Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চলে গেলেন শ্যামল গুহ…

শ্যামল গুহ | কর্ণধার, বই-চিত্র

ব্রত দেবরায়

 

১৯২০-র দশকে কলেজ স্ট্রীটের অ্যালবার্ট হল-এর তিন তলা জুড়ে ছিল চারুচন্দ্র গুহ-র প্রসিদ্ধ সি গুহ স্টুডিও। কে না এসেছেন সেখানে ছবি তুলতে— শরৎচন্দ্র, সুভাষ বসু প্রমুখ বিখ্যাতরা তো বটেই, সাধারণ মধ্যবিত্ত রুচিশীল সম্প্রদায়ের বাঙালির কাছে সি গুহ স্টুডিওতে ছবি তোলানো ছিল একটা উৎসবের মতো ব্যাপার। বোর্ন অ্যান্ড শেপার্ড, হল অ্যান্ড অ্যান্ডারসন-এর মতো সাহেব স্টুডিওর সঙ্গে সমানে পাল্লা দিত এই বাঙালি স্বদেশি প্রতিষ্ঠান। তার পর কালের নিয়মে ১৯৫০-এর দশকে নিভে গেল সেই স্টুডিওর বাতি। ভাঙাচোরা রূপে হলেও, রইল সেই বিখ্যাত ঘর। ততদিনে অ্যালবার্ট হল-এর নাম বদলে হয়েছে কফি হাউস।  চারুচন্দ্র গুহর কনিষ্ঠ পুত্র শ্যামল গুহ বহু টাকার প্রলোভন হেলায় উপেক্ষা করে, উপরন্তু গাঁটের পয়সা খরচ করে ২০০৪ সালে সেই ঐতিহাসিক ঘরকে রূপান্তরিত করেছিলেন বই-চিত্র গ্যালারি ও সভাঘরে, বাণিজ্যিকতা এবং সরকারি অনুদানের কলুষমুক্ত সংস্কৃতি-চর্চার অবাধ কেন্দ্র হিসেবে যা আজ সুপরিচিত। এইভাবেই বজায় রইল ঐতিহ্যর ধারাবাহিকতা আর সম্মুখগতির স্রোত। শ্যামল গুহ চিরকালই সমাজবদলের সংগ্রামে নিবেদিত ছিলেন। সংস্কৃতির ওপর আজকের নিও-লিবারল পণ্যায়নের আঘাতকে কীভাবে অন্তত কিছুটা প্রশমিত করা যায়, ক্রমে সেটাই হয়ে উঠল তাঁর ধ্যানজ্ঞান।

বাঙালিরা হয় গোষ্ঠী-রাজনীতি, নাহয় টাকার প্রলোভনের কাছে সহজে বিকিয়ে যায়— এই বহু-উচ্চারিত ধারণার মূর্ত জ্যান্ত প্রতিবাদ ছিলেন শ্যামল গুহ (২০/৯/১৯৩৮-৩/৪/২০১৯)। রণেন রায়চৌধুরী, পরেশ ধরের সঙ্গীতভাবনা কিংবা রাজেন্দ্রলাল মিত্রর ফোটোগ্রাফি-চর্চা, মুকুর সর্বাধিকারীর বহুমুখী সংস্কৃতি-ভাবনা কিংবা  নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর ফুটবল-চর্চা, বহু পরিশ্রমে এইরকম বহু বিচিত্র বিষয়ের মালমশলা সংগ্রহ করে রেখেছিলেন শ্যামলদা। তাঁরই উৎসাহে ২ জানুয়ারি ‘বেঙ্গল ফোটোগ্রাফি ডে’ হিসেবে নিয়মিত পালিত হয়ে চলেছে বছরের পর। নানা ঘরানার ফোটোগ্রাফি চর্চাকে এক জায়গায় আনতে চেয়েছিলেন তিনি, চেষ্টা করেছিলেন একটি ফোটোগ্রাফি আর্কাইভ তৈরি করতে। অনেক কাজ অপূর্ণ রয়ে গেল। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে রয়ে গেল তাঁর হাতে-গড়া ‘সি গুহ স্মরণে বই-চিত্র গ্যালারি’।

নিখাদ বামপন্থী পরিমণ্ডলের এই মানুষটির অসাধারণ ক্ষমতা ছিল মূল আদর্শে অবিচল থেকে সকলকে নিয়ে চলবার। তাই গড়ে তুলেছিলেন ‘বই-চিত্র কালচারাল সোসাইটি’। তাঁর অভিভাবকত্বে ওই সোসাইটি একের পর এক চিত্র-প্রদর্শনী, আলোচনাসভা, গানবাজনার আসরের আয়োজন করেছে। ফলে অনেকের কাছে বই-চিত্র হয়ে উঠেছিল দু-দণ্ড শান্তিতে নিশ্বাস ফেলার নির্মল আশ্রয়।

সেই সাংস্কৃতিক দূষণমুক্তির ধারা যাতে অব্যাহত থাকে সেই সংকল্প নিয়ে বই-চিত্র কালচারাল সোসাইটি গত ২৪ এপ্রিল বই-চিত্র সভাঘরে তাঁর কর্মকৃতি স্মরণে এক সভার আয়োজন করেছিল। সেখানে গান গেয়েছিলেন সীমা দাস, মেঘনাদ, বিমল দে, সঞ্চিতা রায়চৌধুরী। কবিতা পাঠ করেন ব্রততী দত্তগুপ্ত। আলোচনা করেছিলেন আশীষ লাহিড়ী, তুষার চক্রবর্তী, দেবব্রত পান্ডা, প্রবীর মুখোপাধ্যায়, মিতা ভট্টাচার্য, সলিল বিশ্বাস, ভাস্কর দত্ত ও আরো অনেকে। সংস্কৃতির পণ্যায়নের বিরুদ্ধে শ্যামল গুহর এবং বই-চিত্র কালচারাল সোসাইটির লড়াই জারি আছে ও থাকবে, এই সংকল্পে সামিল সকল সুস্থচেতনাসম্পন্ন বাঙালি।

[ছবি- সলিল বিশ্বাস]