শতাব্দী দাশ
মাম্মাম,
প্রথম চিঠিতে আমরা ভাষার নানা খুঁটিনাটি নিয়ে খানিক আলোচনা করেছিলাম, মনে আছে? নানারকমভাবে লিঙ্গায়িত ভাষা৷ আজ বরং অকূল ভাষাসমুদ্রের একটিমাত্র শব্দের উপর জোর দিই, কেমন?
একটি শব্দ মাত্র। তবে সে শব্দের বিস্তার ও অভিঘাত বড় কম নয়৷ এবারেও ধরে নিচ্ছি, তুমি এ চিঠির ফোল্ডার হাতে পাবে তিরতিরে কৈশোরে৷ যখন শরীর নিজের খেয়ালে ডানা মেলছে। মনে নতুন ভাবনাদের নিত্য যাতায়াত। সে বয়সে আলোচ্য শব্দটি চটজলদি শিখে ফেলা দরকার, তার সমস্ত ছোটবড় তাৎপর্য সহ। নাহলে অচিরেই তপতপে মাটি বড়সড় খোঁচা খেতে পারে। শব্দটি হল, ‘বেশ্যা।’
চমকালে? মা মেয়েকে বেশ্যাবৃত্তান্ত বোঝাতে চিঠি রেখে যায়, এমনও হয়?
আজ ২০১৯। লোকসভা নির্বাচন সমাগত৷ জনতা তাদের প্রতিনিধি বেছে নেবে, তাদের পাঠাবে সংসদে। এহে! তুমি তো বড় হয়েছ এতদিনে। হাতে-কালি হবে ক’বছরে। এখন এসব বোঝো নিশ্চয় খানিক। কেমন করে দুই খারাপের মধ্যে থেকে অপেক্ষাকৃত কম খারাপ বেছে নিতে হয়… তুমি কি স্বপ্ন দেখো? বদলে ফেলার স্বপ্নটপ্ন দেখো তোমরাও?
২০১৯ সালের ভোটের আগে একটি লেখার বরাত পেয়েছি৷ বিষয় হল, ভোটের প্রচার-প্রক্রিয়ায় মহিলা প্রার্থীদের চরিত্রহনন। লিখতে গিয়ে একের পর এক খবর পড়ছি, স্ক্রোল করছি, নিউজ পোর্টাল থেকে নিউজ পোর্টাল… একই শব্দ বারবার চোখে পড়ছে, তার নানা প্রতিশব্দ সহ৷
বেশ্যা৷
প্রসটিটিউট।
পতিতা।
বহুগামিনী৷
রক্ষিতা৷
স্লাট।
এসব শব্দ বিভিন্ন মহিলা প্রার্থীদের হেয় করতে ব্যবহার করছেন তাঁদের প্রতিপক্ষরা। কখনও আগুন-ঝরানো বক্তৃতাতে, কখনও বা লিফলেটে। আর পার্টি-অফিসের ইনফর্মাল আড্ডায়? চায়ের ঠেকে? সেখানে আর একটু নিম্নশ্রেণির অপভাষাও নিশ্চয় জায়েজ! রেন্ডি। মাগী৷ খানকি। জননেত্রী বা হবু জননেত্রীর চরিত্রে কালি লেপে দেওয়া হল বিপক্ষের মোক্ষম হাতিয়ার। তিনি কর্তব্যে গাফিলতি করেছেন বা বড়সড় আর্থিক কেলেঙ্কারি করেছেন, এই মর্মে চরিত্রহনন নয় কিন্তু৷ ইঙ্গিতপূর্ণ বা স্পষ্ট ভাষায় আসলে যা বোঝানো হচ্ছে, তা হল, তিনি ‘বেশ্যা’।
কেন বলো তো? কেন আসছে বারবার এই কথা? একই টার্ম? খবরগুলো পড়ছি, ভাবনাদের গোচ্ছাচ্ছি ভারিক্কি নিবন্ধ লেখার জন্য। কিন্তু কিছুতেই এমন ভাবে সাজাতে পারছি না অধরা লেখাটিকে, যাতে স্পষ্টভাবে একটি বা দুটি সংসদীয় পার্টির বিরুদ্ধে, অথবা একটি বা দুটি সংসদীয় পার্টির পক্ষে অবস্থান নেওয়া যায়। এ এক মুদ্রাদোষ! বরং বারবার তোমার কথাই মনে পড়ছে।
যাইহোক, লোকসভা নির্বাচন ও বেশ্যাবৃত্তান্ত প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সেই অধ্যায়ে সাম্প্রতিকতম সংযোজন হল আতিশি মারলেনার চরিত্রহনন। আতিশি পূর্ব দিল্লি কেন্দ্রের আপ প্রার্থী৷ পূর্ব দিল্লির-ই বিজেপি প্রার্থী গৌতম গম্ভীরের বিরুদ্ধে মানহানি এবং যৌন কুৎসা রটানোর অভিযোগ তুলে সাংবাদিক সম্মেলনে ভেঙে পড়লেন তিনি।
আতিশি এককালে ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। পরবর্তীকালে হয়েছিলেন আপ-এর বিদ্যালয় শিক্ষা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা। তাঁর তত্ত্বাবধানে দিল্লির সরকারি স্কুলগুলির পঠনপাঠনের উন্নতি ঘটছিল, শোনা যায়। স্কুল বাড়ি সংস্কার, শিক্ষক নিয়োগ, টিচিং এইডস ঢেলে সাজানো চলছিল। সাধারণ বাড়ির ছেলেমেয়েরা, বস্তিবাসী ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসতে উৎসাহ পাচ্ছিল৷ শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর এই মেসিহা রূপটিকে কাজে লাগাতেই তাঁকে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী করলেন মনে হয় দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আতিশির নির্বাচনী ইস্তেহারে স্কুলশিক্ষার পাশাপাশি জায়গা পেয়েছিল উচ্চশিক্ষাও৷ এবং সর্বোপরি, মেয়েদের সুরক্ষা। মহিলা বাস। মহিলা থানা৷ আরও অনেক ফিরিস্তি।
সাংবাদিক সম্মেলনে যে লিফলেটটি প্রকাশিত হল, তাতে দেখা গেল, আতিশির উপর ইংরেজি ভাষায় নানা অশালীন আক্রমণ, যা মূলত লিঙ্গভিত্তিক ও বর্ণভিত্তিক। শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, যেহেতু ‘সামান্য প্রাইমারি স্কুলে’ পড়াতেন। কিন্তু আক্রমণকারী দলের নেতাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কি খুব উল্লেখযোগ্য কিছু? তা যে নয়, সে কথা বুঝেই মনে হয় এরপর যৌন সুড়সুড়িময় কিছু বর্ণনা শুরু হল… কীভাবে তিনি এককালে যৌনতা করতে গিয়ে ‘ধরা’ পড়েন ও তাঁর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় সেই ব্যক্তির সঙ্গে। একে শিক্ষিকা, তদুপরি রাজনৈতিক নেত্রী। তাঁর যে অযৌন প্রাণিবিশেষ হওয়ার কথা ছিল, তা কে না জানে?
এরপর আছে উপমুখ্যমন্ত্রী মনীশ সিসোদিয়ার সঙ্গে তাঁর অবৈধ সম্পর্কের ইঙ্গিত। তাঁদের জারজ সন্তানের জন্মের সম্ভাবনার কথাও জানানো হয়েছে। প্রশ্ন করা হয়েছে, কেন তাঁর ‘স্বামী’-কে প্রচারে তাঁর সঙ্গে দেখা যায় না? অতএব প্রমাণ হল, যেমনটা আগেই বলেছি, তিনি বেশ্যা। দুয়ে দুয়ে চার।
পূর্ব দিল্লির কৃষ্ণনগর ও বিভিন্ন মহল্লায় আতিশির নামে নাকি কুৎসা-সম্বলিত ওই প্যামফ্লেট ছড়িয়েছেন গম্ভীরের লোকজন। দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মনীশ শিশোদিয়া ও মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, আতিশির পার্টিগত সহযোদ্ধা, গম্ভীরকে তিরস্কার করার সঙ্গে সঙ্গে মনে করিয়ে দিতে ভুললেন না, এমন মানুষকে ভোট দিলে মহিলাদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত নয়। মানহানির মামলা ঠোকার হুমকিও দিলেন। গম্ভীর এদিকে অদ্ভুতভাবে তার আগেই উক্ত দুজনকে ও আতিশিকেও মানহানির মামলার নোটিশ পাঠিয়েছেন শোনা গেল৷ কারণ, তাঁর কথা হল, তিনি এই লিফলেটের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। এটিকে তিনি আপ-এর নির্বাচনী চাল হিসেবে ব্যাখ্যা করলেন। বললেন লিফলেট তিনি বা তাঁর লোকেরা প্রচার করেছে এমন প্রমাণিত হলে প্রার্থীপদ ত্যাগ করবেন। কিন্তু এখন যেহেতু মনোনয়ন প্রত্যাহারের সময় অতিবাহিত, তাই জিতলেও তিনি নাকি সাংসদ পদ ত্যাগ করবেন, যদি তাঁর অপরাধ প্রমাণিত হয়। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে অন্যদিকে অনিল বাজপায়ি নামক পূর্বতন আপ, বর্তমানে বিজেপি, এক নেতার মুখে লিফলেটের সমর্থনই শোনা গেল প্রকারান্তরে। তিনি বললেন, আতিশিকে বেশ্যা বলছেন না বটে, তবে হ্যাঁ, ওই মেয়েমানুষ গোমাংস খায়, তা তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন৷ অর্থাৎ জল মেপে দল বদলও নীতিগতভাবে অন্যায় নয়, যত বড় অপরাধ হল গো-মাংস ভক্ষণ! তিনি আরও বললেন, নির্বাচনী প্রচারে মহিলার ‘স্বামী’-র অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই উচিত। অর্থাৎ, নির্বাচন লড়তে গেলে বিবাহিত মহিলাকে কারও স্ত্রী রূপে আর অবিবাহিত মহিলাকে কারও কন্যা রূপেই লড়তে হবে। নাহলে তিনি ‘বেশ্যা’ ভিন্ন আর কীরূপেই বা পরিচিত হবেন? ‘প্রস্টিটিউট’ কথাটি তাই নির্দ্বিধায় শোভা পাচ্ছে সেই লিফলেটে।
এ তো গেল লিঙ্গভিত্তিক আক্রমণ। বর্ণ ও জাতিভিত্তিক আক্রমণও আছে। আতিশির মা, বাবা ও স্বামী (যাঁকে এখন তাঁর আশেপাশে দেখা যায় না)— তাঁরা প্রত্যেকেই ভিন্ন ধর্মের/বর্ণের। অর্থাৎ আতিশি ‘মিক্সড ব্রিড’।
আরও এক আশ্চর্য যুক্তিক্রম আছে এখানে। আতিশির ‘অবৈধ প্রেমিক’ শিশোদিয়া এমনিতে সুদর্শন, কিন্তু তিনি এসসি, এবং শিফিউল্ড কাস্ট পরিবারে সকলেই কুদর্শন হয়, তাই শিশোদিয়া নিশ্চয় তাঁর মায়ের অবৈধ সন্তান!
অবাক হোয়ো না। এখনও এশিয়াডে মেয়ে পদক জিতলে বা লেখক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেলে প্রথমেই আন্তর্জালে তার ‘কাস্ট’ তদন্ত করে নেয় সর্বাধিক ভারতবাসী, গুগল তাই বলছে অন্তত।
উল্লেখ করি, ‘মারলেনা’ পদবীর ব্যাখ্যায় এক কালে আতিশি বলেছিলেন, এটি তাঁর পিতা বা স্বামীর পদবী নয়৷ মার্ক্স ও লেনিনের সংশ্লেষে ‘মারলেনা’। স্বনির্বাচিত পদবী তাঁর। দারুণ, নয় কি?
কিন্তু আতিশি তাঁর দলের পুরুষ সহকর্মীদের চাপে, ভোটের প্রচারে, পিতার পদবীই ব্যবহার করছিলেন শেষ পর্যন্ত। ‘সিং’। ৷ তাঁর নির্বাচনী এলাকা পাঞ্জাবী-অধ্যুষিত যে! নিজের দলের ভিতরেও আতিশিরা কতটা স্বকীয়তা নিয়ে টিকে থাকতে পারেন?
*******
২০১৯ সালের নির্বাচনে, বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে, আমরা একের পর এক ঘটনা দেখলাম মহিলা প্রার্থীদের বেশ্যায়নের। ইলেকশন কমিশনের কোড অফ কন্ডাক্টকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একের পর এক নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করে চলেছিলেন নেতারা৷ কয়েকটা ঘটনা বলি।
ধরা যাক, বাংলায় বাণিজ্যিক চলচিত্রের দুই নায়িকা, প্রার্থী হয়েছিলেন শাসক দলের হয়ে৷ তাঁদের সমালোচনা হতে পারত নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তাঁদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সন্দেহাতীত নয়। তাঁরা জনসাধারণের সঙ্গে হাত মেলাতেন গ্লাভস পরে৷ তাঁদের একজন প্রভাব খাটিয়ে প্রাক্তন প্রেমিককে পুলিশের চোখে ফাঁকি দিতে সাহায্য করেছিলেন, এমনও শোনা যায়৷ কিন্তু না, এসব সমালোচনা চাপা পড়ে গেছিল তাঁদের স্বল্পবাস-পোষাকের ছবির পাহাড়ে৷ মিমি আর নুসরতের ঠুমকা ভোটপ্রচারে কাজে আসবে কিনা, তা নিয়ে মিমের পর মিম জমেছিল।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যে আসলে মহাপরাক্রমী অতিপুরুষ, তা বোঝাতে তাঁর দল তাঁর বুকের বহর ছাপান্ন ইঞ্চি বলে প্রচার করে থাকে। তা নিয়ে ঠাট্টাও কম করে না বিরোধীরা৷ বিজেপির রাজ বব্বর তাই বললেন, তৃণমূলের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর বুকের মাপ জানলেন কী করে? পরপুরুষের ছাতির মাপ জেনে ফেলা কি খুব ভালো কথা? এই চটুলতার নামই এদেশে নির্বাচনী প্রচার।
আবার সেই তৃণমূল কংগ্রেসের ফিরহাদ হাকিম যে দক্ষিণ কলকাতার প্রার্থী অধ্যাপিকা নন্দিনী মুখার্জিকে উদ্দেশ্য করে ‘ক্কে তুমি নন্দিনী’ গাইলেন, তারও সাক্ষী থাকবে এই নির্বাচন। দলের মাথা নারী হলেই কি আর দলটি পিতৃতান্ত্রিক ভাষা বর্জনে সক্ষম হয়? হয় না।
সমাজবাদী পার্টির নেতা আবদুল্লাহ আজম খান বললেন, ‘আলি’ বা ‘বজরঙ্গবলি’, সবই তাঁরা মেনে নিতে পারেন (অর্থাৎ কিনা সর্বধর্ম-সমন্বয়ের মুখপাত্র হয়ে উঠলেন এই বলে), কিন্তু আনারকলি (অর্থাৎ নাচনেওয়ালি)-কে সাংসদ হিসেবে মানা যায় না। তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন বিজেপি-র জয়া প্রদা। জয়া প্রদা প্রাক্তন অভিনেত্রী ও সুনর্তকী।
অতিহিন্দু বিজেপির সহায়ক গোষ্ঠী যেহেতু খাকি প্যান্ট-পরিধানকারী আরএসএস স্বেচ্ছাসেবকেরা, তাই একই সমাজবাদী পার্টির আজম খান জয়া প্রদার খাকি অন্তর্বাসেরও ইঙ্গিত দিলেন। ফিরোজ খান বললেন, রামপুরের রাত জয়প্রাদার ছলা-কলায় রঙিন হয়ে উঠবে৷ জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ পিপলস রিপাব্লিকান পার্টির জয়দীপ কাওয়াডে বিজেপির-ই স্মৃতি ইরানি সম্পর্কে বললেন, তিনি যতবারই পুরুষ সঙ্গী বদল করেন, ততই বাড়তে থাকে তাঁর গোল বিন্দির আকার।
কংগ্রেসের প্রিয়াঙ্কা গান্ধিকে কখনও স্কার্টওয়ালি বাঈ, কখনও জিন্স পরা মহিলা বলে হ্যাটা করা হল। এসব যে বেশ্যা-তুল্য পোষাক তা কে না জানে! আরও মজার ব্যাপার হল, প্রিয়াঙ্কা গান্ধির নিজের দলের নেতাই তাঁকে সমর্থন করলেন এইভাবে: ‘আমাদের প্রিয়াঙ্কা সুন্দরী বলে ওদের ঈর্ষা। ওদের দলে কেলেকুচ্ছিত মহিলাদের মধ্যে একমাত্র হেমা মালিনীরই যা বলার মতো রূপ।’ সমর্থনেরও এই ভাষা৷
পক্ষান্তরে বলা হল, রাজনৈতিক নেত্রীরা, বেশ্যার মতোই, রূপোপজীবিনী৷ রূপ ভাঙিয়েই তাঁরা ভোট পান।
নর্তকী স্বপ্না চৌধুরির যেহেতু কংগ্রেস প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল, তাই বিজেপি-র বিধায়ক সুরেন্দ্র নারায়ণ সিং বললেন, কংগ্রেসের তরুণ সভাপতি রাহুলের সঙ্গে নিশ্চয় তাঁর কোনও সম্পর্ক আছে, ঠিক যেমন রাহুলের বাবা, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি এক ‘ইতালীয় নর্তকী’-কে (কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি সনিয়া গান্ধি) বিয়ে করেছিলেন।
কী ভাবছ? পাগলের প্রলাপ? না। নেতারা এ ভাষাতেই কথা বলেন। জনতার পিতৃতান্ত্রিক মগজেও এ ভাষাই ছাপ ফেলে। যদি বলা হয়, কোনও নির্দিষ্ট দলের প্রতিশ্রুতি ও প্রয়োগের ফারাক সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে দেখানো হবে, কোনও নির্দিষ্ট দলের নীতিগত দোষ বা দুর্বলতাগুলিকে যুক্তি সহকারে ধরিয়ে দেবে বিপক্ষ দল, তবে সেইসব আলোচনা জনসাধারণ শুনবে কি? শুনবে না। মহিলাদের নামে রসালো কেচ্ছা শুনতে সাধারণ মানুষও ভালোবাসে। এই সব প্রচারে সত্যি প্রভাবিত হয় তাদের ভোট।
এই প্রিয়াঙ্কা, এই জয়া, এই স্মৃতি, এই মিমি, নুসরত— এদের কারওরই পার্টিগত অবস্থান বা নীতিকে কিন্তু আপন ভাবা আবশ্যিক নয়। এঁরা দক্ষিণপন্থী নানা দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু এদের সবারই বেশ্যায়ন যেন অমোঘ ও অবশ্যম্ভাবী। কারণ এঁরা সকলেই নারী।
ভারতীয় সংসদে আজও মহিলাদের জন্য ৩৩% আসন সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি৷ হলেও সেই মহিলারা অনেকেই পুরুষদের হাতের ক্রীড়নক হিসেবেই কাজ করতেন হয়ত৷ কিন্তু এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই যে রাস্তায় বেরোনো, বেপর্দা চলাচল, চাকরি করা থেকে শুরু করে রাজনীতি করা— সবেতেই মেয়েদের পথকে কণ্টকিত করার প্রধানতম উপায় হল, তাদের চরিত্রহনন করা, তাদের ‘বেশ্যা’ দাগিয়ে দেওয়া৷ কারণ, এই বিশেষণকে মেয়েরা ভয় পান। আতিশি মারলেনা-র সহযোগী পুরুষরা তাঁর অবমাননা-পরবর্তী রাজনৈতিক প্রচারে কী ধরনের টুইট করছেন? কেজরিওয়াল বলছেন, একজন মহিলা এই দুর্নাম সহ্য করবেন কী করে? এ যে কী কঠিন সেই মহিলার পক্ষে, তা অনুমান করাই যায়…! অর্থাৎ, একবার ‘বেশ্যা’ তকমা পেলে যে নারীর ‘মুখ পোড়ে’, তা স্বপক্ষ, প্রতিপক্ষ সকলেই এক বাক্যে মানে। আর ঠিক এই কারণেই ‘বেশ্যা’ বলার, ‘বেশ্যা’ দাগিয়ে দেওয়ার, বেশ্যায়নের এই হিড়িক।
ভাবছ দক্ষিণপন্থী যে কোনও দলের থেকে এর বেশি আর কী আশা করা যায়? তবে জেনে রাখো— এই যে জয়া প্রদা বা নুসরত বা স্বপ্না চৌধুরির প্রসঙ্গ এলে মুজরো-টুজরোর কথা ওঠে, সেই মুজরো-টুজরো সত্যিই প্রত্যন্ত ভারতে ভোটের প্রচারের অঙ্গ। নেত্রী শরীর প্রদর্শন করেন না ঠিকই। তিনি বরং ভোট টানতে সুশীল ভারতীয় নারী হওয়ার দিকেই মন দ্যান এই ক’দিন। কিন্তু নারীশরীর দেখিয়ে ভোট চাওয়ার সংস্কৃতি যে আছে, তা অস্বীকার করা যায় না। বিহারের আরা-তে সিপিআইএমএল (লিবারেশন) দলের প্রচারে, একটি বামপন্থী দলের প্রচারে নারীশরীরের প্রদর্শন হয়েছে। রীতিমতো মাচা বেঁধে ভাড়া-করা স্বল্পবাস মহিলাদের নাচানো হয়েছে রাজু যাদবের প্রচারে। বাম-সংস্কৃতির জন্য সে বড় লজ্জার।
নারীকে স্তন, নিতম্ব, যোনি ইত্যাদির দোকান ভাবার সংস্কৃতি, সুতরাং, কোনও একটি দলের একচেটিয়া নয়। পিতৃতান্ত্রিকতা দক্ষিণপন্থায় হয়ত খোলাখুলি ও নির্লজ্জভাবে বিরাজ করে। বামপন্থায় তা থাকে ফরাসের তলায় চাপা ধূলার মতো।
********
কেন তোমায় বলছি এসব? কেনই বা বললাম, এই বেলা জেনে ফেলা দরকার?
বেশ্যা কে? ‘কামসূত্রে’ বাৎস্যায়ন চতুর্থ অধিকরণটি বরাদ্দ করেছেন বৈশিক বা বেশ্যাদের জন্য। এঁরা বারাঙ্গনা। দেহপোজীবিনী। রক্ষিতা। হাল আমলের যৌনকর্মী। দেহ যাঁর পুঁজি, যৌনক্রীড়া পেশা।
ইংরেজিতে প্রস্টিটিউট কে? বা স্লাট? ‘Prostitute’ কথাটি এসেছিল লাতিন ‘prostitutus’ থেকে।
‘Prostitutus’ হল ‘prostituere’ এর পাস্ট পার্টিসিপল। অর্থাৎ ক্রিয়াবিশেষ, যার অর্থ ‘to expose publicly for sale’। বুৎপত্তিগত অর্থে দেহ বিক্রির কোনও উল্লেখ নেই, তবে ‘প্রস্টিটিউট’ একরকম ‘পাব্লিক উওম্যান’ তো বটেই। আর ‘স্লাট’ হল, এক কথায়, নোংরা মেয়েমানুষ।
এ তো গেল আক্ষরিক অর্থ। কিন্তু সম্প্রসারণে? প্রথমত বহুগামী যে কোনও নারীই বেশ্যা। এমনকী, একটি সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে তারপর অন্য একটি সম্পর্কে জড়ালেও। বিষয়টি আবার শুধু যৌনতাতেও সীমাবদ্ধ নয়৷ একাধিক পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে অযৌন সম্পর্কও খুব নিন্দনীয় ব্যাপার।
বহু নারীসঙ্গ করা পুরুষের ক্ষেত্রে অহঙ্কারের, তা তার যৌন সক্ষমতার পরিচায়ক৷ কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে স্বভাব বড়ই নিন্দার্হ। একে শুধুমাত্র দক্ষিণপন্থী দলের মনোবিকার বা মনুবাদী হিন্দুত্বের অত্যাচার বলে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয় মনে হয়। নারীবাদ যতই নারীর যৌন স্বাধীনতার কথা বলুক, তার মর্মার্থ বুঝতে এখনও ঢের দেরি পিতৃতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় বাস করা নারী পুরুষ উভয়েরই। অথচ দেখো, চলতি কথায় আমরা ‘সতী’ শব্দের যে অর্থ করি, প্রাচীন ভারতেও কি সেই অর্থেই তা ব্যবহৃত হত আদৌ? প্রাচীন শাস্ত্র অনুসারে সীতা, সাবিত্রীরা কিন্তু ‘পঞ্চসতী’-র মর্যাদা পাননি৷ অহল্যা, কুন্তী, দ্রৌপদী, তারা, মন্দোদরী— এই হলেন ‘পঞ্চসতী’। প্রত্যেকেই একাধিক পুরুষের সঙ্গে সঙ্গম করেছিলেন, ২০১৯ সালের ভারতবর্ষের নির্বাচনী প্রচারের ভাষ্য অনুযায়ী সকলেই ছিলেন ‘বেশ্যা’।
এখানেই শেষ নয়। এখন পর্যন্ত শুধু প্রাথমিক অর্থসম্প্রসারণের কথাটুকু বলেছি। আরও আছে বাকি। ‘বেশ্যা’ হওয়ার সঙ্গে গণ্ডি ভাঙার এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। রাজনীতির এই মহিলারা হয়ত কেউ কেউ নিজেই কোনও দলের প্রধান। তবে অধিকাংশই কোনও না কোনও পুরুষ নেতার অঙ্গুলিহেলনে চলেন৷ কিন্তু কিছু নিষিদ্ধ গণ্ডি এঁরাও অতিক্রম করেছেন নিশ্চয়। তাই জুটেছে ‘বেশ্যা’ তকমা। রাজনীতি হল পাকা মাথার খেলা। লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাজনে বুদ্ধিবৃত্তি নারীর ভাগে পড়ে কই? সে গণ্ডি কোনওভাবে পেরিয়ে গেলে, খেসারত দিতে হয় বৈকি!
গণ্ডি ভাঙার হয় আরও রকমফের। ধরা যাক, কোনও মেয়ে সমাজ-নির্দিষ্ট পোষাক পরেনি। তাহলে সে বেশ্যা। ধরা যাক, সমাজ-নির্দিষ্ট ‘এঞ্জেল ইন দ্য হাউজ’ ভূমিকায় মানিয়ে নিতে পারছে না কেউ। সে বেশ্যা। ধরা যাক, মনে আনন্দ জমেছিল খানিক, তাই প্রকাশ্যে গলা ছেড়ে গান গেয়েছে বা নেচেছে। সে বেশ্যা। ব্রা-এর স্ট্র্যাপ দৃশ্যমান? বেশ্যা। রেস্তোঁরায় পছন্দের পানীয় হাতে তুলে নিয়েছিল। বেশ্যা৷ কলেজে রাজনীতি করেছে। বেশ্যা৷ নাটক করেছে। বেশ্যা। তর্ক করেছে। বেশ্যা৷
নিজের বিয়ে ভাঙলে? নিজের শ্বশুরবাড়ির চোখে বেশ্যা। গৃহহিংসায় কাতর অন্য মহিলাকে বিচ্ছেদ নিতে বললে? তার শ্বশুরবাড়ির চোখে বেশ্যা। প্রণয়প্রার্থীকে ‘না’ বলেছে। প্রণয়প্রার্থীর কাছে বেশ্যা৷ প্রেমিককে ‘হ্যাঁ’ বলেছে। বাড়ির লোকের কাছে বেশ্যা। লিঙ্গরাজনীতিতে যাকে আমরা স্লাট-শেমিং বলি, তার সূচনা হয় আসলে পরিবার থেকে, নিজের বাড়ি থেকে৷ পিতৃতান্ত্রিক পরিবার পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষদ্রতম একক যে! ভোটের প্রচারে স্লাট-শেমিং খুব একটা অপ্রত্যাশিত নয় অতএব৷
এইভাবে লক্ষণরেখা ডিঙোনো সব মেয়েই আসলে বেশ্যা। আর তোমাকে তো, মাম্মাম, আকাশ দিতে চাই, চার দেওয়াল নয়। তাহলে তুমিও তো…
আজকাল মাথা চিড়বিড় করে না, দৃষ্টি ঝাপসা হয় না, কান গরম হয় না। রাগ নেই? আছে। থাক। সাবলিমেশনের মাধ্যমে সমষ্টির কাজে লাগুক। কারণ অভিজ্ঞতা সমষ্টির। এই চিঠি এই কথা বলতেও লেখা যে ‘স্লাট’ শুনলে আসলে স্বস্তির শ্বাস ফেলতে হয়৷ ভাবতে হয় ‘যা করেছি, ঠিকই করেছি।’
তৃতীয় তরঙ্গের নারীবাদী ইঙ্গা মুশিও বলেছিলেন, বিচ, হোর, স্লাট, কান্ট শব্দগুলোকে অধিগ্রহণ করে, বহুল পরিমাণে ব্যবহার করে, সাধারণ প্রয়োগে আনতে হবে। গলার হারের এক একটি লকেট করে পরতে হবে তাদের।
সেই পথ ধরেই এলিজাবেথ উর্জেল ‘বিচ: ইন প্রেইজ অব ডিফিকাল্ট উইমেন’ লেখেন, সেখানে ‘বিচ ফিলোসফি’-র কথা বলেন:
I intend to scream, shout, race the engine, call when I feel like it, throw tantrums in Bloomingdale’s if I feel like it and confess intimate details about my life to complete strangers. I intend to do what I want to do and be whom I want to be and answer only to myself: that is, quite simply, the bitch philosophy…
সেই পথ ধরেই…
টরোন্টোর এক পুলিসকর্মী ধর্ষণের জন্য দায়ী করলেন ‘স্লাটি’ পোষাককে আর সারা বিশ্বে শুরু হল গর্বের স্লাট-ওয়াক।
প্রতিবাদ জারি থাকুক। কিন্তু অন্তরে এক উপলব্ধিও জেগে থাকা জরুরি। এ এক লিটমাস টেস্ট। যবে থেকে বেশ্যা ডেকে কুৎসার শুরু, তবে থেকে মুক্তিও শুরু। ‘আদর্শ নারী’ হওয়ার দায় আসলে সবচেয়ে বড় শৃঙ্খল৷
বেশ্যাপৃথিবীর অপেক্ষায়…
তোমার মাম্মাম
১১/৫/২০১৯