পড়ে যায়। মেয়ে সন্তান, যতই ছোট হোক না কেন, রেপড হবার সম্ভাবনা থেকেই যায়। পাগলের মতো সন্তানের জন্য হস্টেল খোঁজে তাই সোনাগাছির মা।
স্বাভাবিক, যে দেশের নির্বাচিত সরকারের কাছে তার চাহিদাগুলি এইরকমই হবে। একটু খেয়াল করলে দেখি দুমুঠো ওষুধ ছাড়া নিজের জন্য কিছুই চায় না এ নারী। একেবারে আত্মকেন্দ্রিক কোন দাবী নেই তার। পেনশন, ডিএ, মাসমাইনে, কোনওপ্রকার ভাতা, অর্থসাহায্য, দুটাকার চাল, গৃহঋণ, কিচ্ছু না। তার চাহিদায় আছে শিক্ষা উন্নয়ন, এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন, মূল্যবৃদ্ধি রোধ, মহিলা সুরক্ষা।
ধর্মের নামও নেয়নি একজন যৌনকর্মীও। হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয় সত্তার দোহাই দিয়ে তার কাছে কেউ যদি ভোট চায় কী করবে সে, এই প্রশ্নে কাচভাঙা হাসে আসিয়া। উলটে আমায় জিজ্ঞাসা করে আমি কোনও হালাল বেশ্যা বা শুদ্ধ বারাঙ্গনার কথা জানি কিনা। আরও বলে, এই মহল্লায় এত মারামারি হয়, কিন্তু ধর্মীয় মারামারি সে দেখেইনি। এ পেশায় জাত ধর্ম নিয়ে ভাবলে চলে না। রক্তদাতা বা ফুলবিক্রেতাকে যেমন কেউ জিজ্ঞাসা করে না তার জাত কী, ঠিক তেমনই ঘরের দরজায় দাঁড়ানো কাস্টমারকে কেউ জাত ধর্ম নাম শুধোয় না। একটাই বিবেচনা, লোকটির পকেটে পয়সা আছে কিনা।
যে রাজনীতিকরা স্বার্থ চরিতার্থতাকেই একমাত্র সাফল্য ও অর্জন বলে ভাবে, ধর্মের নামে দাঙ্গা উসকে যারা ভোট চায়, সীমান্তে প্রহরারত সৈনিকের সুরক্ষার ব্যবস্থা না করেও তার নাম ব্যবহার করে বা অভিশাপের ভয় দেখিয়ে ভোট চায়, যারা বুথ দখল ক’রে আসল ভোটারদের মেরে বাড়ি পাঠায়, খুনখারাবি বা যে কোনও মূল্যে প্রধানমন্ত্রীর মসনদ দখল করতে চায় তাদের কি কিছু শেখার আছে এই মেয়েদের কাছ থেকে?
আর কিছু না থাকুক মে দিবস পালন করাটা শেখাই যায়। কিন্তু দুনম্বরি রাজনীতিক আর তাদের তোলাবাজ চেলাচামুণ্ডারা মে দিবসের তাৎপর্য জানে? গরীবের ন্যায্য পাওনা দিতে যে ভয় পায়, সে শ্রমের মর্যাদার দাবী রাখবে কী করে? সোনাগাছির মেয়েরা সেদিকেও অনেক কদম এগিয়ে আছে। দুর্বারের নেতৃত্বে আগামীকাল ত্রিশে এপ্রিল দুর্বারের নেতৃত্বে শুরু হচ্ছে তাদের মে দিবসের আগাম মিছিল। শ্রমিকের মর্যাদা চাই এবার তাদের। শুধু ভোটাধিকার প্রয়োগে থমকে না থেকে সবচেয়ে বিপজ্জনক পেশার মেয়েটি এই মে দিবসে যে পোস্টার বহন ক’রে সফল করবে শ্রদ্ধানন্দ পার্কের জমায়েত তার ছবি রইল।
প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে…
*সব নাম পরিবর্তিত