অভিজিৎ দত্ত
গত ২৪শে এপ্রিল হাওড়া আদালতে পুলিশের বেআইনি প্রবেশ ও নির্বিচারে আইনজীবী ও অন্যান্যদের নির্যাতন করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে, গত ২৬ শে এপ্রিল থেকে সারা বাংলার সমস্ত আদালত বন্ধ আছে, আইনজীবীদের আন্দোলনের কারণে। আদালতের সমস্ত কাজকর্ম শিকেয় উঠলেও, প্রশাসনের ঘুম ভাঙেনি। হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই বিষয়ে মামলা করলেও, এই মামলার গতি অত্যন্ত স্লথ। বর্তমানে জাস্টিস বিশ্বনাথ সমাদ্দারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এই মামলা শুনছেন। আন্দোলনকারী আইনজীবীরা পথে নেমেছেন। গত ৭ই মে তারিখে, সারা বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রচুর আইনজীবী সিটি সিভিল কোর্টে জড়ো হন। ল ইয়ার্স ইউনিটি নামের অরাজনৈতিক মঞ্চের তলায় আইনজীবীরা একত্রিত হয়ে কলকাতা শহরের কেন্দ্রস্থলে তাঁদের দাবি নিয়ে বিশাল মিছিল করেন। মিছিল ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও উচ্ছ্বাস ছিল দেদার। মহিলা আইনজীবীদের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। ব্যাঙ্কশাল কোর্ট ঘুরে, ডালহৌসি-ধর্মতলায় মিছিল হয়, হাতে ফ্লেক্স আর ব্যানার নিয়ে। এই আন্দোলনে আইনজীবীদের ঐক্যকে তুলে ধরা হয়। অপরাধী পুলিশের শাস্তির দাবি নিয়ে আইনজীবীরা বিচারের আশায় রাজভবনে যান। রাজ্যপালের কাছে দাবি পেশ করেন আইনজীবীদের প্রতিনিধি দল। কাঠফাটা রোদেও আইনজীবীদের অগাধ উৎসাহ ছিল। রাজ্যপাল আশ্বাস দিয়েছেন। তবে প্রশাসন নিশ্চুপ, নির্বিকার। সাধারন আইনজীবীরা আদালত প্রাঙ্গণ ছেড়ে রাজপথে নেমেছেন সুবিচারের আশায়। রাজ্য বার কাউন্সিল আগামী ২১ মে পর্যন্ত কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন। সারা বাংলার সমস্ত আদালত বন্ধ। নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু আন্দোলনের কর্মসূচি। এদিকে, জেলখানাগুলি উপচে পড়ছে বন্দির ভিড়ে। মানুষের অধিকার ভূলুণ্ঠিত অথচ প্রশাসন নির্বিকার। ভোট নিয়ে ব্যস্ত।
ঘটনার সূত্রপাত খুবই সামান্য কারণে। ঘটনার দিন সকাল সাড়ে দশটায় হাওয়া কোর্ট চত্বরের উল্টোদিকে হাওড়া মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের একদল কর্মী ও সিকিউরিটি গার্ডের সাথে গাড়ি রাখা নিয়ে বচসা বাধে এবং ঘটনাচক্রে এক আইনজীবী সুজন ভক্তের মাথায় বাঁশ দিয়ে মিউনিসিপ্যালিটির কিছু কর্মী আঘাত করেন। সেই সঙ্গে কমবেশি একাধিক মহিলা আইনজীবী আহত হন। সুজন ভক্তের মাথায় সাতটা সেলাই পড়ে এবং হাওড়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রক্তাক্ত সুজনকে হাওড়া কোর্টের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে দেখে কোর্ট চত্বরে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ইতিমধ্যে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন থেকে একদল লোক আদালত চত্বরের কিছু উকিলবাবুর সেরেস্তা ভাঙচুর করে। ক্রমশ আইনজীবীরা একত্রিত হয়ে মিউনিসিপ্যালিটির মূল ফটকের কাছে চলে এসে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন ও ঘটনার প্রতিবাদ জানান। এইসময় বাদানুবাদ শুরু হয়। এইসময় মিউনিসিপ্যালিটি ও হাওড়া আদালতের মাঝের মহাত্মা গান্ধী রোড কিছুক্ষণের জন্য রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। মিউনিসিপ্যালিটির মূল ফটক থেকে ইঁটবৃষ্টি শুরু হয় ও ইঁটের আঘাতে বেশকিছু আইনজীবী আঘাত পান ও হাওড়া হাসপাতালে ভর্তি হন। পুলিশ আসে, কিন্তু পুলিশের ভূমিকা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। পুলিশ সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অল্প। প্রশাসনিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে পুলিশ যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যে নিধিরাম সর্দার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মিউনিসিপ্যালিটির গেটের ভেতর থেকে ক্রমাগত প্ররোচনামূলক হুমকি ও অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির কারণে আইনজীবীরা আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। অচলাবস্থা চলতে থাকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত। এর মধ্যে মিউনিসিপ্যালিটি থেকে আরও এক দফা ইঁট বৃষ্টি হয় এবং আরও কিছু আইনজীবী আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পুলিশ-প্রশাসন ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ এই সংযোগস্থলে না আসে উচ্চপদস্থ প্রশাসনের কোনও ব্যক্তি বা পুলিশের কোনও কর্তাব্যক্তি। ভাবনা গুপ্ত নামে এক অল্পবয়সী পুলিশ অফিসার সমস্যার মোকাবিলা করার চেষ্টা করেন। ঘটনাস্থলে যে দুএকজন আইপিএস অফিসার ছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই হিন্দিভাষী এবং প্রচন্ড উত্তেজনার মধ্যে একটি বক্স নিয়ে এসে শান্তি বজায় রাখার আবেদন করতে থাকেন যা শেষ পর্যন্ত হাস্যকর এবং চূড়ান্ত অপদার্থতার নজির হয়ে দাঁড়ায়। ইত্যবসারে এলাকার এমএলএ তথা সমবায় মন্ত্রী এসে মিটমাটের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে দ্রুত সরে পড়েন। বিক্ষোভ অগ্নিগর্ভের চেহারা নেয়।
যাই হোক, বিকাল পাঁচটার পর মিউনিপ্যালিটির ভেতর থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠনের বড় বড় ঝান্ডা নিয়ে এক বিশাল জমায়েত হয়। নিষ্ক্রিয় পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে এবং মাঝে-মধ্যেই আইনজীবীদের দিকে তেড়ে আসতে থাকে। এরপর পুলিশ মিউনিসিপ্যালিটির গেট খুলে দিলে রাস্তার ওপর দুই পক্ষের সংঘর্ষের উপক্রম হয়। আর এক দফা ইঁট বৃষ্টির পরে শেষমেষ পুলিশ ও আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা তার আসল রূপ ধারণ করে। এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক র্যাফ নামে। পুলিশ নির্বিচারে লাঠি চালায় আইনজীবীদের উপরে। মিউনিসিপ্যালিটির গেট খুলে দিলে ঝান্ডা হাতে একদল দুষ্কৃতী পুলিশের সঙ্গ দেয়। হিংস্রমুখে অশ্রাব্য ভাষা নিয়ে মাথায় হেলমেট পড়ে র্যাফ, পুলিশ ও সাধারণ পোশাকের কিছু মানুষ লাঠি হাতে আইনজীবীদের আক্রমণ করে এবং উত্তরদিকের বিভিন্ন প্রবেশদ্বার দিয়ে এরা নির্বিচারে লাঠি চালাতে চালাতে ফৌজদারি ও দেওয়ানি জেলা জজ কোর্টে প্রবেশ করে। আদালতের মধ্যে ঢুকে পুলিশ অশ্রাব্য গালিগালাজ, ভাঙচুর চালায়। কাঁদানে গ্যেসের সেল ফাটায় এবং বেপরোয়া লাঠি চালানোর ফলে মহিলা সহ প্রচুর আইনজীবী আহত হন। পুলিশ ফৌজদারি আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটদের হুমকি দিতে থাকে। তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা জজের আদালতে কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটায়। আদালতের ভিতরে আইনজীবীরা, আদালতের কর্মী ও বিচারপ্রার্থীরা উদভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করতে থাকেন। আদালত চত্বরে এক নারকীয় ঘটনার সৃষ্টি হয়, যা ইতিহাসে বিরল। কমবেশি জনা পঞ্চাশের মতো আইনজীবী, ল-ক্লার্ক ও বিচারপ্রার্থী পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হন। হাওড়া হাসপাতাল আহত আইনজীবীদের আর্তনাদে কেঁপে ওঠে। এরপরে পুলিশ সমস্ত আদালত চত্বরের গেট বন্ধ করে দেয়, যাতে আইনজীবীদের কেউ আদালত থেকে বেরোতে না পারে। ক্ষুব্ধ ও আহত আইনজীবীরা জেলা জজ সাহেবের ঘরে অবস্থান শুরু করেন। অনেক ডাকাডাকির পর হাওড়া পুলিশ কমিশনার আসেন। সেখানে আর এক দফার উত্তেজনা শুরু হয়। পুলিশ ও একদল দুষ্কৃতী মিউনিসিপ্যালিটির ভিতরে এক মহিলা আইনজীবীকে আটকে রেখে মারধোর করে। পরে রাত্রি সাতটার সময় তাকে উদ্ধার করা হয়। সমস্ত ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয় প্রশাসনের চূড়ান্ত অযোগ্যতা, অক্ষমতা ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্য মানুষের অভাব। এই রাষ্ট্র মূলত নির্ভরশীল পুলিশের লাঠি ও গুলির উপর এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খণ্ডিত, খর্বিত। কোনও অনুমতি ছাড়া আদালত চত্বরে প্রবেশ করে আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, ল-ক্লার্ক ইত্যাদি মানুষজনকে নির্বিচারে প্রহার করে এখনও পর্যন্ত কোনও ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিং-এর মুখোমুখি না হয়ে মজায় ক্ষমতা ভোগ করে চলা— এ একমাত্র ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গেই সম্ভব।
আশার কথা হল আইনজীবীরা এরপরে পিছিয়ে যাননি। সারা বাংলা জুড়ে আজ আইনজীবীরা একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ করে চলেছেন। অনির্দিষ্টকালের জন্য সারা রাজ্যে আদালতের কাজকর্ম বন্ধ। জেলায় জেলায় আইনজীবী, ল-ক্লার্ক ও বিচারপ্রার্থীদের নিয়ে সমাবেশ হচ্ছে। দোষী পুলিশ অফিসারদের শাস্তি ও গ্রেপ্তারের দাবিতে আন্দোলন চলছে। গত ছাব্বিশে এপ্রিল বিভিন্ন কোর্টের আইনজীবীরা হাওড়া কোর্টে সামিল হন এবং ধিক্কার মিছিল বের করেন। ওইদিন লইয়ার্স ফর সোশ্যাল জাস্টিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস-এর পক্ষ থেকে আইনজীবী সুজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন মুখার্জি, দিবাকর ভট্টাচার্য, লিটন ভাদুড়ি, রাজীব দত্ত, সৌরভ, অভিজিৎ দত্ত প্রমুখ আন্দোলনরত আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করেন এবং একটি সংহতিপত্র দেন। প্রশাসন যথারীতি নির্বিকার, ভূমিকাহীন, উদ্যোগহীন। নেতারা ভোটের প্রচারে ব্যস্ত। স্বভাবতই ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে ফ্যাসিস্ট শক্তি। কিন্তু এখনও একজোট হয়ে পুলিশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাধারণ আইনজীবীরা লড়ে যাচ্ছেন তাঁদের সম্মানরক্ষা ও উদ্ধারের সংকল্পে।