Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

লোকসুরের জাদুকর অমর পাল

অমর পাল | লোকসঙ্গীতশিল্পী

শুভেন্দু মাইতি

 

যে সময়ে নানাদিক থেকে নানাভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে সুস্থ সংস্কৃতি, ঠিক তখন একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে অমর পালের স্বর্ণকণ্ঠে লোকসঙ্গীত শোনার সুযোগ পেয়েছি আমরা, এ আমাদের সৌভাগ্য। শিল্পী হিসাবে অমর পালের ব্যাপ্তি ছিল বিভিন্ন মানের শ্রোতার কাছে। যিনি এমনিতে লোকসঙ্গীত শোনেন না, তিনিও অমরদার গান শুনেছেন।

শিল্পী হিসাবে অমরদার খ্যাতির বয়সই প্রায় সত্তর বছর। তিরিশের কোঠায় যে জনপ্রিয়তা উনি পেলেন, এই আটানব্বইতে চলে যাবার সময় পর্যন্ত তাতে কোনও খামতি ছিল না। প্রভাতী ও ভাটিয়ালি গানে নাগরিক শিল্পীদের মধ্যে অমরদা ছিলেন দক্ষতম এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নাগরিক শিল্পী— এই বাক্যবন্ধে আমি ধরতে চাইছি তাঁদের, যাঁরা গ্রামে জন্মে ও বড় হয়ে উঠেও গানের চর্চায়, প্রভাববিস্তারে এবং যশোপার্জনে মূলত শহরনির্ভরই ছিলেন। এই গোত্রের শিল্পীদের মধ্যে অমরদা ছাড়াও ছিলেন নির্মলেন্দু চৌধুরী, ছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও দীনেন্দ্র চৌধুরী। এঁদের সকলের মধ্যে অমরদা অনন্য ছিলেন একটি কারণে— এতদিন শহরে কাটিয়েও ওঁর গায়নভঙ্গিতে শহরের ছাপ পড়েনি। লোকসঙ্গীতকে কখনওই তিনি ‘নগরের মত’ করে পরিবেশন করতে চাননি। বহুবিধ বাজনা-সহযোগে নাগরিক মানুষের চাহিদার কথা ভেবে লোকসঙ্গীতের পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে নগরায়নের যে ধারাটি বাহিত হয়েছে, সেই স্রোতে কোনওদিনই অবগাহন করেননি অমরদা। অমরদা ছিলেন সেই ব্যতিক্রমী মানুষ, সারাজীবন নগরে থাকলেও, নাগরিক ক্লেদ গায়ে মাখেননি।

লোকসংস্কৃতির শিকড়ের প্রতি অমরদা এতটাই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, যে ওনার মতে যা লোকসঙ্গীতের বিচ্যুতি, তা উনি সহ্য করতে পারতেন না। এ-নিয়ে আমাদের মধ্যে কিঞ্চিৎ মতান্তরও ঘটে গেছে কখনও সখনও। উনি ছিলেন রক্ষণশীল, আর আমার বক্তব্য হল লোকসঙ্গীত জীবন্ত, তাই পরিবর্তনশীল। এই ব্যাপারে শেষতক ঐকমত্যে পৌঁছনো আর সম্ভব হয়নি। এখানে একটা কথা পরিষ্কার করে রাখা কর্তব্য। কেবলমাত্র বাণিজ্যিক কারণে লোকসঙ্গীতের ওপর পরিবর্তনের খাঁড়া নামিয়ে আনার পক্ষপাতী আমিও নই। আমার মতে, পরিবর্তন হবে জৈবিক নিয়মে, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। বাজারের দিকে তাকিয়ে যে পরিবর্তন, আমি তেমন বদলের বিরোধী।

এই প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ে যায়। বেশ কিছুদিন আগের কথা। লোকমান ফকির তখন বেঁচে। আমি গেছি তাঁর আখড়ায়, ক’দিন গান শুনব শিখব এই বাসনা নিয়ে। আমার থাকাকালীন তৃতীয় দিনে লোকমান একটি লালনের গান গাইলেন। একই গান প্রথমদিনেও শুনেছি। তবে তৃতীয়দিনে এর সুর ছিল প্রথমদিনের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা। এই কথা ওঁকে জিজ্ঞেস করতে উনি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন— সুর কি গানের হয়? সুর হয় ভাবের। যেদিন যেমন ভাব, সেদিন তেমন সুর। গানের শুদ্ধতার প্রসঙ্গে এই গল্পটা শোনাতে ইচ্ছা হল।

নিজের গায়নশৈলীর ক্ষেত্রে অমরদা সুকৌশলে একটা ব্যাপার ঘটিয়েছিলেন। ওঁর কণ্ঠের যে আঁশ, তা মোটেও লোকশিল্পীসুলভ ছিল না। এখানে লোকশিল্পী বলতে আমি বলতে চাইছি স্টারভ্যালুরহিত প্রান্তবাসী সেইসব লোকশিল্পীর কথা যাঁরা লোকশিল্পের মূল ধারক ও বাহক। অমরদা নিজস্ব একটি ভঙ্গি তৈরি করেছিলেন যা লোকশিল্পীরও নয়, আবার নাগরিকও নয়। লোকগানের তীক্ষ্ণ, তীব্র, গাঢ় রসটিকে তিনি কোমলতর রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা শহুরে সংস্কৃত শ্রবণে অনেকটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। ওঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম হয়ত এই বিষয়ে ওঁর সহায় হয়ে থাকবে।

অমরদার আরেকটা গুণ দেখে বিস্মিত হতাম। সেটা ওঁর স্মৃতিশক্তি। ওঁর সুদীর্ঘ সঙ্গীতজীবনের অনেক অনুষ্ঠানেই আমি ওঁকে গান গাইতে দেখেছি। তবু কোথাও ওঁকে খাতা দেখে গাইতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। যে ধরনের গান গাওয়াকে উনি জীবিকা করেছিলেন, তেমন গানকে একেবারে অন্তরে ধারণ না করলে, তার সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব না করলে এমনভাবে মনে রাখা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।

আমি নাস্তিক বামপন্থী মানুষ। ঈশ্বরে বিশ্বাস আমার নেই। তবু অমরদার কণ্ঠ শুনে বলতে ইচ্ছা করে, বিধাতাপুরুষ সমস্ত সুর যেন অকৃপণ হস্তে ওঁকেই অর্পণ করেছেন। জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও সুর ওঁকে বিন্দুমাত্র ছেড়ে যায়নি। এ যে কত বড় পাওয়া, সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত সকলেই তা জানেন ও মানেন। আমি বছর দুয়েক আগেও সামনে থেকে ওঁর গান শুনেছি, এবং দেখেছি, সেই ছিয়ানব্বই বছর বয়সেও, সুর এক চুল নড়ে না! এ-ক্ষেত্রেও অমরদা কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রমই বটেন।

প্রতিটি শিল্পীরই সারাজীবনের সঞ্চয় রেখে যাওয়ার জন্য এক আধার চাই। খেদের বিষয় এই, যে ওঁর ঘরানাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, এমন বিশেষ ছাত্রছাত্রী অমরদা রেখে গেলেন না। এতে নাগরিক পরিমণ্ডলে লোকসঙ্গীত চর্চার একটু ক্ষতি তো হলই। লোকসঙ্গীতের ঘরানা হয় না, বাহিরানা হয় এই সত্য স্মরণে রেখেই অমরদার ক্ষেত্রে ঘরানা শব্দটার অবতারণা করলাম— অমরদার লোকসঙ্গীতের চর্চা ও পরিবেশনের পরিমণ্ডলের কথাটা মাথায় রেখে।

বাংলার লোকসঙ্গীতের প্রতি অমরদার প্রেম ছিল প্রশ্নাতীত। তবু আমার একটা ব্যক্তিগত আক্ষেপ এই, যে উনি কখনও নিজের বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে লোকশিল্পীদের সঙ্গে সময় ব্যয় করলেন না। তাঁদের সঙ্গ করলেন না। এই প্রশ্ন অমরদাকে আমি বহুবার করেছি। কিন্তু প্রতিবারই উনি মৃদু হেসে এড়িয়ে গেছেন। আমার বিশ্বাস, নিজের পরিধিকে অতিক্রম করলে আমরা আরও বেশ কিছুটা লাভবান হতাম। আরও অনেক গান ওঁর হিরণ্ময় কণ্ঠে শুনতে পেতাম।