সোহম দাস
২৪শে জুলাই, ২০১৭। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শিক্ষা সেলের প্রাক্তন প্রধান দীননাথ বাটরা একটি অদ্ভুত দাবী করে বসলেন ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংকে প্রেরিত একটি পত্রে। দাবীটি হল, স্কুলপাঠ্য বইগুলি থেকে বিশেষ কিছু ইংরেজি, আরবি, উর্দু শব্দ সরাতে হবে, পাঞ্জাবী নকশালপন্থী কবি পাশ, মির্জা গালিব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মকবুল ফিদা হুসেন এবং আরও কিছু কবি-লেখকদের লেখার অংশও সরিয়ে ফেলতে হবে। কারণ একটাই, এনাদের লেখাগুলি বিশেষ দলটির স্বার্থের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের সাথে মানবতার প্রভেদটা কোথায়, সেই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বৈপ্লবিক চিন্তাধারা তাঁর সমকালীন সময়ে শুধু এদেশেই নয়, প্রাচ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে তা পাশ্চাত্যের তরুণ সমাজেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। ফলত, আতঙ্কিত সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী তড়িঘড়ি ‘ন্যাশনালিজম’ বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কী অদ্ভুত ঐতিহাসিক পুনরাবৃত্তি, একশো বছর বাদেও (‘ন্যাশনালিজম’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৭ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন) ঠিক ওই একই কারণে রবীন্দ্রনাথকে একাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সিলেবাস থেকে সরানোর দাবী তুলল তাঁরই দেশের একটি বিশেষ দল, রাজনৈতিক উগ্রতায় যারা একদা জাঁকিয়ে বসা ঔপনিবেশিক প্রভুদের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। পরিস্থিতি কিঞ্চিৎ ঘোরালো হয়ে ওঠায় দুদিন বাদেই আবারও শিক্ষা সেল থেকে জানানো হয়, এগুলো নাকি বিরোধী দলগুলির চক্রান্ত। তারা শুধুমাত্র কিছু শব্দের সংশোধন করার কথা বলেছিল, গালিব বা রবীন্দ্রনাথকে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়নি।
যাইহোক, ৯ই মে তাঁর আরেকটা জন্মদিন চলে গেল। ১৫৯-এ পা দিলেন তিনি। জন্মদিনের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, শুভেচ্ছাবার্তা, উৎসব-অনুষ্ঠানের হিড়িকের মধ্যেই একটি লেখা হোয়াটসঅ্যাপে বেশ ভালোই ঘুরেছে। লেখাটির উৎস ‘হিন্দু সংহতি’-র ফেসবুক পোস্ট। এতদিন রবীন্দ্রনাথকে সরাবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল সাম্প্রদায়িক শক্তি, এখন যখন দেখেছে সেই ঘটনার বাস্তবায়ন বেশ কঠিন, তখন পুরোপুরি অন্য একটি পন্থা নিয়েছে উগ্রবাদীদের দল। পাঠকদের জন্য পুরো লেখাটিই এখানে তুলে দিচ্ছি-
সবাই আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। তিনি ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে কী বলেছেন সেটা জানা দরকার। যারা ইসলামকে শান্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম, সব ধর্ম সমান বলে চিল্লান তাদের থেকে নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানী ছিলেন। দেখা যাক তাঁর উক্তি সমূহ-
১/ যে মুসলমানকে আজ ওরা প্রশ্রয় দিচ্ছে সেই মুসলমানেরাই একদিন মুষল ধরবে। (অমিয় চক্রবর্ত্তীকে লেখা চিঠি, ১৫.১১.১৯৩৪, চিঠিপত্র: ১১)
২/ চল্লিশ লাখ হিন্দু একলাখ মুসলিমদের ভয়ে মারাত্মকভাবে অভিভূত। (আনন্দবাজার পত্রিকায় সাক্ষাৎকার, ৫.৯.১৯২৩)
৩/ যদি মুসলমান সমাজ মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা।(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স,১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭,কালান্তর)
৪/ কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু নিজেকেই মারে, আর প্রয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে পারে না। আর মুসলমান কোনো বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন হলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে।(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭,কালান্তর)
৫/ এই ধর্ম যেখানে গেছে সেখানেই আপনার বিরুদ্ধ ধর্মকে আঘাত করে ভূমিস্যাৎ করে তবে ক্ষান্ত হয়েছে। ভারতবর্ষের উপরেও এই প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়েছিল এবং বহু শতাব্দী ধরে এই আঘাত নিরন্তর কাজ করেছে।(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১২ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৮,শান্তিনিকেতন)
৬/ হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে একটা পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই।(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮২, পরিচয়)
৭/ ইতিহাসে দেখা যায়, নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে।(ঐ, পৃষ্ঠা ৪৮৫,ইতিহাস)
৮/ প্রতিদিন নিম্নশ্রেণির হিন্দুরা মুসলমান এবং খৃস্টান হতে চলেছে। কিন্তু ভাটপাড়ার চৈতন্য নেই। একদা ঐ তর্করত্নদের প্রপৌত্রীমণ্ডলীকে মুসলমান যখন জোর করে কলেমা পড়াবে তখন পরিতাপ করার সময় থাকবে না।(হেমন্তীবালা দেবীকে লেখা চিঠি, ১৬.১০.১৯৩৩, চিঠিপত্র-৯)
যেখানে রবীন্দ্রনাথের মতো কবি মুসলিমের সম্পর্কে সজাগ ছিলেন সেখানে বর্তমান খারাপ পরিস্থিতিতে থেকেও কীভাবে হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই এসব উচ্চারণ করি? অবাক হই, হতবাক হই।
রবীন্দ্রনাথকে জানুন, চিন্তা করুন।
এত অবধি পড়ে আপনি কী ভাবছেন, পাঠক? এটাই কি ভাবছেন, যে এতদিন তাহলে যে রবীন্দ্রনাথকে পুজো করে এসেছি, তিনি তাহলে আদৌ কি পূজনীয়? পৃষ্ঠা ক্রম উল্লেখ করে দেওয়ার ফলে আপনি যদি প্রকৃতই এই তথ্যগুলিকে সত্য মনে করে ভেবে নেন, যে রবীন্দ্রনাথও সাম্প্রদায়িক ছিলেন, তবে মানতেই হবে, রবীন্দ্রনাথকে পুজো করার অধিকার সত্যিই আপনার নেই।
৩ নম্বর পয়েন্টটিতে যে বাক্যটির উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে, ‘যদি মুসলমান সমাজ মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা।’, এই লাইনটি ‘কালান্তর’-এর ‘স্বামী শ্রদ্ধানন্দ’ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া। কী সুচতুরভাবে শুধুমাত্র এই একটি লাইনকে তুলে এনে, কথার আগুপিছু কিছুকে না দেখিয়ে পুরো ভিন্ন বার্তা প্রেরণ করা হচ্ছে, সেকথা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ পরিষ্কার বলছেন—
ভারতবর্ষের অধিবাসীদের দুই মোটা ভাগ, হিন্দু ও মুসলমান। যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গলপ্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়োই ভুল করব। ছাদের পাঁচটা কড়িকে মানব, বাকি তিনটে কড়িকে মানবই না, এটা বিরক্তির কথা হতে পারে, কিন্তু ছাদ-রক্ষার পক্ষে সুবুদ্ধির কথা নয়। আমাদের সবচেয়ে বড়ো অমঙ্গল বড়ো দুর্গতি ঘটে যখন মানুষ মানুষের পাশে রয়েছে অথচ পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ নেই, অথবা সে সম্বন্ধ বিকৃত। বিদেশীর রাজ্যে রাজপুরুষদের সঙ্গে আমাদের একটা বাহ্য যোগ থাকে, অথচ আন্তরিক সম্বন্ধ থাকে না। বিদেশীয় রাজত্বে এইটেই আমাদের সবচেয়ে পীড়া দেয়। গায়ে-পড়া যোগটা দুর্বলতা ও অপমান আনে। বিদেশী শাসন সম্পর্কে যদি এ কথা খাটে তবে স্বদেশীয়দের সম্বন্ধে সে আরও কত সত্য। এক দেশে পাশাপাশি থাকতে হবে, অথচ পরস্পরের সঙ্গে হৃদ্যতার সম্বন্ধ থাকবে না, হয়তো বা প্রয়োজনের থাকতে পারে— সেইখানেই যে ছিদ্র— ছিদ্র নয়, কলির সিংহদ্বার। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যেখানে এতখানি ব্যবধান সেখানেই আকাশ ভেদ করে ওঠে অমঙ্গলের জয়তোরণ। আমাদের দেশে কল্যাণের রথযাত্রায় যখনই সকলে মিলে টানতে চেষ্টা করা হয়েছে— কংগ্রেস প্রভৃতি নানা প্রচেষ্টা দ্বারা, সে-রথ কোথায় এসে থেমে যায়, ভেঙে পড়ে? যেখানে গর্তগুলো হাঁ ক’রে আছে হাজার বছর ধরে।
আমাদের দেশে যখন স্বদেশী-আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল তখন আমি তার মধ্যে ছিলেম। মুসলমানরা তখন তাতে যোগ দেয় নি, বিরুদ্ধ ছিল। জননায়কেরা কেউ কেউ তখন ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ওদের একেবারে অস্বীকার করা যাক। জানি, ওরা যোগ দেয় নি। কিন্তু, কেন দেয় নি। তখন বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এত প্রবল যোগ হয়েছিল যে সে আশ্চর্য! কিন্তু, এতবড়ো আবেগ শুধু হিন্দুসমাজের মধ্যেই আবদ্ধ রইল, মুসলমানসমাজকে স্পর্শ করল না! সেদিনও আমাদের শিক্ষা হয় নি। পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদের ডোবাটাকে আমরা সমাজের দোহাই দিয়ে গভীর করে রেখেছি।
হিন্দু-মুসলমানের মধ্যেকার প্রভেদ তো চিরকালই ছিল, আজও আছে। ধর্মীয় প্রভেদ, জাতিগত প্রভেদ তো থাকবেই, সে আমরা যতই চেঁচাই। প্রভেদকে একেবারে ঘোচাতে গেলে তাহলে আমাদেরও নানাপ্রকার উপবাস প্রথা বন্ধ করতে হয়, ওদেরও রোজা পালন বন্ধ করতে হয়। সেটা কি আদৌ সম্ভব? তিনি তো পরিষ্কার সেটাই বলেছেন। কিন্তু সেই প্রভেদটুকু মেনে নিয়েও তো আমরা মনের দিক থেকে একসাথে জোট বাঁধতেই পারি। ব্যক্তিগত আচারকে স্থান না দিয়ে সমষ্টির স্বার্থচিন্তা তো করাই যায়। তাও সেটা কেন হল না, আমাদের হিন্দুসমাজের দোষটা কোথায়, সেটাই তো এখানে বলে দিচ্ছেন। আর এখানে কংগ্রেসকেও যেভাবে তুলোধোনা করছেন, তাতে তো পরিষ্কার যে, দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সুবিধাবাদী রাজনীতির তীব্র বিরোধিতা তাঁর কণ্ঠে। আর এই বিশেষ লাইনটি যে পরিপ্রেক্ষিতে বলা, সেটি একেবারে অন্য প্রসঙ্গ। এখানে তিনি মুসলমান বলতে মুসলমান সমাজকে একেবারেই বোঝাননি, বুঝিয়েছেন মুসলমান ইনভেশনকে। যেকারণে স্পষ্ট করে মহম্মদ ঘোরীর কথা উল্লেখ করেছেন। কী লিখেছেন, একবার দেখা যাক-
আজকে সেই পরীক্ষা-আরম্ভের আয়োজন। আজকে দেখতে হবে, আমাদের হিন্দুসমাজের কোথায় কোন্ ছিদ্র, কোন্ পাপ আছে, অতি নির্মমভাবে তাকে আক্রমণ করা চাই। এই উদ্দেশ্য মনে নিয়ে আজ হিন্দুসমাজকে আহ্বান করতে হবে; বলতে হবে, পীড়িত হয়েছি আমরা, লজ্জিত হয়েছি, বাইরের আঘাতের জন্য নয়, আমাদের ভিতরের পাপের জন্য। এসো আজ সেই পাপ দূর করতে সকলে মিলি। আমাদের পক্ষে এ বড়ো সহজ কথা নয়। কেননা, অন্তরের মধ্যে বহুকালের অভ্যস্ত ভেদবুদ্ধি, বাইরেও বহুদিনের গড়া অতি কঠিন ভেদের প্রাচীর। মুসলমান যখন কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে মুসলমান-সমাজকে ডাক দিয়েছে, সে কোনো বাধা পায় নি— এক ঈশ্বরের নামে ‘আল্লাহো আক্বর’ বলে সে ডেকেছে। আর আজ আমরা যখন ডাকব ‘হিন্দু এসো’ তখন কে আসবে। আমাদের মধ্যে কত ছোটো ছোটো সম্প্রদায়, কত গণ্ডী, কত প্রাদেশিকতা— এ উত্তীর্ণ হয়ে কে আসবে। কত বিপদ গিয়েছে। কই একত্র তো হই নি। বাহির থেকে যখন প্রথম আঘাত নিয়ে এল মহম্মদ ঘোরী, তখন হিন্দুরা সে আসন্ন বিপদের দিনেতেও তো একত্র হয় নি। তার পর যখন মন্দিরের পর মন্দির ভাঙতে লাগল, দেবমূর্তি চূর্ণ হতে লাগল, তখন তারা লড়েছে, মরেছে, খণ্ড খণ্ড ভাবে যুদ্ধ করে মরেছে। তখনও একত্র হতে পারল না। খণ্ডিত ছিলেম বলেই মেরেছে, যুগে যুগে এই প্রমাণ আমরা দিয়েছি। কখনও কখনও ইতিহাস উদ্ঘাটন করে অন্য প্রমাণ পাবার চেষ্টা করি বটে; বলি, শিখরা তো একসময় বাধা ঘুচিয়েছিল। শিখরা যে বাধা ঘুচিয়েছিল সে তো শিখধর্ম দ্বারাই। পাঞ্জাবে কোথাকার জাঠ, কোথাকার কোন্ জাতি সব, শিখধর্মের আহ্বানে একত্র হতে পেরেছিল; বাধাও দিতে পেরেছিল; ধর্মকেও রক্ষা করতে এক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শিবাজি একসময় ধর্মরাজ্যস্থাপনের ভিত গেড়েছিলেন। তাঁর যে অসাধারণ শক্তি ছিল তদ্দ্বারা তিনি মারাঠাদের একত্র করতে পেরেছিলেন। সেই সম্মিলিত শক্তি ভারতবর্ষকে উপদ্রুত করে তুলেছিল। অশ্বের সঙ্গে অশ্বারোহীর যখন সামঞ্জস্য হয় কিছুতেই সে অশ্ব থেকে পড়ে না; শিবাজির হয়ে সেদিন যারা লড়েছিল তাদের সঙ্গে শিবাজির তেমনি সামঞ্জস্য হয়েছিল। পরে আর সে সামঞ্জস্য রইল না; পেশোয়াদের মনে ও আচরণে ভেদবুদ্ধি, খণ্ড খণ্ড স্বার্থবুদ্ধি তীক্ষ্ণ হয়ে ক্ষণকালীন রাষ্ট্রবন্ধনকে টুকরো টুকরো করে দিলে। আমার কথা এই যে, আমাদের মধ্যে এই-যে পাপ পুষে রেখেছি এতে কি শুধু আমাদেরই অকল্যাণ, সে পাপে কি আমরা প্রতিবেশীদের প্রতি অবিচার করি নে, তাদের মধ্যে হিংসা জাগিয়ে তুলি নে? যে দুর্বল সেই প্রবলকে প্রলুব্ধ করে পাপের পথে টেনে আনে। পাপের প্রধান আশ্রয় দুর্বলের মধ্যে। অতএব যদি মুসলমান মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই— তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা। আপনার জন্যেও, প্রতিবেশীর জন্যেও আমাদের নিজেদের দুর্বলতা দূর করতে হবে। আমরা প্রতিবেশীদের কাছে আপিল করতে পারি, তোমরা ক্রূর হোয়ো না, তোমরা ভালো হও, নরহত্যার উপরে কোনো ধর্মের ভিত্তি হতে পারে না— কিন্তু সে আপিল যে দুর্বলের কান্না। বায়ুমণ্ডলে বাতাস লঘু হয়ে এলে ঝড় যেমন আপনিই আসে, ধর্মের দোহাই দিয়ে কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না, তেমনি দুর্বলতা পুষে রেখে দিলে সেখানে অত্যাচার আপনিই আসে— কেউ বাধা দিতে পারে না। কিছুক্ষণের জন্য হয়তো একটা উপলক্ষ্য নিয়ে পরস্পর কৃত্রিম বন্ধুতাবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারি, কিন্তু চিরকালের জন্য তা হয় না। যে-মাটিতে কণ্টকতরু ওঠে, সে-মাটিকে যতক্ষণ শোধন না করা হয় ততক্ষণ তো কোনো ফল হবে না।
রবীন্দ্রনাথ বরাবরই সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী, তা সে খ্রিস্টান ইংরেজই হোক, কী মুসলমান সুলতান। আর সুলতানরা এদেশে এসে মন্দির ধ্বংস করে কী অরাজকতা চালিয়েছে, সেকথা আমাদের সকলের জানা। সেই সর্বৈব সত্যকে সত্য হিসাবে বলাই ভালো। বরং এখানে তো তিনি উল্টে হিন্দুসমাজের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে অনেক বেশি ধিক্কার জানিয়েছেন, মুসলমান সমাজের একতাকে জানিয়েছেন কুর্নিশ। তাহলে এবার বাকিটা বুঝে নেওয়াই ভালো।
একই জিনিস হয়েছে অন্যান্য লাইনগুলির ক্ষেত্রেও। ৪ নম্বর পয়েন্টটির কথা বলব। ‘কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু নিজেকেই মারে, আর প্রয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে পারে না। আর মুসলমান কোনো বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন হলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে।’ এখানে পড়ে মনে হবে, রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের সরাসরি হত্যাকারী জাত বলে চিহ্নিত করছেন। আসলে এখানে তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তা হল দেশের এবং হিন্দু-মুসলমান সমাজের চিরাচরিত সমস্যার কথা। প্রবন্ধের নাম ‘সমস্যা’। যেখানে তিনি লিখছেন-
আমাদের আর-একটি প্রধান সমস্যা হিন্দু-মুসলমান সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান এত দুঃসাধ্য তার কারণ দুই পক্ষই মুখ্যত আপন আপন ধর্মের দ্বারাই অচলভাবে আপনাদের সীমানির্দেশ করেছে। সেই ধর্মই তাদের মানববিশ্বকে সাদা কালো ছক কেটে দুই সুস্পষ্ট ভাগে বিভক্ত করেছে— আত্ম ও পর। সংসারে সর্বত্রই আত্মপরের মধ্যে কিছু পরিমাণে স্বাভাবিক ভেদ আছে। সেই ভেদের পরিমাণটা অতিমাত্র হলেই তাতে অকল্যাণ হয়। বুশ্ম্যান-জাতীয় লোক পরকে দেখবামাত্র তাকে নির্বিশেষে বিষবাণ দিয়ে মারে। তার ফল হচ্ছে, পরের সঙ্গে সত্য মিলনে মানুষের যে-মনুষ্যত্ব পরিস্ফুট হয় বুশ্ম্যানের তা হতে পারে নি, সে চূড়ান্ত বর্বরতার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। এই ভেদের মাত্রা যে-জাতির মধ্যে অন্তরের দিক থেকে যতই কমে এসেছে সেই জাতি ততই উচ্চশ্রেণির মনুষ্যত্বে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। সে-জাতি সকলের সঙ্গে যোগে চিন্তার কর্মের চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন করতে পেরেছে।
হিন্দু নিজেকে ধর্মপ্রাণ বলে পরিচয় দেয়, মুসলমানও তাই দেয়। অর্থাৎ ধর্মের বাহিরে উভয়েরই জীবনের অতি অল্প অংশই অবশিষ্ট থাকে। এই কারণে এরা নিজ নিজ ধর্ম দ্বারাই পরস্পরকে ও জগতের অন্য সকলকে যথাসম্ভব দূরে ঠেকিয়ে রাখে। এই যে দূরত্বের ভেদ এরা নিজেদের চারি দিকে অত্যন্ত মজবুৎ ক’রে গেঁথে রেখেছে, এতে ক’রে সকল মানুষের সঙ্গে সত্যযোগে মনুষ্যত্বের যে প্রসার হয় তা এদের মধ্যে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ধর্মগত ভেদবুদ্ধি সত্যের অসীম স্বরূপ থেকে এদের সংকীর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এইজন্যেই মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে নিত্যসত্যের চেয়ে বাহ্যবিধান কৃত্রিমপ্রথা এদের মধ্যে এত প্রবল হয়ে উঠেছে।
পূর্বেই বলেছি, মানবজগৎ এই দুই সম্প্রদায়ের ধর্মের দ্বারাই আত্ম ও পর এই দুই ভাগে অতিমাত্রায় বিভক্ত হয়েছে। সেই পর চিরকালই পর হয়ে থাক্, হিন্দুর এই ব্যবস্থা; সেই পর, সেই ম্লেচ্ছ বা অন্ত্যজ কোনো ফাঁকে তার ঘরের মধ্যে এসে ঢুকে না পড়ে, এই তার ইচ্ছা। মুসলমানের তরফে ঠিক এর উলটো। ধর্মগণ্ডীর বহির্বর্তী পরকে সে খুব তীব্রভাবেই পর ব’লে জানে; কিন্তু সেই পরকে, সেই কাফেরকে বরাবরকার মতো ঘরে টেনে এনে আটক করতে পারলেই সে খুশি। এদের শাস্ত্রে কোনো একটা খুঁটে-বের-করা শ্লোক কী বলে সেটা কাজের কথা নয়, কিন্তু লোক-ব্যবহারে এদের এক পক্ষ শত শত বৎসর ধ’রে ধর্মকে আপন দুর্গম দুর্গ ক’রে পরকে দূরে ঠেকিয়ে আত্মগত হয়ে আছে, আর অপর পক্ষ ধর্মকে আপন ব্যূহ বানিয়ে পরকে আক্রমণ ক’রে তাকে ছিনিয়ে এনেছে। এতে ক’রে এদের মনঃপ্রকৃতি দুইরকম ছাঁদের ভেদবুদ্ধিতে একেবারে পাকা হয়ে গেছে। বিধির বিধানে এমন দুই দল ভারতবর্ষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রধান স্থান অধিকার ক’রে নিয়েছে— আত্মীয়তার দিক থেকে মুসলমান হিন্দুকে চায় না, তাকে কাফের ব’লে ঠেকিয়ে রাখে; আত্মীয়তার দিক থেকে হিন্দুও মুসলমানকে চায় না, তাকে ম্লেচ্ছ ব’লে ঠেকিয়ে রাখে।
একটি নিরপেক্ষ দিক থেকে তিনি দুই সমাজের গোঁড়ামিকেই দুষছেন, কোনও পক্ষপাতিত্ব করছেন না। এত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করছেন নিজের অভিমত, যে এখানে না বোঝার মতো কোনও জায়গা থাকতেই পারে না। বরং ধর্মকে অধর্মের মূল হিসেবে চিহ্নিত করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা কত সুন্দর যুক্তি সহকারে ব্যক্ত করছেন এই প্রবন্ধেই–
ধর্ম যখন বলে ‘মুসলমানের সঙ্গে মৈত্রী করো’ তখন কোনো তর্ক না করেই কথাটাকে মাথায় করে নেব। ধর্মের এ কথাটা আমার কাছে মহাসমুদ্রের মতোই নিত্য। কিন্তু ধর্ম যখন বলে ‘মুসলমানের ছোঁওয়া অন্ন গ্রহণ করবে না’ তখন আমাকে প্রশ্ন করতেই হবে, কেন করব না। এ-কথাটা আমার কাছে ঘড়ার জলের মতো অনিত্য, তাকে রাখব কি ফেলব সেটার বিচার যুক্তির দ্বারা। যদি বল এসব কথা স্বাধীনবিচারের অতীত, তা হলে শাস্ত্রের সমস্ত বিধানের সামনে দাঁড়িয়েই বলতে হবে, বিচারের যোগ্য বিষয়কে যারা নির্বিচারে গ্রহণ করে তাদের প্রতি সেই দেবতার ধিক্কার আছে ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ— যিনি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি প্রেরণ করেন। তারা পাণ্ডাকে দেবতার চেয়ে বেশি ভয় ও শ্রদ্ধা করে, এমনি করে তারা দেবপূজার অপমান করতে কুন্ঠিত হয় না।
শেষ বাক্যটিতে এদেশে ধর্ম নিয়ে আদ্যিকাল থেকে চলে আসা লাভজনক ব্যাবসার প্রতি তীব্র কটাক্ষপাত।
এবার ৫ নম্বরটির কথায় আসি। ‘এই ধর্ম যেখানে গেছে সেখানেই আপনার বিরুদ্ধ ধর্মকে আঘাত করে ভূমিস্যাৎ করে তবে ক্ষান্ত হয়েছে। ভারতবর্ষের উপরেও এই প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়েছিল এবং বহু শতাব্দী ধরে এই আঘাত নিরন্তর কাজ করেছে।’ প্রবন্ধের নাম ‘ব্রাহ্মসমাজের সার্থকতা’। এখানেও ওই একই মুসলমান সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি তাঁর ঘৃণাকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন। সুলতানি ইতিহাস পড়লেই জানা যাবে, ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হিন্দুমন্দির, জৈনমন্দির ধ্বংস করে তার উপরে উঠেছে মসজিদ। অতএব, বিরুদ্ধ ধর্মকে আঘাতের কথা একবর্ণও কি মিথ্যে? বরং এখানে তিনি বলেছেন যে ওই সুলতানি আমলেও কবির, নানক, রবিদাস, দাদুদয়ালের মতো সাধকগণ আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁরা মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ এখানে বলছেন-
সত্যের আঘাত কেবল সত্যই গ্রহণ করতে পারে। এইজন্য প্রবল আঘাতের মুখে প্রত্যেক জাতি, হয়, আপনার শ্রেষ্ঠ সত্যকে সমুজ্জ্বল করে প্রকাশ করে, নয়, আপনার মিথ্যা সম্বলকে উড়িয়ে দিয়ে দেউলে হয়ে যায়। ভারতবর্ষেরও যখন আত্মরক্ষার দিন উপস্থিত হয়েছিল তখন সাধকের পর সাধক এসে ভারতবর্ষের চিরসত্যকে প্রকাশ করে ধরেছিলেন। সেই যুগের নানক, রবিদাস, কবীর, দাদু প্রভৃতি সাধুদের জীবন ও রচনা যাঁরা আলোচনা করছেন তাঁরা সেই সময়কার ধর্ম-ইতিহাসের যবনিকা অপসারিত করে যখন দেখাবেন তখন দেখতে পাব ভারতবর্ষ তখন আত্মসম্পদ সম্বন্ধে কী রকম সবলে সচেতন হয়ে উঠেছিল।
ভারতবর্ষ তখন দেখিয়েছিল, মুসলমানধর্মের যেটি সত্য সেটি ভারতবর্ষের সত্যের বিরোধী নয়। দেখিয়েছিল ভারতবর্ষের মর্মস্থলে সত্যের এমন একটি বিপুল সাধনা সঞ্চিত হয়ে আছে যা সকল সত্যকে আত্মীয় বলে গ্রহণ করতে পারে। এইজন্যেই সত্যের আঘাত তার বাইরে এসে যতই ঠেকুক তার মর্মে গিয়ে কখনো বাজে না, তাকে বিনাশ করে না।
এখানে কিন্তু তিনি একবারও হিন্দুরাষ্ট্র বা হিন্দুস্তান বা হিন্দুসমাজের কোনও উল্লেখমাত্র করেননি। বারবার বলছেন, ভারতবর্ষ। অর্থাৎ যে ভারতবর্ষে বরাবর নানা ধর্ম, নানা জাতি, নানা ভাষাভাষীর মানুষ শত বিভেদ সত্ত্বেও একসাথে বাস করে গেছেন। এখানে এই বাক্যটি লক্ষ্য করার মত-‘ভারতবর্ষ তখন দেখিয়েছিল, মুসলমানধর্মের যেটি সত্য সেটি ভারতবর্ষের সত্যের বিরোধী নয়।’ অর্থাৎ প্রকৃত ইসলাম ধর্ম যে কত পবিত্র, এবং তার সঙ্গে যে আদৌ ভারতবর্ষের কোনও প্রত্যক্ষ বিরোধ নেই, তা স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছেন। এইসব বাক্যগুলিকে সুপরিকল্পিতভাবে বাদ দিয়ে উস্কানি ছড়ানোর কী অপূর্ব কৌশল সত্যি!
‘হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে একটা পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই’। না, তা সত্যিই উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কেন নয়, সেটা একটু আগে এই লেখাতেই আমি বলেওছি। ‘হিন্দু-বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এই কথাটি বলেছেন, এবং তারপর এর সার্থকতা বিচার করতে গিয়ে কী বলেছেন, দেখুন–
হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সকল দিক দিয়া একটা সত্যকার ঐক্য জন্মে নাই বলিয়াই রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদিগকে এক করিয়া তুলিবার চেষ্টায় সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সূত্রপাত হইল। এই সন্দেহকে অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। আমরা মুসলমানকে যখন আহ্বান করিয়াছি তখন তাহাকে কাজ উদ্ধারের সহায় বলিয়া ডাকিয়াছি, আপন বলিয়া ডাকি নাই। যদি কখনো দেখি তাহাকে কাজের জন্য আর দরকার নাই তবে তাহাকে অনাবশ্যক বলিয়া পিছনে ঠেলিতে আমাদের বাধিবে না। তাহাকে যথার্থ আমাদের সঙ্গী বলিয়া অনুভব করি নাই, আনুষঙ্গিক বলিয়া মানিয়া লইয়াছি। যেখানে দুইপক্ষের মধ্যে অসামঞ্জস্য আছে সেখানে যদি তাহারা শরিক হয়, তবে কেবল ততদিন পর্যন্ত তাহাদের বন্ধন থাকে যতদিন বাহিরের কোনো বাধা অতিক্রমের জন্য তাহাদের একত্র থাকা আবশ্যক হয়,— সে আবশ্যকটা অতীত হইলেই ভাগবাঁটোয়ারার বেলায় উভয় পক্ষেই ফাঁকিচলিতেথাকে।
মুসলমান এই সন্দেহটি মনে লইয়া আমাদের ডাকে সাড়া দেয় নাই। আমরা দুই পক্ষ একত্র থাকিলে মোটের উপর লাভের অঙ্ক বেশি হইবে বটে, কিন্তু লাভের অংশ তাহার পক্ষে বেশি হইবে কি না, মুসলমানের সেইটেই বিবেচ্য। অতএব মুসলমানের এ কথা বলা অসংগত নহে যে আমি যদি পৃথক থাকিয়াই বড়ো হইতে পারি তবেই তাহাতে আমার লাভ।
কিছুকাল পূর্বে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এই স্বাতন্ত্র্য-অনুভূতি তীব্র ছিল না। আমরা এমন এক রকম করিয়া মিলিয়া ছিলাম যে আমাদের মধ্যেকার ভিন্নতাটা চোখে পড়িত না। কিন্তু স্বাতন্ত্র্য-অনুভূতির অভাবটা একটা অ-ভাবমাত্র, ইহা ভাবাত্মক নহে। অর্থাৎ আমাদের মধ্যে সত্যকার অভেদ ছিল বলিয়াই যে, ভেদ সম্বন্ধে আমরা অচেতন ছিলাম তাহা নহে— আমাদের মধ্যে প্রাণশক্তির অভাব ঘটিয়াছিল বলিয়াই একটা নিশ্চেতনতায় আমাদিগকে অভিভূত করিয়াছিল। একটা দিন আসিল যখন হিন্দু আপন হিন্দুত্ব লইয়া গৌরব করিতে উদ্যত হইল। তখন মুসলমান যদি হিন্দুর গৌরব মানিয়া লইয়া নিজেরা চুপচাপ পড়িয়া থাকিত তবে হিন্দু খুব খুশি হইত সন্দেহ নাই, কিন্তু যে কারণে হিন্দুর হিন্দুত্ব উগ্র হইয়া উঠিল সেই কারণেই মুসলমানের মুসলমানি মাথা তুলিয়া উঠিল। এখন সে মুসলমানরূপেই প্রবল হইতে চায়, হিন্দুর সঙ্গে মিশিয়া গিয়া প্রবল হইতে চায় না।
এখন জগৎ জুড়িয়া সমস্যা এ নহে যে, কী করিয়া ভেদ ঘুচাইয়া এক হইব— কিন্তু কী করিয়া ভেদ রক্ষা করিয়াই মিলন হইবে। সে কাজটা কঠিন— কারণ, সেখানে কোনো প্রকার ফাঁকি চলে না, সেখানে পরস্পরকে পরস্পরের জায়গা ছাড়িয়া দিতে হয়। সেটা সহজ নহে, কিন্তু যেটা সহজ সেটা সাধ্য নহে; পরিণামের দিকে চাহিলে দেখা যায় যেটা কঠিন সেটাই সহজ।
আজ আমাদের দেশে মুসলমান স্বতন্ত্র থাকিয়া নিজের উন্নতিসাধনের চেষ্টা করিতেছে। তাহা আমাদের পক্ষে যতই অপ্রিয় এবং তাহাতে আপাতত আমাদের যতই অসুবিধা হউক, একদিন পরস্পরের যথার্থ মিলনসাধনের ইহাই প্রকৃত উপায়। ধনী না হইলে দান করা কষ্টকর; মানুষ যখন আপনাকে বড়ো করে তখনই আপনাকে ত্যাগ করিতে পারে। যত দিন তাহার অভাব ও ক্ষুদ্রতা ততদিনই তাহার ঈর্ষা ও বিরোধ। ততদিন যদি সে আর কাহারও সঙ্গে মেলে তবে দায়ে পড়িয়া মেলে— সে মিলন কৃত্রিম মিলন। ছোটো বলিয়া আত্মলোপ করাটা অকল্যাণ, বড়ো হইয়া আত্ম-বিসর্জন করাটাই শ্রেয়।
হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য কেন সাধিত হয়নি, তার আলোচনা করতে গিয়ে হিন্দুদের এই কর্তৃত্ব কায়েম করার কথা বলছেন, ‘হিন্দুর হিন্দুত্ব উগ্র হইয়া’-র অবতারণা করছেন, এবং সেটাই যে মুসলমানের উগ্র মাথাচাড়া দেওয়ার কারণ সেকথাও বলতে পিছপা হচ্ছেন না। আজকে ভারতবর্ষে যে ধর্মীয় উগ্রবাদী সন্ত্রাসের সৃষ্টি করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে, সেখানকার চিত্রটাও তো একই। এই প্রবন্ধেই মুসলমান সমাজ কোন জায়গায় পিছিয়ে পড়ছে, এবং তার জন্য কী করণীয় সেকথাও জানাতে ভুলছেন না। তাঁর মতে, দুই সমাজ যদি শিক্ষায়, বুদ্ধিতে সমান হয়, তবেই একমাত্র বিরোধের সম্ভাবনা কমে।
আধুনিক কালের শিক্ষার প্রতি সময় থাকিতে মনোযোগ না করায় ভারতবর্ষের মুসলমান হিন্দুর চেয়ে অনেক বিষয়ে পিছাইয়া পড়িয়াছে। সেখানে তাহাকে সমান হইয়া লইতে হইবে। এই বৈষম্যটি দূর করিবার জন্য মুসলমান সকল বিষয়েই হিন্দুর চেয়ে বেশি দাবি করিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাহাদের এই দাবিতে আমাদের আন্তরিক সম্মতি থাকাই উচিত। পদ-মান-শিক্ষায় তাহারা হিন্দুর সমান হইয়া উঠে ইহা হিন্দুরই পক্ষে মঙ্গলকর।বস্তুত বাহির হইতে যেটুকু পাওয়া যাইতে পারে, যাহা অন্যের নিকট প্রার্থনা করিয়া পাওয়া যায় তাহার একটা সীমা আছেই। সে সীমা হিন্দু ও মুসলমানের কাছে প্রায় সমান। সেই সীমায় যতদিন পর্যন্ত না পৌঁছানো যায় ততদিন মনে একটা আশা থাকে বুঝি সীমা নাই, বুঝি এই পথেই পরমার্থ লাভ করা যায়। তখনই সেই পথের পাথেয় কার একটু বেশি জুটিয়াছে কার একটু কম, তাই লইয়া পরস্পর ঘোরতর ঈর্ষা বিরোধ ঘটিতে থাকে।
‘ইতিহাসে দেখা যায়, নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে।’– এই বাক্যটি রবীন্দ্র রচনাবলীতে থাকলেও সেখানে লেখা আছে শ্রীআব্দুল করিম বি. এ. প্রণীত। ‘ভারতবর্ষে মুসলমান রাজত্বের ইতিবৃত্ত-প্রথম খণ্ডে’র ‘মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস’ নামক একটি প্রবন্ধের অংশ। ইনি আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ কিনা জানা নেই। তবে যিনিই লিখে থাকুন, তিনি অত্যন্ত নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই যোদ্ধৃভাবের সমালোচনা করেছেন। শিখ, মুসলমান, খ্রিস্টান সকলেই যে দেশদখল করতে গিয়ে কীরূপ হত্যালীলা চালিয়েছে, সেখানে হিন্দুরা বরাবর মরতে এগিয়ে এসেছে, প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি, হিন্দুদের এই মেরুদণ্ডহীন আত্মহত্যাপ্রীতিকে সমালোচনা করেছেন। বাকি বাক্যগুলির সম্পর্কে তথ্য কম সময়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে, এবিষয়ে একশো ভাগ নিশ্চিত থাকা যায়, সেখানেও সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজের কথা লেখা থাকবে।
সত্যি কথা বলতে, রবীন্দ্রনাথ মহীরুহসম, এবং যা লিখে গেছেন সেসবের কাছে এই উস্কানি দেওয়া শক্তি স্রেফ খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে। সেই অর্থে আলাদা করে ক্ল্যারিফিকেশনের দরকারই নেই। কিন্তু আবার আছেও। কারণ, এরা এত স্পর্ধা পায় কোথা থেকে, যে সরাসরি বলে ‘যেখানে রবীন্দ্রনাথের মতো কবি মুসলিমের সম্পর্কে সজাগ ছিলেন সেখানে বর্তমান খারাপ পরিস্থিতিতে থেকেও কীভাবে হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই এসব উচ্চারণ করি? অবাক হই, হতবাক হই।’ এর উত্তর লুকিয়ে আছে, আমাদের অর্ধবিদ্যার ভয়ঙ্করতার মধ্যেই। এই যে এরা পৃষ্ঠা নম্বর, প্রবন্ধের নাম, এগুলো দিয়ে একটা ভারিক্কি বিবলিওগ্রাফি দেওয়ার চেষ্টাটা করল, এতেই বহু মানুষ প্রভাবিত হয়ে যাবেন, যে এই তো সূত্র উল্লেখ করেই দেওয়া রয়েছে, তাহলে তো ঠিকই বলছে। এখানেই সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ওদের উদ্দেশ্য সফল করে দেওয়ার পথে এক ধাপ এগিয়ে দেবআমরা। ভালো করে খুঁজে দেখতেই চাইব না যে, আদৌ অত বড় মানুষটা এগুলো বলেছেন কিনা। আমাদের সার্বিক চরিত্রের চূড়ান্ত দ্বিচারিতার সঙ্গে প্রবলভাবে যুক্ত হয়েছে, ভাসা ভাসা পড়াশোনা করেই নিজেকে বিশাল কেউকেটা ভাবার প্রবণতা। উগ্রশক্তি কেবল এই দুর্বলতাগুলোকে ব্যবহার করছে। তাই তাদের বাড়বাড়ন্তের পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছি আমরাই।
শেষ লাইনে আবার কী কৌশল করে লেখা– ‘রবীন্দ্রনাথকে জানুন, চিন্তা করুন।’ জানুন, চিন্তা করুন, তবে তা গভীরভাবে। ওদের কথাকেই অনুসরণ করে ওদের চক্রান্ত ব্যর্থ করুন।